দানব দমন by অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ
অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ। গবেষক ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী |
কথার
পেছনে কথা থাকে। ২০০৫ সালের কথা। ধানমণ্ডির বাসায় একটি বই নিয়ে
সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। নবীন-বরেণ্য সাংবাদিকরা এসেছিলেন।
এসেছিলেন ক্যামেরাম্যান। সংবাদ সম্মেলনের শেষ দিকে ধানমণ্ডির ৬নং সড়কের
দু'দিকে ব্যারিকেড দেওয়া হয় । পুলিশ, র্যাব ও সাদা পোশাকের গোয়েন্দা
সংস্থার লোকজন আকস্মিক ড্রয়িং রুমে ঢুকে পড়েন। তাদের আচরণে, হাবভাবে মনে
হচ্ছিল যেন যুদ্ধ করতে এসেছেন। অনেক সাংবাদিক সটকে পড়েন। কক্ষের মধ্যে
ঢোকার পর তাদের চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলাম, কোন অধিকারে তারা রুমে ঢুকেছেন?
কেন এসেছেন? ওয়ারেন্ট আছে? সার্চ ওয়ারেন্ট আছে? তাদের বললাম, আপনারা আইনের
লোক। শুধু আইন নয়, সংবিধান মানতে হবে। সংবিধানে লেখা আছে, 'প্রবেশ, তল্লাশি
ও আটক হইতে স্বীয় গৃহে নিরাপত্তা লাভের অধিকার থাকিবে।' আপনাদের কাছে
কিছুই যখন নেই তখন দয়া করে চলে যান। বেরিয়ে যাওয়ার কথাটি রাগের মাথায়
ঝাঁঝালো ছিল। কিছুক্ষণ ওয়াকিটকিতে ঝড় তুললেন। তারপর যাদের আটক করেছিলেন
তাদের ছেড়ে দেন। তবে পাশে রাখা বইগুলো নিয়ে যান।
কেন এসেছিলেন তারা? একটি বই প্রকাশ হয়েছে। সেটির জন্মগত জানান দেওয়ার জন্য সংবাদ সম্মেলন। বইটির নাম অঘোষিত যুদ্ধের বল্গুপ্রিন্ট। বইটিতে কী ছিল? বাংলাদেশে যে জঙ্গিবাদের উত্থান অনিবার্য ঘটতে চলছে, তার কিছু তথ্য ও বল্গুপ্রিন্ট তুলে ধরা হয়েছিল। জঙ্গিদের উত্থান, তাদের পরিকল্পনা, বিস্তৃতি, জাতিসত্তার ওপর আঘাত, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধ ও মূল্যবোধকে মুছে ফেলে দেওয়ার যে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত তার মুখোশ উন্মোচন করে লেখা বইটির ওপর আক্রোশী হামলা নেমে এসেছিল। সেই বইয়ের অনুপূরক হিসেবে 'বাংলাদেশ : থ্রেট অব ওয়ার' দ্বিতীয় বইটিতে কোথায় কীভাবে জঙ্গিদের ট্রেনিং হচ্ছে, কোন কোন স্থান তারা বিশেষভাবে বেছে নিয়েছিল তার কৌশলগত অবস্থানের কথা লেখা হয়েছিল। লেখা হয়েছিল তাদের আন্তর্জাতিক যোগসূত্রের কথা। অস্ত্রের উৎস, তাদের আস্তানা ও অস্ত্র ভাণ্ডার সম্পর্কে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, গত দশ বছর আগে তাদের চোখে আঙুল দিয়ে এসব অস্ত্র , অবস্থান ও স্থানের কথা থাকা সত্ত্বেও কেন কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি?
