অলিম্পিক গেম ও দুই কোরিয়ার সম্পর্ক by মোহাম্মদ জমির
দক্ষিণ
কোরিয়ার পিয়ংচ্যাংয়ে অনুষ্ঠিত শীতকালীন অলিম্পিক-২০১৮-এ উত্তর কোরিয়ার
অংশগ্রহণে বিশ্বের প্রতিক্রিয়া খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। কেউ বিচিত্রময় খেলার
আয়োজনে চোখ রেখেছেন আবার কেউ উত্তর কোরিয়ার প্রশাসনের জনসংযোগে
ভারসাম্যপূর্ণ তৎপরতাকে সতর্কভাবে বিশ্নেষণ করেছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার
গাংনেয়াং থেকে সিএনএনের সাংবাদিক এমি লুইস দেখিয়েছেন, ঐক্যবদ্ধ কোরিয়ার
অংশগ্রহণে হকি দল এটা প্রমাণ করেছে যে, 'জেতাই সবকিছু নয়।' এটা বলা
প্রয়োজন, এবার অলিম্পিকে দুই কোরিয়ার ঐক্যবদ্ধ হকি দলের সূচনা হয়েছে।
কিন্তু তাদের হার বিশ্বের কাছে এ বার্তা দিয়েছে যে, জয় সর্বদা সবকিছু নয়
কিংবা সব শেষও নয়। দুই কোরিয়ার ঐক্যবদ্ধ এ নারী দলের পুনর্মিলনের একটি
উপলক্ষ হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সব প্রজন্মের মানুষ উচ্ছ্বসিত হয়ে ঐক্যবদ্ধ
কোরীয় উপদ্বীপের পতাকা নাড়িয়েছে। এক বছর আগেও পিয়ংইয়ংয়ের ক্ষেপণাস্ত্র
হামলাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট শত্রুতার পর আবার এই অলিম্পিক কোরীয় উপদ্বীপের
দুই দেশকে আলোচনার টেবিলে এনেছে। কেউ কেউ অবশ্য ২০১৭ সালের শুরুতে এ রকম
পরিবর্তনের ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। এই ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সূচনা
করেছিলেন উত্তর কোরিয়ার আলঙ্কারিক রাষ্ট্রপ্রধান কিম ইয়ং ন্যাম ও উত্তর
কোরিয়ার শীর্ষ নেতা কিম জং উনের ছোট বোন কিম ইয়ো জং। ১৯৫০-৫৩ সালের কোরীয়
যুদ্ধের পর পিয়ংইয়ংয়ের শাসকগোষ্ঠীর কোনো সদস্যের এটাই ছিল প্রথম দক্ষিণ
কোরিয়া সফর। যা হোক, কোরিয়ার হকি দল সুইজারল্যান্ডের কাছে হারার পর ম্যাচ
শেষে কোরিয়ানরা ঐক্যবদ্ধ দল হিসেবে পরস্পরের সঙ্গে ভাববিনিময় করেছে এবং
একত্রে ছবি তুলেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার অনেকেই সংবাদমাধ্যমের কাছে বলেছে- তারা
আশা করেছিল, ঐক্যবদ্ধ দল দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার সম্পর্কে আরও
উন্নয়ন ঘটবে। তারা একে আশা ও শান্তির বার্তা হিসেবে বিবেচনা করে। এই
প্রচেষ্টা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে জনহপকিন্স ইউনিভার্সিটির
মার্কিন-কোরীয় ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং স্কলার মিচেল ম্যাডেন বলেন, দুই
কোরিয়ার ঐক্যবদ্ধ হকি দল কোনো পদক জিততে না পারলেও তারা একটি ভালো প্রচার
পেয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, এ জন্য উত্তর কোরিয়া কোনো অর্থ পাচ্ছে না। এমনকি
তারা যদি কোনো জয়ও না পায়, তাতে ব্যথিত হওয়ার কিছু নেই। আর উত্তর কোরিয়া
কখনোই তাদের হকির ক্ষেত্রে খুব শক্তিশালী দল মনে করে না। সেখানে হয়তো
হাড্ডাহাড্ডি খেলা হয়নি; তবে খেলায় অংশ নিয়েই তারা খুশি। তিনি আশান্বিত এ
কারণে যে, এটি অনেক নেতিবাচক ধারণা ও চিন্তার অবসান ঘটাতে যাচ্ছে। সিএনএনের
