ওষুধ ছাড়াই কোলেস্টেরলের মাত্রা স্বাভাবিক রাখুন by মুনীর উদ্দিন আহমদ
আমেরিকা
যুক্তরাষ্ট্রে ৪৫ বয়সোর্ধ্ব প্রতি চারজনের একজন স্ট্যাটিন (Statin)
গ্রুপের ওষুধ (অ্যাটরভ্যাস্টাটিন, লোভাস্ট্যাটিন, রসুভ্যাস্টাটিন,
সিমভ্যাস্টাটিন, ইমভ্যাস্টাটিন, ফ্লুভ্যাস্টাটিন, প্রেভ্যাস্টাটিন) গ্রহণ
করে। শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানোর জন্য বিশ্বব্যাপী ব্যাপক হারে
স্ট্যাটিন গ্রুপের এই ওষুধগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
কোলেস্টেরল কমানোর ক্ষেত্রে স্ট্যাটিন ওষুধগুলো কার্যকর হলেও বিশেষজ্ঞরা
মনে করেন, প্রাকৃতিক উপায় অবলম্বন করেও সমপরিমাণ কোলেস্টেরল কমানো সম্ভব। এ
পর্যন্ত সারা বিশ্বে পরিচালিত প্রায় ৯০০ গবেষণা ফলাফলে দেখা গেছে-
কোলেস্টেরল কমানোর জন্য ব্যবহৃত স্ট্যাটিন গ্রুপের এসব ওষুধের মারাত্মক ও
ধ্বংসাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। পেশি ধ্বংস, ডায়াবেটিস ও ক্যান্সারের
ঝুঁকি বৃদ্ধি ইত্যাদি এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে অন্যতম। পরিচালিত
গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে- জন্মগতভাবে যাদের রক্তে মাত্রাতিরিক্ত
কোলেস্টেরল থাকে, শুধু তাদের জন্য স্ট্যাটিন গ্রুপের ওষুধগুলো প্রযোজ্য হতে
পারে। যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যান সব দেশে সমভাবে প্রযোজ্য না হলেও বিশ্বের
অসংখ্য মানুষ অ্যান্টিকোলেস্টেরল ওষুধ গ্রহণ করে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
ভবিষ্যতেও হয়তো আরও অনেক বেশি মানুষ এসব ওষুধ গ্রহণ করবে। ব্যবহার ও
বিক্রয়ের দিক থেকে বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় ওষুধগুলোর মধ্যে প্রথম স্থানটি দখল
করে আছে স্ট্যাটিন গ্রুপের ওষুধ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়
অ্যাটরভ্যাস্টাটিন (Atorvastatin)। ফাইজারের অ্যাটরভ্যাস্টাটিনের ব্র্যান্ড
নাম লিপিটর। ২০০৭ সালে সারা বিশ্বে লিপিটরের মোট বিক্রির পরিমাণ ছিল ১২
বিলিয়ন ডলার। স্ট্যাটিন গ্রুপের ওষুধগুলো শরীরে কিভাবে কাজ করে, তা জানা
গেলে আমরা এ জাতীয় ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াজনিত নানা জটিল সমস্যা থেকে
অনেকাংশে মুক্তিলাভ করতে পারি। শরীরে কোলেস্টেরলের উৎস মূলত দুটি।
কোলেস্টেরলসমৃদ্ধ খাবার (ডিম, দুধ, খাসি, গরু, শূকর, মগজ, লিভার) থেকে আমরা
কোলেস্টেরল পেয়ে থাকি। কিন্তু শরীরে বেশিরভাগ অর্থাৎ প্রায় ৮৫ শতাংশ
কোলেস্টেরল তৈরি হয় লিভার বা যকৃতে সংশ্লেষণের মাধ্যমে। এই সংশ্লেষণের জন্য
আবশ্যক যৌগটির নাম অ্যাসিটাইল কো-এ বা অ্যাসিটাইল কোএনজাইম-এ। অ্যাসিটাইল
কো-এর উৎস হল মূলত কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা (গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ, সুক্রোজ
বা চিনি, স্টার্চ অথবা ভাত, গম, আটা, ময়দা), প্রোটিন বা আমিষ ও ফ্যাট বা
চর্বি। যারা মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে শর্করাজাতীয় খাবার খান, তাদের
কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি হবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। শরীরে কোলেস্টেরল
মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারণ প্রক্রিয়াজাত চিনি ও চিনিসমৃদ্ধ
খাবার। এসব খাবারের মধ্যে ওপরে বর্ণিত শর্করাজাতীয় খাবার ছাড়াও রয়েছে চিনি,
গুড়, আইসক্রিম, ক্যান্ডি, চকলেট, কোমল পানীয়, হরেক রকম মিষ্টি ইত্যাদি।
কৃত্রিমভাবে তৈরি কোলেস্টেরলভীতি আমাদের অতিমাত্রায় নৈর্বাচিক (selective)
করে তুলেছে। সপ্তাহে একটি বা দুটি ডিম, মাঝে মধ্যে দুয়েক টুকরো খাসি বা
গরুর গোশত খেলে কোলেস্টেরলের মাত্রা খুব একটা বাড়ে না। অনর্থক ভয়ভীতি ও
আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে অন্যায়ভাবে কোলেস্টেরলসমৃদ্ধ খাবার থেকে মানুষকে
সম্পূর্ণ বিরত রাখা হচ্ছে। স্ট্রোক বা হৃদরোগীদের মধ্যে অনেককেই আমি জানি,
যাদের চিকিৎসকরা বছরের পর বছর ধরে কুসুম বর্জন করে ডিমের সাদা অংশ খেয়ে
যেতে পরামর্শ দিচ্ছেন। অনেকেই আবার বহু বছর ধরে খাসি বা গরুর গোশত কেনাই
বন্ধ করে দিয়েছেন, খাওয়া তো দূরের কথা! বাটার, পনির, দুধ, কলিজা, মগজ,
চিংড়ি মাছকে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রেখে দেয়া হয়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হল-
চিকিৎসকরা রোগীকে ডিম, দুধ, খাসি, গরু, শূকর, মগজ, লিভার ও অন্যান্য
কোলেস্টেরলসমৃদ্ধ খাবার খেতে নিষেধ করেন, অথচ মাত্রাতিরিক্ত ভাত, রুটি,
চিনি, গুড়, আইসক্রিম, ক্যান্ডি, চকলেট, কোমল পানীয়, হরেক রকম মিষ্টি খেতে
নিষেধ করেন না। চিকিৎসকরা কি জানেন না- মাত্রাতিরিক্ত ভাত, রুটি,
প্রক্রিয়াজাত চিনি ও চিনিসমৃদ্ধ খাবারই শরীরে ৮৫ শতাংশ কোলেস্টেরল তৈরির
মূল কারণ। এ মানসিকতা অবশ্যই ঠিক নয়। বাড়াবাড়ি না করে মধ্যপন্থা অবলম্বনের
মাধ্যমে আমরা অনেক ক্ষেত্রে সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপন করে যেতে পারি। ফিরে
যাই আবার লিভারে কোলেস্টেরল তৈরির প্রক্রিয়ায়। একাধিক অ্যাসিটাইল কো-এ
একে-অপরের সঙ্গে বিক্রিয়া করে কোলেস্টেরল সংশ্লেষণের সূত্রপাত করে। তারপর