---- ২. সম্প্রতি চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার লটমনি দুর্গম পাহাড়ে আন্তর্জাতিক জঙ্গি প্রশিক্ষণ ঘাঁটি আবিষ্কার করেছে র্যাব। এখানে নিয়মিত 'জঙ্গি প্রশিক্ষণ' দেওয়া হতো বলে র্যাব কর্মকর্তারা বলেছেন। এ ঘাঁটি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে একে-২২ রাইফেলসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলা ও প্রশিক্ষণের সরঞ্জাম। আটক করা হয়েছে ৫ জঙ্গিকে। ২২ ফেব্রুয়ারি রোববার দুপুরে ঘটনাস্থলে র্যাব ৭-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে জানান, হাটহাজারী এলাকা থেকে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি আটক জঙ্গিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে শনিবার বিকেলে লটমনি দুর্গম পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ ঘাঁটির সন্ধান পায় র্যাব। এ ঘাঁটি থেকে উদ্ধার করা অস্ত্রশস্ত্র ও প্রশিক্ষণ সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে তিনটি একে-২২, ছয়টি বিদেশি পিস্তল, একটি রিভলবার, তিনটি দেশি বন্দুক, ছয়টি একে-২২-এর ম্যাগাজিন, নয়টি পিস্তলের ম্যাগাজিন, বিভিন্ন ধরনের ৭৫১ রাউন্ড গুলি, তিনটি চাপাতি, দুটি ওয়াকিটকি, ১৪ জোড়া জঙ্গল বুট, দুই জোড়া আর্মি বুট, চার জোড়া পিটি শু, পাঁচটি টর্চলাইট ও ৩৮ সেট প্রশিক্ষণের পোশাক। মাটির গর্তে এসব অস্ত্র, গোলাবারুদ ও সরঞ্জাম পুঁতে রাখা হয়েছিল। আটক জঙ্গিরা বিভিন্ন এলাকার। আলফাডাঙ্গা, ধোবাউড়া, গোপালপুর, মির্জাপুর এবং কোটালীপাড়া উপজেলা থেকে এসেছে তারা। বন বিভাগের সংরক্ষিত এলাকায় অবস্থিত এ জঙ্গি প্রশিক্ষণ ঘাঁটি। এ এলাকা দিয়ে জঙ্গিদের লটমনি পাহাড়ের গভীর জঙ্গলে নিয়ে আসা হতো। পাহাড় কেটে সেখানে তৈরি করা হয় ফায়ারিং রেঞ্জ ও বাঙ্কার। এসব আলামত প্রমাণ করে প্রশিক্ষণার্থীদের হাতে-কলমে গেরিলা যুদ্ধ, শারীরিক ও সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, এটি কখনও কল্পনাও করেননি কেউ! প্রথমে তাদের বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্যাতিত মুসলমানদের ছবি এবং দেশে-বিদেশে নিহত মুসলিম শিশুদের পরিবারের আহাজারির ভিডিও দেখিয়ে জিহাদে উদ্বুদ্ধ করত। আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আল কায়দা, আইএস, আল আজহারি, আল সাবাব ও আল নুসরার বাংলা অনুবাদ করা বিভিন্ন ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে রাতের বেলায় এসব প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।
উলেল্গখ্য, ১৯ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার একটি মাদ্রাসা থেকে ২৫ জনকে আটক করে র্যাব। এর মধ্যে ১২ জনের সঙ্গে জঙ্গিদের সম্পর্ক রয়েছে। এ ১২ জঙ্গির স্বীকারোক্তি অনুযায়ী বাঁশখালীর গভীর জঙ্গলে অভিযান চালায় র্যাব।
---- ৩. লিখেছিলাম দক্ষ প্রশিক্ষকদের নেতৃত্বে প্রশিক্ষণার্থীরা চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা সীতাকুণ্ড এবং পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এলকায় প্রশিক্ষণ-উপযুক্ত স্থান বেছে নেয়। পাকিস্তানের মৌলবাদী সংগঠন জমিয়তে তালাবার শীর্ষ নেতা জুবের, ওয়ামিয়ের আন্তর্জাতিক সংস্থা যার সঙ্গে ছাত্রশিবির জড়িত। এটি বিশ্বের ১৭টি মুসলিম রাষ্ট্রের ইসলামী যুব সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক যুব সংগঠন। তারা বিশ্বব্যাপী জিহাদি কার্যক্রম, প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।
