বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি মামলার তদন্ত সচল
প্রায় এক বছর বন্ধ থাকার পর বেসিক ব্যাংকে দুর্নীতি মামলার তদন্ত আবারও চাঙ্গা হচ্ছে। ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু ও পরিচালনা পর্ষদ সদস্যদের আসামি করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে তদন্ত বন্ধ রেখেছিল দুদক। তবে নতুন করে মামলার তদন্ত সচল করা হয়েছে। এজাহারভুক্ত ১২৩ আসামির মধ্যে পলাতক ১১২ জন আসামিকে গ্রেফতারের উদ্যোগ নিয়েছে দুদক। সেই সঙ্গে বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টি দুদক নতুন করে ভাবনায় নিয়েছে। অন্যদিকে বেসিক ব্যাংকের তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের অনিয়ম-দুর্নীতির সম্পৃক্ততাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। বেসিক ব্যাংক মামলা তদন্তের অগ্রগতি, মামলার আসামিদের গ্রেফতার ও আবদুল হাই বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল সোমবার যুগান্তরকে বলেন, মামলাগুলোর তদন্ত শেষ করার জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তারা জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, মামলার আসামিদের গ্রেফতারের ক্ষমতা তদন্তকারী কর্মকর্তাদের দেয়া হয়েছে। সেই ক্ষমতাবলে তারা আসামি গ্রেফতারের চেষ্টা করছেন। তিনি আরও বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা অনেক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। বেসিক ব্যাংকের ক্ষেত্রেও সেটা প্রযোজ্য। তদন্তের স্বার্থে বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে কিনা- এমন প্রশ্নে দুদক সচিব বলেন, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে কোনো বাধা নেই। তবে এ বিষয়টি তদন্তকারী কর্মকর্তারা ঠিক করে থাকেন। মামলা তদন্তের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তারা চাইলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন। দুদকের বিদ্যমান আইন ও বিধি অনুযায়ী কোনো মামলা রুজুর পর যে তারিখ তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ হবেন, সেই তারিখ থেকে পরবর্তী ১২০ দিন বা চার মাসের মধ্যে তদন্ত কাজ তাকে শেষ করতে হবে। যদি তিনি তা না পারেন, তবে তার আবেদনের ভিত্তিতে তাকে আরও ৬০ দিন সময় দেয়া হবে। সে হিসাবে ১৮০ দিন বা ৬ মাস সময় পান একজন তদন্তকারী কর্মকর্তা। বেসিক ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের ৫৬টি মামলা হয়েছিল ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে। ওই মাসেই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাও নিয়োগ দেয়া হয়। তারপর কেটে গেছে এক বছর ১০ মাস। কিন্তু তদন্ত শেষ হয়নি কোনো একটি মামলারও। দুদক এখন মনে করছে, অনন্তকাল ধরে মামলার তদন্ত ঝুলিয়ে রাখার সুযোগ নেই। বেসিক ব্যাংক মামলার তদন্তও শেষ করতে হবে। ফলে তদন্ত নিষ্পত্তির অংশ হিসেবে কিছু পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে বেসিক ব্যাংকের তিনটি শাখায় প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে। এর মধ্যে গুলশান শাখায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, শান্তিনগর শাখার ৩৮৭ কোটি, মেইন শাখায় প্রায় ২৪৮ কোটি ও দিলকুশা শাখায় ১৩০ কোটি টাকা অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ শনাক্ত করা হয়। পাশাপাশি বেসিক ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্তে আরও এক হাজার কোটি টাকার জালিয়াতি বেরিয়ে আসে। সব মিলে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে। তবে দুদকের ৫৬ মামলায় আড়াই হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। এসব মামলায় বেসিক ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী ফকরুল ইসলাম, সিইও সাজেদুর রহমান, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সেলিম ও ফজলুস সোবহানসহ ২৭ ব্যাংক কর্মকর্তা, ৮৫ ঋণ গ্রহীতা ও ১১ সার্ভেয়ারসহ ১২৩ জনকে আসামি করা হয়। আসামিদের মধ্যে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুস সোবহান, মো. সেলিম, বেসিক ব্যাংক গুলশান শাখার ম্যানেজার শিপার আহমেদ, সৈয়দপুর নীলফামারী শাখার ম্যানেজার ইকরামুল বারী ও বেসিক ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ের ম্যানেজার জয়নাল আবেদিন চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়।
