ইসরাইল হামলা করলে, সিরিয়া কি টিকবে? by চাক ফ্রেইলিচ
ইসরাইলের
সামরিক বাহিনী আইডিএফ’র প্রতিষ্ঠিতই হয়েছিল সিরিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর কথা
মাথায় রেখে। কয়েক দশক ধরে এই বাহিনীই ছিল ইসরাইলের প্রধান প্রতিপক্ষ।
কিন্তু সিরিয়ান সামরিক বাহিনী গত কয়েক বছর ধরে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধে প্রায়
বিপর্যস্ত। সিরিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কথা বাদ দিলে, দেশটির সামরিক
বাহিনী আজ ইসরাইলের জন্য বড় কোনো সামরিক চ্যালেঞ্জই নয়। ইসরাইলের অপর দুই
প্রতিবেশী দেশ মিশর ও জর্দান অনেক আগেই শান্তিচুক্তিতে পৌঁছেছে। দ্বিতীয়
উপসাগরীয় যুদ্ধের পর কথিত ‘ইস্টার্ন ফ্রন্ট’-এর অবসান ঘটে। ফলে ইসরাইলের আজ
এমন কোনো প্রতিবেশী দেশ নেই যেই দেশ কিনা ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লড়ার
সামর্থ্য রাখে ও ইচ্ছা আছে। কিন্তু প্রকৃতি শূন্যতা পছন্দ করে না।
সিরিয়া যদিও ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, অন্যান্য পক্ষ যেন সেই শূন্যতা পূরণে নেমে গেছে।
গত ৮ বছর ধরে সিরিয়ায় উত্তাল পরিস্থিতি চলছে। এই সময়ব্যাপী বেশ কয়েকবার এমন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল যা কিনা ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তায় ভীষণ প্রভাব ফেলতে পারতো। যেমন এই গৃহযুদ্ধের একটি সম্ভাবনা ছিল, আইএস-অধ্যুষিত সিরিয়া। ইসরাইলি সীমান্তের ঠিক ওপারে একটি জঙ্গিরাষ্ট্র নিশ্চিতভাবেই দেশটির নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কিন্তু মার্কিন নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের কার্যকর পদক্ষেপের কারণে এই ঝুঁকি নিরসন করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু অদ্ভুত শোনালেও সত্য, আইএস নিয়ে আরব দেশগুলো, যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যতটা উদ্বিগ্ন ছিল, ততটা ছিল না ইসরাইল। অপরদিকে আইএসও নিজেদের সুন্নি প্রতিপক্ষ ও পশ্চিমা দেশগুলো নিয়েই বেশি ব্যতিব্যস্ত ছিল।
এই গৃহযুদ্ধের দ্বিতীয় সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে ইসরাইলের ভয় ছিল বেশি। এবং বাস্তবে সেটাই হয়েছে। ইসরাইলের ভয় ছিল, গৃহযুদ্ধ শেষে সিরিয়া পুনরায় সুসংহত হবে। আর দেশটিতে প্রাধান্য থাকবে ইসরাইলের চরম শত্রু ইরান, আর রাশিয়া। ইসরাইলের জন্য যৎসামান্য ভালো খবর হচ্ছে, সিরিয়া দৃশ্যত একটি রাষ্ট্র হিসেবে পুনর্গঠিত হয়েছে। খ-বিখ- সিরিয়া দেশটিতে ইরান ও ইরান-সমর্থিত হেজবুল্লাহর প্রভাব বৃদ্ধির জন্য উত্তম ক্ষেত্র প্রস্তুত হতো। তখন এই দুই পক্ষকে সামাল দেয়ারও কেউ থাকতো না।
স্পষ্টতই, বাশার আল আসাদ চান না তার ওপর ইরান বা রাশিয়া খবরদারি করুক। কিন্তু যৎসামান্য সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে এই দুই দেশকে তুষ্ট রাখা ছাড়া তার আর কোনো গতিও নেই।
