শ্রীলঙ্কায় মুসলিম বিরোধী দাঙ্গার নেপথ্যে by মিসবাহুল হক
শ্রীলঙ্কায়
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরুর আগের দিন একটি সিংহলী জাতীয়তাবাদী দলের নেতা
অমিত উইরাসিংহে ক্যান্ডি সফর করেন। শ্রীলঙ্কার মধ্যাঞ্চলের এই পার্বত্য
জেলার দিগানা শহরে দলীয় প্রচারণার জন্য দোকানে দোকানে লিফলেট বিতরণ করেন
তিনি। এ সময় নিজের মোবাইল ফোনে একটি ভিডিওচিত্র ধারণ করেন। এতে বলেন, ‘আমরা
লিফলেট বিতরণ করছি। বর্তমানে দিগানা শহরে পৌঁছেছি। কিন্তু এখানে আমরা
সিংহলীজদের মালিকানাধীন ২০টি দোকানও পাইনি। এখন এই শহর মুসলিমদের দখলে চলে
গেছে। এই বিষয়টি আমাদের অনেক আগেই উপলব্ধি করা দরকার ছিল। এজন্য আমরা
সিংহলীরাই দায়ী। দিগানা শহর ও এর আশেপাশে যদি কোনো সিংহলী থাকেন, দয়া করে
এগিয়ে আসেন।’
তার এই বক্তব্য ফেসবুক, ইউটিউব ও টুইটারে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। এর পরেই ক্যান্ডিতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। তীব্র সহিংসতার মুখে সরকার সেখানে সেনা মোতায়েন করে। একই সঙ্গে পুরো দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সহিংসতার সূচনা হয় একদল মুসলিমের হাতে একজন সিংহলী নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এতে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরে সিংহলীজরা দু’জন মুসলিমকে হত্যা করে, কয়েকটি মসজিদ, মুসলিমদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এতে দক্ষিণ এশীয় দেশটিতে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।
২০০৯ সালে তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে যুদ্ধের সমাপ্তি টানে শ্রীলঙ্কা সরকার। কিন্তু ক্যান্ডির দাঙ্গায় আবারো বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। এবারে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলী বৌদ্ধ ও সংখ্যালঘু মুসলিম অধিবাসীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ দেখা দিয়েছে। উল্লেখ্য, শ্রীলঙ্কার মোট জনসংখ্যা দুই কোটি দশ লাখ। এর মধ্যে সিংহলীজ বৌদ্ধের পরিমাণ ৭৫ শতাংশ। আর মুসলিম অধিবাসীর সংখ্যা মাত্র নয় শতাংশ।
হুমকির মুখে সংখ্যালঘুরা : শ্রীলঙ্কায় বহুদিন ধরেই সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে দুই সম্প্রদায় বসবাস করে আসছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন সিংহলী বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে মুসলিম-বিদ্বেষের জন্ম দিয়েছে। কলম্বোভিত্তিক ‘ন্যাশনাল পিস কাউন্সিলের’ পরিচালক জাহান পেরেরা বলেন, সিংহলীজদের অনিরাপত্তাবোধের কারণে মুসলিম-বিরোধী মনোভাবের উদ্ভব ঘটেছে। কেননা, এই অঞ্চলে সিংহলীরা নিজেদের ঝুঁকিপূর্ণ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী মনে করে। তারা সেখানকার মুসলিমদের, বৃহত্তর মুসলিম সম্প্রদায়ের অংশ মনে করে। সিংহলীদের আশঙ্কা, এই মুসলিমরা একদিন পুরো শ্রীলঙ্কা নিজেদের দখলে নিতে পারে। এছাড়া মুসলিম সম্প্রদায়ের উচ্চ জন্মহার তাদের মনে ভীতির সঞ্চার করে। সেখানে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয় যে, সিংহলীদের সংখ্যালঘু করার পরিকল্পনা করেছে মুসলিমরা। এজন্য সিংহলীদের গোপনে গর্ভনিরোধক পিল সেবন করানো হচ্ছে। একজন মুসলিম শেফের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়, তিনি সিংহলী ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা খাবারে গর্ভ নিরোধক পিল মিশিয়েছেন। এই মিথ্যা গুজবই তাদের মুসলিমদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দিতে উদ্বুদ্ধ করে। পেরেরা বলেন, এসব গুজব পুরোপুরি মিথ্যা ও কল্পনাপ্রসূত। এছাড়া মুসলিমদের অধিক অর্থনৈতিক শক্তি রয়েছে- এমন ধারণা ছোট এই শহরে মুসলিম-বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ার আরেকটি কারণ হতে পারে। শ্রীলঙ্কা মুসলিম কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট নিজামুদ্দিন মোহাম্মদ আমিন বলেন, মুসলিমদের অর্থনৈতিক শক্তির ওপর ঈর্ষা থেকে মুসলিম-বিদ্বেষের জন্ম নিতে পারে। তবে এটা ধারণা মাত্র। শহরের ছোট দোকানগুলোর অনেকই মুসলিমদের মালিকানায় রয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবেই তারা ব্যবসায়ী। তবে তাদের ব্যবসা নিতান্তই ক্ষুদ্র। তারা দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিক্রি করে।
