সেই মিছিলে আমিও ছিলাম by রফিকুল ইসলাম

বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির সকালে ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকা থেকে ছয়-সাত হাজার স্কুলছাত্র মিছিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিল। সেই মিছিলের নেতৃত্বে ছিলাম আমি। ২০১৩ সালে আমাদের কালের ছাত্রনেত্রী হালিমা খাতুন প্রকাশ করেছেন কিভাবে তিনি সেদিন আর্মানিটোলা গার্লস স্কুলের ছাত্রীদের সংগঠিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল করে গিয়েছিলেন। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা ও গণিতের তৃতীয় বর্ষ সম্মানের ছাত্র। ফজলুল হক হল ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এক বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় তথা হল থেকে বহিষ্কৃত। ২০ ফেব্রুয়ারি আনুমানিক বেলা তিনটায় মাইকে ঘোষণা করা হয়েছিল, পুনরাদেশ না দেয়া পর্যন্ত ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা বলবৎ করা হল। ১৪৪ ধারা জারি করা হয় বাঙালি ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট হায়দার আলীকে বদলি করে উর্দুভাষী কোরেশিকে সেই পদে নিয়োগের মাধ্যমে। পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রীকে না জানিয়ে এসব অপকর্ম করা হয়েছিল। পূর্ব বাংলার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন পাঞ্জাবি আইসিএস অফিসার আজিজ আহম্মদ। তাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন স্বয়ং মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ। ব্রিটিশ আমলে দেশীয় রাজ্যগুলোতে আইসিএস অথবা মিলিটারি অফিসারদের এজেন্ট নিয়োগ করা হতো রাজ্যগুলোর আইনশৃংখলা পরিস্থিতির দিকে তীক্ষè দৃষ্টি রাখার জন্য, যাতে প্রয়োজনে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া যায়। জিন্নাহ সে রকমই একটা সিস্টেম চালু করেছিলেন পূর্ব বাংলাকে শাসন করার জন্য।
ফজলুল হক হলের পুকুরের ঘাটে ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টায় ফজলুল হক হল ছাত্র ইউনিয়ন, সলিমুল্লাহ্ হল ছাত্র ইউনিয়ন এবং মেডিকেল কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের মিটিং হওয়ার কথা ছিল পরদিন অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি সম্মিলিত ছাত্রদের কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য। মিটিংয়ের কার্যক্রম যথাসময়ে শুরু না হওয়ায় রাত সাড়ে ৯টায় আমি ফজলুল হক হলের জেনারেল সেক্রেটারি আনোয়ারুল হক খানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নারিন্দায় আমার নতুন আবাসে চলে আসি।
২১ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে আটটায় ভিক্টোরিয়া পার্কের পূর্ব দিকে অবস্থিত সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের গেটে এককভাবে স্লোগান দিতে থাকি রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। দুজন ব্রাদার এসে গেটে তালা লাগিয়ে দেন। আমি সেখান থেকে সদরঘাটের ইস্ট বেঙ্গল ইন্সটিটিউশনে গিয়ে আবার এককভাবে স্লোগান দিতে থাকি রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। এবার আমি সফল হই। স্কুলের ছেলেরা বেরিয়ে এসে আমার সঙ্গে স্লোগান দিতে থাকে।