সিরিয়ায় এই মুহূর্তে সবচেয়ে ক্ষমতাধর একক পক্ষ হলো রাশিয়া। সিরিয়ায় নিজেদের বিমান ও নৌ ঘাঁটির জন্য ৫০ বছরের লিজ পেয়েছে রাশিয়া। ফলে পূর্ব ভূমধ্যসাগর অবধি ক্ষমতা বিস্তারের সুযোগ পেয়েছে রাশিয়া। যেই রাশিয়া নিজের সুপার পাওয়ার স্ট্যাটাস পুনরুদ্ধার ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাল¬া দিতে মরিয়া, সেই রাশিয়ার জন্য সিরিয়ান গৃহযুদ্ধের এই ফলাফলের চেয়ে ভালো কিছু হতেই পারে না। মধ্যপ্রাচ্যে নিজের হৃত প্রভাব পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে দেশটি। এই অঞ্চলে এখন গুরুত্বপূর্ণ ভারসাম্যদায়ী শক্তি রাশিয়া। পিছু হটা আমেরিকার চেয়েও বড় শক্তি এখন রাশিয়া।
ইরানের জন্য সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের এই ফলাফল যেন দেশটির দীর্ঘদিনের লালিত ‘শিয়া অক্ষ’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নপূরণের চাবিকাঠি। ইরাক, সিরিয়া ও লেবানন হয়ে ভূমধ্যসাগর অবধি থাকবে তাদের প্রভাব। থাকবে ইসরাইলি সীমান্ত ঘেঁষে স্থায়ী স্থল, আকাশ ও নৌ উপস্থিতি। কিন্তু এই স্বপ্ন পূরণে এখন পর্যন্ত প্রতিবন্ধকতা ছিল পূর্ব সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান, যেটি কিনা ক্রমশই ক্ষয়িষ্ণু হয়ে উঠছে। আরেকটি হলো ইসরাইলের শ’ শ’ বিমান হামলা, যা ইরানের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
ইসরাইল এখন একটি শক্তিশালী ও নিরাপদ রাষ্ট্র। বহু চ্যালেঞ্জের মুখেও এখন ধৈর্য দেখাতে পারে দেশটি। কিন্তু ইরানের চাওয়া পূরণ হলে এই অঞ্চলের ক্ষমতার ভারসাম্যে বিপজ্জনক পরিবর্তন দেখতে পাবে ইসরাইল। যেই পরিবর্তন ইসরাইলের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। প্রয়োজনে যুদ্ধ করে হলেও সেই পরিবর্তন ঠেকাতে চাইবে ইসরাইল। কিন্তু ইসরাইলের জন্য সমস্যা হলো, দেশটি প্রতিরক্ষামূলক লড়াইয়ে লিপ্ত। আর ইরান যদি সত্যিকার অর্থেই লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকে, তাহলে ইসরাইলের এই কৌশল পরাভূত হবে এমন সম্ভাবনাই বেশি।
ইসরাইল কেবলমাত্র সামরিক চালান ও ঘাঁটিতে হামলা করতে পারবে অনেকবার। যদি ৯৯ শতাংশ বারও ইসরাইল সফল হয় (যেটি খুব অবাস্তব সম্ভাবনা), তবুও ইরান ধীরে ধীরে সিরিয়ায় তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করবে। ঠিক যেভাবে দশকের পর দশক ধরে হিজবুল¬াহ ১ লাখ ৩০ হাজার রকেট জমা করেছে। সিরিয়াকে দ্বিতীয় লেবানন হতে দেয়ার ঝুঁকি নিতে পারবে না ইসরাইল।
ওবামা ও ট্রাম্প উভয়ের আমলেই মার্কিন প্রশাসন দৃশ্যত সিরিয়াকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছে। ফলে সেখানে প্রভাব বেড়েছে উজ্জীবিত রাশিয়া ও ইরানের। আঞ্চলিক অনেক শক্তিই এখন মনে করে, মার্কিন মধ্যপ্রাচ্য নীতিমালা সামঞ্জস্যহীন ও অকার্যকর। ট্রাম্প যদি সিরিয়ায় যৎসামান্য সামরিক উপস্থিতি বজায়ও রাখেন, ইসরাইল ইতিমধ্যে এমন পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে যেখানে কিনা পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল করতে সক্ষম এমন একমাত্র দেশ হলো রাশিয়া। কিংবা, সিরিয়ায় কিংবা সরাসরি ইরানের সঙ্গে ইসরাইলের সংঘাত সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে এমন পরিস্থিতি ঠেকানোর সামর্থ্য এখন কেবল রাশিয়ারই আছে।
