ইসির বক্তব্য মেনে নেয়া যায় না by মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
বাংলাদেশ
সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান।
নির্বাচন কমিশনের প্রধান কাজ হল নির্বাচন করা। কমিশনকে নিরপেক্ষ ও
পেশাদারিত্বের সঙ্গে সরকারি সহায়তা নিয়ে নির্বাচন করতে হয়। নির্বাচন করার
জন্য ইসিকে সরকার প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে সাংবিধানিকভাবে বাধ্য।
তবে
নির্বাচন কমিশনকে কেবল নির্বাচন করলেই হবে না। সে নির্বাচন যাতে
অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য ও সন্ত্রাস-দুর্নীতিমুক্ত হয়, সে লক্ষ্যে কাজ
করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের বিভিন্ন নির্বাচন কমিশনের কার্যাবলী পর্যালোচনা
করে দেখা যায় যে, খুব কম কমিশনই নির্বাচন পরিচালনায় নিরপেক্ষ রেফারির
ভূমিকা পালন করতে পেরেছে। যেহেতু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন গঠনের
জন্য কোনো আইন তৈরি করা হয়নি, সে কারণে ক্ষমতাসীন সরকার এমন
ব্যক্তিত্বদেরকেই কমিশনে সিইসি বা কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেন, যাদেরকে
প্রভাবিত করে নির্বাচনে কমিশনের কাছ থেকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা সম্ভব।
এই নিয়োগের সময় অনুসন্ধান কমিটির আশ্রয় নেয়া হলেও সরকার কমিশনে নিয়োগ দেয়ার
ক্ষেত্রে নির্বাচিতদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও পেশাদারিত্বকে গুরুত্ব দেয় বলে
প্রতীয়মান হয় না। নির্বাচনের মাঠে রাজনৈতিক দলগুলো প্রধান খেলোয়াড়। কারণ,
নির্বাচন তো করে রাজনৈতিক দলগুলোই। এরাই ভোটে প্রার্থী দেয়। দলীয়
প্রার্থীরাই জনগণের কাছে ভোট চান। তারা নির্বাচনী প্রচারণা করেন। তারাই
নির্বাচনে জেতেন, হারেন, সরকার গঠন করেন এবং সরকারদলীয় বা বিরোধীদলীয় এমপি
হন। এরাই সংসদে প্রাণবন্ত আলোচনা করে গণতান্ত্রিকভাবে দেশ পরিচালনা করেন।
কাজেই নির্বাচন কমিশনের প্রধান ক্লায়েন্ট হল রাজনৈতিক দলগুলো। কমিশন
প্রয়োজনে বারবার দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে পারে। কীভাবে ভালো
নির্বাচন করা যায় সে সম্পর্কে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারে। অথচ বর্তমান
কমিশন শুরু থেকেই দলগুলোকে প্রত্যাশিত গুরুত্ব দিচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয় না।
কারণ, গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে দায়িত্বে এসে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে
আলাপ-আলোচনা করার আগে কমিশন বিদেশি রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক
করেছে। কমিশন কি ভুলে গিয়েছিল যে বিদেশি রাষ্ট্রদূতগণ নির্বাচনের
পর্যবেক্ষক? স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আলোচনায় তারা কোনো পক্ষ নয়। এ
রকম আলোচনায় প্রথমেই প্রাধান্য পাওয়া উচিত ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর। অথচ গত
বছর ৩০ মে, সিইসি মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের সঙ্গে বৈঠক
করেছিলেন।
‘উভয় পক্ষ’ ষষ্ঠ বা দশম সংসদ নির্বাচনের মতো নির্বাচন না করতে
মতামত ব্যক্ত করে ‘ইনক্লুসিভ’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে একমত পোষণ
করেন। এ বৈঠকের পর ওই সময়ের ইসি সচিব মো. আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা দু’পক্ষই
একমত হয়েছি যে, ১৫ ফেব্র“য়ারি ও ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন আর নয়। আর যেন এ
রকম না হয়, সে জন্যই সবার চেষ্টা থাকবে’ (যুগান্তর : ৩১-৫-১৭)। ইসি সচিবের এ
বক্তব্য বিশ্লেষণ করে বলা যায়, ইসি ভালো নির্বাচন করার জন্য দেশের
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করার আগেই মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে একটি ’পক্ষ’
বিবেচনা করেছে। নির্বাচনের মূল খেলোয়াড় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করার
আগেই একটি বিদেশি রাষ্ট্রদূতকে ইসির এ ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া নির্বাচন
বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজের কাছে একেবারেই দৃষ্টিশোভন হয়নি। সংসদ নির্বাচনের
