টাইমের চোখে প্রভাবশালী ১০ মুসলিম by মনযূরুল হক
প্রতি
বছরের মতো এ বছরও যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন ‘টাইম’ বিশ্বের ১০০
প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকা প্রকাশ করেছে। ১৯৯৯ সালে শুরু হওয়া ‘টাইম ওয়ান
হানড্রেড’ ১৭ এপ্রিল সংখ্যায় রয়েছে চমকের বাহার। বিখ্যাত অনেকেই অবস্থান
হারিয়েছেন এবং দেখা মিলেছে অনেক নতুন মুখের। পাইওনিয়ার, আর্টিস্ট, লিডার,
আইকন ও টাইটান- এমন পাঁচ ক্যাটাগরির তালিকায় স্থান পেয়েছেন প্রভাবশালী ১০
মুসলিম ব্যক্তিত্ব।
২১ জনের পাইওনিয়ার তালিকায় রয়েছেন মার্কিন কমেডিয়ান হাসান মিনহাজ ও সামিন নুসরাত। শিল্পীদের ১৭ জনের তালিকায় রয়েছেন সম্প্রতি অস্কারজয়ী অভিনেতা মাহেরশাল আলী। বিশ্বের প্রভাবশালী নেতাদের তালিকায় থাকা ২৬ জনের মধ্যে স্থান পেয়েছেন ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ, মালয়েশিয়ার মাহাথির, পাকিস্তানের ইমরান খান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ। প্রভাবশালী আইকনদের ১৪ জনের তালিকায় রয়েছেন দুজন মুসলিম নারী মানবাধিকার কর্মীÑ রাজিয়া আল-মুতাওয়াকিল ও লুজাইন আল-হাজলুল। আর সর্বশেষ টাইটান বা ‘দানব’দের নিয়ে তৈরি ১৬ জনের তালিকায় সবচেয়ে উজ্জ্বল অবস্থানে আছেন মিসরীয় ফুটবল তারকা মোহাম্মদ সালাহ, যিনি মার্ক জাকারবার্গ ও মুকেশ আম্বানিকেও পেছনে ফেলেছেন। আসুন টাইমের চোখে বিশ্বখ্যাত মুসলিম তারকাদের সম্পর্কে চেনাজানা হোক।
১. হাসান মিনহাজ
১৯৮৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর জন্ম নেওয়া হাসান মিনহাজ একজন লেখক, রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও টেলিভিশন প্রযোজক। টাইম ম্যাগাজিনের পক্ষে তাকে নিয়ে লিখেছেন ডেইলি শোতে তার সহকর্মী ট্রেভার নোয়া। তিনি লেখেনÑ ২০১৪ সালে যখন হাসান মিনহাজের সঙ্গে প্রথমবারের মতো আমার দেখা, তখন আমরা এখানে কাজ করতে এসেছিলাম। এরপর পাঁচ বছর কেটে গেছে, আর হাসানের মুখ এখন বিশ্বব্যাপী টেলিভিশন পর্দায় দেখা যাচ্ছে। ২০১৭ সালে হোয়াইট হাউসের প্রতিনিধিদের ডিনারে কৌতুক পরিবেশনের পর তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে এবং লেটনাইট শোতে তার উপস্থিতি আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন মুসলমান ও অভিবাসীদের প্রতি খ—গহস্ত হয়ে পড়েন, তখন হাসান মিনহাজের কণ্ঠ প্রতিবাদে ছিল মুখর। হাসান একজন প্রথম প্রজন্মের ইন্ডিয়ান আমেরিকান মুসলিম। দীর্ঘ পরিশ্রম ও সাধনার মধ্য দিয়ে হাসান তার ধারালো ও স্মার্ট ভাষ্য, ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিত্ব ও আন্তরিকতা দিয়ে আমেরিকা জয় করেছেন। এখন হাসানই আমেরিকা এবং আমেরিকাই হাসান।
কৌতুকই হাসানের শক্তি। তার কৌতুকের ধারালো আঘাতে বেশ কয়েকবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মিনহাজের মজলিস এড়িয়ে যান। মিনহাজের পৈতৃক বসতি ভারতের উত্তর প্রদেশের আলীগড়ে। তারা বাবা নাজমি রসায়নবিদ এবং মা সিমা ডাক্তার। তারা ক্যালিফোর্নিয়ার দাভোসে অভিবাসী হন। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক করেন মিনহাজ। তিনি ইংরেজি ভাষা ছাড়াও অবিরত হিন্দি ও উর্দুতে কথা বলতে পারেন।
২. সামিন নুসরাত
সামিন নুসরাত হলেন শেফ ও রান্নাবিষয়ক জনপ্রিয় লেখক। নিউইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনে তিনি নিয়মিত লেখেন। জন্ম ১৯৭৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার সানদিয়েগো শহরে। কিন্তু তার বাবা-মা ইরানি, ১৯৭৬ সালে তারা অভিবাসী হয়ে আমেরিকায় আসেন। ১৯৯৭ সালে বার্কেলের ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি বিষয়ে পড়াশোনার জন্য ভর্তি হন। তখনই শেজ পেনিশ রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে বিখ্যাত শেফ অ্যালিস ওয়াটার্সের সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং দীর্ঘদিন তার সঙ্গে কাজ করার পর অ্যালিস মন্তব্য করেনÑ সামিন নুসরাত হবে আমেরিকার পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে খ্যাতিমান রন্ধন শিক্ষক। টাইমের পক্ষে অ্যালিস তাকে নিয়ে লেখেনÑ সততা, হৃদ্যতা, নিরলস প্রচেষ্টা আর একাগ্রতার বদৌলতে সামিন এখন পৃথিবী বিখ্যাত একজন শেফ। সামিন দেখিয়েছে যে, কে কোথা থেকে এসেছে, সেটা কোনো বিষয় নয়। বরং সে আপনার উপাদানগুলো বুঝতে পারছে। বিশ্বের যেখানেই আপনি থাকেন বা বেড়ে ওঠেন, সেখানকার পরিবেশে কীভাবে স্বাস্থ্যসম্মত ও সুস্বাদু খাবার তৈরি করে নিতে পারেন, তা আমাদের বলে সামিন।