আরো একটি বিষয় সিংহলী বৌদ্ধদের মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি করতে পারে। সেটি হলো, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শ্রীলঙ্কার মুসলিমদের সাংস্কৃতিক পরিবর্তন। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার লাখ লাখ মুসলিম বিদেশে কর্মরত রয়েছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। দেশে ফিরে আসার সময় তারা প্রচুর অর্থ নিয়ে আসে। পাশাপাশি দীর্ঘদিন আরব দেশে অবস্থান থাকায় সেখানকার মূল্যবোধের দ্বারা প্রভাবিত হয় তারা। পেরেরা বলেন, এভাবে আরব দেশগুলো থেকে প্রচুর অর্থ শ্রীলঙ্কায় আসছে। নতুন নতুন মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। তাদের পোশাক-আশাকের ধরনেও পরিবর্তন এসেছে। অনেক মুসলিম নারী পূর্বের পোশাক বাদ দিয়ে ‘নিকাব’ পরা শুরু করেছে। নিজামুদ্দিন মোহাম্মদ আমিন বলেন, আমাদের মায়েরা তাদের মাথা আবৃত রাখে। কিন্তু তারা ‘নিকাব’ পরে না। তবে মধ্যপ্রাচ্য ফেরত শ্রমিকদের পরিবারের অনেকেই নিকাব পরা শুরু করেছে। শ্রীলঙ্কার মুসলিমদের অধিক হারে মধ্যপ্রাচ্য সফর স্থানীয় মুসলিমদের ভাবধারায় পরিবর্তন এনেছে। এতে সিংহলী বৌদ্ধরা মনে করে, শ্রীলঙ্কার মুসলিমরা সৌদি আরবসহ অন্যান্য আরব দেশের সংস্কৃতি অনুসরণ করছে।
দায়মুক্তি : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে এসব গুজব অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ফেসবুক মিমি, ভিডিও ও পোস্টের মাধ্যমে এসব ভ্রান্ত ধারণা আরো বেশি ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে সিংহলী জাতীয়তাবাদী দলগুলো কর্তৃক পরিচালিত ফেসবুক পেজগুলো এগুলো ছড়িয়ে দিয়েছে। এই ভাবধারার প্রসিদ্ধ দুই নেতা হলেন উইরাসিংহে মহাসন বলাকায়া ও বৌদ্ধ ভিক্ষু বদু বালা সেন (বিবিএস)। এদের অনুসারীদের মিয়ানমারের কট্টরপন্থী বৌদ্ধ দল ‘মা বা থা’র সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। পেরেরা বলেন, বদু বালা সেন ও মহাসন বলাকায়া সাধারণ সিংহলীদের সমর্থন লাভ করতে ব্যর্থ হওয়ায় অনুসারীরা তাদের মুসলিম-বিদ্বেষী বক্তব্য প্রচার করা শুরু করে। এতে সেখানে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু মাইথ্রিপালা সিরিসেনার নেতৃত্বাধীন সরকার এসব বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচারের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়। ২০১৪ সালে ধর্মীয় বৌদ্ধ নেতা গনাসারার উস্কানিমূলক বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আলুথগামায় মুসলিমদের ওপর হামলা চালানো হয়। এতে চার জন নিহত হয়। আহত হয় আরো ৮০ জন। কিন্তু তখন হামলার উস্কানিদাতাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। পরে ২০১৭ সালে তাকে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দেয়ার দায়ে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। কিন্তু আদালতে হাজির না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। পরে আত্মসমর্পণ করলেও জামিনে মুক্তি পান গনাসারা। তার বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। তবে সে মামলা এখনো চলছে।
এদিকে, সম্প্রতি ক্যান্ডিতে সংঘটিত সহিংসতায় শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা বাহিনী উইরাসিংহ ও তার নয় সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে সমালোচকরা বলছেন, এই পদক্ষেপ খুবই নগণ্য। এছাড়া তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে অনেক দেরিতে। শ্রীলঙ্কার মানবাধিকার কর্মী থেয়াকি রুয়ানপাথিরা বলেন, শুধু উইরাসিংহেকে গ্রেপ্তারই যথেষ্ট না। এর আগেও অনেকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের কেউই সাজা পায় নি। যদি সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই দায়মুক্তির চক্র ভঙ্গ করতে সক্ষম হতো, তাহলে অপরাধীরা এতো সাহসী হয়ে উঠতো না। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদের জনগণকে এই ধারণা দিতে হবে যে, সংখ্যালঘুদের ওপর কোনো নির্যাতন মেনে নেয়া হবে না।