রোডম্যাপ তৈরি করার সময়ও ইসি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো পরামর্শ করেনি।
স্থানীয় সরকারের যে নির্বাচনগুলো করেছে, সেখানেও কমিশন পূর্ণ পেশাদারিত্ব
প্রমাণ করতে পারেনি। যেমন, ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ কুসিক নির্বাচনে কমিশনের
ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। নাগরিক সমাজ এ নির্বাচনটিকে দুই বড় দলের জনপ্রিয়তা
যাচাই এবং ইসির পেশাদারিত্বের পরিমাপক বিবেচনা করে নির্বাচনটিকে আগ্রহ
নিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছিল। ওই নির্বাচনের প্রচারণার সময়গুলো ভালোভাবে কাটলেও
নির্বাচনের দিন ইসির পেশাদারিত্ব ভেঙে পড়েছিল। নির্বাচনের দিন সকালে
উল্লেখযোগ্য অনিয়ম চোখে না পড়লেও দুপুরের পর শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ ভোট
কেন্দ্রে সরকারদলীয় প্রার্থীর পক্ষে ব্যালট পেপারে সিল মারার ঘটনা ঘটে।
২৯টি ওয়ার্ডের ১০৩টি কেন্দ্রের মধ্যে ৮টি ওয়ার্ডের ২১টি কেন্দ্র
পর্যবেক্ষণকারী ব্রতীর প্রতিবেদনে ৬টি ভোট কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের
প্রার্থীর পক্ষে বেআইনিভাবে সিল মারার ঘটনা উল্লেখিত হয়। অথচ, এর মধ্যে
মাত্র দুটি ভোট কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছিল।এখন সামনে রয়েছে কিছু
উপনির্বাচন এবং কতিপয় বড় সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। এসব নির্বাচনে কমিশন
কতটা ভালো করবে সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। তবে এসব স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং
উপনির্বাচনের চেয়ে নাগরিক সমাজের আগ্রহ বেশি একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে।
দলীয় সরকারের অধীনে সরকার এ সংসদ নির্বাচন করতে চাইছে।
সংসদ নির্বাচন যে
ভালো হবে না সে লক্ষণ ইতিমধ্যে প্রতিভাত হয়েছে। কমিশন জানে লেভেল প্লেয়িং
ফিল্ড তৈরি না করে সংসদ নির্বাচনে ভালো করা যাবে না। কিন্তু সেদিকে ইসির
কোনো আগ্রহ নেই। ইসির সাম্প্রতিক বক্তব্য-বিবৃতি শুনে মনে হচ্ছে, ৫ বছরের
মধ্যে ৪ বছর ১১ মাস নির্বাচনের মাঠে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকল কিনা সে
বিষয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। কেবল নির্বাচনী সিডিউল ঘোষণা করার পর
আনুষ্ঠানিকভাবে যখন দলগুলো নির্বাচনী প্রচারণায় নামবে, তখন তারা সক্রিয়
হবে। এ কেমন কথা? একটা দলের প্রধান নেতা ৪ বছর ১১ মাস নাগরিক সমাজের টাকায়
সরকারি যানবাহন ও প্রটোকল ব্যবহার করে নির্বাচনী জনসভা করে নিজ দলীয়
মার্কায় ভোট চাইবেন, আর অন্য দলগুলো নির্বাচনী জনসভা করতে সমান
সুযোগ-সুবিধা পাবে কেবল কয়েক সপ্তাহের জন্য নির্বাচনী সিডিউল ঘোষণার পর?
তাহলে কীভাবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রতিষ্ঠিত হবে? এক দলের নেতাকর্মীরা হয়
জেলে থাকবেন, না হয় মামলা-মোকদ্দমা মোকাবেলা করার জন্য কোর্টের বারান্দায়
সময় কাটাবেন; আর অন্য এক দলের নেতা-কর্মীগণ সরকারি প্রটোকল ব্যবহার করে বড়
বড় জনসভা করে দলীয় প্রতীকে ভোট চাইলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হবে? এ
ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হয়ে ইসি সচিব হেলালউদ্দীন আহমদ বলেন, নির্বাচনী সিডিউল
ঘোষণা করার পর সবকিছু দেখভালের দায়িত্ব ইসির। ইসি যদি এমন সুরে কথা বলে,
তাহলে তো সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের সোনায় সোহাগা। সরকারদলীয় সাধারণ
সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সেজন্য সাংবাদিকদের বলে দিয়েছেন, ‘সরকারি সভা করে
প্রধানমন্ত্রীর নৌকায় ভোট চাওয়ায় আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।’ এভাবে সরকারি
দলকে ৪ বছর ১১ মাস জনগণের টাকায় সরকারি প্রটোকল ব্যবহার করে নির্বাচনী
প্রচারণা করতে দিয়ে অন্য দলগুলোকে নির্বাচনী সিডিউল ঘোষণা করার পর মাত্র
২০-২৫ দিন আনুষ্ঠানিক প্রচারণা করার সুযোগ দিয়ে ইসি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড
তৈরি করেছে দাবি করলে সে দাবির যৌক্তিকতা নির্বাচন গবেষক ও নির্বাচনী
পর্যবেক্ষদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে কি?