‘সল্ট, ফ্যাট, এসিড, হিট’ (২০১৭) শিরোনামে লেখা তার বইকে লন্ডনের দ্য টাইমস বর্ষসেরা রান্নাবিষয়ক বই হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং নিউইয়র্ক টাইমসের জরিপে সবচেয়ে বেশি বিক্রীত বইয়ের তালিকায় স্থান পায়। বইটি অবলম্বনে ‘সল্ট, ফ্যাট, এসিড, হিট’ নামে একটি ডকু সিরিজ নেটফ্লিক্সে প্রচারিত হচ্ছে।
৩. মাহেরশাল আলী
আলীর জন্ম ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডে ১৯৭৪ সালে। তিনি সেন্ট মারিস কলেজ অব ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ১৯৯৬ সালে গণযোগাযোগ বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অভিনয় প্রোগ্রামে মাস্টার্স করেন। ধর্মভীরু খ্রিষ্টান পরিবারে বেড়ে ওঠা আলী ১৯৯৯ সালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং তার আগের নাম মাহেরশাল আলহাশবাজ গিলমোর থেকে পরিবর্তন করে মাহেরশাল আলহাশবাজ আলী রাখেন। তিনি মুসলিম অভিনেত্রী আমাতুস সামি করিমকে বিয়ে করেন এবং তাদের শিশুকন্যার নাম রাখেন বারি নাজমা।
২০১৭ সালে ‘মুনলাইট’ ছবিতে অভিনয় করে অস্কারের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম অভিনেতা হিসেবে একাডেমিক পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৯ সালে ‘গ্রিনবুক’ ছবির জন্য দ্বিতীয়বার অস্কার পান তিনি। তিনি হাঙ্গার গেমস, হাউস অব কার্ডস ও কর্নেল স্টোকসের মতো জনপ্রিয় বেশ কিছু টিভি সিরিজে অভিনয় করেছেন। টাইম ম্যাগাজিনে তার পক্ষে আরেক অস্কারজয়ী অভিনেত্রী অক্টাভিয়া স্পেন্সর লেখেনÑ মাহেরশাল আলী বহু বছর ধরে দর্শকদের যা দিয়েছেন, আমাদের ইন্ডাস্ট্রি সম্প্রতি তার মূল্যায়ন করেছে। তিনি আমাদের শিল্পকে সর্বোচ্চ শিখরে নিয়ে গেছেন। প্রতিটি চরিত্রে নিখুঁত অভিনয়ের খেলা খেলেন তিনি। একজন দক্ষ ও যোগ্য অভিনেতা হিসেবে আমি সবসময় তাকে শ্রদ্ধা করি।
৪. আবি আহমেদ
তার পুরো নাম আবি আহমেদ আলী। ২০১৮ সালের ২ এপ্রিল তিনি ইথিওপিয়ার চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট জন্ম নেওয়া এ নেতার বাবা ছিলেন একজন অরমো উপজাতীয় মুসলিম আর মা খ্রিষ্টান। আদ্দিস আবাবার মাইক্রো লিংক ইনফরমেশন টেকনোলজি কলেজ থেকে স্নাতক সম্মান লাভ করে তিন লন্ডনের গ্রিন উইচ ইউনিভার্সিটির অধীনে ইন্টারন্যাশনাল লিডারশিপ ইনস্টিটিউট থেকে মাস্টার্স করেন। সামরিক বাহিনীতে থাকাকালে তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদবি পেয়েছিলেন। এরপর রাজনীতিতে আসেন।
ইথিওপিয়ার অলিম্পিক ক্রীড়াবিদ ফেইসা লিলেসা তার সম্পর্কে টাইম ম্যাগাজিনে লেখেনÑ ২০১৬ সালে ইথিওপিয়া যে বাজে অবস্থায় উপনীত হয়েছিল এবং সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিবাদে দেশটি যখন গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে, আমি অলিম্পিকের ম্যারাথনে কাক্সিক্ষত রেখা পার হচ্ছিলাম, আর আমার দেশ ও মাকেও চিরতরে হারাতে বসেছিলাম। তখনই ত্রাতার ভূমিকায় ড. আবি আহমেদ আবির্ভূত হন। আফ্রিকা মহাদেশের সর্বকনিষ্ঠ এ সরকারপ্রধান স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন, গত ২০ বছর ধরে চলা পূর্ব আফ্রিকার দেশটিতে গৃহযুদ্ধ বন্ধ হয়ে শান্তি ফিরে এসেছে। আমি বলব, ইথিওপিয়ার ইতিহাসে তার মতো নেতা আর দেখিনি। তিনি হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দিয়েছেন। জনগণ এখনও প্রতিবাদ করে সত্য; কিন্তু প্রতিবাদ করলেই তারা জেলে যায় না। এটাই আশার আলো, এটাই গণতন্ত্র।
৫. ইমরান খান
ইমরান খান ১৯৫২ সালের ২৫ নভেম্বর পাঞ্জাবের শাহিওয়ালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ইকরামুল্লাহ খান নিয়াজির একমাত্র ছেলে। ১৯৭৫ সালে তিনি অক্সফোর্ডের কিবল কলেজে রাজনীতি, দর্শন ও অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৯৬ সালে রাজনীতিতে আসেন এবং পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমবার নির্বাচনে হারলেও ২০০২ সালে জয়ী হন এবং ২০১৮ সালের আগস্টে পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