আমি ইস্ট বেঙ্গল ইন্সটিটিউশনের ছাত্রদের নিয়ে মিছিল করে নর্থব্রুক হল পেরিয়ে জুবিলি স্কুলে স্লোগান দিতে থাকি। জুবিলি স্কুল ছিল সে আমলের নামকরা স্কুল। এখানেও আমি স্কুলে স্ট্রাইক করাতে সফল হলাম। সম্মিলিত ছাত্রদের নিয়ে আবার ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায় ফিরে এলাম। তখন ঢাকার স্কুলগুলো ওই এলাকায় অবস্থিত ছিল। ইতিমধ্যে মুসলিম হাই স্কুল, কলেজিয়েট স্কুল এবং পোগোজ স্কুলের ছাত্ররা আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়।
আমি এ ছাত্রদের নিয়ে নবাবপুর রোড ধরে এগোতে থাকি। রথখোলায় ডানদিকে মোড় নিয়ে গ্রাজুয়েটস স্কুলের সামনে আসি। স্কুল কর্তৃপক্ষ গেটে তালা লাগিয়ে দিলে অনেক ছাত্র স্কুলের দেয়াল ডিঙিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। মিছিল নিয়ে আবার নবাবপুর রোড দিয়ে উত্তর দিকে এগোতে থাকি। নবাবপুর রোডের পূর্ব পাশে ছিল প্রিয়নাথ স্কুল। পরে এর নামকরণ হয় নবাবপুর গভর্নমেন্ট হাই স্কুল। ছাত্র সংখ্যার দিক দিয়ে প্রিয়নাথ স্কুল তখন ঢাকার সবচেয়ে বড় স্কুল ছিল। আমাদের মিছিল নিয়ে যখন এ স্কুলে পৌঁছলাম, কাপ্তান বাজারে কমিউনিস্ট পার্টির শাখা অফিসের দু-তিনজন কমরেড আমাদের সহায়তা করতে এগিয়ে আসেন। প্রিয়নাথ স্কুলের ছাত্ররা আমাদের মিছিলে শরিক হওয়ার ফলে আমাদের মিছিলের আকার অনেক বেড়ে গিয়েছিল।
মিছিলের অগ্রভাগ যখন নবাবপুর লেভেল ক্রসিং পার হয়, তখন দেখতে পেলাম নারী শিক্ষা মন্দিরের আট-দশজন ছাত্রী গভর্নর হাউসের পাশ দিয়ে মিছিল করে আসছে। ছাত্রীদের এ দলটিকে আমাদের মিছিলের পুরোভাগে স্থান দিই। মিছিলটি নিয়ে রমনা পোস্ট অফিসের সামনে দিয়ে আজকের নগরভবন, পুলিশ হেডকোয়ার্টার পেরিয়ে এশিয়াটিক সোসাইটির দক্ষিণ পাশ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনে প্রবেশ করি। তখন বেলা সাড়ে বারোটা পেরিয়েছে।
ফজলুল হক হলের আবাসিক ছাত্র গাজীউল হক একটা ছোট টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে পরবর্তী কর্মসূচির ঘোষণা দেন। এরপরের ইতিহাস সবাই জানেন। কলাভবনের গেট দিয়ে চারজন চারজন করে ছাত্রছাত্রী ১৪৪ ধারা অমান্য না করে পূর্ব বাংলা অ্যাসেম্বলির দিকে এগোতে থাকে। তখনকার এসপি উর্দুুভাষী মাসুদ গুলির নির্দেশ দিলে বরকত, সালাম, রফিক ও জব্বার নিহত হন। ২২ ফেব্র“য়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সচিবালয়ের কর্মচারীরা হরতাল পালন করে মেডিকেল কলেজের গেটে ও রাস্তায় সমবেত হয়েছিল। কলকাতার রাইটারস্ বিল্ডিংয়ের করণিকরা ১৯০ বছরের ইতিহাসে কখনও যে কাজটি করেননি, পূর্ব বাংলার সচিবালয়ের কর্মচারীরা পাঁচ বছরের মধ্যে হরতাল করে নতুন ইতিহাস গড়েছিলেন।
সেদিন লাখো লোকের জমায়েতে গায়েবানা জানাজা যিনি পরিচালনা করেছিলেন, তিনি কোনো পেশাদার রাজনীতিক, বক্তা বা মৌলভী ছিলেন না। তিনি ছিলেন আমাদের কাছে অপরিচিত একজন সাধারণ নাগরিক। তিনি দরদভরা কণ্ঠে ছাত্রঘাতক জালিম সরকারের বিনাশের জন্য দোয়া প্রার্থনা করেছিলেন। তার সেই দোয়া আমাদের হৃদয় স্পর্শ করেছিল। দুই বছরের মাথায় মুসলিম লীগ ক্ষমতার কক্ষ থেকে বিচ্যুত হয়। পূর্ব বাংলায় আর কোনোদিন ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি তারা।
২২ ফেব্রুয়ারি গায়েবানা জানাজার পর লাখো লোকের মিছিল কার্জন হলের উত্তর পাশের সড়ক দিয়ে যখন অগ্রসর হচ্ছিল, গণিত বিভাগের জার্মান অধ্যাপক ম্যাক্স পিন্ল্ আমাকে দেখে বললেন, দিস্ ইজ রেভ্যুলিউশন, দিস্ ইজ রেভ্যুলিউশন। না, সেদিন রেভ্যুলিউশন হয়নি। সেটি হয়েছিল ১৯৭১ সালের মার্চে, চলেছিল ডিসেম্বর পর্যন্ত। এর ফলে পূর্ব বাংলার ভূখণ্ড থেকে পাকিস্তান চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। সে সংগ্রামেও আমি অংশগ্রহণ করেছিলাম। যা হোক, বায়ান্নর ২২ ফেব্রুয়ারির মিছিলে পাকিস্তানি মিলিটারি গুলি চালিয়ে অনেক লোককে হত্যা করে। তখনকার সরকার সে সংখ্যা প্রকাশ করেনি।