সাংবাদিক জ্যামি তারাবে স্মরণ করছেন, ১৯৮৮ সালে যখন দক্ষিণ কোরিয়া
অলিম্পিকের আয়োজন করে, তখন তারা চায় উত্তর কোরিয়া যাতে অংশ নেয়। পিয়ংইয়ং
তখন সেখানে অংশগ্রহণে অস্বীকার করে এবং আন্তর্জাতিকভাবে তা বয়কটের ঘোষণা
দেয়। তারা সফল হয়নি। কারণ তখন খেলাটির পৃষ্ঠপোষক ছিল কমিউনিস্ট চীনের
বেইজিং ও রাশিয়ার মস্কো। অন্যদিকে ১৯৮৯ সালে উত্তর কোরিয়া কয়েক বিলিয়ন ডলার
খরচ করে সেখানে একটি বিশ্ব তরুণ সম্মেলনের আয়োজন করে তাদের ক্ষমতা
প্রদর্শনের জন্য। সেখানে ১৭০টিরও অধিক দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে
সপ্তাহব্যাপী সেমিনার, প্রতিযোগিতা ও সঙ্গীত আসরের আয়োজন হয়। তারা ১০৫
তলাবিশিষ্ট হোটেল, মার্বেল পাথরের পাতাল রেল, ফ্রান্সের আর্ক দ্য
ট্রিয়েমফের আদলে একটি স্মৃতিসৌধ এবং দেড় লাখ দর্শকের আসনবিশিষ্ট একটি
স্টেডিয়াম নির্মাণ করে। বিদেশিদের জন্য তখন এক হাজার অত্যাধুনিক গাড়ি
আমদানি করা হয়। এতে উত্তর কোরিয়ার কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতিই হয়নি বরং তাতে সে
রকম সাফল্য অর্জিত না হওয়ায় বিষয়টি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আলোচনার জন্ম
দেয়। এটা বলা প্রয়োজন যে, পিয়ংইয়ংয়ের ১০৫ তলা রিউগইয়ং হোটেলের কাজ শুরু হয়
১৯৮৭ সালে; কিন্তু আজও হোটেলটির কাজ শেষ হয়নি। যা হোক, এ সময় উত্তর কোরিয়া এ
শিক্ষা পেয়েছে যে, অর্থই সবকিছু নয়। এখন আমরা দেখছি, দক্ষিণ কোরিয়ার তরফ
থেকে ইতিবাচক পরিবর্তন। তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-জাপানসহ অন্যরা নড়েচড়ে
বসেছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রশাসন ও দেশটির প্রেসিডেন্টের উদ্যোগকে উত্তর
কোরিয়া ইতিবাচকভাবেই নিয়েছে। এর মাধ্যমে দেশটি দুই দেশের সম্পর্ক আরও এগিয়ে
নিতে চায়। স্মরণ করা যেতে পারে- দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জা-ইন তার
নির্বাচনী প্রচারের সময় বলেছিলেন, তিনি নির্বাচিত হলে দুই কোরিয়ার
শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করবেন। ফলে তার
সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের বোন কিম ইয়ং জংয়ের সাক্ষাৎ খুব একটা
চমকপ্রদ ঘটনা নয়। বোনের মাধ্যমে মুন জা-ইনকে উত্তর কোরিয়া সফরে আনুষ্ঠানিক
আমন্ত্রণপত্র দেন দেশটির নেতা কিম জং উন। ২০০৭ সালে কিম জং উনের পিতা কিম
জং ইলের সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট রো মু হিউনের সাক্ষাতের পর একে
বলা হয় কোরীয় উপদ্বীপের প্রথম ও ঘটনাবহুল সম্মেলন। এ রকম একটি প্রতীক্ষিত
সফরকে কোরিয়ার বিশ্নেষকরা মুনের জন্য কূটনৈতিক ক্যু হিসেবে ব্যাখ্যা
করেছেন। যে সফর তার রক্ষণশীল পূর্বপুরুষদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে উত্তর
কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। এমনকি এ সম্পর্ক
দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কেও টান পড়বে। এ রকম
প্রেক্ষাপটে উত্তর কোরিয়ার প্রতিনিধি দল যখন উষ্ণ আতিথেয়তা পায় এবং বিষয়টি
