যুদ্ধবাজ ট্রাম্প by ফজলুল কবির
মার্কিন
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মানুষটাই হয়তো উসকানিমূলক। কী প্রেম, কী
যুদ্ধ, ঘর কিংবা বাহির, সব ক্ষেত্রেই তিনি যা করেন, তা-ই কারও না কারও জন্য
উসকানিমূলক হয়ে উঠছে। এর কোনটি তিনি ভেবে করেন, আর কোনটি করেন না তা অবশ্য
বলা মুশকিল। কারণ ‘খেয়ালি রাজা’ হিসেবে তো তিনি এরই মধ্যে বেশ নাম
কুড়িয়েছেন। হোয়াইট হাউসের ওই ওভাল অফিসে ঢোকার পর থেকে তিনি কত কী না
করলেন, একে ধরলেন, তাকে ছাড়লেন, মন্ত্রিপরিষদের সভাকে রীতিমতো বিদূষক সভায়
রূপান্তর করে ছাড়লেন। রাজা হয়ে হম্বিতম্বি করলেন এবং করেই যাচ্ছেন। আর তাঁর
মন্ত্রী মশাইয়েরা নিজেরা ‘কম কী’ বোঝাতেই যেন আরও সরেস হয়ে মাঠে নামলেন।
এ চলতেই লাগল, কখনো অভিবাসন, কখনো স্বাস্থ্যসেবা, কখনোবা সীমান্ত নিরাপত্তার দোহাইয়ে। গত তিন বছরে আমেরিকা ও সারা বিশ্ব তাঁর এ অসীম ক্ষমতা বেশ মনোযোগের সঙ্গেই প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু এতেও যেন মন ভরল না। ‘দা আলটিমেট অ্যাটেনশন সিকার’ অভিধা পাওয়া এই প্রেসিডেন্ট এবার বিশ্ব রাজনীতিতেও নিজেকে ‘বেস্ট এভার ডিলমেকার’ প্রমাণে মাঠে নামলেন। নিজের মেয়াদের তৃতীয় বছরে এসেই আন্তর্জাতিক রাজনীতির সব দৃষ্টি নিজের দিকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করলেন একটি ‘অতি সফল’ উত্তর কোরিয়া চুক্তির মাধ্যমে। এমনকি এই ‘সফল’ চুক্তির জন্য ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার ট্রাম্পেরই পাওয়া উচিত’ বলে প্রচার চালানো শুরু করল তাঁর ঘনিষ্ঠরা।
কিন্তু বিধি বাম। বাম যে, তা অবশ্য নিজ ঘরেই বেশ ভালোভাবে টের পাচ্ছেন তিনি ও তাঁর দল। সে যা হোক, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধুচন্দ্রিমার ঘোর কাটে কাটে করছে অনেক দিন। কিম ট্রাম্প সম্পর্কে অনেক মধু বাণী দিলেও বিনা শর্তে চুক্তিটি মানতে রাজি নন। তিনি তাঁর দেশের নিরাপত্তা চান। বিশেষত চান পরমাণু কর্মসূচি বন্ধের প্রথম ধাপেই অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার প্রত্যাহার। বিপরীতে ওয়াশিংটন চায় আগে কর্মসূচি বন্ধ হোক। এই যে ব্যবধান এই ব্যবধানই হচ্ছে সেই লোহার বাসরের ফুটো, যা দিয়ে এরই মধ্যে ঢুকে পড়েছে ভ্লাদিমির পুতিনের দেশ রাশিয়া। এটা এই তো কয়েক দিন আগের ঘটনা।
ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনো বিকল্পহীন থাকেন না। ‘গ্রেট ডিলমেকার’ হিসেবে সব সময় ‘হাতের পাঁচ’ রেখে দেন তিনি। আর এই হাতের পাঁচ হিসেবেই কিনা কে জানে, একই সময়ে ট্রাম্প নামলেন চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধে। এবার তাঁর অস্ত্র শুল্কারোপ। অর্থনীতি বাঁচানোর কথা বলে চীনা পণ্য আমদানিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন যে শুল্কারোপ করল, তা বুমেরাং হয়ে নিজের কোম্পানিগুলোকেই আঘাত করল। চীনের পাল্টা আঘাতে বিপর্যস্ত হলেন মার্কিন কৃষকেরাও। কিন্তু জগতের সব ‘ভদ্রলোকের’ মতো ট্রাম্পও এক কথার লোক। তিনি তাঁর কথা থেকে নড়লেন না। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা চলার মধ্যেই তিনি দ্বিতীয় ধাপে ২০ হাজার কোটি ডলার পণ্যে শুল্কের পরিমাণ বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করেন।