ক্রমধারায় অসংখ্য বিক্রিয়ার মাধ্যমে কোলেস্টেরল উৎপন্ন হয়। কোলেস্টেরল
সংশ্লেষণের একটি ধাপে হাইড্রোক্সিমিথাইল গ্লুটারাইল কো-এ রিডাক্টেজ নামের
একটি এনজাইম হাইড্রোক্সিমিথাইল গ্লুটারাইল কো-একে মেভালনিক অ্যাসিডে
রূপান্তরিত করে। মেভালনিক অ্যাসিড থেকে অসংখ্য ধাপ পেরিয়ে আমাদের পৌঁছাতে
হয় কোলেস্টেরলে। স্ট্যাটিন গ্রুপের ওষুধগুলো হাইড্রোক্সিমিথাইল গ্লুটারাইল
কো-এ রিডাক্টেজ এনজাইমকে প্রতিহত করে মেভালনিক অ্যাসিডে রূপান্তর বন্ধ করে
দেয়। ফলে বিক্রিয়া আর এগোতে না পারার কারণে কোলেস্টেরল সংশ্লেষণ বন্ধ হয়ে
যায়। ফলে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে যায়। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা
বেশি কমে গেলে সমস্যা আছে। শরীরের কোটি কোটি কোষপ্রাচীর তৈরির জন্য
কোলেস্টেরল একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। পর্যাপ্ত কোলেস্টেরলের অভাবে
কোষপ্রাচীর ঠিকভাবে তৈরি না হলে শরীরে নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়। শরীরে অসংখ্য
অত্যাবশ্যকীয় যৌগ রয়েছে, যেগুলো কোলেস্টেরল থেকে লিভারে তৈরি হয়। এ সব
অত্যাবশ্যকীয় যৌগের মধ্যে রয়েছে ভিটামিন ডি২, ভিটামিন ডি৩, শরীরের সেক্স
হরমোন (টেস্টোস্টেরন, প্রোজেস্টেরন ইসট্রোজেন ইত্যাদি), কর্টিসন, কর্টিসলের
মতো প্রয়োজনীয় স্টেরয়েড, ডলিকলস ও কোলিক অ্যাসিড, যা আমাদের অন্ত্রে খাবার
পরিপাকে সাহায্য করে। শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা অনিয়মতান্ত্রিকভাবে কমে
গেলে উল্লিখিত যৌগগুলোর উৎপাদন হ্রাস পায় বা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে শরীর ঠিকমতো
কাজ করতে পারে না। আমাদের মস্তিষ্কের ২৫ শতাংশ হল কোলেস্টেরল। মস্তিষ্কের
স্বাভাবিক কার্যক্রমের জন্য এই পরিমাণ কোলেস্টেরলের উপস্থিতি একান্ত
প্রয়োজন। প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত কোলেস্টেরল স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়।
১২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বা তার চেয়েও বেশি তাপমাত্রায় ১ ঘণ্টা উত্তপ্ত বা
পোড়ানো হলে কোলেস্টেরল অক্সিডেশনের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক যৌগে
রূপান্তরিত হয়। ২০০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করা হলে কোলেস্টেরলের গাঠনিক
সংকেত পুরো ভেঙে যায়। কেউ যদি প্রতিনিয়ত রাসায়নিকভাবে পরিবর্তিত ক্ষতিকর
কোলেস্টেরলসমৃদ্ধ খাবার, ট্রান্সফ্যাট, পোড়া তেল, ভাজা-পোড়া খাবার খায়- তবে
এসব ক্ষতিকর উপাদান রক্তের ঘনত্ব বাড়িয়ে দেবে এবং শিরা-উপশিরার অভ্যন্তরীণ