---- ৪. পাকিস্তানি নাগরিক আখতার খানের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি আইএসআইর টিম এক দশক আগে নিজেদের ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিলেও তারা যে আইএসআইর দায়িত্বপ্রাপ্ত তা ওয়াকিবহাল মহল নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশে ঢাকাস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনের প্রাক্তন কাউন্সিলর আরিফ মাহমুদ এবং প্রথম সচিব মাজহার হোসেন জাফরী থাকাকালে আখতার খান আইএসআইর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন এবং তিনি প্রায়ই ঢাকায় আসেন। আখতার খান হোটেলে নাম লেখা সত্ত্বেও তিনি কাউন্সিলর শাহেদ মাহমুদের বাসায় এবং গুলশানের পাকিস্তান হাইকমিশনের রেস্ট হাউসে বিশ্রাম ও অধিকাংশ সময় কাটান।
---- ৫. অস্ত্র চোরাচালানে আইএসআই কানেকশন : চট্টগ্রামে চাঞ্চল্যকর অস্ত্রের চালান আটক ঘটনার হোতাদের অন্যতম চোরাচালানি হাফিজুর রহমানের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর। হাফিজ সফর করেছে পাকিস্তান, চীন, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার। এর পরই চট্টগ্রামে ধরা পড়ে অস্ত্রের বিশাল চালান। চট্টগ্রামের সিইউএফএল ঘাট থেকে খালাসের অস্ত্রবাহী ট্রাকের গন্তব্য ছিল হবিগঞ্জ। সীমান্তবর্তী অঞ্চলের জঙ্গি সংগঠনগুলোর মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকার সন্ত্রাসীদের হাতে অবৈধ অস্ত্র ছড়িয়ে পড়ছে। অর্থের প্রয়োজনে প্রতিবেশী একাধিক দেশের জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যরা স্বয়ংক্রিয় ও অত্যাধুনিক নানা অস্ত্র নিয়মিতভাবেই বিক্রি করে। কক্সবাজার ও বান্দরবানের দুর্গম ও পাহাড়ি এলাকার তৎপর আরএসও (রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন) এবং আরএনও (আরাকান রোহিঙ্গ ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন) নামে মিয়ানমারের জঙ্গি সংগঠনগুলোর সদস্যরা অর্থ সংগ্রহের জন্য প্রায়ই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অপরাধী চক্রের কাছে কম দামে ভারী অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি করে দিচ্ছে। গত এক দশক ধরে এ এলাকায় অস্ত্র বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এক সময় ওই অঞ্চলে দারুণ সক্রিয় আরাকান আর্মি সব অস্ত্রশস্ত্র বাংলাদেশি জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের কাছে বিক্রি করে দিয়ে এখন প্রায় বিলুপ্ত।
---- ৬. ভারী অস্ত্র পাচারের নিরাপদ রুট হচ্ছে পাহাড়ঘেরা দুর্গম এলাকা নাইক্ষ্যংছড়ি। গোয়েন্দা জাফর নামের মিয়ানমারের এক নাগরিক ও 'আরএসও'র সক্রিয় সদস্য গত এক দশকে নাইক্ষ্যংছড়ি, গর্জনিয়া, ইদগড়, মহেশখালীতে চিহ্নিত কিছু লোকের মাধ্যমে জঙ্গিদের বিপুল পরিমাণ ভারী অস্ত্র বিক্রি করে। এ সময় তাকে এসব অস্ত্র বিক্রিতে সহযোগিতা দিত কক্সবাজারের সাবেক শিবির ক্যাডার রামুর নজরুল, টেকনাফের কেফায়েত, মহেশখালীর সরোয়ার, নাইক্ষ্যংছড়িতে বসবাসকারী মিয়ানমারের নাগরিক এমপি এজাহার, মৌলভী সেলিম, আবদুল গাফফার, গোয়েন্দা জাফরের আত্মীয় আইয়ুব প্রমুখ। বর্তমানে জড়িত নাইক্ষ্যংছড়িতে বসবাসকারী মিয়ানমারের নাগরিক আবদুস সালাম, আবদুল নবী, আবু বক্কর, নুরুল আলম প্রমুখ। কক্সবাজার পুলিশের গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়, মহেশখালী, রামু, চকরিয়া, উখিয়াতে ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে প্রভাবশালী শতাধিক সন্ত্রাসী। এর মধ্যে মহেশখালীতে একে-৪৭, এম-১৬ রাইফেল, জিথ্রি রাইফেল, অত্যাধুনিক পিস্তল, রিভলবার ব্যবহার করে ৫২ জন। ২০০১ সালের আগস্ট মাসে সে সময়কার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা লতিফুর রহমান সংবাদপত্রে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, দেশে আড়াই লাখ অবৈধ অস্ত্র আছে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহেদুল আনাম তার এক গবেষণা জরিপে বলেছেন, দেশে দুই লাখ অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। এসব অস্ত্রের চার ভাগের এক ভাগ সুসংগঠিত পেশাদার জঙ্গিচক্র, মাস্তান ও তাদের গডফাদারদের কাছে এবং বাদবাকি অস্ত্র রাজনৈতিক ছদ্মাবরণে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের দখলে রয়েছে। এসব অস্ত্রের মূল উৎসস্থল আফগানিস্তান, মিয়ানমার ও পাকিস্তান।