যখন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের সামনে সাংবাদিকরা তুলে ধরেন,
তখন সেটি পেন্সের কাছে যেন অস্বস্তির বিষয় ছিল। অবশ্য উত্তর কোরিয়ার
নিমন্ত্রণে মুন জা ইনের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল কিছুটা সতর্ক। তার
কার্যালয়ের তরফ থেকে বলা হয়, দুই দেশের মধ্যে এ ধরনের বৈঠক একটি ভালো ফলই
আনবে। তাতে আরও বলা হয়, উত্তর কোরিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেও বৈঠক
হওয়া প্রয়োজন। এ কথা এটা ইঙ্গিত করে যে, কূটনৈতিক কৌশলের মাধ্যমেই মুন
সামনে এগোতে চান। মুন অবশ্য জোর দিয়ে বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর
কোরিয়ার মধ্যে সংলাপের ব্যাপারে একটা জনমত তৈরি হয়েছে। যে সংলাপ আসলে
পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব গড়তে সহায়ক হবে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে
মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের দপ্তরের প্রতিক্রিয়া জানা যায়
মুখপাত্র অলিসা ফারার মাধ্যমে- 'আমাদের ভাইস প্রেসিডেন্ট দক্ষিণ কোরিয়ার
প্রেসিডেন্ট মুন জা-ইনের প্রতি কৃতজ্ঞ; কারণ মুন বৈশ্বিক অবস্থানের প্রতি
দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন এবং পারমাণবিক অবরোধের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত
করেছেন।' পেন্স আরও বলেছেন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হলো, আমরা
সর্বতোভাবে উত্তর কোরিয়ার প্রতি অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে যাব,
যতক্ষণ না দেশটি তার পারমাণবিক অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি পরিত্যাগ না
করে। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ১০ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকদের
বলেছেন, উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া ও
জাপানের অবস্থান একই। দৃশ্যত এটা বলা যায় যে, উত্তর কোরিয়ার প্রশাসন পুরো
পরিস্থিতি সতর্কতার সঙ্গেই অবলোকন করছে। আর সেটা উত্তর কোরীয় পররাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়ের পরিচালক জো ইয়ং স্যামের কথায় বোঝা যায়। তবে সর্বশেষ পরিস্থিতি
হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও উত্তর কোরিয়ার নেতার মধ্যে একটি
বৈঠকের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,
কিম জং উনের একটি আমন্ত্রণপত্র গ্রহণ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। মে মাস নাগাদ
দু'জনের মধ্যে বৈঠকটি হতে পারে। গোটা পরিস্থিতির আলোকে এ উপসংহার টানা যায়
যে, পারমাণবিক আকাঙ্ক্ষার আক্রমণাত্মক কর্মসূচি বনাম প্রচারণা- এ উভয়ের
মধ্যে অলিম্পিকের খেলা সমান্তরালভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। শীতকালীন অলিম্পিক খেলা
যেহেতু শেষ, সামনে কী হয়, সেটাই দেখার বিষয়।
সাবেক রাষ্ট্রদূত
muhammadzamir0@gmail.com
সাবেক রাষ্ট্রদূত
muhammadzamir0@gmail.com
No comments