দেয়ালে জমতে শুরু করবে, যা পরবর্তী পর্যায়ে হৃদরোগ বা স্ট্রোকের কারণ হয়ে
উঠতে পারে। কোলেস্টেরল আমাদের শরীরের জন্য একটি আবশ্যকীয় রাসায়নিক যৌগ।
যেমন আগেই বলা হয়েছে, আমাদের শরীরের কয়েকশ’ কোটি সেল বা কোষের প্রাচীর
তৈরির জন্য কোলেস্টেরল প্রয়োজন হয়। কোলেস্টেরলের অভাবে কোষপ্রাচীর ঠিকভাবে
তৈরি হতে পারে না। অথচ ভালোমন্দ বিচার না করেই এই অত্যাবশ্যকীয় উপাদানটি
কমানোর জন্য আমরা মানুষকে মুড়ি-মুড়কির মতো ওষুধ দিচ্ছি। স্ট্যাটিন গ্রুপের
ওষুধের কারণে সৃষ্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যায় যাওয়ার আগে অন্যসব
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে একটু আলোচনা করি। কোচরান লাইব্রেরি কর্তৃক
প্রকাশিত এক সমীক্ষায় বলা হয়, ৩৪ হাজার রোগীর মধ্যে স্ট্যাটিনের ১৪টি
ট্রায়ালের ফলাফলে হতাশা, মেজাজ পরিবর্তন, লিভারের ক্ষতিসাধন বা কর্মক্ষমতা
হ্রাস, কিডনি বিকল, চোখে ছানি পড়া, পেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং স্মৃতিশক্তি
লোপ পাওয়া অন্যতম বলে প্রমাণিত হয়েছে। স্ট্যাটিন গ্রুপের ওষুধের কারণে
ডায়াবেটিস ও ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধির কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এবার মূল
সমস্যাটির কথা বলি। হাজার হাজার মানুষের মধ্যে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা
গেছে, যারা স্ট্যাটিন গ্রুপের ওষুধ গ্রহণ করেন, তাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই
যৌনক্ষমতা বা যৌনবাসনা হ্রাস পায় বা বিলুপ্ত হয়। ওষুধের ডোজ বাড়ার সঙ্গে
সঙ্গে সমস্যাও বাড়ে। বেশি মাত্রায় অর্থাৎ ২০ থেকে ৪০ মিলিগ্রামের স্ট্যাটিন
নিলে লিঙ্গোত্থান হয় না বলে অসংখ্য দম্পতি যৌন মিলনে সক্ষম হয় না।
বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষ এ ধরনের সমস্যার কথা চিকিৎসকের কাছে প্রতিনিয়তই
উপস্থাপন করেন। স্ট্যাটিন গ্রুপের ওষুধের সঙ্গে যৌনবাসনা হ্রাস বা বিলুপ্ত
হওয়ার কী সম্পর্ক, তা নিয়ে একটু আলোচনা করা দরকার। এলডিএলকে আমরা ঢালাওভাবে
আখ্যায়িত করি বিষ বা সবচেয়ে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল হিসেবে। কিন্তু এলডিএলের
উপকারিতার কথা আমরা খুব কমই জানি। শিরা-উপশিরার অভ্যন্তর দেয়ালে যদি প্রদাহ
বা ক্ষত সৃষ্টি হয়, তখন শুধু এনডিএল দেয়ালগাত্রে জমে যেতে পারে এবং
অ্যাথেরোসক্লেরোসিস সৃষ্টি করতে পারে। শিরা-উপশিরার দেয়াল স্বাভাবিক থাকলে
এলডিএলের কারণে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়; বরং এলডিএল কোষ দেয়াল তৈরি ও