---- ৭. জামায়াত ও আইএসআইর সংশিল্গষ্টতা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার স্পিকার ও কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান হাশিম আবদুর হালিম বলেছেন, বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার পেছনে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর হাত রয়েছে এবং এদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সংশিল্গষ্টতা রয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশেই আইএসআই অধিকমাত্রায় সক্রিয়। তারা জামায়াতকে ফান্ডিং ও ট্রেনিং দিচ্ছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে জঙ্গি তৎপরতাকে কোন দৃষ্টিতে দেখছেন_ এ প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের স্পিকার বলেন, বাংলাদেশে আইএসআই খুবই সক্রিয়। তাদের সঙ্গে রয়েছে স্থানীয় জামায়াতের ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র। তবে বাংলাদেশের মানুষ এসব অপশক্তিকে রুখে দাঁড়াবেই। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের সারাদা সংস্থা জামায়াতকে ফান্ডিং করছে। ভারতে জঙ্গি তৎপরতা রয়েছে। বাংলাদেশে আছে। নেপালে আছে। মিয়ানমারে আছে। সেভেন সিস্টারে অস্ত্র-সন্ত্রাসী রয়েছে। তবে জঙ্গিদেরও তারা আশ্রয় দিয়ে থাকে বলে কথিত আছে।
যে কথা দশ বছর আগে বলেছিলাম বলে আমাদের ওপর গজব নেমে এসেছিল। আজ বাংলাদেশ সেই নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি। রাজনৈতিক সংকটের অন্তরালে ক্ষুদে জঙ্গিরা পেট্রোল বোমা, ককটেল নিয়ে মাঠে নেমেছে। তাদের দমন করতে হবে। না হলে এদের হাত ধরে চলে আসবে অত্যাধুনিক অস্ত্রধারী দানবরা। বর্তমান সময়ে জরুরি কর্তব্য নাশকতার মূল উচ্ছেদ। আদর্শিক ও প্রায়োগিকভাবে সাঁড়াশি আক্রমণ চালাতে হবে, না হলে এদের নির্মূল করা দুরূহ। কারণ আন্তর্জাতিক জঙ্গি দানবরা এদের পেছনে। এখনই সর্বাত্মক সক্রিয়তায় দানব দমনের প্রক্রিয়া, কৌশল এবং বল্গুপ্রিন্ট হাতে এগিয়ে যেতে হবে।
গবেষক ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী
কেন এসেছিলেন তারা? একটি বই প্রকাশ হয়েছে। সেটির জন্মগত জানান দেওয়ার জন্য সংবাদ সম্মেলন। বইটির নাম অঘোষিত যুদ্ধের বল্গুপ্রিন্ট। বইটিতে কী ছিল? বাংলাদেশে যে জঙ্গিবাদের উত্থান অনিবার্য ঘটতে চলছে, তার কিছু তথ্য ও বল্গুপ্রিন্ট তুলে ধরা হয়েছিল। জঙ্গিদের উত্থান, তাদের পরিকল্পনা, বিস্তৃতি, জাতিসত্তার ওপর আঘাত, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধ ও মূল্যবোধকে মুছে ফেলে দেওয়ার যে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত তার মুখোশ উন্মোচন করে লেখা বইটির ওপর আক্রোশী হামলা নেমে এসেছিল। সেই বইয়ের অনুপূরক হিসেবে 'বাংলাদেশ : থ্রেট অব ওয়ার' দ্বিতীয় বইটিতে কোথায় কীভাবে জঙ্গিদের ট্রেনিং হচ্ছে, কোন কোন স্থান তারা বিশেষভাবে বেছে নিয়েছিল তার কৌশলগত অবস্থানের কথা লেখা হয়েছিল। লেখা হয়েছিল তাদের আন্তর্জাতিক যোগসূত্রের কথা। অস্ত্রের উৎস, তাদের আস্তানা ও অস্ত্র ভাণ্ডার সম্পর্কে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, গত দশ বছর আগে তাদের চোখে আঙুল দিয়ে এসব অস্ত্র , অবস্থান ও স্থানের কথা থাকা সত্ত্বেও কেন কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি?