তবে, আজ অবধি ‘মডারেটরে’র ভূমিকায় রাশিয়া আংশিকভাবে সফল হয়েছে। এর কারণ হতে পারে যে, সিরিয়ায় ও ইরানের ওপর রাশিয়ার প্রভাব আসলে সীমিত। কিংবা ইসরাইলসহ সকল পক্ষকে একে অপরের বিরুদ্ধে খেলাতে চায় রাশিয়া।
গত সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার একটি বিমান ইসরাইলের গুলিতে ভূপাতিত হয়। তার আগ অবধি রাশিয়া সিরিয়ায় ইরান ও হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে যেভাবে ইচ্ছা আক্রমণ করার স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছিল ইসরাইলকে। রাশিয়ার ওই বিমান ভূপাতিত হওয়ার ঘটনা হয়তো সাজানো ছিল। কিন্তু ওই ঘটনার পর ইসরাইলের জন্য পরিস্থিতি একেবারেই পাল্টে গেছে।
ইসরাইল অবশ্য বারবার জোর দিয়ে বলেছে সিরিয়ায় আক্রমণ করার অধিকার তাদের আছে। কিন্তু রাশিয়ার বিধিনিষেধ ইসরাইলের আক্রমণের স্বাধীনতাকে ভীষণ সঙ্কুচিত করে দিয়েছে। ওই ঘটনার পর ইসরাইলের হামলার সংখ্যা অনেক কমে গেছে। সিরিয়ায় রাশিয়ার দেয়া এস৩০০ মিশাইল ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কার্যকর হওয়ার আগ থেকেই ইসরাইল আক্রমণ কমিয়ে দিয়েছে।
রাশিয়া ইসরাইলকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ইরানি ও হিজবুল্লাহ বাহিনীকে গোলান সীমান্তের ৬০-৮০ কিলোমিটারের মধ্যে ঘেঁষতে দেয়া হবে না। ইসরাইলের দাবি ছিল, তাদেরকে সিরিয়া থেকে পুরোপুরি প্রত্যাহার করতে হবে। ইসরাইলের দাবি দূরে থাক, নিজেদের প্রতিশ্রুতিই রাখতে পারেনি রাশিয়া। প্রকৃতপক্ষে, ইরান ও হিজবুল্লাহ নিজেদের বাহিনীকে সিরিয়ান সেনাবাহিনীর সঙ্গে একীভূত করে ফেলছে। সিরিয়ান বাহিনীর সকল ইউনিটে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের যেখানে থাকা উচিত ছিল, সেখানে তারা নেই। অগত্যা রাশিয়ান সহায়তা চাওয়া ব্যতীত ইসরাইলের আর কোনো বিকল্প নেই।
সিরিয়ায় স্থায়ী সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিতে ইরান যদি অনড় থাকে, এবং ইসরাইলের প্রতিরোধ প্রচেষ্টা যদি যথেষ্ট না হয়, তাহলে সিরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বড় ধরনের হামলা চালানোই সমীচীন মনে করবে ইসরাইল। প্রথমে বার্তা দেয়ার জন্য সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়ে এই আক্রমণ শুরু হতে পারে। এরপর হয়তো সরাসরি শাসকগোষ্ঠীকে টার্গেট করা হতে পারে। এতেও যদি কাজ না হয়, ইসরাইল হয়তো খোদ ইরানের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও শাসকগোষ্ঠীকেই টার্গেট করার কথা চিন্তা করবে।
