ত্রিপুরা নির্বাচনে বিজেপির জয়লাভ ও উত্থানের তাৎপর্য by গৌতম দাস
সম্প্রতি
ভারতের ত্রিপুরায় প্রাদেশিক রাজ্য বা বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে
গেল। আর তাতে ২০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা কমিউনিস্ট সিপিএম জোট সরকারের পতন
ঘটেছে খুবই শোচনীয়ভাবে। এর চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো মোদির
হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার সেখানে একাই সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা
লাভ করেছে। বিগত ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিজেপির যেখানে কোনো দলীয় অস্তিত্বই
ছিল না, সেখানে এবার বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তনের কারণ কী? এটা
কি হিন্দুত্ববাদী দল বলে নাকি অন্য কিছু? ত্রিপুরা বাংলাদেশের খুব দূরের
নয়।
অতীত জন্ম হিসেবে এটি আসলে ব্রিটিশ-ভারতের কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত এক
ছোট তবে মূলত করদরাজ্যের রাজার এলাকা। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান জন্ম নেয়ার পর
কুমিল্লা জেলা বাংলাদেশের মানে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে আসে আর এর বাইরের
একাংশ আর ত্রিপুরার রাজার রাজ্য এলাকা ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত অমীমাংসিত থেকে
যায়, যা পরে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজার রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটিয়ে ভারতে যোগদান
করে। তবে ত্রিপুরা রাজ্যসহ বাকি অংশ তখন ভারতেরও কোনো আলাদা রাজ্যের
মর্যাদা পায়নি, একটা কেন্দ্রীয় সরকারের শাসনাধীন এলাকার (ইউনিয়ন টেরিটরি)
মর্যাদায় থেকে গিয়েছিল। পরে ১৯৭২ সালে ত্রিপুরা, মেঘালয় আর নাগাল্যান্ড- এ
তিনটি নতুন রাজ্যের জন্ম হয়। ত্রিপুরা ভারতের ২৯ রাজ্যের একটি রাজ্য, খুবই
ছোট আর ভারতের ছোট রাজ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিচের দিক থেকে তৃতীয়- গোয়া আর
সিকিমের চেয়ে ওপরে। তুলনা করে বোঝার জন্য যেমন- ত্রিপুরার আয়তন ৪০৫০
বর্গমাইল, যেখানে বাংলাদেশের ৫৬০০০ বর্গমাইল। ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যা মাত্র
৩৬ লাখ। এর মধ্যে আবার ১৯০১ সালের আদমশুমারি অনুসারে ৫৩ শতাংশ ছিল পাহাড়ি
আদিবাসী, ভারতের ভাষায় ইন্ডেজিনিয়াস, ট্রাইবাল বা আদিবাসী। অনেকে হিন্দিতে
জনজাতিও বলে। আমাদের পাহাড়িদের ভারতীয় অপর অংশের মতো ত্রিপুরায় তাদের
বসবাস। যদিও স্থানীয় হিন্দু বাঙালিদের সাথে তাদের কালচারাল নৈকট্য
বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। বলা হয়ে থাকে, দেশভাগে পাকিস্তান মানে পূর্ব
পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্রের অংশ হওয়ায় পুরো উত্তর-পূর্ব ভারত, যা পরে সাত
ছোট রাজ্য হিসেবে ঢেলে সাজানো হয়েছে, এদের মূল সঙ্কট শুরু হয়। প্রথম সঙ্কট
হলো উত্তর-পূর্ব ভারতের এরা ভারতের অপর বা মূল অংশ থেকে প্রায় পুরোটাই
আলাদা হয়ে যায়। অর্থাৎ বাংলাদেশের দিক থেকে দেখলে আমাদের পশ্চিমে পশ্চিম
বাংলাসহ মূল ভারত অবস্থিত, অথচ বাংলাদেশের পূর্বে ও উত্তরেও ভারত আছে,
যেটাকে আমরা সাত ভাইয়ের উত্তর-পূর্ব ভারত বলছি। কুমিল্লা-ফেনী জেলারই
লাগোয়া অপর পার হলো ত্রিপুরা। অথচ ত্রিপুরা থেকে কলকাতা যেতে হলে তাকে
উজানে আরো উত্তরে গিয়ে এরপর উত্তরাঞ্চল আসাম ঘুরে শিলিগুড়ি দিয়ে কলকাতা
যেতে হবে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে আগে সরাসরি ত্রিপুরা-কলকাতার সড়ক দূরত্ব
ছিল প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। সেটা এখন হয়েছে ১৭০০ কিলোমিটার। এমনিতেই পাহাড়ি
অঞ্চল বলে উত্তর-পূর্ব ভারতের যোগাযোগ অবকাঠামো দুর্বল। এর ওপর ভৌগোলিকভাবে
বাংলাদেশের অবস্থান মাঝখানে পড়ায় উত্তর-পূর্ব ভারতের যোগাযোগ অবকাঠামো আরো
দুর্বল হয়ে গেছে সেই ১৯৪৭ সাল থেকেই।
আর তাদের দ্বিতীয় সঙ্কট হিসেবে
ভারতীয় বক্তব্য হলো, বাংলাদেশ থেকে ১৯৪৭ সালে এবং ১৯৭১ সালে বিপুল জনগোষ্ঠী
ত্রিপুরায় বসবাস শুরু করেছিল। ২০০৭ সালে ভারতীয় পার্লামেন্টে ত্রিপুরাকে
নিয়ে যে সার্ভে রিপোর্ট পেশ করা হয়েছিল, সেই দলিল অনুসারে ত্রিপুরায় ১৯০১
সালে ট্রাইবাল জনসংখ্যা আগে ছিল ৫৩ শতাংশ, যেটা এখন হয়েছে ৩১ শতাংশ। কিন্তু
আসামের মতো সত্যি-মিথ্যা যুক্তিতে এখানে কিন্তু মুসলমান ‘বাঙালি খেদাও’
ইস্যু হয়নি। কারণ, সবাই দেখছে মাইগ্রেটেডরা হিন্দু বাঙালি, তাই চেপে গেছে।
তবু বাঙালি-পাহাড়ি টেনশন হিসেবে তা হাজির হয়ে উঠেছিল। এর মূলকথা ত্রিপুরার
সংখ্যাগরিষ্ঠ ট্রাইবালরা, হিন্দু বাঙালির মাইগ্রেশনের কারণে সংখ্যালঘু ৩০
শতাংশ হয়ে যাওয়া। ফলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ব্যাপকতাও দেখা দিয়েছিল;
কিন্তু দুটো ঘটনায় তা সামলানো যায়। এক. ১৯৭২ সালে ত্রিপুরাকে রাজ্য করার
সময় এর প্রাদেশিক সংসদ ও সরকার ছিল ৬০ আসনের। ওই ৬০ আসন থেকে (এক-তৃতীয়াংশ)
মানে ২০টি আসন ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষিত করে দেয়া হয়। ফলে এক
ধরনের স্বায়ত্তশাসনের অবস্থা তৈরি হয় এতে। অপর বড় ঘটনা হলো পাহাড়ি বা তাদের
ভাষায় আদিবাসী (ট্রাইবাল) আন্দোলনের নেতা ছিলেন দশরথ দেব। বিগত ১৯৪৮-৫০
সাল থেকেই তৎকালীন ত্রিপুরা রাজার বিরুদ্ধে তিনি গণমুক্তি পরিষদ নামে
সশস্ত্র আন্দোলনের মূল নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। পরে ১৯৫০ সালে তিনি