১৯৯২ সালে তার নেতৃত্বে ক্রিকেট বিশ্বকাপ জেতে পাকিস্তান। নিজ উদ্যোগে লাহোরে তিনি তার মায়ের নামে একটি বিশ্বমানের ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণ করেছেন। পাকিস্তানের খ্যাতিমান সাংবাদিক ও ‘তালিবান’ গ্রন্থের লেখক আহমেদ রশিদ টাইম ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে তার সম্পর্কে লেখেনÑ কঠিন সময় পাড়ি দিচ্ছে পাকিস্তান, যখন দেশটি ঋণের ভারে জর্জরিত এবং চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলোর ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। এমন সময় দেশটির হাল ধরেন ইমরান খান। তিনি যেমন বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন পাকিস্তানকে, তেমনি ২০ বছর আগে পাকিস্তানি কলুষিত রাজনীতিতে প্রবেশ করে একেবারে শূন্য অবস্থান থেকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছেন। সমালোচকরা বলেন, পাকিস্তানি আর্মি ও ইসলামি চরমপন্থি দলগুলোর সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তবে তার নেতৃত্বে বলীয়ান হয়ে উঠছে পাকিস্তান। কেননা তিনি চালকের আসনে বসে ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করতে পারেন। দক্ষিণ এশিয়ার দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ ঘুচে তার নেতৃত্বে স্থায়ী শান্তি আসবে আশা করা যায়।
৬. যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান
১৯৬১ সালে জন্ম নেওয়া আরব আমিরাতের ক্রাউন প্রিন্স ‘এমবিজেড’ নামে পরিচিত। তিনি দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্ট ও আবুধাবির শাসক জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ানের তৃতীয় ছেলে, বর্তমান আমির খলিফা বিন জায়েদের ছোট ভাই এবং আবুধাবির সিংহাসনের উত্তরসূরি। একই সঙ্গে তিনি রাষ্ট্রীয় ইউনিয়ন ডিফেন্স ফোর্সের প্রধান এবং আমির খলিফা বিন জায়েদের অবর্তমানে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন।
মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক গবেষক রায়ান বোহল টাইমের পক্ষে তার সম্পর্কে লেখেনÑ উত্তরাধিকার সূত্রে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট খলিফা বিন জায়েদ হলেও দেশটির ক্ষমতার মূল কেন্দ্র আসলে ক্রাউন প্রিন্স মোহম্মদ বিন জায়েদ। সম্প্রতি শত্রুভাবাপন্ন দেশ ইরান এবং কাতারের সঙ্গে যে উপসাগরীয় বিবাদের শুরু হয়, এতে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন তিনি। ঝুঁঁকি গ্রহণে তিনি এমনই সিদ্ধহস্ত যে, সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান তাকে অনেকাংশেই অনুকরণ করেন।
৭. মাহাথির মোহাম্মদ
ডা. মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি। ১৯৮১ সালে প্রথমবার দায়িত্ব গ্রহণের পর তার দল পরপর পাঁচবার সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে এবং এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। ২০০৩ সালের ৩০ অক্টোবর তিনি স্বেচ্ছায় পদ ছেড়ে দেন। ১৫ বছর পর আবারও আসেন রাজনীতিতে। মাহাথিরের ভাষায়Ñ জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সংশোধনের জন্য তিনি আবার সক্রিয় হয়েছেন। ২০১৮ সালের ৯ মে সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ৯২ বছর বয়সে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।
১৯২৫ সালে তিনি মালয়েশিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর অ্যালোর সেটরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন স্কুলশিক্ষক এবং মা ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত নারী; যিনি মাহাথিরকে বাড়িতে কোরআন শিক্ষা দিতেন। ১৯৪৭ সালে তিনি সিঙ্গাপুরের কিং অ্যাডওয়ার্ড মেডিসিন কলেজে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন।
টাইম ম্যাগাজিনে তার সম্পর্কে ব্রিটিশ অনুসন্ধানী সাংবাদিক ক্লারে রিক্যাসল ব্রাউন বলেনÑ ক্ষমতার লড়াইয়ে নামার জন্য তার যথেষ্ট তারুণ্য ছিল না। তদুপরি নিজের নৈতিক মনোবলের ওপর দাঁড়িয়ে ৯২ বছর বয়সে উত্তরসূরি নাজিব রাজাককে হারিয়ে প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। বোঝা যায়, বয়োজ্যেষ্ঠ এ নেতার ওপর এখনও আস্থা রাখেন মালয়েশিয়ার জনগণ। এখন তিনি ৯৩ বছরের বৃদ্ধ এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে, এরপর ৭১ বছর বয়সি আনোয়ার ইব্রাহিমের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