এটি নিশ্চিতভাবেই বিপজ্জনক দিকে মোড় নিতে পারে। কিন্তু ইসরাইলের জন্য হয়তো ভবিষ্যতের চেয়ে এখনই এমন হামলা করাটা ভালো হবে। কেননা, পারমাণবিক চুক্তির কারণে ইরান এখনো পারমাণবিক সামর্থ্য অর্জন করতে পারছে না। ভবিষ্যতে হয়তো পরিস্থিতি এতটা অনুকূলে থাকবে না।
ইসরাইলি সীমান্তে ইরানের সামরিক তোড়জোড় নিয়ে দেশটি যে উদ্বিগ্ন তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও অবগত। ফলে ইসরাইল সামরিক পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দিলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হয়তো সিরিয়া ও ইরানের ওপর চাপ প্রয়োগ করবে।
সিরিয়ার ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি এখনো শেষ হয়নি। সিরিয়ার এই অবস্থা দেখে ইসরাইলের অনেকের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত হয়েছে। নব্বয়ের দশকের গোড়ার দিকে ইসরাইলে আলোচনা চলছিল, মিশর ও জর্দানের মতো সিরিয়ার সঙ্গেও গোলান উপত্যকা ফিরিয়ে দিয়ে শান্তিচুক্তি করা যেতে পারে কিনা। কিন্তু অনেকেই সেই ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, সিরিয়ার কোনো স্থায়ী পক্ষের সঙ্গে চুক্তি হবে না। সিরিয়ার খ-বিখ- অবস্থা সেই আশঙ্কাকেই সত্য প্রমাণ করেছে। ইসরাইলের জন্য ভয়াবহ হলেও এটি সত্য যে, তাদের উত্তরে ও দক্ষিণে সংঘাতের আশঙ্কা এমন সময় বেড়েছে যখন কিনা দেশের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ আনা হয়েছে। আর ইসরাইলের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিজয়ী দল সরকার গঠনে ব্যর্থ হওয়ায়, পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে হয়েছে।
(চাক ফ্রেইলিচ ইসরাইলের সাবেক উপ-জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। তিনি বর্তমানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ফেলো ও তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তার এই নিবন্ধ হারেৎসে প্রকাশিত হয়েছে।)
সিরিয়া যদিও ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, অন্যান্য পক্ষ যেন সেই শূন্যতা পূরণে নেমে গেছে।
গত ৮ বছর ধরে সিরিয়ায় উত্তাল পরিস্থিতি চলছে। এই সময়ব্যাপী বেশ কয়েকবার এমন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল যা কিনা ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তায় ভীষণ প্রভাব ফেলতে পারতো। যেমন এই গৃহযুদ্ধের একটি সম্ভাবনা ছিল, আইএস-অধ্যুষিত সিরিয়া। ইসরাইলি সীমান্তের ঠিক ওপারে একটি জঙ্গিরাষ্ট্র নিশ্চিতভাবেই দেশটির নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কিন্তু মার্কিন নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের কার্যকর পদক্ষেপের কারণে এই ঝুঁকি নিরসন করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু অদ্ভুত শোনালেও সত্য, আইএস নিয়ে আরব দেশগুলো, যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যতটা উদ্বিগ্ন ছিল, ততটা ছিল না ইসরাইল। অপরদিকে আইএসও নিজেদের সুন্নি প্রতিপক্ষ ও পশ্চিমা দেশগুলো নিয়েই বেশি ব্যতিব্যস্ত ছিল।
