লাখো মানুষের ভিটেমাটি কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র
রাজধানীর রামপুরা থেকে খিলক্ষেত পর্যন্ত সড়কের দু’পাশের কয়েক লাখ মানুষের জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত বিভ্রান্তির নিরসন হয়নি এখনও। গত মাসে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হওয়ার কথা থাকলেও রহস্যজনক কারণে সেই সভা স্থগিত করা হয়। এজন্য নেপথ্য থেকে ভূমিকা রেখেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও ঢাকা ডিসি অফিস। দু’জন রাষ্ট্রপতির অধিগ্রহণ অবমুক্ত আদেশের পরও ওই জমি নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত করার ঘটনাকে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র বলে মনে করা হচ্ছে। আর এ কাজে সম্পূর্ণ অন্যায় ও অবৈধভাবে প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রাখছে রাজউক ও ঢাকা ডিসি অফিস- এমন অভিমত ভুক্তভোগীদের। নির্বাচনী আমেজ শুরু হওয়ার পর এমন অবস্থা সরকারের জন্য বুমেরাং হবে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। ভুক্তভোগীদের প্রশ্ন- যেখানে মালিকানাবলে রাজউকের অনুমোদন নিয়ে শত শত ভবন গড়ে উঠেছে সেখানে এত বছর পর প্রশাসনের এমন উদ্যোগ রীতিমতো হাস্যকর। খোদ ভূমি মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, যদি রাজউককে প্রশ্ন করা হয় তাহলে এসব ভবনের নকশা অনুমোদন করল কে? আর দু’জন রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত কী ফেলনা? এছাড়া এসব জমি কত হাতবদল হয়ে বেচাকেনাও হয়েছে। আর এখন তারা আষাঢ়ে গল্পের ফাঁদ পেতেছেন। আসলে এসব প্রশ্নের বিষয়ে তাদের কাছে কোনো জবাব নেই। যে কারণে এ পর্যন্ত বারবার সভার তারিখ পেছানো হয়েছে। তারা বলেন, এতে প্রমাণিত হয়, কোনো পক্ষের দ্বারা মোটিভেটেড হয়ে রাজউক এবং ডিসি অফিস এমন যুক্তিহীন পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রকারান্তরে এভাবে তারা নির্বাচনের বছরে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার হীনচক্রান্ত করছে। এদিকে ২৮ বছর পর উদ্ভট এমন আমলাতান্ত্রিক মারপ্যাঁচ থেকে সুরক্ষা দিতে সংশ্লিষ্ট এলাকার লাখো বাসিন্দা প্রধানমন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। সংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমান সরকার যখন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, সে সময় সরকারকে বিপাকে ফেলতেই নিষ্পত্তিকৃত ইস্যুকে সামনে এনে পরিকল্পিতভাবে জনরোষ সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে প্রশাসনের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা সরকারবিরোধী একটি পক্ষ।
যারা সরকারি দলের সমর্থকের লেবাসে কাজ করছেন সরকারের বিরুদ্ধে। এ এলাকার ভুক্তভোগী বিক্ষুব্ধ লোকজনের অনেকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, প্রশাসনের হাস্যকর ও চরম ভুল সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে তারা পাড়ায় পাড়ায় কমিটি করে একত্রিত হচ্ছেন। সরকার যদি দ্রুত ইতিবাচক কোনো সিদ্ধান্ত না দেয় তাহলে তারা একযোগে রাজপথে নেমে প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হবেন। তাদের সঙ্গে সরকারদলীয় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও অংশ নেবেন। তারা আশা করছেন, কয়েক লাখ লোক এ প্রতিবাদ সমাবেশে যুক্ত হবে। খোঁজখবরে জানা যায়, ২০১৩ সালে ঢাকা জেলা প্রশাসনের ভূমি হুকুমদখল কর্মকর্তা স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে জোয়ার সাহারা, ভাটারা, বাড্ডা, উলন, সুতিখোলা, ভোলা, সামাইর, শাহজাদপুর, খিলক্ষেত, নূরেরচালা, কুড়িল, নয়ানগর, কালাচাঁদপুর, জগন্নাথপুর, নর্দ্দা, কুড়াতলীসহ আশপাশের আরও বেশকিছু মৌজার জমির খাজনা, নামজারি বন্ধ রাখতে সংশ্লিষ্ট এসি ল্যান্ড এবং তহশিল অফিসকে নির্দেশ দেয়া হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, ভূমি মন্ত্রণালয় জারিকৃত ২০০০ সালের ১২ মার্চ ১১৭ নম্বর স্মারকের পরিপত্রে এসব এলাকার জমির খাজনা এবং নামজারির বিষয়ে আপত্তি জানানোয় এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকা ডিসি অফিসের এ আদেশের পর ওইসব এলাকার কয়েক লাখ মানুষ আতঙ্কে দিনাতিপাত করছেন। তাদের আশঙ্কা, প্রশাসনের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা বিএনপি-জামায়াতপন্থীরা সরকারকে বিপাকে ফেলতে এই ষড়যন্ত্রকে আরও ত্বরান্বিত করলে পরিস্থিতি খারাপের দিকে মোড় নেবে। সূত্র মতে, সংশ্লিষ্ট এলাকার জমিগুলো অবমুক্ত করা কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে ১৭ মার্চ যৌথ প্রতিবেদন দিয়েছে রাজউক ও ঢাকার ডিসি অফিস। ওই প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করেছেন রাজউক চেয়ারম্যান এম বজলুল করিম চৌধুরী ও ঢাকার ডিসি মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন। এ কারণে সংক্ষুব্ধরা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এই দুই কর্মকর্তার কোনো দুরভিসন্ধি রয়েছে বলে অভিযোগ করছেন। এলাকাবাসী বলছেন, তাদের কোনো দুরভিসন্ধি না থাকলে নিষ্পত্তিকৃত পুরনো ইস্যুকে কেন তারা সামনে আনলেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, এলএ কেস (ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন) ১৩৮/১৯৬১-৬২, ৯১/১৯৫৭-৫৮ ও ২৩/১৯৬৬-এর কারণে ওই এলাকাবাসীর দুর্দশা শুরু হয়। আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলার লক্ষ্যে এই প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। প্রথম অধিগ্রহণ জমির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৭৬০ একর। ৬৫২ একর চূড়ান্তভাবে অধিগ্রহণ করলেও বাকি জমি ফিরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। জমি অবমুক্ত করে লাখো মানুষের দুর্দশা লাঘব করার জন্য সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদ এবং সাহাবুদ্দীন আহমদ লিখিত নির্দেশও দেন। এরপরও নানা অজুহাতে কিছু সরকারি আমলা এবং ডিসি অফিসের কর্মকর্তা এলাকাবাসীর জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছেন। দুই রাষ্ট্রপতির অর্ডারের পরও কিভাবে সে জমি অধিগ্রহণভুক্ত থাকে, সেই প্রশ্ন ক্ষতিগ্রস্তদের। ভুক্তভোগীরা জানান, ১৯৮৯ সালের দিকে সরকারের অন্যায় সিদ্ধান্তের কারণে অধিগ্রহণকৃত এলাকার মানুষ ফুঁসে উঠেছিল। তারা রাস্তাঘাট বন্ধ করে অধিগ্রহণ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায়। তখন ওই আন্দোলন বন্ধ করতে রাস্তায় পুলিশ নামানো হয়। কিন্তু সর্বস্ব হারানো উত্তেজিত জনতা পুলিশের বাধা অমান্য করে বিক্ষোভ করে। এতে পুলিশের গুলিতে একজন নিহত হওয়াসহ বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হন। এ অবস্থা সামাল দিতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদ ঘটনাস্থলে এসে প্রথমে মৌখিকভাবে সব জমি অবমুক্ত বলে ঘোষণা দেন। পরবর্তী সময়ে তিনি এক আদেশে সেটা কার্যকর করার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় এবং ঢাকা ডিসি অফিসকে নির্দেশ দেন। কিন্তু যথাযথ অফিসিয়াল পদ্ধতি অনুসরণ করে সেটা কার্যকর করা হয়নি। যদিও ওইসব জমিতে ১৯৯১ সাল থেকে ভবন নির্মাণের জন্য ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র ও নকশা অনুমোদন দেয়া শুরু করে রাজউক।
ওই এলাকায় ৫, ৭, ১০, ১৫ তলা পর্যন্ত রাজউক অনুমোদিত ভবন রয়েছে। এসব ভবনের ফ্ল্যাটও অনেকে বিক্রি করেছেন। ভবন নির্মাণসহ অন্যান্য প্রয়োজনে এসব জমি বাবদ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার ব্যাংক লোন রয়েছে। ঢাকার ডিসি অফিস সূত্র মতে, অধিগ্রহণ করা সম্পত্তি সরকারের প্রয়োজন না হওয়ায় ১৯৬৫ সালে তা অবমুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর একটি নোটিশের মাধ্যমে ওই বছরের ১৫ অক্টোবরের মধ্যে উত্তোলিত ক্ষতিপূরণের টাকা ফেরত দেয়ার জন্য তৎকালীন বিশেষ ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা নির্দেশ দেন। নির্দেশ মোতাবেক ভূমি মালিকরা ক্ষতিপূরণের টাকা ফেরত দেন। ১৯৯২ সালে ঢাকা জেলা প্রশাসনও একইভাবে নোটিশ করে ক্ষতিপূরণের টাকা ফেরত নেয়। তবে ওই সময়ে সবাই জমির টাকা পরিশোধ করেনি। রাজউক সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালের ২৭ জানুয়ারি উন্নয়ন কাজ ত্বরান্বিত এবং প্রতিষ্ঠানের নিষ্কণ্টক মালিকানা নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে রাজউক তাদের প্রয়োজনীয় জমির তালিকা প্রকাশ করে ১৩৮ নম্বর এলএ কেসের সব সম্পত্তি ছেড়ে দেয়। সেই তালিকায় স্বাক্ষর করেন রাজউকের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টরা। মূলত রাজউক এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন জমির স্বত্ব আলাদা করার জন্য চূড়ান্তভাবে এ তালিকা প্রস্তত করা হয় বলে রাজউকের একাধিক কর্মকর্তা জানান। এ প্রসঙ্গে ঢাকার ডিসি মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আগামীকাল আন্তঃমন্ত্রণালয়ের একটি সভার আহ্বান করা হয়েছে। সেখানে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি, কর্মকর্তারা থাকবেন। আশাকরি ওই বৈঠকে একটি সুষ্ঠু সমাধান বেরিয়ে আসবে। এ বিষয়ে রাজউক চেয়ারম্যান এম বজলুল করিম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, উত্থাপিত জমির ব্যাপারে রাজউকের কোনো আগ্রহ নেই। এটা সম্পূর্ণভাবে ডিসি অফিস ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার। এক্ষেত্রে ভূমি মন্ত্রণালয় যেই সিদ্ধান্ত নেবে, সেটাই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। তবে রাজউকের জন্য অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে রাজউককেও অন্তর্ভুক্ত করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়।
No comments