(আল জাজিরায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অবলম্বনে)
তার এই বক্তব্য ফেসবুক, ইউটিউব ও টুইটারে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। এর পরেই ক্যান্ডিতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। তীব্র সহিংসতার মুখে সরকার সেখানে সেনা মোতায়েন করে। একই সঙ্গে পুরো দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সহিংসতার সূচনা হয় একদল মুসলিমের হাতে একজন সিংহলী নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এতে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরে সিংহলীজরা দু’জন মুসলিমকে হত্যা করে, কয়েকটি মসজিদ, মুসলিমদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এতে দক্ষিণ এশীয় দেশটিতে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।
২০০৯ সালে তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে যুদ্ধের সমাপ্তি টানে শ্রীলঙ্কা সরকার। কিন্তু ক্যান্ডির দাঙ্গায় আবারো বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। এবারে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলী বৌদ্ধ ও সংখ্যালঘু মুসলিম অধিবাসীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ দেখা দিয়েছে। উল্লেখ্য, শ্রীলঙ্কার মোট জনসংখ্যা দুই কোটি দশ লাখ। এর মধ্যে সিংহলীজ বৌদ্ধের পরিমাণ ৭৫ শতাংশ। আর মুসলিম অধিবাসীর সংখ্যা মাত্র নয় শতাংশ।
হুমকির মুখে সংখ্যালঘুরা : শ্রীলঙ্কায় বহুদিন ধরেই সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে দুই সম্প্রদায় বসবাস করে আসছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন সিংহলী বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে মুসলিম-বিদ্বেষের জন্ম দিয়েছে। কলম্বোভিত্তিক ‘ন্যাশনাল পিস কাউন্সিলের’ পরিচালক জাহান পেরেরা বলেন, সিংহলীজদের অনিরাপত্তাবোধের কারণে মুসলিম-বিরোধী মনোভাবের উদ্ভব ঘটেছে। কেননা, এই অঞ্চলে সিংহলীরা নিজেদের ঝুঁকিপূর্ণ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী মনে করে। তারা সেখানকার মুসলিমদের, বৃহত্তর মুসলিম সম্প্রদায়ের অংশ মনে করে। সিংহলীদের আশঙ্কা, এই মুসলিমরা একদিন পুরো শ্রীলঙ্কা নিজেদের দখলে নিতে পারে। এছাড়া মুসলিম সম্প্রদায়ের উচ্চ জন্মহার তাদের মনে ভীতির সঞ্চার করে। সেখানে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয় যে, সিংহলীদের সংখ্যালঘু করার পরিকল্পনা করেছে মুসলিমরা। এজন্য সিংহলীদের গোপনে গর্ভনিরোধক পিল সেবন করানো হচ্ছে। একজন মুসলিম শেফের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়, তিনি সিংহলী ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা খাবারে গর্ভ নিরোধক পিল মিশিয়েছেন। এই মিথ্যা গুজবই তাদের মুসলিমদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দিতে উদ্বুদ্ধ করে। পেরেরা বলেন, এসব গুজব পুরোপুরি মিথ্যা ও কল্পনাপ্রসূত। এছাড়া মুসলিমদের অধিক অর্থনৈতিক শক্তি রয়েছে- এমন ধারণা ছোট এই শহরে মুসলিম-বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ার আরেকটি কারণ হতে পারে। শ্রীলঙ্কা মুসলিম কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট নিজামুদ্দিন মোহাম্মদ আমিন বলেন, মুসলিমদের অর্থনৈতিক শক্তির ওপর ঈর্ষা থেকে মুসলিম-বিদ্বেষের জন্ম নিতে পারে। তবে এটা ধারণা মাত্র। শহরের ছোট দোকানগুলোর অনেকই মুসলিমদের মালিকানায় রয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবেই তারা ব্যবসায়ী। তবে তাদের ব্যবসা নিতান্তই ক্ষুদ্র। তারা দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিক্রি করে।
