মমতা পারবেন প্রথম বাঙালি প্রধানমন্ত্রী হতে?
২০১৯
সালের লোকসভা নির্বাচনের মাধ্যমে বিজেপির পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসা নিয়ে
সংশয় দেখা দিয়েছে। নোট বাতিলসহ নানা ঘটনায় বিজেপির ওপর ক্ষুব্ধ অনেকেই।
বিজেপির এই কর্মকাণ্ডে নাখোশ তাদের এনডিএ জোটের শরিকেরা। কংগ্রেসও যে
বলিষ্ঠ নেতা আছে, তা জোর দিয়ে বলা যায় না। কারণ, দলের অন্যতম কান্ডারি
রাহুল গান্ধী এখনো প্রভাব খাটানোর মতো ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে পারেননি। ভারতের
সাধারণ মানুষ চায় একজন তেজস্বী নেতা, যাঁর মধ্যে নীতিতে অটল থাকার গুণ
রয়েছে। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামটা
উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ কারণেই পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা এখন
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের মাধ্যমে বাঙালি প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন
দেখছেন। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা ১৯৯৬ সালে দেশের প্রথম একজন বাঙালি
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। তিনি ছিলেন সিপিএম নেতা ও
পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। কিন্তু দল তাঁকে
প্রধানমন্ত্রী পদে বসানোর অনুমতি দেয়নি, যদিও সেদিনকার বিরোধী ১৩ দলের
যুক্তফ্রন্ট চেয়েছিল জ্যোতি বসুকে। ফলে সেদিন ভেস্তে গিয়েছিল একজন বাঙালির
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন ও সুযোগ। এরপর অবশ্য ভারতের রাষ্ট্রপতি
হওয়ারও পথ খুলেছিল জ্যোতি বসুর। কিন্তু এতেও সায় মেলেনি দলের। তবে ভারতের
স্বাধীনতার দীর্ঘ ৬৫ বছর পর প্রথম একজন বাঙালির রাষ্ট্রপতি হওয়ার সুযোগ
পেয়েছিলেন কংগ্রেস দলের প্রবীণ নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায়। তিনি একটানা পাঁচ
বছর রাষ্ট্রপতি পদে থেকে অবসর নিয়েছেন গত বছরের ২৫ জুলাই। ক্ষমতায় এসেছিলেন
২০১২ সালের ২৫ জুলাই। ফলে বাঙালির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আর কোনো সুযোগ
রাজ্যবাসীর কাছে হাতছানি দেয়নি। এখন ভারতের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বিজেপি।
ভারতীয় জনতা পার্টি। বিজেপির গায়ে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ থাকলেও তারা বিপুল
ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে ২০১৪ সালে। প্রধানমন্ত্রী হন নরেন্দ্র মোদি।
নরেন্দ্র মোদির ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিপুল জয়ের পর বিজেপি দেখতে
থাকে ক্ষমতায় টিকে থাকার নানা স্বপ্ন। নেতারা তো বলেই ফেলেন, কংগ্রেস বিদায়
হয়েছে। কংগ্রেসের যুগ শেষ। এবার আসছে বিজেপির যুগ। সুতরাং বিজেপি এখনো আছে
এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। বিজেপির নেতারাও মনে করেন, আগামী বছর অনুষ্ঠেয়
ভারতের পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ফের ক্ষমতায় থাকছে। মানুষ এখনো
বিজেপির দিকে ঝুঁকে আছে। বিমুখ করেনি মানুষ তাদের। সর্বশেষ তারা ত্রিপুরা
রাজ্যে বামফ্রন্টকে হারিয়ে চমক দিয়েছে দেশবাসীকে। তবু প্রশ্ন উঠে এসেছে,
সত্যি কি তা-ই? বিজেপি ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় থাকতে
পারবে? পারবে কি তাদের দুর্গ রক্ষা করতে? পারবে কি তাদের আসন ধরে রাখতে?