এই পদক্ষেপ যখন নেওয়া হচ্ছে, ঠিক একই সময়ে রণতরি পাঠিয়ে উসকানো হচ্ছে ইরানকে। আর দক্ষিণ আমেরিকার ভেনেজুয়েলার গণতন্ত্রায়ণ নিয়ে জলঘোলা করা হচ্ছে। অথচ তিনি বলেছিলেন, অন্য দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দায় আমেরিকা নেবে না আর। এসবই চলছে একসঙ্গে। কথা হচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প কি সত্যিকার অর্থেই এতগুলো ফ্রন্টে একসঙ্গে লড়তে প্রস্তুত? নাকি নির্বাচনের আগের বছর একটু জলঘোলা করে যেনতেনভাবে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পাঁয়তারা করছেন তিনি।
অবশ্য যুদ্ধে উসকানি দেওয়া কিংবা নানাভাবে যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি করায় আমেরিকার সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ১৯৮৬ সালে আজকের ইরানের মতোই লিবিয়াকে যুদ্ধে নামার উসকানি দিয়েছিল তৎকালীন রোনাল্ড রিগ্যান প্রশাসন। লিবিয়ার তৎকালীন নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে যুদ্ধে টেনে আনতে দেশটির সমুদ্রসীমায় রণতরির সমাবেশ ঘটিয়েছিল আমেরিকা। সেটি যে সুপরিকল্পিত উসকানি ছিল, তা একই বছর লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসের কাছে স্বীকারও করেছিলেন মার্কিন নৌবাহিনীর এক শীর্ষ কর্মকর্তা। বলার অপেক্ষা রাখে না, গাদ্দাফি ওই উসকানির ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। লিবিয়ার সমুদ্রসীমায় টহল দেওয়া মার্কিন যুদ্ধবিমান লক্ষ্য করে অন্তত ছয়টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিলেন তিনি, যা তাঁর গায়ে একজন আগ্রাসী ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাহীন নেতার তকমা লাগিয়ে দেয়। ফলাফল, লিবিয়ার নৌবাহিনীর টহল জাহাজে মার্কিন হামলা, প্রাণহানি।
যুদ্ধ বাধানোর মার্কিন সক্ষমতা সবচেয়ে বড় উদাহরণ হয়ে আছে ইরাক যুদ্ধ। ২০০৩ সালে ভুয়া গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে দেশটিতে হামলা চালায় তৎকালীন জর্জ বুশ প্রশাসন, যার ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে ইরাক। গত ১৬ বছরেও ইরাক স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারেনি। এই আগ্রাসনে ইরাক তো ছিন্নভিন্ন হয়েছেই, আমেরিকাও হারিয়েছে অন্তত ৪ হাজার সেনা। ভিয়েতনাম যুদ্ধও সংঘটিত হয়েছিল মার্কিন পক্ষের উসকানির জের ধরেই, যা ৫৭ হাজার মার্কিন সেনা ও ১০ লাখের বেশি ভিয়েতনামি সেনার মৃত্যু দেখিয়েছিল। এখন ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের সঙ্গে যে আচরণ করছে, তা সুস্পষ্ট উসকানি হিসেবে চিহ্নিত করছেন বিশ্লেষকেরা। প্রশ্ন হচ্ছে এই উসকানির মাধ্যমে ট্রাম্প প্রশাসন কি আরেকটি যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমেরিকাকে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে যতই ‘গ্রেট ডিলমেকার’ দাবি করুন না কেন শুরু থেকেই বিশ্ব তাঁকে একজন ‘যুদ্ধবাজ’ নেতা হিসেবেই দেখেছে। হোয়াইট হাউসের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তিনি উত্তর কোরিয়া, ইরান, কিউবাসহ বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে নানা উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে আসছেন। ২০১৭ সালে ওভাল অফিসে প্রবেশের পরপরই তাঁর তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ফ্লিন ইরানকে হুমকি দিয়ে রেখেছিলেন। সরাসরি বলেছিলেন, ‘আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে ইরানকে সতর্ক করছি।’ ইরানের সঙ্গে হওয়া ছয় জাতি চুক্তি থেকে আমেরিকাকে প্রত্যাহার করে গত বছর এ সতর্কবার্তাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া হয়। আর কিছুদিন আগে পারস্য উপসাগরে রণতরি পাঠিয়ে চূড়ান্ত উসকানিটি দেওয়া হলো। মজার বিষয় হচ্ছে, এই রণতরি পাঠানোর খবরটি কিন্তু পেন্টাগন থেকে আসেনি; এসেছে বর্তমান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টনের দপ্তর থেকে। এর কারণ হিসেবে ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্রটি থেকে হামলার হুমকি রয়েছে’ বলে উল্লেখ করা হলেও সুনির্দিষ্টভাবে কিছুই বলা হয়নি। এই বক্তব্য ও মার্কিন প্রশাসনের অবস্থান নিঃসন্দেহে ইরাক যুদ্ধের পূর্ববর্তী অবস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
ওয়াশিংটন কি তবে মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধ চায়? চাইলে তার কারণ কি? সাবেক বারাক ওবামা প্রশাসনের সবকিছুই পরিত্যাজ্য এমন ধারণা থেকে আর যা-ই হোক একটি যুদ্ধ অন্তত করা যায় না। তাহলে এমন উসকানির পেছনে ঠিক কী কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে উঠে আসছে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার দুই মিত্র সৌদি আরব ও ইসরায়েলের নাম। এ দুই মিত্রেরই প্রতিপক্ষ ইরান। ইসরায়েল ইরানকে শত্রু মনে করে হিজবুল্লাহ প্রশ্নে। আর সৌদি আরবের প্রশ্নটি আধিপত্যকেন্দ্রিক। এ দুটি দেশই মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে আমেরিকাকে ব্যবহার করে আসছে। বিশ্ব মোড়ল আমেরিকার ভূমিকা এ অঞ্চলে অনেকটা ভাড়াটে যোদ্ধার মতো।
কথা হচ্ছে, এই সময়ে এসে আরেকটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সামর্থ্য আমেরিকার রয়েছে কিনা। না, সামরিক সামর্থ্যের কথা বলা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, অর্থনৈতিক সামর্থ্যের কথা। বিশেষত যখন ট্রাম্প প্রশাসন চীনের মতো একটি বৃহৎ শক্তির সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধে নামে, তখন ইরানের সঙ্গে একটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কতটা সামর্থ্য তার রয়েছে, সে প্রশ্নটি তোলাই যায়। কারণ, ওয়াশিংটন যতই বলুক বাণিজ্য ঘাটতির সমন্বয়ের জন্য চাপ দিতে চীনকে শায়েস্তা করার পন্থা হিসেবে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করা হয়েছে। কিন্তু সত্য হচ্ছে এই পদক্ষেপে আমেরিকাও কম শায়েস্তা হচ্ছে না। নিজেদের নেওয়া পদক্ষেপ ও চীনের নেওয়া পাল্টা পদক্ষেপে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মার্কিন অর্থনীতিই।
আর অভিবাসন, স্বাস্থ্য, সুরক্ষাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে ঘরের ভেতরেই দুর্বল হয়ে পড়ছে প্রশাসন। সঙ্গে রয়েছে রবার্ট ম্যুলারের প্রতিবেদন, যা সরাসরি প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ না তুললেও এমন বহু তথ্যের সন্নিবেশ ঘটিয়েছে, যা দিয়ে অনায়াসে তাঁকে অভিযুক্ত করা যায়। বিষয়টি নিয়ে বিরোধী ডেমোক্র্যাট দলে বেশ আলোচনা চলছে। সিনেটে ডেমোক্র্যাট নেতা ন্যান্সি পেলোসি এখন পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রস্তাব উত্থাপন না করার পক্ষে মত দিয়েছেন। এই অবস্থায় বাইরে বলপ্রয়োগকে নিজেদের শক্তি সংহত করার উপায় হিসেবে নিলে, তা বুমেরাং হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। আমেরিকার খেয়ালি রাজা ডোনাল্ড ট্রাম্প এই শঙ্কার সমীকরণটি বুঝবেন, তেমনটা আশা করা যাচ্ছে না। তবে তাঁর অমাত্যরা, নিদেনপক্ষে কংগ্রেস বুঝবে—এ আশা করাই যায়।