আরো একটি বিষয় সিংহলী বৌদ্ধদের মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি করতে পারে। সেটি হলো, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শ্রীলঙ্কার মুসলিমদের সাংস্কৃতিক পরিবর্তন। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার লাখ লাখ মুসলিম বিদেশে কর্মরত রয়েছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। দেশে ফিরে আসার সময় তারা প্রচুর অর্থ নিয়ে আসে। পাশাপাশি দীর্ঘদিন আরব দেশে অবস্থান থাকায় সেখানকার মূল্যবোধের দ্বারা প্রভাবিত হয় তারা। পেরেরা বলেন, এভাবে আরব দেশগুলো থেকে প্রচুর অর্থ শ্রীলঙ্কায় আসছে। নতুন নতুন মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। তাদের পোশাক-আশাকের ধরনেও পরিবর্তন এসেছে। অনেক মুসলিম নারী পূর্বের পোশাক বাদ দিয়ে ‘নিকাব’ পরা শুরু করেছে। নিজামুদ্দিন মোহাম্মদ আমিন বলেন, আমাদের মায়েরা তাদের মাথা আবৃত রাখে। কিন্তু তারা ‘নিকাব’ পরে না। তবে মধ্যপ্রাচ্য ফেরত শ্রমিকদের পরিবারের অনেকেই নিকাব পরা শুরু করেছে। শ্রীলঙ্কার মুসলিমদের অধিক হারে মধ্যপ্রাচ্য সফর স্থানীয় মুসলিমদের ভাবধারায় পরিবর্তন এনেছে। এতে সিংহলী বৌদ্ধরা মনে করে, শ্রীলঙ্কার মুসলিমরা সৌদি আরবসহ অন্যান্য আরব দেশের সংস্কৃতি অনুসরণ করছে।
দায়মুক্তি : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে এসব গুজব অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ফেসবুক মিমি, ভিডিও ও পোস্টের মাধ্যমে এসব ভ্রান্ত ধারণা আরো বেশি ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে সিংহলী জাতীয়তাবাদী দলগুলো কর্তৃক পরিচালিত ফেসবুক পেজগুলো এগুলো ছড়িয়ে দিয়েছে। এই ভাবধারার প্রসিদ্ধ দুই নেতা হলেন উইরাসিংহে মহাসন বলাকায়া ও বৌদ্ধ ভিক্ষু বদু বালা সেন (বিবিএস)। এদের অনুসারীদের মিয়ানমারের কট্টরপন্থী বৌদ্ধ দল ‘মা বা থা’র সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। পেরেরা বলেন, বদু বালা সেন ও মহাসন বলাকায়া সাধারণ সিংহলীদের সমর্থন লাভ করতে ব্যর্থ হওয়ায় অনুসারীরা তাদের মুসলিম-বিদ্বেষী বক্তব্য প্রচার করা শুরু করে। এতে সেখানে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু মাইথ্রিপালা সিরিসেনার নেতৃত্বাধীন সরকার এসব বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচারের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়। ২০১৪ সালে ধর্মীয় বৌদ্ধ নেতা গনাসারার উস্কানিমূলক বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আলুথগামায় মুসলিমদের ওপর হামলা চালানো হয়। এতে চার জন নিহত হয়। আহত হয় আরো ৮০ জন। কিন্তু তখন হামলার উস্কানিদাতাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। পরে ২০১৭ সালে তাকে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দেয়ার দায়ে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। কিন্তু আদালতে হাজির না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। পরে আত্মসমর্পণ করলেও জামিনে মুক্তি পান গনাসারা। তার বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। তবে সে মামলা এখনো চলছে।
এদিকে, সম্প্রতি ক্যান্ডিতে সংঘটিত সহিংসতায় শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা বাহিনী উইরাসিংহ ও তার নয় সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে সমালোচকরা বলছেন, এই পদক্ষেপ খুবই নগণ্য। এছাড়া তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে অনেক দেরিতে। শ্রীলঙ্কার মানবাধিকার কর্মী থেয়াকি রুয়ানপাথিরা বলেন, শুধু উইরাসিংহেকে গ্রেপ্তারই যথেষ্ট না। এর আগেও অনেকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের কেউই সাজা পায় নি। যদি সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই দায়মুক্তির চক্র ভঙ্গ করতে সক্ষম হতো, তাহলে অপরাধীরা এতো সাহসী হয়ে উঠতো না। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদের জনগণকে এই ধারণা দিতে হবে যে, সংখ্যালঘুদের ওপর কোনো নির্যাতন মেনে নেয়া হবে না।
(আল জাজিরায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অবলম্বনে)
No comments