এই গৃহযুদ্ধের দ্বিতীয় সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে ইসরাইলের ভয় ছিল বেশি। এবং বাস্তবে সেটাই হয়েছে। ইসরাইলের ভয় ছিল, গৃহযুদ্ধ শেষে সিরিয়া পুনরায় সুসংহত হবে। আর দেশটিতে প্রাধান্য থাকবে ইসরাইলের চরম শত্রু ইরান, আর রাশিয়া। ইসরাইলের জন্য যৎসামান্য ভালো খবর হচ্ছে, সিরিয়া দৃশ্যত একটি রাষ্ট্র হিসেবে পুনর্গঠিত হয়েছে। খ-বিখ- সিরিয়া দেশটিতে ইরান ও ইরান-সমর্থিত হেজবুল্লাহর প্রভাব বৃদ্ধির জন্য উত্তম ক্ষেত্র প্রস্তুত হতো। তখন এই দুই পক্ষকে সামাল দেয়ারও কেউ থাকতো না।
স্পষ্টতই, বাশার আল আসাদ চান না তার ওপর ইরান বা রাশিয়া খবরদারি করুক। কিন্তু যৎসামান্য সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে এই দুই দেশকে তুষ্ট রাখা ছাড়া তার আর কোনো গতিও নেই।
সিরিয়ায় এই মুহূর্তে সবচেয়ে ক্ষমতাধর একক পক্ষ হলো রাশিয়া। সিরিয়ায় নিজেদের বিমান ও নৌ ঘাঁটির জন্য ৫০ বছরের লিজ পেয়েছে রাশিয়া। ফলে পূর্ব ভূমধ্যসাগর অবধি ক্ষমতা বিস্তারের সুযোগ পেয়েছে রাশিয়া। যেই রাশিয়া নিজের সুপার পাওয়ার স্ট্যাটাস পুনরুদ্ধার ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাল¬া দিতে মরিয়া, সেই রাশিয়ার জন্য সিরিয়ান গৃহযুদ্ধের এই ফলাফলের চেয়ে ভালো কিছু হতেই পারে না। মধ্যপ্রাচ্যে নিজের হৃত প্রভাব পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে দেশটি। এই অঞ্চলে এখন গুরুত্বপূর্ণ ভারসাম্যদায়ী শক্তি রাশিয়া। পিছু হটা আমেরিকার চেয়েও বড় শক্তি এখন রাশিয়া।
ইরানের জন্য সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের এই ফলাফল যেন দেশটির দীর্ঘদিনের লালিত ‘শিয়া অক্ষ’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নপূরণের চাবিকাঠি। ইরাক, সিরিয়া ও লেবানন হয়ে ভূমধ্যসাগর অবধি থাকবে তাদের প্রভাব। থাকবে ইসরাইলি সীমান্ত ঘেঁষে স্থায়ী স্থল, আকাশ ও নৌ উপস্থিতি। কিন্তু এই স্বপ্ন পূরণে এখন পর্যন্ত প্রতিবন্ধকতা ছিল পূর্ব সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান, যেটি কিনা ক্রমশই ক্ষয়িষ্ণু হয়ে উঠছে। আরেকটি হলো ইসরাইলের শ’ শ’ বিমান হামলা, যা ইরানের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
ইসরাইল এখন একটি শক্তিশালী ও নিরাপদ রাষ্ট্র। বহু চ্যালেঞ্জের মুখেও এখন ধৈর্য দেখাতে পারে দেশটি। কিন্তু ইরানের চাওয়া পূরণ হলে এই অঞ্চলের ক্ষমতার ভারসাম্যে বিপজ্জনক পরিবর্তন দেখতে পাবে ইসরাইল। যেই পরিবর্তন ইসরাইলের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। প্রয়োজনে যুদ্ধ করে হলেও সেই পরিবর্তন ঠেকাতে চাইবে ইসরাইল। কিন্তু ইসরাইলের জন্য সমস্যা হলো, দেশটি প্রতিরক্ষামূলক লড়াইয়ে লিপ্ত। আর ইরান যদি সত্যিকার অর্থেই লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকে, তাহলে ইসরাইলের এই কৌশল পরাভূত হবে এমন সম্ভাবনাই বেশি।
