ইরানে ট্যাংকার আটক: জাহাজের পতাকা কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ?
বাণিজ্যিক জাহাজে ব্রিটিশ পতাকা |
পারস্য উপসাগরে মালবাহী জাহাজ স্টেনা
ইমপেরো আটক করেছে ইরান, যেটি চলছিল ব্রিটিশ পতাকা নিয়ে। কিন্তু আসলে এই
জাহাজটির মালিক একটি সুইডিশ কোম্পানি এবং পুরো জাহাজে কোন ব্রিটিশ নাগরিক
ছিল না।
কিন্তু এটা অস্বাভাবিক নয়। বরং অনেক সময়েই দেখা যায় যে,
জাহাজটি এমন একটি দেশের পতাকা নিয়ে চলাচল করছে, যার মালিক একেবারেই ভিন্ন
দেশের লোক।
কিন্তু কেন এটা করা হয়? তাতে কি সুবিধা?
কেন লাইবেরিয়া, পানামা আর মার্শাল আইল্যান্ডের পতাকাবাহী জাহাজ বেশি দেখা যায়?
সাগরে
চলাচলকারী প্রতিটি বাণিজ্যিক জাহাজকে কোন না কোন দেশে নিবন্ধন করতে হয়
এবং সেই দেশের পতাকা ওই জাহাজটি বহন করবে। দেশটিকে বলা হয় ফ্ল্যাগড স্টেট।
ওপেন রেজিস্ট্রি পদ্ধতিতে, যাকে অনেক সময় 'সুবিধা অনুযায়ী
পতাকা' বলেও বর্ণনা করা হয়, জাহাজ যেকোনো দেশে তালিকাভুক্ত হতে পারে,
জাহাজের মালিক অন্য দেশের হলেও তাতে কোন সমস্যা নেই।
তবে অন্য
পদ্ধতিগুলোয় পতাকার বিষয়ে বেশ কড়াকড়ি রয়েছে যে, এসব জাহাজের মালিক কে
হতে পারবে এবং কিভাবে জাহাজ পরিচালনা করা হবে। যে দেশে নিবন্ধন করা হয়,
সে দেশের আইনকানুন জাহাজটিকে মেনে চলতে হয়।
ব্রিটিশ পতাকাবাহী জাহাজ স্টেনা ইমপেরো - এই ট্যাংকারটিকেই আটক করেছে ইরান। |
পানামা, মার্শাল আইল্যান্ড আর লাইবেরিয়া হচ্ছে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ফ্ল্যাগ স্টেট বা পছন্দের পতাকার দেশ।
যুক্তরাজ্যের বাণিজ্যিক জাহাজের তালিকায় প্রায় তেরশো জাহাজ তালিকাভুক্ত রয়েছে।
এই
লাল পতাকার ব্যানারের দলে যুক্তরাজ্য, ক্রাউন ডিপেন্ডেনসিস (আইল অফ ম্যান,
গার্নসে, এবং জার্সি) এবং যুক্তরাজ্যের ওভারসিজ টেরিটরি
(অ্যানগুলিয়া,বারমুডা, দ্যা ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, দ্যা কেইম্যান
আইল্যান্ড, দ্যা ফকল্যান্ড আইল্যান্ড, জিব্রাল্টার, মন্টসেরাত, সেন্ট
হেলেনা এবং দ্যা টার্ক ও কাইকোস আইল্যান্ড) মিলে বিশ্বের নবম বৃহত্তম জাহাজ
বহরে পরিণত হয়েছে।
নিজে দেশ ছেড়ে কেন অন্য দেশের পতাকা?
অনেকগুলো বাণিজ্যিক কারণ বিবেচনায় রেখে জাহাজ মালিকরা নিবন্ধন করার দেশটিকে বাছাই করেন।
এসবের মধ্যে রয়েছে সেখানকার আইনকানুন, করের হার, সেবার মান- বলছেন ম্যারিটাইম নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আয়োনিস চাপসোস।
তিনি বলছেন, গ্রীস হচ্ছে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় জাহাজ মালিকের দেশ। কিন্তু সেখানকার বেশিরভাগ জাহাজই গ্রীসের পতাকা বহন করে না।
এর একটি বড় কারণ, সেখানে এজন্য অনেক বেশি অংকের ট্যাক্স দিতে হয়।
বরং 'ফ্ল্যাগ স্টেট, অনেক সময় দেখা যায় যেগুলো একটু গরীব দেশ, তারা জাহাজ নিবন্ধন করে অর্থ আয় করার সুযোগ পায়।
জিব্রাল্টারের কাছে এই ইরানি তেলবাহী জাহাজটি আটক করেছিল ব্রিটেন, তার পর থেকেই ইরান পাল্টা ব্যবস্থার হুমকি দিচ্ছিল |
যেমন জাহাজ নিবন্ধন খাত থেকে পানামার অর্থনীতিতে প্রতিবছর কোটি কোটি ডলার যোগ হয়।
এখানকার নিবন্ধন পদ্ধতির কারণে বিশ্বের যেকোনো স্থান থেকে জাহাজের কর্মীদের নিয়োগ দেয়া যায়, যা কোম্পানির খরচও অনেক কমিয়ে আনে।
এই
'সুবিধা অনুযায়ী পতাকা' পদ্ধতির অনেক সমালোচনা রয়েছে, বিশেষ করে এর
দুর্বল নিয়মাবলী আর তদারকির অভাব, যা এমনকি অনেক সময় আন্তর্জাতিক জাহাজ
চলাচলের নিয়মের বিরুদ্ধে চলে যায়। যদিও গত তিন দশক ধরে জাহাজ চলাচলের
রীতিনীতির বিশেষ উন্নতি ঘটতে দেখা গেছে।
তবে এখনো এই ব্যবস্থার অনেক সমালোচনা করা হয়।
ভিন্ন
দেশের পতাকাবাহী হওয়ার কারণে অনেক সময় মজুরি বৈষম্য বা খারাপ কাজের
পরিবেশর জন্য মালিকের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে, বলছে
আন্তর্জাতিক ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কাস ফেডারেশন।
কার দায় বেশি?
