অভিজিৎ হত্যাকাণ্ড- মুক্তচিন্তা স্তব্ধ করা যাবে না
বাংলাদেশ
কি প্রগতিশীল ও মুক্তচিন্তার বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে? ধর্মান্ধ
জঙ্গিগোষ্ঠী কি বাংলাদেশকে অন্ধকার সময়ে ফিরিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টায় সফলকাম
হবে? বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের স্বাধীন ও মুক্তচিন্তার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে
পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র এলাকায় ড. অভিজিৎ রায়কে
নিষ্ঠুর পৈশাচিক উপায়ে হত্যা এবং তার স্ত্রীকে গুরুতর আহত করার ঘটনা ফের এই
প্রশ্ন সামনে এনেছে। গত কয়েকদিনে বইমেলার আশপাশে সন্ত্রাসীদের ককটেল
নিক্ষেপে কয়েকজন আহত হলেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা কাঙ্ক্ষিত
মাত্রার তুলনায় কম ছিল বলে অভিযোগ অনেকের। ঘাতকদের কাউকে যেহেতু তাৎক্ষণিক
ধরা যায়নি, সে কারণে কারা এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন
করেছে, সেটা বলা যাবে না। টুইটারে একটি পোস্টে আনসার বাংলা-৭ নামের একটি
সংগঠন এর দায় স্বীকার করেছে। নিহত ড. অভিজিতের পিতা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং
মুক্তচিন্তার অগ্রণী ব্যক্তি অধ্যাপক অজয় রায় এ হত্যাকাণ্ডের জন্য জামায়াতে
ইসলামীসহ সাম্প্রদায়িক জঙ্গিগোষ্ঠীকে দায়ী করেছেন। একুশের বইমেলা স্থলের
অদূরেই ঘটানো হয়েছে এ ঘৃণ্য হামলা, যা আমাদের ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি
প্রথাবিরোধী খ্যাতিমান লেখক হুমায়ুন আজাদকে হত্যার জন্য পরিকল্পিত আক্রমণের
ঘটনাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি বইমেলা শেষে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে
বাসায় ফিরছিলেন। ওত পেতে থাকা ঘাতক দল তাকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। কিছুদিন
পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। কিন্তু অভিজিৎ রায়ের ক্ষেত্রে
চিকিৎসার সামান্য সুযোগও পাওয়া যায়নি। স্বামীকে বাঁচাতে গিয়ে গুরুতর আহত
হয়েছেন ড. অভিজিতের স্ত্রী ডা. রাফিদা আহমদ বন্যা। এবারে বইমেলায় নিজের
দুটি বই প্রকাশ উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সস্ত্রীক মাতৃভূমিতে এসেছিলেন
অভিজিৎ রায়। মৃত্যুর মাত্র অল্প সময় আগে তার রচিত 'শূন্য থেকে মহাবিশ্ব
:উৎপত্তি ও অস্তিত্বের সাম্প্রতিকতম ধারণা' গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠান
আয়োজিত হয়েছিল। ইতিমধ্যে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ড. অভিজিৎ শিক্ষাজীবনে
অনন্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখায় নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বুয়েটের শিক্ষক
হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। পরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করলেও দেশের টানে বারবার
ছুটে এসেছেন। কিন্তু বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও মুক্তবুদ্ধির
চর্চা যারা চায় না, মহান একুশে ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যাদের
বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই, তাদের কাছে তিনি শত্রু হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। এই
শক্তিই একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বাঁচাতে সক্রিয়। তারাই
২০১৩ সালে দেশজুড়ে অশান্তি ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিল। তাদের হাতেই মৃত্যু হয়
ব্লগার হিসেবে পরিচিত মিরপুরের তরুণ রাজীব হায়দারের। এ অপশক্তিই গত প্রায়
দুই মাস ধরে যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোল বোমা ছুড়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মারছে অসহায়
নারী-পুরুষ-শিশুদের। তারা রেলপথে নাশকতা চালায়, প্রায় ১৫ লাখ এসএসসি
পরীক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত করে তোলে। ব্যবসা-বাণিজ্যের অপূরণীয়
ক্ষতি তাদের দুর্ভাবনায় ফেলে না। এদের রুখতেই হবে। এজন্য আইন-শৃঙ্খলা
রক্ষাকারী বাহিনীর যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি চাই অসাম্প্রদায়িক,
গণতান্ত্রিক প্রতিটি দল ও সংগঠনের দৃঢ়সংকল্প ও সক্রিয় কার্যক্রম। আমরা
সুন্দর ও মঙ্গলময় বাংলাদেশ চাই, মুক্তবুদ্ধির চর্চা চাই। এ পথ থেকে কেউ
দেশকে বিচ্যুত করতে পারবে না। ড. অভিজিৎ রায়ের শোকাহত পরিবারের সদস্য ও
স্বজনদের প্রতি আমাদের সমবেদনা। একই সঙ্গে প্রত্যাশা, অনতিবিলম্বে তার
ঘাতকদের গ্রেফতার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা।
No comments