>>>ফজলুল কবির: সাংবাদিক
এ চলতেই লাগল, কখনো অভিবাসন, কখনো স্বাস্থ্যসেবা, কখনোবা সীমান্ত নিরাপত্তার দোহাইয়ে। গত তিন বছরে আমেরিকা ও সারা বিশ্ব তাঁর এ অসীম ক্ষমতা বেশ মনোযোগের সঙ্গেই প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু এতেও যেন মন ভরল না। ‘দা আলটিমেট অ্যাটেনশন সিকার’ অভিধা পাওয়া এই প্রেসিডেন্ট এবার বিশ্ব রাজনীতিতেও নিজেকে ‘বেস্ট এভার ডিলমেকার’ প্রমাণে মাঠে নামলেন। নিজের মেয়াদের তৃতীয় বছরে এসেই আন্তর্জাতিক রাজনীতির সব দৃষ্টি নিজের দিকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করলেন একটি ‘অতি সফল’ উত্তর কোরিয়া চুক্তির মাধ্যমে। এমনকি এই ‘সফল’ চুক্তির জন্য ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার ট্রাম্পেরই পাওয়া উচিত’ বলে প্রচার চালানো শুরু করল তাঁর ঘনিষ্ঠরা।
কিন্তু বিধি বাম। বাম যে, তা অবশ্য নিজ ঘরেই বেশ ভালোভাবে টের পাচ্ছেন তিনি ও তাঁর দল। সে যা হোক, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধুচন্দ্রিমার ঘোর কাটে কাটে করছে অনেক দিন। কিম ট্রাম্প সম্পর্কে অনেক মধু বাণী দিলেও বিনা শর্তে চুক্তিটি মানতে রাজি নন। তিনি তাঁর দেশের নিরাপত্তা চান। বিশেষত চান পরমাণু কর্মসূচি বন্ধের প্রথম ধাপেই অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার প্রত্যাহার। বিপরীতে ওয়াশিংটন চায় আগে কর্মসূচি বন্ধ হোক। এই যে ব্যবধান এই ব্যবধানই হচ্ছে সেই লোহার বাসরের ফুটো, যা দিয়ে এরই মধ্যে ঢুকে পড়েছে ভ্লাদিমির পুতিনের দেশ রাশিয়া। এটা এই তো কয়েক দিন আগের ঘটনা।
ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনো বিকল্পহীন থাকেন না। ‘গ্রেট ডিলমেকার’ হিসেবে সব সময় ‘হাতের পাঁচ’ রেখে দেন তিনি। আর এই হাতের পাঁচ হিসেবেই কিনা কে জানে, একই সময়ে ট্রাম্প নামলেন চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধে। এবার তাঁর অস্ত্র শুল্কারোপ। অর্থনীতি বাঁচানোর কথা বলে চীনা পণ্য আমদানিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন যে শুল্কারোপ করল, তা বুমেরাং হয়ে নিজের কোম্পানিগুলোকেই আঘাত করল। চীনের পাল্টা আঘাতে বিপর্যস্ত হলেন মার্কিন কৃষকেরাও। কিন্তু জগতের সব ‘ভদ্রলোকের’ মতো ট্রাম্পও এক কথার লোক। তিনি তাঁর কথা থেকে নড়লেন না। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা চলার মধ্যেই তিনি দ্বিতীয় ধাপে ২০ হাজার কোটি ডলার পণ্যে শুল্কের পরিমাণ বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করেন।
এই পদক্ষেপ যখন নেওয়া হচ্ছে, ঠিক একই সময়ে রণতরি পাঠিয়ে উসকানো হচ্ছে ইরানকে। আর দক্ষিণ আমেরিকার ভেনেজুয়েলার গণতন্ত্রায়ণ নিয়ে জলঘোলা করা হচ্ছে। অথচ তিনি বলেছিলেন, অন্য দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দায় আমেরিকা নেবে না আর। এসবই চলছে একসঙ্গে। কথা হচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প কি সত্যিকার অর্থেই এতগুলো ফ্রন্টে একসঙ্গে লড়তে প্রস্তুত? নাকি নির্বাচনের আগের বছর একটু জলঘোলা করে যেনতেনভাবে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পাঁয়তারা করছেন তিনি।
