অচলাবস্থা ও সংলাপ by ড. আবদুল লতিফ মাসুম
প্রায়
দু'মাস ধরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কাটছে জনজীবন। একটি রাজনৈতিক সংকটে নিপতিত
গোটা জাতি। সংকটের উৎসমূল সবারই জানা কথা। বছর শেষে 'অবৈধ' অথবা 'নিয়ম
রক্ষার' নির্বাচন প্রশ্নে রাজনৈতিক দ্বিধাবিভক্তি এবং আন্দোলন চরমে পেঁৗছে।
দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামে মূলত মানবিক বিপর্যয় ঘটে। পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হয়
মানুষ। নিত্যদিন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে মরছে মানুষ। স্বাভাবিক জীবনযাপনই
অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, কল-কারখানা, আমদানি-রফতানি এবং
শিক্ষা ব্যবস্থা এক রকম স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রতিটি নাগরিক এ অবস্থা থেকে
মুক্তি চায়। অব্যাহত সহিংসতা এবং নির্মমতায় বিচলিত দেশের সেরা মানুষেরা
সম্প্রতি জাতীয় সংকট নিরসনে এক গোলটেবিল বৈঠক ডাকেন। রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স
ইনস্টিটিউশনের সেমিনার কক্ষে 'জাতীয় সংকট নিরসনে জাতীয় সংলাপ' শীর্ষক এ
আলোচনার আয়োজন করে 'জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া'। এতে সাবেক প্রধান নির্বাচন
কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা বলেন, 'পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে যে,
দেশের ভবিষ্যৎ নিয়েও দুশ্চিন্তার কারণ সৃষ্টি হয়েছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে
নিঃশেষ করে দিতে চাইছে। এ অবস্থায় শুধু বর্তমান পরিস্থিতির নিরসন নয়;
ভবিষ্যতের জন্য স্থিতিশীল রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের জন্য একটি জাতীয় সনদ প্রণয়ন
করা দরকার।' বর্তমান সংকটমুক্তি এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি জাতীয় সনদ
প্রণয়নের প্রয়োজনে তারা সরকার ও বিরোধী দল তথা সব রাজনৈতিক মত ও পথের
সমন্বয়ে জাতীয় সংলাপ অনুষ্ঠানের তাগাদা দেন। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে
রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপিপ্রধানের কাছে চিঠি দেওয়া হয়। রাজনৈতিক
সংকট নিরসনে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টির জন্য তাদের কাছে নাগরিক সমাজের একটি
প্রস্তাবও পাঠানো হয়। নাগরিক সমাজ রাষ্ট্রপতির কাছে লেখা চিঠিতে রাষ্ট্রের
অভিভাবক হিসেবে তাকে সংলাপের শুভ উদ্যোগ গ্রহণে বিশেষ ভূমিকা রাখার অনুরোধ
জানায়।
এই নাগরিক সংলাপ উদ্যোগের পূর্বে জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহল সহিংসতা পরিহার ও সংলাপের মাধ্যমে সংকট নিরসনের আহ্বান জানায়। চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে বিএনপিকে আলোচনায় ডাকতে আওয়ামী লীগের প্রতি ইতিমধ্যে আহ্বান জানায় ব্রাসেলসভিত্তিক গবেষণা সংস্থা 'ইন্টারন্যশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ'। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা 'নিউইয়র্ক টাইমস' তাদের এক সম্পাদকীয়তে বলেছে, বাংলাদেশে নির্বাচনী সংস্কার নিয়ে সরকারকে অবশ্যই বিরোধীদের আলোচনায় ডাকতে হবে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরতে হবে। অবশেষে বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা থেকে উত্তরণে সংলাপে বসতে দুই নেত্রীকে আহ্বান জানান জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। ঢাকায় অবস্থানরত উদ্বিগ্ন কূটনীতিকরা সংলাপ এবং সমঝোতার মাধ্যমে সংকট সমাধানের আহ্বান জানান।
দেশ-বিদেশে এত আকুলতা সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে সাড়া মেলেনি। প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন উত্থাপন করেন কার সঙ্গে আলোচনা করব? খুনির সঙ্গে? সম্প্রতি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে সংলাপ বা আলোচনায় না যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে প্রদত্ত তার বক্তৃতায় খালেদা জিয়াকে আইএসের সমার্থক বলে উল্লেখ করে সংলাপে বসতে অস্বীকার করেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিএনপির আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ বলে অভিহিত করেন এবং আলোচনায় অস্বীকৃতি জানান। প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদ নাগরিক সমাজের প্রস্তাব প্রসঙ্গে বলেন, 'তাদের প্রস্তাব অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য। সন্ত্রাস, নাশকতা ও সন্ত্রাসী তৎপরতাকে আড়াল করার জন্য একটি গণতান্ত্রিক দলকে নাশকতাকারী দলের একই কাতারে দাঁড় করানোর চেষ্টা রয়েছে এই প্রস্তাবে।'
স্মরণ করা যেতে পারে, বিএনপি চেয়ারপাসন এবং ২০ দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া আন্দোলন শুরুর প্রাক্কালে পুনর্নির্বাচনের বিষয়টি নিয়ে সংলাপের আহ্বান জানান। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সংলাপের যে আহ্বান জানানো হয়; বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে সে উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। তবে অবরোধ আন্দোলনে বিএনপি অনড় এবং আপসহীন থাকে। কথা হচ্ছে, জনগণের ব্যাকুলতা যদি পরিমাপ করা যায় তাহলে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সংলাপ-সমঝোতাই অনিবার্য হয়ে ওঠে। জনগণের পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে। তারা বাঁচতে চায়।