৮. রাজিয়া আল-মুতাওয়াকিল
টাইম ম্যাগাজিনের নির্বাচিত প্রভাবশালীদের মধ্যে সম্ভবত রাজিয়া আল-মুতওয়াকিল মিডিয়ায় সবচেয়ে কম পরিচিত। তিনি মূলত একজন ইয়েমেনি মানবাধিকার কর্মী, যিনি ‘মাওয়াতানা অর্গানাইজেশন’-এর মতো একটি মানবাধিকার সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন। ২০০৪ সাল থেকে ইয়েমেনের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো সংগঠনের সঙ্গে কাজ করছেন তিনি। এর আগে সানাআ ইউনিভার্সিটি থেকে ম্যাস-কমিউনিকেশনের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো কোনো ইয়েমেনি নারী হিসেবে তিনি ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট ও জাতিসংঘের সিকিউরিটি কাউন্সিলে ইয়েমেনের পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্রিফ করার জন্য আমন্ত্রণ পান।
আমেরিকার ভার্মন্ট অঙ্গরাজ্যের সিনেটর ও প্রবীণ মার্কিন রাজনীতিক বার্নি স্যান্ডার্স তাকে নিয়ে টাইম ম্যাগাজিনে লিখেছেনÑ রাজিয়া এমন নারী, যিনি প্রথম যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে সৌদি আরব ও হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলছেন। ইয়েমেন পরিস্থিতি নিয়ে বড় পরিসরে গণমাধ্যমে লিখতে শুরু করেছেন। দুর্ভিক্ষপীড়িত ইয়েমেনের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে কাজ করতে গিয়ে রাজিয়া এবং তার দলকে প্রতিনিয়ত বিপদের ঝুঁঁকিতে থাকতে হয়। তার এ দুঃসাহসিক পদক্ষেপ আমাদের সবার জন্য অনুকরণীয়।
৯. লুজাইন আল-হাজলুল
১৯৮৯ সালের জুলাইতে জন্ম নেওয়া এ তরুণী সৌদি নারী অধিকারকর্মী ও সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে পরিচিত। তবে তিনি প্রথম খ্যাতি পান সৌদির রাস্তায় প্রকাশ্যে গাড়ি চালানোর কারণে। যার ফলে তাকে বেশ কয়েকবার কারাবরণ করতে হয়। ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়া লুজাইন সর্বশেষ ২০১৮ সালে বেশ কয়েকজন নারীবাদীর সঙ্গে গ্রেপ্তার হন। মুক্তি পান সৌদি আরবে নারীদের গাড়ি চালানো সংক্রান্ত আইনি বিধিনিষেধের বিলুপ্তি ঘটার মাধ্যমে। এর আগে ২০১৫ সালে তিনি প্রভাবশালী ১০০ আরব নারীর মধ্যে তৃতীয় বলে বিবেচিত হয়েছিলেন। ২০১৬ সালে তিনি ১৪ হাজার নারীর স্বাক্ষরসহ নারীদের চলাফেরার স্বাধীনতার বিষয়ে বাদশা সালমান বরাবর রিট পিটিশন দাখিল করেন।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাবিষয়ক নির্বাহী পরিচালক সারাহ লি উইটসন টাইম ম্যাগাজিনে তার সম্পর্কে লেখেন- লুজাইন যা করেছেন, তার জন্য সে একই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে এবং সৌদি আরব কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিগৃহীত হয়েছে একজন নারী। আসলে সে হলো সৌদি নারিত্বের আদর্শ।
১০. মোহাম্মদ সালাহ
১৯৯২ সালের ১৫ জুন মিসরের নাজরিজে জন্ম নেওয়া সালাহ মাত্র ২০ বছর বয়সে পেশাদার ফুটবলার হিসেবে সুইজারল্যান্ডে পাড়ি জমান। ২০১৭ সালে জনপ্রিয় ক্লাব লিভারপুলে যোগ দেওয়ার আগে তিনি ব্রিটিশ ক্লাব চেলসি, ইতালিয়ান ক্লাব ফিওরেন্তিনা ও রোমার হয়ে খেলেছেন। ২০১৩ সালে ম্যাগিকে বিয়ে করেন তিনি। পরের বছর জন্ম নেয় তার কন্যাসন্তানÑ মক্কা।
সালাহকে বলা হয় মিসরের মেসি। ফুটবলের পাশাপাশি তিনি মিসর ও মধ্যপ্রাচ্যে অবহেলিত নারীদের জন্য কাজ করেন। এ বছর টাইম ম্যাগাজিনের ছয়জন কভার তারকার একজন সালাহ এবং একই সঙ্গে ওয়েবসাইটে তাকে নিয়ে একটি দেড় মিনিটের ভিডিও ডকুমেন্টারি আপ করা হয়েছে। যেখানে তিনি বলেছেনÑ আমাদের সংস্কৃতিতে যেভাবে মেয়েদের দেখা হয়, সেটা পাল্টানো দরকার। এটা হতেই হবে, এর বিকল্প নেই। আমি আগের চেয়েও বেশি সমর্থন দিই মেয়েদের। কারণ আমি উপলব্ধি করি তারা আরও বেশি কিছু পাওয়ার দাবি রাখে।
এইচবিও’র কার্যনির্বাহী প্রজোযক জন অলিভার টাইম ম্যাগাজিনে তাকে নিয়ে লিখেছেনÑ একজন ফুটবল খেলোয়াড়ের চেয়েও বড় ব্যাপার হচ্ছে সালাহ একজন ভালো মানুষ। যদিও বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলারও তিনি। সারা বিশ্বের মিসরীয়, লিভারপুল ও মুসলিমদের কাছে তিনি একজন আইকন। যদিও বিশ্বকাপে আশানুরূপ ফল দেখাতে ব্যর্থ হয় তার দেশ। কিন্তু তিনি প্রতিটি গোলের পরই সিজদার মাধ্যমে তা উদযাপন করেছেন। বিনয়ী, চিন্তাবিদ ও মজার মানুষ হিসেবে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত।