অবশ্য যুদ্ধে উসকানি দেওয়া কিংবা নানাভাবে যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি করায় আমেরিকার সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ১৯৮৬ সালে আজকের ইরানের মতোই লিবিয়াকে যুদ্ধে নামার উসকানি দিয়েছিল তৎকালীন রোনাল্ড রিগ্যান প্রশাসন। লিবিয়ার তৎকালীন নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে যুদ্ধে টেনে আনতে দেশটির সমুদ্রসীমায় রণতরির সমাবেশ ঘটিয়েছিল আমেরিকা। সেটি যে সুপরিকল্পিত উসকানি ছিল, তা একই বছর লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসের কাছে স্বীকারও করেছিলেন মার্কিন নৌবাহিনীর এক শীর্ষ কর্মকর্তা। বলার অপেক্ষা রাখে না, গাদ্দাফি ওই উসকানির ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। লিবিয়ার সমুদ্রসীমায় টহল দেওয়া মার্কিন যুদ্ধবিমান লক্ষ্য করে অন্তত ছয়টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিলেন তিনি, যা তাঁর গায়ে একজন আগ্রাসী ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাহীন নেতার তকমা লাগিয়ে দেয়। ফলাফল, লিবিয়ার নৌবাহিনীর টহল জাহাজে মার্কিন হামলা, প্রাণহানি।
যুদ্ধ বাধানোর মার্কিন সক্ষমতা সবচেয়ে বড় উদাহরণ হয়ে আছে ইরাক যুদ্ধ। ২০০৩ সালে ভুয়া গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে দেশটিতে হামলা চালায় তৎকালীন জর্জ বুশ প্রশাসন, যার ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে ইরাক। গত ১৬ বছরেও ইরাক স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারেনি। এই আগ্রাসনে ইরাক তো ছিন্নভিন্ন হয়েছেই, আমেরিকাও হারিয়েছে অন্তত ৪ হাজার সেনা। ভিয়েতনাম যুদ্ধও সংঘটিত হয়েছিল মার্কিন পক্ষের উসকানির জের ধরেই, যা ৫৭ হাজার মার্কিন সেনা ও ১০ লাখের বেশি ভিয়েতনামি সেনার মৃত্যু দেখিয়েছিল। এখন ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের সঙ্গে যে আচরণ করছে, তা সুস্পষ্ট উসকানি হিসেবে চিহ্নিত করছেন বিশ্লেষকেরা। প্রশ্ন হচ্ছে এই উসকানির মাধ্যমে ট্রাম্প প্রশাসন কি আরেকটি যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমেরিকাকে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে যতই ‘গ্রেট ডিলমেকার’ দাবি করুন না কেন শুরু থেকেই বিশ্ব তাঁকে একজন ‘যুদ্ধবাজ’ নেতা হিসেবেই দেখেছে। হোয়াইট হাউসের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তিনি উত্তর কোরিয়া, ইরান, কিউবাসহ বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে নানা উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে আসছেন। ২০১৭ সালে ওভাল অফিসে প্রবেশের পরপরই তাঁর তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ফ্লিন ইরানকে হুমকি দিয়ে রেখেছিলেন। সরাসরি বলেছিলেন, ‘আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে ইরানকে সতর্ক করছি।’ ইরানের সঙ্গে হওয়া ছয় জাতি চুক্তি থেকে আমেরিকাকে প্রত্যাহার করে গত বছর এ সতর্কবার্তাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া হয়। আর কিছুদিন আগে পারস্য উপসাগরে রণতরি পাঠিয়ে চূড়ান্ত উসকানিটি দেওয়া হলো। মজার বিষয় হচ্ছে, এই রণতরি পাঠানোর খবরটি কিন্তু পেন্টাগন থেকে আসেনি; এসেছে বর্তমান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টনের দপ্তর থেকে। এর কারণ হিসেবে ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্রটি থেকে হামলার হুমকি রয়েছে’ বলে উল্লেখ করা হলেও সুনির্দিষ্টভাবে কিছুই বলা হয়নি। এই বক্তব্য ও মার্কিন প্রশাসনের অবস্থান নিঃসন্দেহে ইরাক যুদ্ধের পূর্ববর্তী অবস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
ওয়াশিংটন কি তবে মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধ চায়? চাইলে তার কারণ কি? সাবেক বারাক ওবামা প্রশাসনের সবকিছুই পরিত্যাজ্য এমন ধারণা থেকে আর যা-ই হোক একটি যুদ্ধ অন্তত করা যায় না। তাহলে এমন উসকানির পেছনে ঠিক কী কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে উঠে আসছে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার দুই মিত্র সৌদি আরব ও ইসরায়েলের নাম। এ দুই মিত্রেরই প্রতিপক্ষ ইরান। ইসরায়েল ইরানকে শত্রু মনে করে হিজবুল্লাহ প্রশ্নে। আর সৌদি আরবের প্রশ্নটি আধিপত্যকেন্দ্রিক। এ দুটি দেশই মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে আমেরিকাকে ব্যবহার করে আসছে। বিশ্ব মোড়ল আমেরিকার ভূমিকা এ অঞ্চলে অনেকটা ভাড়াটে যোদ্ধার মতো।
কথা হচ্ছে, এই সময়ে এসে আরেকটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সামর্থ্য আমেরিকার রয়েছে কিনা। না, সামরিক সামর্থ্যের কথা বলা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, অর্থনৈতিক সামর্থ্যের কথা। বিশেষত যখন ট্রাম্প প্রশাসন চীনের মতো একটি বৃহৎ শক্তির সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধে নামে, তখন ইরানের সঙ্গে একটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কতটা সামর্থ্য তার রয়েছে, সে প্রশ্নটি তোলাই যায়। কারণ, ওয়াশিংটন যতই বলুক বাণিজ্য ঘাটতির সমন্বয়ের জন্য চাপ দিতে চীনকে শায়েস্তা করার পন্থা হিসেবে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করা হয়েছে। কিন্তু সত্য হচ্ছে এই পদক্ষেপে আমেরিকাও কম শায়েস্তা হচ্ছে না। নিজেদের নেওয়া পদক্ষেপ ও চীনের নেওয়া পাল্টা পদক্ষেপে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মার্কিন অর্থনীতিই।
আর অভিবাসন, স্বাস্থ্য, সুরক্ষাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে ঘরের ভেতরেই দুর্বল হয়ে পড়ছে প্রশাসন। সঙ্গে রয়েছে রবার্ট ম্যুলারের প্রতিবেদন, যা সরাসরি প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ না তুললেও এমন বহু তথ্যের সন্নিবেশ ঘটিয়েছে, যা দিয়ে অনায়াসে তাঁকে অভিযুক্ত করা যায়। বিষয়টি নিয়ে বিরোধী ডেমোক্র্যাট দলে বেশ আলোচনা চলছে। সিনেটে ডেমোক্র্যাট নেতা ন্যান্সি পেলোসি এখন পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রস্তাব উত্থাপন না করার পক্ষে মত দিয়েছেন। এই অবস্থায় বাইরে বলপ্রয়োগকে নিজেদের শক্তি সংহত করার উপায় হিসেবে নিলে, তা বুমেরাং হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। আমেরিকার খেয়ালি রাজা ডোনাল্ড ট্রাম্প এই শঙ্কার সমীকরণটি বুঝবেন, তেমনটা আশা করা যাচ্ছে না। তবে তাঁর অমাত্যরা, নিদেনপক্ষে কংগ্রেস বুঝবে—এ আশা করাই যায়।
>>>ফজলুল কবির: সাংবাদিক
No comments