বিরোধী দলকে অবশ্য মনে রাখতে হবে যে, সন্ত্রাস ও সংলাপ একসঙ্গে চলে না। সন্ত্রাস এবং নির্মমতা সব সময়ই নিন্দনীয়। এ ধরনের অস্বাভাবিক অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা বা সংলাপের বিকল্প নেই। কিন্তু যে সন্ত্রাসের কারণ দেখিয়ে সরকার মুখ ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছে, তার অবসান আরেকটি সন্ত্রাস দিয়ে সম্ভব নয়। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে অনড় অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে। পারস্পরিক বিশ্বাস, আস্থা এবং সমঝোতার মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে তাদের কাজের মাধ্যমে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। তাদের অনুভূতি এবং উপলব্ধির খবর রাখতে হবে। তাদের নাড়ির টান বুঝতে হবে। প্রায় দু'মাস ধরে মানুষ যেভাবে রাজনৈতিক জেদাজেদির শিকার হয়েছে, অবিলম্বে তার অবসান ঘটাতে হবে।
প্রফেসর, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
mal55ju@yahoo.com
এই নাগরিক সংলাপ উদ্যোগের পূর্বে জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহল সহিংসতা পরিহার ও সংলাপের মাধ্যমে সংকট নিরসনের আহ্বান জানায়। চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে বিএনপিকে আলোচনায় ডাকতে আওয়ামী লীগের প্রতি ইতিমধ্যে আহ্বান জানায় ব্রাসেলসভিত্তিক গবেষণা সংস্থা 'ইন্টারন্যশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ'। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা 'নিউইয়র্ক টাইমস' তাদের এক সম্পাদকীয়তে বলেছে, বাংলাদেশে নির্বাচনী সংস্কার নিয়ে সরকারকে অবশ্যই বিরোধীদের আলোচনায় ডাকতে হবে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরতে হবে। অবশেষে বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা থেকে উত্তরণে সংলাপে বসতে দুই নেত্রীকে আহ্বান জানান জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। ঢাকায় অবস্থানরত উদ্বিগ্ন কূটনীতিকরা সংলাপ এবং সমঝোতার মাধ্যমে সংকট সমাধানের আহ্বান জানান।
দেশ-বিদেশে এত আকুলতা সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে সাড়া মেলেনি। প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন উত্থাপন করেন কার সঙ্গে আলোচনা করব? খুনির সঙ্গে? সম্প্রতি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে সংলাপ বা আলোচনায় না যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে প্রদত্ত তার বক্তৃতায় খালেদা জিয়াকে আইএসের সমার্থক বলে উল্লেখ করে সংলাপে বসতে অস্বীকার করেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিএনপির আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ বলে অভিহিত করেন এবং আলোচনায় অস্বীকৃতি জানান। প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদ নাগরিক সমাজের প্রস্তাব প্রসঙ্গে বলেন, 'তাদের প্রস্তাব অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য। সন্ত্রাস, নাশকতা ও সন্ত্রাসী তৎপরতাকে আড়াল করার জন্য একটি গণতান্ত্রিক দলকে নাশকতাকারী দলের একই কাতারে দাঁড় করানোর চেষ্টা রয়েছে এই প্রস্তাবে।'
স্মরণ করা যেতে পারে, বিএনপি চেয়ারপাসন এবং ২০ দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া আন্দোলন শুরুর প্রাক্কালে পুনর্নির্বাচনের বিষয়টি নিয়ে সংলাপের আহ্বান জানান। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সংলাপের যে আহ্বান জানানো হয়; বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে সে উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। তবে অবরোধ আন্দোলনে বিএনপি অনড় এবং আপসহীন থাকে। কথা হচ্ছে, জনগণের ব্যাকুলতা যদি পরিমাপ করা যায় তাহলে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সংলাপ-সমঝোতাই অনিবার্য হয়ে ওঠে। জনগণের পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে। তারা বাঁচতে চায়।
বিরোধী দলকে অবশ্য মনে রাখতে হবে যে, সন্ত্রাস ও সংলাপ একসঙ্গে চলে না। সন্ত্রাস এবং নির্মমতা সব সময়ই নিন্দনীয়। এ ধরনের অস্বাভাবিক অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা বা সংলাপের বিকল্প নেই। কিন্তু যে সন্ত্রাসের কারণ দেখিয়ে সরকার মুখ ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছে, তার অবসান আরেকটি সন্ত্রাস দিয়ে সম্ভব নয়। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে অনড় অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে। পারস্পরিক বিশ্বাস, আস্থা এবং সমঝোতার মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে তাদের কাজের মাধ্যমে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। তাদের অনুভূতি এবং উপলব্ধির খবর রাখতে হবে। তাদের নাড়ির টান বুঝতে হবে। প্রায় দু'মাস ধরে মানুষ যেভাবে রাজনৈতিক জেদাজেদির শিকার হয়েছে, অবিলম্বে তার অবসান ঘটাতে হবে।
প্রফেসর, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
mal55ju@yahoo.com
No comments