২১ জনের পাইওনিয়ার তালিকায় রয়েছেন মার্কিন কমেডিয়ান হাসান মিনহাজ ও সামিন নুসরাত। শিল্পীদের ১৭ জনের তালিকায় রয়েছেন সম্প্রতি অস্কারজয়ী অভিনেতা মাহেরশাল আলী। বিশ্বের প্রভাবশালী নেতাদের তালিকায় থাকা ২৬ জনের মধ্যে স্থান পেয়েছেন ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ, মালয়েশিয়ার মাহাথির, পাকিস্তানের ইমরান খান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ। প্রভাবশালী আইকনদের ১৪ জনের তালিকায় রয়েছেন দুজন মুসলিম নারী মানবাধিকার কর্মীÑ রাজিয়া আল-মুতাওয়াকিল ও লুজাইন আল-হাজলুল। আর সর্বশেষ টাইটান বা ‘দানব’দের নিয়ে তৈরি ১৬ জনের তালিকায় সবচেয়ে উজ্জ্বল অবস্থানে আছেন মিসরীয় ফুটবল তারকা মোহাম্মদ সালাহ, যিনি মার্ক জাকারবার্গ ও মুকেশ আম্বানিকেও পেছনে ফেলেছেন। আসুন টাইমের চোখে বিশ্বখ্যাত মুসলিম তারকাদের সম্পর্কে চেনাজানা হোক।
১. হাসান মিনহাজ
১৯৮৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর জন্ম নেওয়া হাসান মিনহাজ একজন লেখক, রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও টেলিভিশন প্রযোজক। টাইম ম্যাগাজিনের পক্ষে তাকে নিয়ে লিখেছেন ডেইলি শোতে তার সহকর্মী ট্রেভার নোয়া। তিনি লেখেনÑ ২০১৪ সালে যখন হাসান মিনহাজের সঙ্গে প্রথমবারের মতো আমার দেখা, তখন আমরা এখানে কাজ করতে এসেছিলাম। এরপর পাঁচ বছর কেটে গেছে, আর হাসানের মুখ এখন বিশ্বব্যাপী টেলিভিশন পর্দায় দেখা যাচ্ছে। ২০১৭ সালে হোয়াইট হাউসের প্রতিনিধিদের ডিনারে কৌতুক পরিবেশনের পর তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে এবং লেটনাইট শোতে তার উপস্থিতি আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন মুসলমান ও অভিবাসীদের প্রতি খ—গহস্ত হয়ে পড়েন, তখন হাসান মিনহাজের কণ্ঠ প্রতিবাদে ছিল মুখর। হাসান একজন প্রথম প্রজন্মের ইন্ডিয়ান আমেরিকান মুসলিম। দীর্ঘ পরিশ্রম ও সাধনার মধ্য দিয়ে হাসান তার ধারালো ও স্মার্ট ভাষ্য, ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিত্ব ও আন্তরিকতা দিয়ে আমেরিকা জয় করেছেন। এখন হাসানই আমেরিকা এবং আমেরিকাই হাসান।
কৌতুকই হাসানের শক্তি। তার কৌতুকের ধারালো আঘাতে বেশ কয়েকবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মিনহাজের মজলিস এড়িয়ে যান। মিনহাজের পৈতৃক বসতি ভারতের উত্তর প্রদেশের আলীগড়ে। তারা বাবা নাজমি রসায়নবিদ এবং মা সিমা ডাক্তার। তারা ক্যালিফোর্নিয়ার দাভোসে অভিবাসী হন। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক করেন মিনহাজ। তিনি ইংরেজি ভাষা ছাড়াও অবিরত হিন্দি ও উর্দুতে কথা বলতে পারেন।
২. সামিন নুসরাত
সামিন নুসরাত হলেন শেফ ও রান্নাবিষয়ক জনপ্রিয় লেখক। নিউইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনে তিনি নিয়মিত লেখেন। জন্ম ১৯৭৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার সানদিয়েগো শহরে। কিন্তু তার বাবা-মা ইরানি, ১৯৭৬ সালে তারা অভিবাসী হয়ে আমেরিকায় আসেন। ১৯৯৭ সালে বার্কেলের ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি বিষয়ে পড়াশোনার জন্য ভর্তি হন। তখনই শেজ পেনিশ রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে বিখ্যাত শেফ অ্যালিস ওয়াটার্সের সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং দীর্ঘদিন তার সঙ্গে কাজ করার পর অ্যালিস মন্তব্য করেনÑ সামিন নুসরাত হবে আমেরিকার পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে খ্যাতিমান রন্ধন শিক্ষক। টাইমের পক্ষে অ্যালিস তাকে নিয়ে লেখেনÑ সততা, হৃদ্যতা, নিরলস প্রচেষ্টা আর একাগ্রতার বদৌলতে সামিন এখন পৃথিবী বিখ্যাত একজন শেফ। সামিন দেখিয়েছে যে, কে কোথা থেকে এসেছে, সেটা কোনো বিষয় নয়। বরং সে আপনার উপাদানগুলো বুঝতে পারছে। বিশ্বের যেখানেই আপনি থাকেন বা বেড়ে ওঠেন, সেখানকার পরিবেশে কীভাবে স্বাস্থ্যসম্মত ও সুস্বাদু খাবার তৈরি করে নিতে পারেন, তা আমাদের বলে সামিন।