অন্যদিকে ঋণ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠান ফেন্সী ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী ফায়জুন্নবী চৌধুরী, ফাস্ট অ্যান্ড বেস্ট ট্রেডার্স ইমপেক্সের প্রোপ্রাইটর জাবির হোসাইন, তাহমিনা ডেনিমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইয়াসির আহমেদ খান ও চেয়ারম্যান কামাল জামান মোল্লা ও এমিরাল অটো ব্রিকসের পরিচালক মো. সরোয়ার জাহানকে গ্রেফতার করা হয়। সরোয়ার জাহান ছাড়া গ্রেফতার হওয়া ঋণ গ্রহীতা তিনজন জামিন পেয়েছেন। ১১ সার্ভেয়ারের মধ্যে রূপসা সার্ভেয়ার্সের ম্যানেজিং পার্টনার মো. শাহজাহান আলীকে গ্রেফতার করা হয়। এ ছাড়া তদন্তকালে অপরাধের সম্পৃক্ততা পাওয়ায় ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত দুদকের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন ১৫ জন। এর মধ্যে এজাহারভুক্ত ১১ জন। ৫৬ মামলার এজাহারভুক্ত বাকি ১১২ আসামিকে গ্রেফতারে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে দুদক। সূত্র জানায়, পলাতক আসামিদের গ্রেফতারেও অভিযান শুরু করা হয়েছে। গ্রেফতারের এ তালিকায় বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে আছেন ২২ জন এবং অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ পাওয়া ৮৫ জন ও ব্যাংক ঋণ ছাড় করার আগে যেসব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া হচ্ছে তাদের বিষয়ে ভুয়া সার্ভে রিপোর্ট প্রদানকারী ১০ প্রতিষ্ঠানের ১০ জন কর্মকর্তা। দুদকের ৮ কর্মকর্তা বেসিক ব্যাংক মামলার তদন্ত করছেন। তাদের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, আমরা গ্রেফতারের বাইরে থাকা আসামিদের গ্রেফতারের জোর চেষ্টা শুরু করেছি। এসব আসামি যাতে দেশত্যাগ করতে না পারে, সেজন্য বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে তাদের বিষয়ে তথ্য দেয়া আছে। তবে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, দুদক থেকে আসামিদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার আগেই ৫৬ মামলার অভিন্ন আসামি ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলামসহ অনেক আসামি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। অনেকে দেশে থাকলেও রয়েছেন আত্মগোপনে। এদিকে দুদকের তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে এক কর্মকর্তা জানান, তদন্ত প্রক্রিয়ায় এরই মধ্যে ব্যাংকে রক্ষিত অর্থ আত্মসাৎকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর রেকর্ডপত্র জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাব নম্বর খোলার আবেদনপত্র, নমুনা স্বাক্ষর, গ্রাহক পরিচিতি, প্রতিষ্ঠানের মেমোরেন্ডাম অব আর্টিকেলস, বেসিক ব্যাংকের ঋণ প্রদানকারী শাখা ম্যানেজারকে দেয়া ঋণের আবেদন, ব্রাঞ্চ ক্রেডিট কমিটির সুপারিশ, প্রধান কার্যালয়ে শাখা থেকে পাঠানো ঋণ প্রস্তাব, ঋণের বিপরীতে বন্ধক দেয়া স্থাবর সম্পত্তির মালিকানা স্বত্ব দলিল ও নামজারি পরচা, বন্ধকী সম্পত্তি মূল্যায়ন প্রতিবেদন ও সার্ভে রিপোর্ট, বন্ধকী জমির ঋণ মঞ্জুরিপত্র। এ ছাড়াও ঋণ হিসাব বিবরণী, ঋণ বিতরণের বোর্ড অনুমোদন, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন, ঋণের অর্থ পরিশোধের চেক, ব্যাংক স্টেটমেন্ট, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদান সংক্রান্ত শাখায় রক্ষিত সব প্রমাণপত্র, ঋণ মঞ্জুর সংক্রান্ত ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে রক্ষিত পূর্ণাঙ্গ নথিসহ ঋণের বিষয়ে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, বেসিক ব্যাংকের যাবতীয় ডকুমেন্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শতকরা ৯৫ ভাগ ঋণই পরিচালনা পর্ষদ অবৈধভাবে দিয়েছে। এমন অনেক প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া হয়েছে, ঋণের জন্য তারা আবেদনই করেনি। এসব কারণে পরিচালনা পর্ষদ বা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান বাচ্চু এ ঋণ জালিয়াতির দায় এড়াতে পারেন না।
No comments