ইসরাইল কেবলমাত্র সামরিক চালান ও ঘাঁটিতে হামলা করতে পারবে অনেকবার। যদি ৯৯ শতাংশ বারও ইসরাইল সফল হয় (যেটি খুব অবাস্তব সম্ভাবনা), তবুও ইরান ধীরে ধীরে সিরিয়ায় তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করবে। ঠিক যেভাবে দশকের পর দশক ধরে হিজবুল¬াহ ১ লাখ ৩০ হাজার রকেট জমা করেছে। সিরিয়াকে দ্বিতীয় লেবানন হতে দেয়ার ঝুঁকি নিতে পারবে না ইসরাইল।
ওবামা ও ট্রাম্প উভয়ের আমলেই মার্কিন প্রশাসন দৃশ্যত সিরিয়াকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছে। ফলে সেখানে প্রভাব বেড়েছে উজ্জীবিত রাশিয়া ও ইরানের। আঞ্চলিক অনেক শক্তিই এখন মনে করে, মার্কিন মধ্যপ্রাচ্য নীতিমালা সামঞ্জস্যহীন ও অকার্যকর। ট্রাম্প যদি সিরিয়ায় যৎসামান্য সামরিক উপস্থিতি বজায়ও রাখেন, ইসরাইল ইতিমধ্যে এমন পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে যেখানে কিনা পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল করতে সক্ষম এমন একমাত্র দেশ হলো রাশিয়া। কিংবা, সিরিয়ায় কিংবা সরাসরি ইরানের সঙ্গে ইসরাইলের সংঘাত সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে এমন পরিস্থিতি ঠেকানোর সামর্থ্য এখন কেবল রাশিয়ারই আছে।
তবে, আজ অবধি ‘মডারেটরে’র ভূমিকায় রাশিয়া আংশিকভাবে সফল হয়েছে। এর কারণ হতে পারে যে, সিরিয়ায় ও ইরানের ওপর রাশিয়ার প্রভাব আসলে সীমিত। কিংবা ইসরাইলসহ সকল পক্ষকে একে অপরের বিরুদ্ধে খেলাতে চায় রাশিয়া।
গত সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার একটি বিমান ইসরাইলের গুলিতে ভূপাতিত হয়। তার আগ অবধি রাশিয়া সিরিয়ায় ইরান ও হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে যেভাবে ইচ্ছা আক্রমণ করার স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছিল ইসরাইলকে। রাশিয়ার ওই বিমান ভূপাতিত হওয়ার ঘটনা হয়তো সাজানো ছিল। কিন্তু ওই ঘটনার পর ইসরাইলের জন্য পরিস্থিতি একেবারেই পাল্টে গেছে।
ইসরাইল অবশ্য বারবার জোর দিয়ে বলেছে সিরিয়ায় আক্রমণ করার অধিকার তাদের আছে। কিন্তু রাশিয়ার বিধিনিষেধ ইসরাইলের আক্রমণের স্বাধীনতাকে ভীষণ সঙ্কুচিত করে দিয়েছে। ওই ঘটনার পর ইসরাইলের হামলার সংখ্যা অনেক কমে গেছে। সিরিয়ায় রাশিয়ার দেয়া এস৩০০ মিশাইল ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কার্যকর হওয়ার আগ থেকেই ইসরাইল আক্রমণ কমিয়ে দিয়েছে।
রাশিয়া ইসরাইলকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ইরানি ও হিজবুল্লাহ বাহিনীকে গোলান সীমান্তের ৬০-৮০ কিলোমিটারের মধ্যে ঘেঁষতে দেয়া হবে না। ইসরাইলের দাবি ছিল, তাদেরকে সিরিয়া থেকে পুরোপুরি প্রত্যাহার করতে হবে। ইসরাইলের দাবি দূরে থাক, নিজেদের প্রতিশ্রুতিই রাখতে পারেনি রাশিয়া। প্রকৃতপক্ষে, ইরান ও হিজবুল্লাহ নিজেদের বাহিনীকে সিরিয়ান সেনাবাহিনীর সঙ্গে একীভূত করে ফেলছে। সিরিয়ান বাহিনীর সকল ইউনিটে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের যেখানে থাকা উচিত ছিল, সেখানে তারা নেই। অগত্যা রাশিয়ান সহায়তা চাওয়া ব্যতীত ইসরাইলের আর কোনো বিকল্প নেই।