কমিউনিস্ট সিপিএম দলে যোগ দেন। এতে সেই থেকে তিনি হয়ে যান ত্রিপুরায়
কমিউনিস্টদের বিপুল শক্তি-সামর্থ্যরে উৎস। যিনি একই সাথে ট্রাইবাল ও
কমিউনিস্ট নেতা। শুধু তাই নয়, তিনি একই সাথে হয়ে যান ট্রাইবাল ও হিন্দু
বাঙালির সমঝোতা করে খাড়া করা এক রাজনৈতিক ঐক্যের প্রতীক। এ কারণে ১৯৯৮ সালে
তার স্বাভাবিক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী ও মূল নেতা;
কিন্তু ধীরে ধীরে অন্যান্য পাহাড়ি রাজনৈতিক দলও গঠিত হতে থাকে মূলত
অবকাঠামোগত বিনিয়োগ না হওয়ায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর পরিচয় পায় তারা- এ
কারণে। এ ছাড়া ট্রাইবাল নাগরিকেরা অভাবে জমি ধরে রাখতে না পেরে এবার তা
বাঙালির কাছে বিক্রি করাতে এটাকে বাঙালিদের অনুপ্রবেশ হিসেবে ব্যাখ্যা করার
আদিবাসী ইস্যু তৈরি হয়েছে। সব মিলিয়ে এখন ট্রাইবাল রাজনৈতিক দল প্রায়
১১টা।
ফলে ত্রিপুরা ল্যান্ড নামে নতুন রাজ্য গঠন করতে হবে, সেটাও তাদের
দাবি। এ পটভূমিতে এবার ত্রিপুরার নির্বাচন হয়েছে। এক কথায় বললে ‘ট্রাইবাল
জনগোষ্ঠী বনাম হিন্দু বাঙালি’ এই টেনশন রেষারেষি ত্রিপুরাতে যে আছে, বিজেপি
এই দ্বন্দ্বে ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীর ক্ষোভগুলোকে উসকে বা উচ্চকিত অ্যাড্রেস
করে ট্রাইবাল রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আঁতাত ও নির্বাচনী জোট করে আগানোর
সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো, বিজেপির সরকার হিসেবে মাইগ্রেশন
ইস্যুতে তাদের অবস্থান ঠিক এর উল্টো। ২০১৬ সালে তারা একটা বিল এনেছিল
যেখানে মূল বিষয় হলো, এই বিলে তিনটি দেশ আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান
থেকে যারা ভারতে মাইগ্রেট করেছে বা করছে- এদের মধ্যে মুসলমান ছাড়া ছয়
ধর্মের মানুষকে স্বাগত জানানো হবে। সেই ছয় ধর্ম হলো- হিন্দু, শিখ,
বুদ্ধিস্ট, জৈন, পার্সি ও ক্রিশ্চান। এদেরকে আর অবৈধ নাগরিক বলা হবে না।
তাদেরকে প্রধান দ্রুত ধারার (ফাস্ট ট্র্যাকে) উপায়ে নাগরিকত্ব দেয়া হবে।
এখন এই বিল পাস হওয়া মানে আসাম বা ত্রিপুরার বাঙালি হিন্দুরা নাগরিকত্ব
পেয়ে যাবে, যেটা আসলে স্থানীয় ট্রাইবাল রাজনীতির প্রধান আপত্তির ইস্যু।
অন্য দিকের মূল বিষয় হলো, এ আইনটি একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে
যে, মোদি সরকার ইসলামবিদ্বেষী। কেউ মুসলমান হলে তার প্রতি বৈষম্য করা হবে
কেন, এর কোনো ব্যাখ্যা মোদি কোথাও দেননি। কনস্টিটিউশন অনুসারে, সেটি কোনো
সরকার করতে পারে না। এই নির্বাচনে মোদির বিজেপি যাদেরকে বলা হচ্ছে; যারা
ত্রিপুরার ৬০ আসনের নির্বাচনে জেতার জন্য দলের পক্ষে কাজ করেছেন, এরা কারা?