---- ২. সম্প্রতি চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার লটমনি দুর্গম পাহাড়ে আন্তর্জাতিক জঙ্গি প্রশিক্ষণ ঘাঁটি আবিষ্কার করেছে র্যাব। এখানে নিয়মিত 'জঙ্গি প্রশিক্ষণ' দেওয়া হতো বলে র্যাব কর্মকর্তারা বলেছেন। এ ঘাঁটি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে একে-২২ রাইফেলসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলা ও প্রশিক্ষণের সরঞ্জাম। আটক করা হয়েছে ৫ জঙ্গিকে। ২২ ফেব্রুয়ারি রোববার দুপুরে ঘটনাস্থলে র্যাব ৭-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে জানান, হাটহাজারী এলাকা থেকে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি আটক জঙ্গিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে শনিবার বিকেলে লটমনি দুর্গম পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ ঘাঁটির সন্ধান পায় র্যাব। এ ঘাঁটি থেকে উদ্ধার করা অস্ত্রশস্ত্র ও প্রশিক্ষণ সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে তিনটি একে-২২, ছয়টি বিদেশি পিস্তল, একটি রিভলবার, তিনটি দেশি বন্দুক, ছয়টি একে-২২-এর ম্যাগাজিন, নয়টি পিস্তলের ম্যাগাজিন, বিভিন্ন ধরনের ৭৫১ রাউন্ড গুলি, তিনটি চাপাতি, দুটি ওয়াকিটকি, ১৪ জোড়া জঙ্গল বুট, দুই জোড়া আর্মি বুট, চার জোড়া পিটি শু, পাঁচটি টর্চলাইট ও ৩৮ সেট প্রশিক্ষণের পোশাক। মাটির গর্তে এসব অস্ত্র, গোলাবারুদ ও সরঞ্জাম পুঁতে রাখা হয়েছিল। আটক জঙ্গিরা বিভিন্ন এলাকার। আলফাডাঙ্গা, ধোবাউড়া, গোপালপুর, মির্জাপুর এবং কোটালীপাড়া উপজেলা থেকে এসেছে তারা। বন বিভাগের সংরক্ষিত এলাকায় অবস্থিত এ জঙ্গি প্রশিক্ষণ ঘাঁটি। এ এলাকা দিয়ে জঙ্গিদের লটমনি পাহাড়ের গভীর জঙ্গলে নিয়ে আসা হতো। পাহাড় কেটে সেখানে তৈরি করা হয় ফায়ারিং রেঞ্জ ও বাঙ্কার। এসব আলামত প্রমাণ করে প্রশিক্ষণার্থীদের হাতে-কলমে গেরিলা যুদ্ধ, শারীরিক ও সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, এটি কখনও কল্পনাও করেননি কেউ! প্রথমে তাদের বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্যাতিত মুসলমানদের ছবি এবং দেশে-বিদেশে নিহত মুসলিম শিশুদের পরিবারের আহাজারির ভিডিও দেখিয়ে জিহাদে উদ্বুদ্ধ করত। আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আল কায়দা, আইএস, আল আজহারি, আল সাবাব ও আল নুসরার বাংলা অনুবাদ করা বিভিন্ন ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে রাতের বেলায় এসব প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।
উলেল্গখ্য, ১৯ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার একটি মাদ্রাসা থেকে ২৫ জনকে আটক করে র্যাব। এর মধ্যে ১২ জনের সঙ্গে জঙ্গিদের সম্পর্ক রয়েছে। এ ১২ জঙ্গির স্বীকারোক্তি অনুযায়ী বাঁশখালীর গভীর জঙ্গলে অভিযান চালায় র্যাব।
---- ৩. লিখেছিলাম দক্ষ প্রশিক্ষকদের নেতৃত্বে প্রশিক্ষণার্থীরা চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা সীতাকুণ্ড এবং পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এলকায় প্রশিক্ষণ-উপযুক্ত স্থান বেছে নেয়। পাকিস্তানের মৌলবাদী সংগঠন জমিয়তে তালাবার শীর্ষ নেতা জুবের, ওয়ামিয়ের আন্তর্জাতিক সংস্থা যার সঙ্গে ছাত্রশিবির জড়িত। এটি বিশ্বের ১৭টি মুসলিম রাষ্ট্রের ইসলামী যুব সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক যুব সংগঠন। তারা বিশ্বব্যাপী জিহাদি কার্যক্রম, প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।