‘সল্ট, ফ্যাট, এসিড, হিট’ (২০১৭) শিরোনামে লেখা তার বইকে লন্ডনের দ্য টাইমস বর্ষসেরা রান্নাবিষয়ক বই হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং নিউইয়র্ক টাইমসের জরিপে সবচেয়ে বেশি বিক্রীত বইয়ের তালিকায় স্থান পায়। বইটি অবলম্বনে ‘সল্ট, ফ্যাট, এসিড, হিট’ নামে একটি ডকু সিরিজ নেটফ্লিক্সে প্রচারিত হচ্ছে।
৩. মাহেরশাল আলী
আলীর জন্ম ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডে ১৯৭৪ সালে। তিনি সেন্ট মারিস কলেজ অব ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ১৯৯৬ সালে গণযোগাযোগ বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অভিনয় প্রোগ্রামে মাস্টার্স করেন। ধর্মভীরু খ্রিষ্টান পরিবারে বেড়ে ওঠা আলী ১৯৯৯ সালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং তার আগের নাম মাহেরশাল আলহাশবাজ গিলমোর থেকে পরিবর্তন করে মাহেরশাল আলহাশবাজ আলী রাখেন। তিনি মুসলিম অভিনেত্রী আমাতুস সামি করিমকে বিয়ে করেন এবং তাদের শিশুকন্যার নাম রাখেন বারি নাজমা।
২০১৭ সালে ‘মুনলাইট’ ছবিতে অভিনয় করে অস্কারের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম অভিনেতা হিসেবে একাডেমিক পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৯ সালে ‘গ্রিনবুক’ ছবির জন্য দ্বিতীয়বার অস্কার পান তিনি। তিনি হাঙ্গার গেমস, হাউস অব কার্ডস ও কর্নেল স্টোকসের মতো জনপ্রিয় বেশ কিছু টিভি সিরিজে অভিনয় করেছেন। টাইম ম্যাগাজিনে তার পক্ষে আরেক অস্কারজয়ী অভিনেত্রী অক্টাভিয়া স্পেন্সর লেখেনÑ মাহেরশাল আলী বহু বছর ধরে দর্শকদের যা দিয়েছেন, আমাদের ইন্ডাস্ট্রি সম্প্রতি তার মূল্যায়ন করেছে। তিনি আমাদের শিল্পকে সর্বোচ্চ শিখরে নিয়ে গেছেন। প্রতিটি চরিত্রে নিখুঁত অভিনয়ের খেলা খেলেন তিনি। একজন দক্ষ ও যোগ্য অভিনেতা হিসেবে আমি সবসময় তাকে শ্রদ্ধা করি।
৪. আবি আহমেদ
তার পুরো নাম আবি আহমেদ আলী। ২০১৮ সালের ২ এপ্রিল তিনি ইথিওপিয়ার চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট জন্ম নেওয়া এ নেতার বাবা ছিলেন একজন অরমো উপজাতীয় মুসলিম আর মা খ্রিষ্টান। আদ্দিস আবাবার মাইক্রো লিংক ইনফরমেশন টেকনোলজি কলেজ থেকে স্নাতক সম্মান লাভ করে তিন লন্ডনের গ্রিন উইচ ইউনিভার্সিটির অধীনে ইন্টারন্যাশনাল লিডারশিপ ইনস্টিটিউট থেকে মাস্টার্স করেন। সামরিক বাহিনীতে থাকাকালে তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদবি পেয়েছিলেন। এরপর রাজনীতিতে আসেন।
ইথিওপিয়ার অলিম্পিক ক্রীড়াবিদ ফেইসা লিলেসা তার সম্পর্কে টাইম ম্যাগাজিনে লেখেনÑ ২০১৬ সালে ইথিওপিয়া যে বাজে অবস্থায় উপনীত হয়েছিল এবং সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিবাদে দেশটি যখন গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে, আমি অলিম্পিকের ম্যারাথনে কাক্সিক্ষত রেখা পার হচ্ছিলাম, আর আমার দেশ ও মাকেও চিরতরে হারাতে বসেছিলাম। তখনই ত্রাতার ভূমিকায় ড. আবি আহমেদ আবির্ভূত হন। আফ্রিকা মহাদেশের সর্বকনিষ্ঠ এ সরকারপ্রধান স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন, গত ২০ বছর ধরে চলা পূর্ব আফ্রিকার দেশটিতে গৃহযুদ্ধ বন্ধ হয়ে শান্তি ফিরে এসেছে। আমি বলব, ইথিওপিয়ার ইতিহাসে তার মতো নেতা আর দেখিনি। তিনি হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দিয়েছেন। জনগণ এখনও প্রতিবাদ করে সত্য; কিন্তু প্রতিবাদ করলেই তারা জেলে যায় না। এটাই আশার আলো, এটাই গণতন্ত্র।
৫. ইমরান খান
ইমরান খান ১৯৫২ সালের ২৫ নভেম্বর পাঞ্জাবের শাহিওয়ালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ইকরামুল্লাহ খান নিয়াজির একমাত্র ছেলে। ১৯৭৫ সালে তিনি অক্সফোর্ডের কিবল কলেজে রাজনীতি, দর্শন ও অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৯৬ সালে রাজনীতিতে আসেন এবং পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমবার নির্বাচনে হারলেও ২০০২ সালে জয়ী হন এবং ২০১৮ সালের আগস্টে পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