ইতিমধ্যে সরকারি দল বড় শহরগুলোতে
নির্বাচনী জনসভা শুরু করেছে। সরকারপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ
হাসিনা এসব সভায় শত শত উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করে জনগণের মন জয়ের চেষ্টা
করে নৌকায় ভোট চাইছেন। যেমন- ৩ মার্চ খুলনার জনসভায় তিনি ১০০টি উন্নয়ন
প্রকল্প উদ্বোধন/ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে নৌকায় ভোট চেয়েছেন। এসব জনসভায়
সরকারপ্রধান যদি দলীয় আয়োজনে দলীয় যানবাহন ও প্রটোকল ব্যবহার করে আসতেন,
তাহলেও কথা ছিল। কিন্তু তিনি গিয়েছেন সরকারি প্রটোকলে, জনগণের টাকায়। এ
প্রসঙ্গে মাঠের প্রধান বিরোধী দল কমিশনে লিখিত অভিযোগ করলে ইসি সচিব ১
মার্চ নির্বাচন ভবনে আইন-শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ
প্রশ্নের যে জবাব দেন, বিবেকবান নাগরিক সমাজ তা মেনে নেবে না। ইসি সচিব
বলেন, ‘আইন অনুসরণ করে বিএনপির চিঠি নিষ্পত্তি করতে ইসিতে আলোচনা হয়েছে।
আইনে বলা আছে, তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনসংক্রান্ত সবকিছু দেখভালের
দায়িত্ব ইসির ওপর বর্তায়।’ এ কেমন আইন? এ কেমন বক্তব্য? নির্বাচনের সিডিউল
ঘোষণার আগের ৪ বছর ১১ মাস সরকারি দলকে কোনো আইন যদি জনগণের টাকায় সরকারি
প্রটোকল ব্যবহার করে দলীয় নির্বাচনী প্রচারণার সুযোগ দেয়, তাহলে একটি
স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইসি কি সে আইন পরিবর্তনের ক্ষমতা
রাখে না? সরকারি দলের একতরফা নির্বাচনী প্রচারণার সুযোগ অব্যাহত থাকলে
একাদশ সংসদ নির্বাচনে যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রতিষ্ঠা করা যাবে না, তা
এখনই বলে দেয়া যায়। এরকম প্রচারণা সংসদ নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচন
এবং ৫টি বড় সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের ওপর
নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। উল্লেখ্য, বর্তমান নির্বাচন কমিশন যেভাবে এবং যে
প্রক্রিয়ায় নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছে তাতে এ কমিশনের ওপর রাজনৈতিক দল ও নাগরিক
সমাজের আস্থা গড়ে ওঠেনি। সেজন্য কমিশন যখন গত বছর জুলাইয়ে রাজধানীর সুশীল
সমাজের সঙ্গে এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময়
করেছিল, তখন সুশীল সমাজ সদস্যদের অনেকেই এবং প্রায় সব রাজনৈতিক দলই কমিশনকে
নাগরিক সমাজের আস্থা অর্জনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। সে জন্য কমিশনের ওই
পরামর্শটি মাথায় রেখে সততা, দক্ষতা, নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ
করা দরকার। কমিশন ইতিমধ্যে কিছু স্থানীয় সরকার নির্বাচন করেছে। ওই
নির্বাচনগুলোর ভালো-মন্দ দেখে কমিশনকে প্রশংসা বা সমালোচনা করা যাবে না।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা এবং সব
দলের প্রতি সমান আচরণ করার মধ্য দিয়ে কমিশনকে বিরোধী দলের আস্থা অর্জন করতে
হবে। ইনক্লুসিভ নির্বাচন দেখতে আগ্রহী নাগরিক সমাজ চায় কমিশন এখন থেকেই এ
ব্যাপারে সক্রিয় হোক। সব দলের জন্য সংসদ নির্বাচনে সমান প্রচারণার সুযোগ
সৃষ্টির জন্য যা করা প্রয়োজন এবং তা করতে যদি বারবার আরপিও সংশোধন করতে হয়,
কমিশনকে ইনক্লুসিভ নির্বাচন করার স্বার্থে তা-ই করতে হবে।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
akhtermy@gmail.com
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
akhtermy@gmail.com
No comments