---- ৪. পাকিস্তানি নাগরিক আখতার খানের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি আইএসআইর টিম এক দশক আগে নিজেদের ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিলেও তারা যে আইএসআইর দায়িত্বপ্রাপ্ত তা ওয়াকিবহাল মহল নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশে ঢাকাস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনের প্রাক্তন কাউন্সিলর আরিফ মাহমুদ এবং প্রথম সচিব মাজহার হোসেন জাফরী থাকাকালে আখতার খান আইএসআইর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন এবং তিনি প্রায়ই ঢাকায় আসেন। আখতার খান হোটেলে নাম লেখা সত্ত্বেও তিনি কাউন্সিলর শাহেদ মাহমুদের বাসায় এবং গুলশানের পাকিস্তান হাইকমিশনের রেস্ট হাউসে বিশ্রাম ও অধিকাংশ সময় কাটান।
---- ৫. অস্ত্র চোরাচালানে আইএসআই কানেকশন : চট্টগ্রামে চাঞ্চল্যকর অস্ত্রের চালান আটক ঘটনার হোতাদের অন্যতম চোরাচালানি হাফিজুর রহমানের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর। হাফিজ সফর করেছে পাকিস্তান, চীন, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার। এর পরই চট্টগ্রামে ধরা পড়ে অস্ত্রের বিশাল চালান। চট্টগ্রামের সিইউএফএল ঘাট থেকে খালাসের অস্ত্রবাহী ট্রাকের গন্তব্য ছিল হবিগঞ্জ। সীমান্তবর্তী অঞ্চলের জঙ্গি সংগঠনগুলোর মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকার সন্ত্রাসীদের হাতে অবৈধ অস্ত্র ছড়িয়ে পড়ছে। অর্থের প্রয়োজনে প্রতিবেশী একাধিক দেশের জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যরা স্বয়ংক্রিয় ও অত্যাধুনিক নানা অস্ত্র নিয়মিতভাবেই বিক্রি করে। কক্সবাজার ও বান্দরবানের দুর্গম ও পাহাড়ি এলাকার তৎপর আরএসও (রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন) এবং আরএনও (আরাকান রোহিঙ্গ ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন) নামে মিয়ানমারের জঙ্গি সংগঠনগুলোর সদস্যরা অর্থ সংগ্রহের জন্য প্রায়ই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অপরাধী চক্রের কাছে কম দামে ভারী অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি করে দিচ্ছে। গত এক দশক ধরে এ এলাকায় অস্ত্র বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এক সময় ওই অঞ্চলে দারুণ সক্রিয় আরাকান আর্মি সব অস্ত্রশস্ত্র বাংলাদেশি জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের কাছে বিক্রি করে দিয়ে এখন প্রায় বিলুপ্ত।
---- ৬. ভারী অস্ত্র পাচারের নিরাপদ রুট হচ্ছে পাহাড়ঘেরা দুর্গম এলাকা নাইক্ষ্যংছড়ি। গোয়েন্দা জাফর নামের মিয়ানমারের এক নাগরিক ও 'আরএসও'র সক্রিয় সদস্য গত এক দশকে নাইক্ষ্যংছড়ি, গর্জনিয়া, ইদগড়, মহেশখালীতে চিহ্নিত কিছু লোকের মাধ্যমে জঙ্গিদের বিপুল পরিমাণ ভারী অস্ত্র বিক্রি করে। এ সময় তাকে এসব অস্ত্র বিক্রিতে সহযোগিতা দিত কক্সবাজারের সাবেক শিবির ক্যাডার রামুর নজরুল, টেকনাফের কেফায়েত, মহেশখালীর সরোয়ার, নাইক্ষ্যংছড়িতে বসবাসকারী মিয়ানমারের নাগরিক এমপি এজাহার, মৌলভী সেলিম, আবদুল গাফফার, গোয়েন্দা জাফরের আত্মীয় আইয়ুব প্রমুখ। বর্তমানে জড়িত