২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনে বাঙালি জাতির নগদ প্রাপ্তি ছিল শহীদ মিনার। যতদূর মনে পড়ে, ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শহীদ মিনার নির্মাণ করেছিলেন। নির্মাণ কাজে দু-তিনটা ইট আমিও বয়ে এনেছিলাম। যে শহীদ মিনারটার ছবি আমার স্মৃতিতে ভাস্বর, সেটা আজকের শহীদ মিনার নয়। পাকিস্তানি দুর্বৃত্তরা প্রথম শহীদ মিনার ভেঙে দিয়েছিল ২৬-২৭ ফেব্র“য়ারি। আলাদা নকশায় সেটি পুনঃর্নিমাণ করা হয়েছিল। সেটাকেও পাকিস্তানি দুর্বৃত্তরা ভেঙে ফেলেছিল।
শহীদ মিনারকে নিয়ে আমাদের কালের অনেক কবি মর্মস্পর্শী কবিতা লিখেছেন, যা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। শোষিত-বঞ্চিত শ্রমিক-জনতা বিভিন্ন সময়ে শহীদ মিনারে সমবেত হয়ে তাদের দাবি জনসম্মুখে প্রকাশ করেছেন প্রতিকার পাওয়ার আশায়। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রয়াত বুদ্ধিজীবীদের মরদেহ শহীদ মিনারে হাজির করা হতো যাতে ভক্তরা তাদের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারে। গভীর পরিতাপের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, ইদানীং শহীদ মিনারকে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর সম্পত্তিতে পরিণত করা হয়েছে। একজন ভিন্নমতাবলম্বী বুদ্ধিজীবীর মরদেহ শহীদ মিনারে নিয়ে যেতে দেয়া হয়নি। এটি একটি অসুস্থ মানসিকতা। আশা করছি এর অবসান হবে।
২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস গণ্য করে বিশ্ববাসী বাঙালি জাতির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। এটা আমাদের এক বিরাট অর্জন।
আজ ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন এ লেখাটি লিখছি, তখন আমার মন ভীষণভাবে সংক্ষুব্ধ। পেট্রলের আগুনে নিরীহ হতভাগ্য মানুষ পুড়ছে। দুই নেত্রীর দ্বৈরথ কি আমাদের দেশটাকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করবে? এক নেত্রী আমাকে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন, আরেক নেত্রী আমাকে পথচলার আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেছেন। আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে, বাঙালি কি প্রতারক জাতি? মহাভারতের সংকলক ব্যাসদেব ছয় হাজার বছর আগে বঙ্গ পুণ্ড্র এবং কীরাতের রাজা পৌণ্ড্রকের যে চরিত্র অঙ্কন করেছেন, তা প্রতারকের চরিত্র। মানব চরিত্রের বিপুল বৈচিত্র্যের মধ্যে ব্যাসদেব প্রতারকের চরিত্র কেন পৌণ্ড্রকের জন্য বেছে নিয়েছিলেন? এটা কি নিছক কাকতালীয়, না তখনকার জনশ্র“তির ফসল?
ঔপনিবেশিক শাসনের সময় ভারতবর্ষের ফৌজদারি দণ্ডবিধির প্রণেতা লর্ড মেকলে লিখে গিয়েছেন, গ্রিক রমণীর সৌন্দর্য যেমন সত্য, গণ্ডারের শিং যেমন সত্য, তেমনি সত্য হচ্ছে বাঙালির প্রতারণা ও জালিয়াতি। একটা কম্বলের নিচে তিনজন ফকির ঘুমাতে পারে; কিন্তু একই পাড়ায় দুজন প্রতারক থাকতে পারে না। পরস্পর হানাহানি করে বিনষ্ট হয়। আমরা কি বিনষ্টির পথেই এগোচ্ছি না?
অগ্নিদগ্ধ, যন্ত্রণায় কাতর, সমাজ সচেতন বাঙালি নারী গীতা সেনের বাণী দিয়ে আমরা এ লেখাটি শেষ করতে চাই : আমি খালেদারে চিনি না। আমি আপনের কাছেও যাই না। আমরা আপনেরে বানাইছি। আপনারা আমাদের বানান নাই। আমি আমার স্বামীরটা খাই। আমরা সুশাসন চাই।
রফিকুল ইসলাম : ভাষাসৈনিক
technomi@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.