সিরিয়ায় স্থায়ী সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিতে ইরান যদি অনড় থাকে, এবং ইসরাইলের প্রতিরোধ প্রচেষ্টা যদি যথেষ্ট না হয়, তাহলে সিরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বড় ধরনের হামলা চালানোই সমীচীন মনে করবে ইসরাইল। প্রথমে বার্তা দেয়ার জন্য সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়ে এই আক্রমণ শুরু হতে পারে। এরপর হয়তো সরাসরি শাসকগোষ্ঠীকে টার্গেট করা হতে পারে। এতেও যদি কাজ না হয়, ইসরাইল হয়তো খোদ ইরানের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও শাসকগোষ্ঠীকেই টার্গেট করার কথা চিন্তা করবে।
এটি নিশ্চিতভাবেই বিপজ্জনক দিকে মোড় নিতে পারে। কিন্তু ইসরাইলের জন্য হয়তো ভবিষ্যতের চেয়ে এখনই এমন হামলা করাটা ভালো হবে। কেননা, পারমাণবিক চুক্তির কারণে ইরান এখনো পারমাণবিক সামর্থ্য অর্জন করতে পারছে না। ভবিষ্যতে হয়তো পরিস্থিতি এতটা অনুকূলে থাকবে না।
ইসরাইলি সীমান্তে ইরানের সামরিক তোড়জোড় নিয়ে দেশটি যে উদ্বিগ্ন তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও অবগত। ফলে ইসরাইল সামরিক পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দিলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হয়তো সিরিয়া ও ইরানের ওপর চাপ প্রয়োগ করবে।
সিরিয়ার ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি এখনো শেষ হয়নি। সিরিয়ার এই অবস্থা দেখে ইসরাইলের অনেকের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত হয়েছে। নব্বয়ের দশকের গোড়ার দিকে ইসরাইলে আলোচনা চলছিল, মিশর ও জর্দানের মতো সিরিয়ার সঙ্গেও গোলান উপত্যকা ফিরিয়ে দিয়ে শান্তিচুক্তি করা যেতে পারে কিনা। কিন্তু অনেকেই সেই ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, সিরিয়ার কোনো স্থায়ী পক্ষের সঙ্গে চুক্তি হবে না। সিরিয়ার খ-বিখ- অবস্থা সেই আশঙ্কাকেই সত্য প্রমাণ করেছে। ইসরাইলের জন্য ভয়াবহ হলেও এটি সত্য যে, তাদের উত্তরে ও দক্ষিণে সংঘাতের আশঙ্কা এমন সময় বেড়েছে যখন কিনা দেশের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ আনা হয়েছে। আর ইসরাইলের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিজয়ী দল সরকার গঠনে ব্যর্থ হওয়ায়, পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে হয়েছে।
(চাক ফ্রেইলিচ ইসরাইলের সাবেক উপ-জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। তিনি বর্তমানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ফেলো ও তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তার এই নিবন্ধ হারেৎসে প্রকাশিত হয়েছে।)
No comments