রক্ষণাবেক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এলডিএলের মুখ্য ভূমিকা হল
টেস্টোস্টেরন প্রস্তুত। টেস্টোস্টেরন হল একটি গুরুত্বর্পূণ সেক্স হরমোন,
যার অভাবে যৌনবাসনা হ্রাস পায় বা বিলুপ্ত হয়। টেস্টিকল বা অণ্ডকোষের লেইডিগ
কোষ এলডিএল কোলেস্টেরল থেকে টেস্টোস্টেরন তৈরি করে। এ ধরনের কোষগুলো
রক্তপ্রবাহ থেকে এলডিএল কোলেস্টেরল সংগ্রহ করে টেস্টোস্টেরন উৎপাদনে বেশ
পারদর্শী। অনেক ক্ষেত্রে কোষ অভ্যন্তরে পুঞ্জীভূত এলডিএল কোলেস্টেরল থেকেও
তারা টেস্টোস্টেরন উৎপাদন করতে পারে। এই অবস্থায় কেউ স্ট্যাটিন গ্রুপের
ওষুধ গ্রহণ করলে রক্তপ্রবাহে এলডিএলের মাত্রা কমে যায়। ফলে লেইডিগ কোষ
রক্তপ্রবাহ থেকে পর্যাপ্ত এলডিএল সংগ্রহ করতে পারে না। লেইডিগ কোষ ঠিক
লিভারের মতো একই এনজাইম ব্যবহার করে কোলেস্টেরল উৎপন্ন করে। লেইডিগ কোষ
পর্যাপ্ত পরিমাণ স্ট্যাটিন গ্রুপের ওষুধ শোষণ করে নিতে সক্ষম বলে এনজাইম
প্রতিহত হওয়ার কারণে এলডিএল কোলেস্টেরল থেকে টেস্টোস্টেরন উৎপাদন যথেষ্ট
মাত্রায় বাধাগ্রস্ত হয়। স্ট্যাটিন গ্রুপের ওষুধ সিমভ্যাস্ট্যাটিন
কোলেস্টেরল উৎপাদনে বাড়তি সমস্যা সৃষ্টি করে। এই ওষুধ অণ্ডকোষ এলডিএল
কোলেস্টেরল বিশ্লেষণ শুধু বাধাগ্রস্তই করে না, উল্টো টেস্টোস্টেরন ও
অ্যানড্রোস্টেনডাইওল প্রস্তুতে দুটি মধ্যবর্তী যৌগের উৎপাদনও প্রতিহত করে।
ডিহাইড্রো এপিয়েন্ড্রোস্টেরন, ডিহাইড্রো-অ্যান্ড্রোস্টেরনডাইওন বা
টেস্টোস্টেরন শুধু পুরুষের যৌনবাসনার জন্য প্রয়োজন, তা নয়।
সিমভ্যাস্ট্যাটিন গ্রহণ করার কারণে মহিলারাও লস অব লিবিডো বা যৌন অক্ষমতায়
ভোগে। এতক্ষণ শুধু বিদেশের কথা বললাম। এবার বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দুয়েকটি
কথা বলি। কোলেস্টেরল কমানোর জন্য স্ট্যাটিন গ্রুপের ওষুধ প্রেসক্রাইব করার
ক্ষেত্রে অনিয়ম ও যুক্তিহীনতা প্রায়ই পরিলক্ষিত হয় আমাদের দেশে।
বাংলাদেশেও লাখ লাখ রোগী ও সুস্থ মানুষকে স্ট্যাটিন গ্রুপের ওষুধ প্রদান
করা হয়। এদের মধ্যে হৃদরোগ, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ, হাইপার
কোলেস্টেরলেমিয়ায় আক্রান্ত রোগী ছাড়াও সুস্থ ও স্বাভাবিক কোলেস্টরল মাত্রার
মানুষও রয়েছে। আমি এমন একজন ভদ্রলোককে জানি, স্বাভাবিক কোলেস্টরল মাত্রা
থাকা সত্ত্বেও যাকে ২০ মিলিগ্রামের অ্যাটরভ্যাস্ট্যাটিন প্রদান করা হয়েছে।
এই ওষুধ গ্রহণ করার কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি পূর্বোল্লিখিত যৌন সমস্যায়
আক্রান্ত হলেন। তিনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না, কী কারণে এমন হল এবং তার কী