এর প্রথম বড় চাঙ্ক হলো ‘ইন্ডেজেনিয়াস পিপলস ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা (IPFT)’
স্থানীয় ট্রাইবাল এ দলটি। বিজেপি উত্তর-পূর্ব ভারতের এ রকম ১১টি দলের সাথে
মিলে জোটে আবদ্ধ হয়েছে, যে জোটের নাম The North East Regional Parties
Forum। ত্রিপুরা নির্বাচনে IPFT দলকে ৯টি আসন ছেড়ে দিয়ে বিজেপি নিজের নামে
৫১ আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। আসলে মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের কমিউনিস্ট জোট
ছাড়া বাকি ত্রিপুরার সব দলের গুরুত্বপূর্ণ লোকেরা গত পাঁচ বছরের বিভিন্ন
সময়ে এসে বিজেপিতে যোগদান করেছেন। মোটা দাগে বললে এমন যোগদানের মূল
ট্রাকরুট হলো এ রকম যে, যারা কংগ্রেস করতেন সেখান থেকে; এরাই কমিউনিস্টদের
প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। এরপর সেখান থেকে তারা চলে যায় তৃণমূল কংগ্রেস
দলে। আর শেষ তৃণমূল থেকে বিজেপি। এভাবেই বিজেপি ৫৯ আসনের (একজন কমিউনিস্ট
প্রার্থী মারা যাওয়ায় ওই আসনে নির্বাচন স্থগিত) মধ্যে ৪৩ আসনে জয়লাভ করে।
আর ওই ৪৩ আসনের মধ্যে IPFT-এর জেতা আট আসন আছে। এ দিকে ফলাফল ঘোষণার পর
থেকেই IPFT বিজেপির সাথে গোপন কথাবার্তা সামনে নিয়ে এসেছে। তারা ‘ত্রিপুরা
ল্যান্ড’ নামে নতুন রাজ্য ও স্বায়ত্তশাসনের দাবি এখন তুলছে, যেটা
নির্বাচনের সময় একেবারেই কথাও তোলেনি। বলছে বিজেপি এটা জানে, তারা কেবল
ফলাফলের পরে এই দাবি তুলতে বলেছে। এমনিতেই উত্তর-পূর্ব এই ভারতের সাত ছোট
রাজ্য সবার প্রধান সমস্যা যোগাযোগব্যবস্থা আর দুর্বল অবকাঠামো বিনিয়োগ;
কিন্তু এ থেকে তৈরি হওয়া অসন্তোষগুলোর সারকথা বা প্রধান প্রকাশ হলো
বিচ্ছিন্নতাবাদ। যেন বিচ্ছিন্নতা বা স্বাধীন রাষ্ট্র তাদের অবকাঠামো বা
বিনিয়োগের সমস্যা মিটিয়ে দেবে। তবুও এ রাজনীতিই সেখানে চলছে। এ পরিস্থিতিতে
বিজেপি সেখানে নিয়ে গিয়েছে এক মাত্রা, একেবারেই সম্পর্কহীন নতুন মাত্রা,
এই নতুন মাত্রা হলো ‘হিন্দুত্ব’। মোদি যেন বলতে চাচ্ছে, হিন্দুত্বের
ভিত্তিতে সবাই জোট বাঁধতে হবে, আর তাতেই সব সমস্যার সমাধান। ফলে এই চরম
ইসলামবিদ্বেষ দেখার অপেক্ষায় আমাদের থাকতে হবে। যার প্রথম টাইম ফ্রেম হলো
আগামী জুনের শেষে আর অন্যটা ২০১৯ সালের মে মাস। প্রথমটা আসামের, কারা
আসামের নাগরিক নয় মানে তাদের ভাষায় বাংলাদেশী মুসলমান, সেই তালিকা তৈরি
চলছে আদালতের নির্দেশে, যার প্রকাশের শেষ দিন ৩০ জুন। আর দ্বিতীয়টি হলো
ভারতের কেন্দ্রীয় নির্বাচন, যা ২০১৯ সালের মে মাসের মধ্যে শেষ হবে।
স্বভাবতই তাতে মোদির একমাত্র বয়ান হবে মুসলিমবিদ্বেষ। কারণ, তার অর্থনীতির
বিকাশ ও উন্নয়ন ইতোমধ্যেই ফেল করেছে।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
No comments