নাকি তাদের আসন কমে যাবে? কংগ্রেস তাদের বড় ধাক্কা দেবে? ইত্যাদি প্রশ্নে
এখন গোটা দেশে বিজেপি জেরবার হচ্ছে। কারণ, ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর ভারতের
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হঠাৎ করে এক ঘোষণায় বাতিল করে দেন ভারতের
চলমান ১০০০ ও ৫০০ রুপির নোট। এই ঘটনাকে মেনে নিতে পারেনি গোটা দেশের সাধারণ
মানুষ। তারা এর বিরুদ্ধে পথে নামে।
আন্দোলনে শামিল হয়। নেতৃত্বে চলে আসেন
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী
অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তাঁরা দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুললেও কাজের কাজ কিছুই
হয়নি; বরং নোট বাতিলের ধাক্কায় গরিব মানুষের ভোগান্তি চরমে ওঠে। আর
বড়লোকদের নোট গোপন পথে ব্যাংকে জমা হয়ে যায়। পরবর্তী ঘটনা জিএসটি চালু।
জিএসটি হলো পণ্য ও সেবা কর বা গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স। এটাও মেনে
নিতে পারেনি দেশবাসী। পণ্যমূল্য ও সেবা কর চালুর পর বেড়ে যায় পণ্যমূল্য।
একশ্রেণির ব্যবসায়ী জিএসটির নামে অধিক মূল্যে বিক্রি শুরু করেন তাঁদের
পণ্য। ফলে ক্ষোভ বাড়তে থাকে সাধারণ মানুষের মনে। সেই সঙ্গে ছোটখাটো
ব্যবসায়ীদেরও। এরপরে রয়েছে মোদির ঘোষণামতে গোটা দেশে পণ্যমূল্যে রাশ টানতে
ব্যর্থ হওয়ার ঘটনা। এতে এখন দেশে লাগামহীনভাবে বাড়ছে পণ্যমূল্য। চলে গেছে
নিয়ন্ত্রণের বাইরে। মোদি সরকার কমাতে পারেনি বেকার সমস্যা। বেড়েছে
সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালন। সাম্প্রদায়িকতা। ফলে গোটা দেশই এখন এই সব
ঘটনায় সোচ্চার। সোচ্চার সাধারণ মানুষ। আর এসব ঘটনার এখন ফল পেতে শুরু করেছে
বিজেপি। বিজেপির এই কর্মকাণ্ডে নাখোশ তাদের এনডিএ জোটের শরিকেরা।
মহারাষ্ট্রের জোটসঙ্গী শিবসেনা ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে, তারা আগামীর কোনো
নির্বাচনে বিজেপির সঙ্গে জোট করবে না। জোটে থাকবে না ওডিশার নবীন
পট্টনায়কের বিজেডি দলও। অন্ধ প্রদেশের তেলেগু দেশম পার্টির নেতা চন্দ্রবাবু
নাইডুও এনডিএ জোট ছেড়ে বিকল্প পথে হাঁটতে শুরু করেছেন। ফলে দিনে দিনে এটা
স্পষ্ট হয়ে উঠছে, বিজেপির পালে হাওয়ার বেগ এখন স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে। তাই তো
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও হিন্দুস্তানি আওয়াম মোর্চা
দলের নেতা জিতন রাম মাঝি বিজেপি ছেড়ে যোগ দিয়েছেন লালু প্রসাদ যাদবের
রাষ্ট্রীয় জনতা দল বা আরজেডিতে। অন্যদিকে, ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসে মোদি
যেভাবে গোটা দেশে ঝড় তুলেছিলেন, সেই ঝড়ের ঝাপটা এখন অনেকটাই কমে গেছে। ২০১৪
সালে ৫৪৩ আসনের লোকসভায় বিজেপি পেয়েছিল ২৮২টি আসন—একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা। আর
কংগ্রেস পেয়েছিল মাত্র ৪৪টি আসন। মমতা পেয়েছিল ৩৪টি আসন। এই বিপুল বিজয়ের
পর মোদি স্বপ্ন দেখা শুরু করেন তাঁকে আর তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী
কংগ্রেস নামাতে পারবে না গদি থেকে। বিজেপির উত্থান ঠেকাতে পারবে না
কংগ্রেস। কিন্তু নোট বাতিল, জিএসটি চালু, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বেকারত্ব
বৃদ্ধি এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান বিজেপির ঘাড়ে নতুন করে প্রভাব ফেলতে
শুরু করেছে। বিজেপি-শাসিত মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, রাজস্থানের স্থানীয় সরকারসহ
সংসদ ও বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির পরাজয় শুরু হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন জনমত
সমীক্ষায় উঠে এসেছে বিজেপির জনপ্রিয়তায় ভাটার টানের ছবি। ফলে ২০১৯ সালের
লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এককভাবে জয়ের ধ্বজা ধরে রাখতে পারবে কি না, তা
নিয়ে ইতিমধ্যে রাজনৈতিক মহলে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে পশ্চিমবঙ্গের
তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা এখন নতুন করে দেখা শুরু করেছেন ২০১৯ সালের লোকসভা
নির্বাচনের মাধ্যমে একজন বাঙালি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন। আর সেই পদের
জন্য তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তুলে এনেছেন। তৃণমূলের যুক্তি, আগামীর
নির্বাচনে বিজেপি আর তাদের আসন ধরে রাখতে পারবে না। তাদের আসন কমবে।
অন্যদিকে আসন বাড়বে কংগ্রেসের। তবে এই দুটি দল যদি তাদের আসনসংখ্যা ১৫০-এর
ওপরে তুলতে না পারে, সে ক্ষেত্রে তাদের পক্ষে সরকার গড়া সম্ভব হবে না।
প্রয়োজন হবে শরিক বা অন্যান্য দলের সমর্থন। তৃণমূলের ধারণা, বিজেপি ও
কংগ্রেসের পরই হবে তাদের স্থান। কারণ, কংগ্রেস যদি সরকার গড়তে না পারে,
ক্ষেত্রে তারা ধর্মনিরপেক্ষ কোনো জোটকে সমর্থন দিতে পারে। আর তখনই সুযোগ
এসে যেতে পারে মমতার ভাগ্যে। এই নিয়ে তৃণমূল স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। কারণ,
তৃণমূলের ধারণা, দেশে মোদীবিরোধী শক্তির প্রধান সৈনিক মমতা। মমতার
জনপ্রিয়তা দিনে দিনে বাড়ছে। বিরোধীরা সেটা মানছেও। তবু এ কথা বলার অপেক্ষা
রাখে না যে মমতাকে সত্যি মোদিবিরোধী সব দল প্রধানমন্ত্রী পদে সমর্থন
জোগাবে? কারণ, মমতার মতো আরও বেশ কজন নেতা রয়েছেন বিভিন্ন বিরোধী দলে,
যাঁরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদের যোগ্য এবং দাবিদার। যদিও তৃণমূল এখন
চাইছে, মোদি বিরোধিতার এবার প্রধান মুখ হোন মমতা। কারণ, মমতা সাতবার
লোকসভার সাংসদ হয়েছেন। ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের রেলমন্ত্রী, কয়লামন্ত্রী ও
যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী। সুতরাং তাঁর যোগ্যতার প্রশ্নে কারও দ্বিমত না
থাকলেও প্রধানমন্ত্রী পদে তাঁকে বিরোধীরা বসাবেন কি না, সেই প্রশ্নে দ্বিমত
রয়েছে। কারণ, মমতার দল মূলত পশ্চিমবঙ্গকেন্দ্রিক। সুতরাং সর্বভারতীয় অন্য
যেসব দল আছে, তারা চাইবে না মমতাকে এই পদে বসাতে। তবু অপেক্ষার পালা ২০১৯
সালের লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত। দেখা যাক কী ঘটে যায় সেই নির্বাচনে?
No comments