কোন দেশে
নিবন্ধন করার পর পতাকা বহনের পাশাপাশি ওই জাহাজের ওপর ওই দেশের আইন কার্যকর
হবে। পতাকাবাহী জাহাজের কোন অপরাধের জন্য দায়দায়িত্ব বহন করবে যে দেশে
তালিকাভুক্ত হয়েছে, সেই দেশটি।
যার মানে হলো নিবন্ধন দেয়ার সময়
প্রতিটা জাহাজকে জরিপ এবং যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড
নিশ্চিত করতে হবে, বলছে আইএমও।
পারস্য উপসাগরে একটি বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নরওয়ের মালিকানাধীন কিন্তু মার্শাল আইল্যান্ডে নিবন্ধনকৃত জাহাজ ফ্রন্ট অলটেয়ার |
যেসব দেশে জাহাজ তালিকাভুক্ত হয়,
প্রতিটা দেশই আন্তর্জাতিক ম্যারিটাইম চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে এবং চুক্তির
শর্তগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিয়েছে। যেসব বিধিবিধানের মধ্যে রয়েছে
জাহাজ কিভাবে তৈরি হবে, নকশা, সরঞ্জাম এবং কিভাবে জাহাজটি পরিচালিত হবে
ইত্যাদি।
জাতিসংঘের কনভেনশন ফর দি ল' অফ দি সী অনুযায়ী, সমুদ্রে
চলাচলের সময় জাহাজে যেন সবরকম নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকে, সেটা নিশ্চিত
করবে নিবন্ধন করা দেশটি, যাদের পতাকা ওই জাহাজে রয়েছে।
নিবন্ধনের বিষয়গুলো কে দেখে?
এটা
খুব অস্বাভাবিক ব্যাপার নয় যে, কোন একটা দেশে জাহাজ নিবন্ধন এবং ওই দেশের
পতাকা জাহাজটি বহন করলেও, এই নিবন্ধনের পুরো কাজটি হয়তো করা হচ্ছে আরেকটি
দেশে।
লাইবেরিয়ার উদাহরণ দেখা যাক, যেখানে জাহাজ নিবন্ধনের কাজটি করে একটি আমেরিকান কোম্পানি, যাদের সদর দপ্তর ওয়াশিংটন ডিসিতে।
ভূমিবেষ্টিত মঙ্গোলিয়ার নিবন্ধন দপ্তর সিঙ্গাপুরে অবস্থিত।
কোমোরোসের নিবন্ধন হয় বুলগেরিয়া থেকে।
ভানুয়াটুর জাহাজ নিবন্ধন অফিস রয়েছে নিউইয়র্কে।
জাহাজ নিবন্ধনের এই অস্বাভাবিক পদ্ধতি অনেক সময় নিরাপত্তা ঝুঁকিরও তৈরি করে।
নিবন্ধনকারী
কোন দেশের পক্ষে তালিকাভুক্ত হওয়া সব জাহাজকে নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব নয়,
বলছেন মি. চাপসোস, যদিও ওই জাহাজটি হয়তো ওই দেশেরই একটি বর্ধিত অংশ।
আর
এটা সেসব দেশের জন্য আরো কঠিন যাদের হয়তো ছোট আকারের নৌবাহিনী রয়েছে,
যেমন রয়্যাল নৌবাহিনী, কিন্তু বাণিজ্যিক জাহাজের বিশাল বহর রয়েছে।
ব্রিটিশ ইরানিয়ান নাগরিক নাজনিন যাগারি-র্যাটক্লিফকে ইরান আটক করে রাখায় ইরানের সঙ্গে ব্রিটেনের সম্পর্ক আগে থেকেই তিক্ত হয়ে উঠেছে। ছবিতে মেয়ের সঙ্গে নাজনিন |
No comments