নাইক্ষ্যংছড়িতে বসবাসকারী মিয়ানমারের নাগরিক আবদুস সালাম, আবদুল নবী, আবু বক্কর, নুরুল আলম প্রমুখ। কক্সবাজার পুলিশের গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়, মহেশখালী, রামু, চকরিয়া, উখিয়াতে ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে প্রভাবশালী শতাধিক সন্ত্রাসী। এর মধ্যে মহেশখালীতে একে-৪৭, এম-১৬ রাইফেল, জিথ্রি রাইফেল, অত্যাধুনিক পিস্তল, রিভলবার ব্যবহার করে ৫২ জন। ২০০১ সালের আগস্ট মাসে সে সময়কার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা লতিফুর রহমান সংবাদপত্রে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, দেশে আড়াই লাখ অবৈধ অস্ত্র আছে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহেদুল আনাম তার এক গবেষণা জরিপে বলেছেন, দেশে দুই লাখ অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। এসব অস্ত্রের চার ভাগের এক ভাগ সুসংগঠিত পেশাদার জঙ্গিচক্র, মাস্তান ও তাদের গডফাদারদের কাছে এবং বাদবাকি অস্ত্র রাজনৈতিক ছদ্মাবরণে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের দখলে রয়েছে। এসব অস্ত্রের মূল উৎসস্থল আফগানিস্তান, মিয়ানমার ও পাকিস্তান।
---- ৭. জামায়াত ও আইএসআইর সংশিল্গষ্টতা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার স্পিকার ও কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান হাশিম আবদুর হালিম বলেছেন, বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার পেছনে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর হাত রয়েছে এবং এদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সংশিল্গষ্টতা রয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশেই আইএসআই অধিকমাত্রায় সক্রিয়। তারা জামায়াতকে ফান্ডিং ও ট্রেনিং দিচ্ছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে জঙ্গি তৎপরতাকে কোন দৃষ্টিতে দেখছেন_ এ প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের স্পিকার বলেন, বাংলাদেশে আইএসআই খুবই সক্রিয়। তাদের সঙ্গে রয়েছে স্থানীয় জামায়াতের ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র। তবে বাংলাদেশের মানুষ এসব অপশক্তিকে রুখে দাঁড়াবেই। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের সারাদা সংস্থা জামায়াতকে ফান্ডিং করছে। ভারতে জঙ্গি তৎপরতা রয়েছে। বাংলাদেশে আছে। নেপালে আছে। মিয়ানমারে আছে। সেভেন সিস্টারে অস্ত্র-সন্ত্রাসী রয়েছে। তবে জঙ্গিদেরও তারা আশ্রয় দিয়ে থাকে বলে কথিত আছে।
যে কথা দশ বছর আগে বলেছিলাম বলে আমাদের ওপর গজব নেমে এসেছিল। আজ বাংলাদেশ সেই নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি। রাজনৈতিক সংকটের অন্তরালে ক্ষুদে জঙ্গিরা পেট্রোল বোমা, ককটেল নিয়ে মাঠে নেমেছে। তাদের দমন করতে হবে। না হলে এদের হাত ধরে চলে আসবে অত্যাধুনিক অস্ত্রধারী দানবরা। বর্তমান সময়ে জরুরি কর্তব্য নাশকতার মূল উচ্ছেদ। আদর্শিক ও প্রায়োগিকভাবে সাঁড়াশি আক্রমণ চালাতে হবে, না হলে এদের নির্মূল করা দুরূহ। কারণ আন্তর্জাতিক জঙ্গি দানবরা এদের পেছনে। এখনই সর্বাত্মক সক্রিয়তায় দানব দমনের প্রক্রিয়া, কৌশল এবং বল্গুপ্রিন্ট হাতে এগিয়ে যেতে হবে।
গবেষক ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী
No comments