১৯৯২ সালে তার নেতৃত্বে ক্রিকেট বিশ্বকাপ জেতে পাকিস্তান। নিজ উদ্যোগে লাহোরে তিনি তার মায়ের নামে একটি বিশ্বমানের ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণ করেছেন। পাকিস্তানের খ্যাতিমান সাংবাদিক ও ‘তালিবান’ গ্রন্থের লেখক আহমেদ রশিদ টাইম ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে তার সম্পর্কে লেখেনÑ কঠিন সময় পাড়ি দিচ্ছে পাকিস্তান, যখন দেশটি ঋণের ভারে জর্জরিত এবং চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলোর ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। এমন সময় দেশটির হাল ধরেন ইমরান খান। তিনি যেমন বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন পাকিস্তানকে, তেমনি ২০ বছর আগে পাকিস্তানি কলুষিত রাজনীতিতে প্রবেশ করে একেবারে শূন্য অবস্থান থেকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছেন। সমালোচকরা বলেন, পাকিস্তানি আর্মি ও ইসলামি চরমপন্থি দলগুলোর সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তবে তার নেতৃত্বে বলীয়ান হয়ে উঠছে পাকিস্তান। কেননা তিনি চালকের আসনে বসে ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করতে পারেন। দক্ষিণ এশিয়ার দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ ঘুচে তার নেতৃত্বে স্থায়ী শান্তি আসবে আশা করা যায়।
৬. যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান
১৯৬১ সালে জন্ম নেওয়া আরব আমিরাতের ক্রাউন প্রিন্স ‘এমবিজেড’ নামে পরিচিত। তিনি দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্ট ও আবুধাবির শাসক জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ানের তৃতীয় ছেলে, বর্তমান আমির খলিফা বিন জায়েদের ছোট ভাই এবং আবুধাবির সিংহাসনের উত্তরসূরি। একই সঙ্গে তিনি রাষ্ট্রীয় ইউনিয়ন ডিফেন্স ফোর্সের প্রধান এবং আমির খলিফা বিন জায়েদের অবর্তমানে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন।
মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক গবেষক রায়ান বোহল টাইমের পক্ষে তার সম্পর্কে লেখেনÑ উত্তরাধিকার সূত্রে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট খলিফা বিন জায়েদ হলেও দেশটির ক্ষমতার মূল কেন্দ্র আসলে ক্রাউন প্রিন্স মোহম্মদ বিন জায়েদ। সম্প্রতি শত্রুভাবাপন্ন দেশ ইরান এবং কাতারের সঙ্গে যে উপসাগরীয় বিবাদের শুরু হয়, এতে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন তিনি। ঝুঁঁকি গ্রহণে তিনি এমনই সিদ্ধহস্ত যে, সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান তাকে অনেকাংশেই অনুকরণ করেন।
৭. মাহাথির মোহাম্মদ
ডা. মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি। ১৯৮১ সালে প্রথমবার দায়িত্ব গ্রহণের পর তার দল পরপর পাঁচবার সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে এবং এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। ২০০৩ সালের ৩০ অক্টোবর তিনি স্বেচ্ছায় পদ ছেড়ে দেন। ১৫ বছর পর আবারও আসেন রাজনীতিতে। মাহাথিরের ভাষায়Ñ জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সংশোধনের জন্য তিনি আবার সক্রিয় হয়েছেন। ২০১৮ সালের ৯ মে সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ৯২ বছর বয়সে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।
১৯২৫ সালে তিনি মালয়েশিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর অ্যালোর সেটরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন স্কুলশিক্ষক এবং মা ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত নারী; যিনি মাহাথিরকে বাড়িতে কোরআন শিক্ষা দিতেন। ১৯৪৭ সালে তিনি সিঙ্গাপুরের কিং অ্যাডওয়ার্ড মেডিসিন কলেজে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন।
টাইম ম্যাগাজিনে তার সম্পর্কে ব্রিটিশ অনুসন্ধানী সাংবাদিক ক্লারে রিক্যাসল ব্রাউন বলেনÑ ক্ষমতার লড়াইয়ে নামার জন্য তার যথেষ্ট তারুণ্য ছিল না। তদুপরি নিজের নৈতিক মনোবলের ওপর দাঁড়িয়ে ৯২ বছর বয়সে উত্তরসূরি নাজিব রাজাককে হারিয়ে প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। বোঝা যায়, বয়োজ্যেষ্ঠ এ নেতার ওপর এখনও আস্থা রাখেন মালয়েশিয়ার জনগণ। এখন তিনি ৯৩ বছরের বৃদ্ধ এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে, এরপর ৭১ বছর বয়সি আনোয়ার ইব্রাহিমের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
৮. রাজিয়া আল-মুতাওয়াকিল