করা উচিত। ঘটনাটি তিনি আমাকে জানালেন এবং আমি ওষুধটি বন্ধ করে দিতে বলে
প্রাকৃতিক উপায়ে কোলেস্টেরল কমানোর পরামর্শ দিলাম। দিন দশেক পরে একদিন
ভদ্রলোক আমাকে জানালেন, তার সমস্যাটি এখন আর নেই। এটা কোনো বিছিন্ন ঘটনা
নয়। এ রকম অসংখ্য ঘটনার সঙ্গে আমি পরিচিত। ফার্মাসিস্ট হওয়ার সুবাদে
পরামর্শ দেয়ার যোগ্যতা ও এখতিয়ার আমার আছে বলে বহু রোগী ও মানুষের কাছ থেকে
আমি নানাবিধ সমস্যার কথা প্রায়ই অবগত হই এবং সমাধান দিতে চেষ্টা করি।
আমাদের দেশে বহু প্রগতিবাদী চিকিৎসক রয়েছেন। এসব চিকিৎসক বিবেক, বুদ্ধি ও
যুক্তি প্রয়োগ করে অল্প ওষুধে বহু রোগী সারিয়ে তোলেন। তাদের আমি শ্রদ্ধা
করি। তারা অপ্রয়োজনে রোগীকে ওষুধ প্রদান করেন না। অন্যদিকে আমি বহু
চিকিৎসককে জানি, যারা পেশাগত দিক থেকে সৎ নন। তারা সুস্থ মানুষকে অসুস্থ
করে তোলেন এবং রোগী বানিয়ে ছাড়েন। ওষুধ কোম্পানির স্বার্থরক্ষার্থে এসব
চিকিৎসক রোগীকে অহেতুক গাদাগাদা ওষুধ প্রদান করেন। এভাবে স্ট্যাটিন গ্রুপের
ওষুধগুলোও মারাত্মকভাবে অপব্যবহার হচ্ছে, যার খেসারত দিচ্ছে নিরীহ মানুষ।
মাত্রাতিরিক্ত কোলেস্টেরলের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমরা কিছু কার্যকর
পন্থা অবলম্বন করতে পারি। খাদ্যতালিকা হতে হবে পরিমিত ও সুষম। চর্বিজাতীয়
খাবার কম খেতে হবে। শর্করাজাতীয় খাবারের আধিক্য পরিত্যাগ করতে হবে। মনে
রাখবেন, প্রতিবেলায় এক থেকে দু’কাপ ভাত বা দুটো রুটি যথেষ্ট। চিনি,
ফ্রুকটোজ কর্ন সিরাপসমৃদ্ধ কোমল পানীয় বর্জন করতে হবে। ফাইবার বা আঁশজাতীয়
শাকসবজি, ফলমূল, খোসাযুক্ত আটা খাবারের মূল অংশ হতে হবে। স্বাস্থ্যের
উপযোগী চর্বির জন্য অ্যাভাকাডো, অলিভ, নারিকেল, অর্গানিক ডিম, মিঠা পানির
মাছ খেতে হবে। তেল বা ডালডায় পোড়া খাবার, আগুনে ঝলসানো ও উচ্চ তাপে রান্না
প্রাণিজ খাবার একেবারেই কম খেতে হবে। আর রইল ব্যায়াম। ব্যায়ামের কোনো
বিকল্প নেই সুস্থ, সুন্দর জীবনের জন্য। এসব নিয়ম মেনে চললে প্রাকৃতিক উপায়ে
আপনার কোলেস্টেরলের মাত্রা স্বাভাবিক থাকবে। তখন আর আপনাকে অনর্থক ওষুধ
খেতে হবে না। আর মনে রাখবেন- আপনি সুস্থ থাকলে আপনার কোলেস্টেরল ভীতিও
থাকবে না। কোলেস্টেরলভীতি আমাদের সর্বক্ষণ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আর তাই হয়তো
আমরা এত বেশি ওষুধনির্ভর হয়ে পড়েছি।
মুনীরউদ্দিন আহমদ: অধ্যাপক, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
drmuniruddin@gmail.com
মুনীরউদ্দিন আহমদ: অধ্যাপক, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
drmuniruddin@gmail.com
No comments