টাইম ম্যাগাজিনের নির্বাচিত প্রভাবশালীদের মধ্যে সম্ভবত রাজিয়া আল-মুতওয়াকিল মিডিয়ায় সবচেয়ে কম পরিচিত। তিনি মূলত একজন ইয়েমেনি মানবাধিকার কর্মী, যিনি ‘মাওয়াতানা অর্গানাইজেশন’-এর মতো একটি মানবাধিকার সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন। ২০০৪ সাল থেকে ইয়েমেনের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো সংগঠনের সঙ্গে কাজ করছেন তিনি। এর আগে সানাআ ইউনিভার্সিটি থেকে ম্যাস-কমিউনিকেশনের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো কোনো ইয়েমেনি নারী হিসেবে তিনি ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট ও জাতিসংঘের সিকিউরিটি কাউন্সিলে ইয়েমেনের পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্রিফ করার জন্য আমন্ত্রণ পান।
আমেরিকার ভার্মন্ট অঙ্গরাজ্যের সিনেটর ও প্রবীণ মার্কিন রাজনীতিক বার্নি স্যান্ডার্স তাকে নিয়ে টাইম ম্যাগাজিনে লিখেছেনÑ রাজিয়া এমন নারী, যিনি প্রথম যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে সৌদি আরব ও হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলছেন। ইয়েমেন পরিস্থিতি নিয়ে বড় পরিসরে গণমাধ্যমে লিখতে শুরু করেছেন। দুর্ভিক্ষপীড়িত ইয়েমেনের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে কাজ করতে গিয়ে রাজিয়া এবং তার দলকে প্রতিনিয়ত বিপদের ঝুঁঁকিতে থাকতে হয়। তার এ দুঃসাহসিক পদক্ষেপ আমাদের সবার জন্য অনুকরণীয়।
৯. লুজাইন আল-হাজলুল
১৯৮৯ সালের জুলাইতে জন্ম নেওয়া এ তরুণী সৌদি নারী অধিকারকর্মী ও সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে পরিচিত। তবে তিনি প্রথম খ্যাতি পান সৌদির রাস্তায় প্রকাশ্যে গাড়ি চালানোর কারণে। যার ফলে তাকে বেশ কয়েকবার কারাবরণ করতে হয়। ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়া লুজাইন সর্বশেষ ২০১৮ সালে বেশ কয়েকজন নারীবাদীর সঙ্গে গ্রেপ্তার হন। মুক্তি পান সৌদি আরবে নারীদের গাড়ি চালানো সংক্রান্ত আইনি বিধিনিষেধের বিলুপ্তি ঘটার মাধ্যমে। এর আগে ২০১৫ সালে তিনি প্রভাবশালী ১০০ আরব নারীর মধ্যে তৃতীয় বলে বিবেচিত হয়েছিলেন। ২০১৬ সালে তিনি ১৪ হাজার নারীর স্বাক্ষরসহ নারীদের চলাফেরার স্বাধীনতার বিষয়ে বাদশা সালমান বরাবর রিট পিটিশন দাখিল করেন।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাবিষয়ক নির্বাহী পরিচালক সারাহ লি উইটসন টাইম ম্যাগাজিনে তার সম্পর্কে লেখেন- লুজাইন যা করেছেন, তার জন্য সে একই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে এবং সৌদি আরব কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিগৃহীত হয়েছে একজন নারী। আসলে সে হলো সৌদি নারিত্বের আদর্শ।
১০. মোহাম্মদ সালাহ
১৯৯২ সালের ১৫ জুন মিসরের নাজরিজে জন্ম নেওয়া সালাহ মাত্র ২০ বছর বয়সে পেশাদার ফুটবলার হিসেবে সুইজারল্যান্ডে পাড়ি জমান। ২০১৭ সালে জনপ্রিয় ক্লাব লিভারপুলে যোগ দেওয়ার আগে তিনি ব্রিটিশ ক্লাব চেলসি, ইতালিয়ান ক্লাব ফিওরেন্তিনা ও রোমার হয়ে খেলেছেন। ২০১৩ সালে ম্যাগিকে বিয়ে করেন তিনি। পরের বছর জন্ম নেয় তার কন্যাসন্তানÑ মক্কা।
সালাহকে বলা হয় মিসরের মেসি। ফুটবলের পাশাপাশি তিনি মিসর ও মধ্যপ্রাচ্যে অবহেলিত নারীদের জন্য কাজ করেন। এ বছর টাইম ম্যাগাজিনের ছয়জন কভার তারকার একজন সালাহ এবং একই সঙ্গে ওয়েবসাইটে তাকে নিয়ে একটি দেড় মিনিটের ভিডিও ডকুমেন্টারি আপ করা হয়েছে। যেখানে তিনি বলেছেনÑ আমাদের সংস্কৃতিতে যেভাবে মেয়েদের দেখা হয়, সেটা পাল্টানো দরকার। এটা হতেই হবে, এর বিকল্প নেই। আমি আগের চেয়েও বেশি সমর্থন দিই মেয়েদের। কারণ আমি উপলব্ধি করি তারা আরও বেশি কিছু পাওয়ার দাবি রাখে।
এইচবিও’র কার্যনির্বাহী প্রজোযক জন অলিভার টাইম ম্যাগাজিনে তাকে নিয়ে লিখেছেনÑ একজন ফুটবল খেলোয়াড়ের চেয়েও বড় ব্যাপার হচ্ছে সালাহ একজন ভালো মানুষ। যদিও বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলারও তিনি। সারা বিশ্বের মিসরীয়, লিভারপুল ও মুসলিমদের কাছে তিনি একজন আইকন। যদিও বিশ্বকাপে আশানুরূপ ফল দেখাতে ব্যর্থ হয় তার দেশ। কিন্তু তিনি প্রতিটি গোলের পরই সিজদার মাধ্যমে তা উদযাপন করেছেন। বিনয়ী, চিন্তাবিদ ও মজার মানুষ হিসেবে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত।
No comments