বঞ্চিত পৌনে ৯ কোটি ভোটার
আগামী ছয় মাসের মধ্যে ৮ কোটি ৭৭ লাখ ভোটারের স্মার্টকার্ড পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশংকা রয়েছে। কারণ এখন পর্যন্ত এক কোটি ২০ লাখ কার্ড তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে বিতরণ হয়েছে প্রায় ২৩ লাখ। ৯৭ লাখ কার্ড বিতরণ করা সম্ভব হয়নি। ৭ কোটি ৮০ লাখ কার্ড এখনও তৈরিই হয়নি। এরই মধ্যে পার হয়ে গেছে ছয় বছর। এ প্রকল্পের মেয়াদ আছে আর ছয় মাস। এরপর প্রকল্পের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তাই এর আগেই সাত কোটি ৮০ লাখ কার্ড তৈরি এবং আট কোটি ৭৭ লাখ কার্ড বিতরণ করতে হবে। কিন্তু গত ছয় বছর যে গতিতে কাজ হয়েছে আগামীতেও একই হারে চললে ছয় মাস (ডিসেম্বর) নয়, কয়েক বছরেও আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর ইনহ্যান্সিং একসেস টু সার্ভিসেস (আইডিইএ) শীর্ষক প্রকল্পের কাজ শেষ হবে না। দেশের নয় কোটি ভোটারের হাতে স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র (স্মার্টকার্ড) তুলে দিতে প্রকল্প নেয়া হয় ২০১১ সালে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে চলমান এ প্রকল্পের আওতায় আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ৯ কোটি মানুষের হাতে স্মার্টকার্ড তুলে দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু সাত বছরে (মে ’১৭ পর্যন্ত) এ প্রকল্পে ৮৩৩ কোটি ২২ লাখ টাকা খরচ করে ২৩ লাখ নাগরিকের হাতে কার্ড তুলে দেয়া হয়েছে। সাত বছরে কার্ড বিতরণে অগ্রগতি হয়েছে শতকরা হিসাবে মাত্র দুই দশমিক ৫৫ ভাগ। মে পর্যন্ত আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৫০ দশমিক ৯০ শতাংশ। প্রকল্পটির মেয়াদ আছে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত।
এর মধ্যে বাকি ৮ কোটি ৭৭ লাখ স্মার্টকার্ড নাগরিকদের কাছে পৌঁছাতে হবে। ডিসেম্বরের পর মেয়াদ না বাড়ালে প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, প্রকল্প পরিকল্পনার সঙ্গে বাস্তবতার তেমন মিল ছিল না। ফলে তৈরি করা কার্ড বিতরণের সঙ্গে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সমন্বয়ের অভাব ছিল স্পষ্ট। শেষ পর্যন্ত যন্ত্রের অভাবের কারণেই কাজের গতি কমে গেছে। যার প্রভাব পড়েছে পুরো প্রকল্পের ওপর। আইডিইএ প্রকল্পের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি, কীভাবে দ্রুত প্রকল্পের কাজ এগোনো যায়। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে নানান ধরনের সমস্যা ছিল, কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। যেসব সমস্যা ছিল সেগুলো চিহ্নিত করেছি। এখন তা সমাধানের চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, কমিশন অনুমোদন দিলে ২ হাজার ফিঙ্গার প্রিন্ট ও ২ হাজার আইরিশ স্ক্যানার কিনতে পারব। এসব যন্ত্র কেনা হলে সব জায়গায় একই সঙ্গে স্মার্টকার্ড বিতরণের কাজ শুরু করতে পারব। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ডিসেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এরপর প্রকল্প বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় চলবে নাকি আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে চলবে তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। দেশের স্বার্থে যা ভালো হবে তাই করা হবে। নির্বাচন কমিশনের পরিকল্পনা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দেশের নয় কোটি ভোটারের হাতে স্মার্টকার্ড তুলে দেয়ার লক্ষ্যে ২০১১ সালে নেয়া হয় ১ হাজার ৬৩৬ কোটি ৯৯ লাখ টাকা ব্যয়ে আইডিইএ প্রকল্প। পরে প্রকল্পের মেয়াদ দেড় বছর বাড়িয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বরের কার্ড দেয়ার কথা রয়েছে। মে মাস পর্যন্ত কার্ড বিতরণে অগ্রগতি হয়েছে মাত্র দুই দশমিক ৫৫ ভাগ। আর্থিক অগ্রগতি ৫০ দশমিক ৯০ শতাংশ, যা লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক। প্রকল্পে এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৮৩৩ কোটি ২২ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রকল্প সাহায্য ৭৪৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। বাকি টাকা সরকারি তহবিলের। চলতি বছর বরাদ্দকৃত এডিপির অগ্রগতি ৭৬ দশমিক ২২ শতাংশ। আরও জানা গেছে, স্মার্টকার্ড প্রস্তুত ও বিতরণের লক্ষ্যে ফ্রান্সের অবার্থুর টেকনোলজিস (ওটি) নামে এক কোম্পানির সঙ্গে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার চুক্তি করে ইসি। ওই চুক্তির অধীনে নয় কোটি কার্ড উৎপাদন ও বিতরণের কথা রয়েছে। দফায় দফায় পিছিয়ে সেই কার্ড বিতরণ শুরু হয় ২০১৬ সালে। চলতি জুন মাসে এ কোম্পানির সঙ্গে ইসির চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। নয় কোটি কার্ডের মধ্যে এ কোম্পানিটি এ পর্যন্ত ৫ কোটি ৮০ লাখ ব্ল্যাংক কার্ড আমদানি করেছে। এমন পরিস্থিতিতে এ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি নবায়ন নাকি বাতিল করা হবে- সে বিষয়ে শিগগিরই সিদ্ধান্ত নেয়ার চিন্তা করছে কমিশন। সূত্র জানায়, তৈরি থাকার পরও এক কোটি স্মার্টকার্ড বিতরণ করতে পারছে না ইলেকশন কমিশন (ইসি)। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে নাগরিকদের হাতে কার্ডগুলো তুলে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এছাড়া পড়ে থাকার কারণে কার্ডগুলোর গুণগতমান নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। স্মার্টকার্ড সংগ্রহের সময়ে প্রত্যেক নাগরিকের হাতের দশ আঙ্গুলের ছাপ ও চোখের কনীনিকার প্রতিচ্ছবি (আইরিশ) নেয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু ইসির কাছে এ সংক্রান্ত পর্যাপ্ত মেশিন নেই। বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের কাছে দুইশ’ আইরিশ ও ফিঙ্গার প্রিন্ট নেয়ার মেশিন আছে।
অথচ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার জন্য কয়েক হাজার মেশিন প্রয়োজন। চাহিদা অনুযায়ী মেশিন জোগান দেয়া সম্ভব না হওয়ায় তৈরি স্মার্টকার্ডগুলো দ্রুত বিতরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। স্মার্টকার্ড বিতরণ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে চলমান এ প্রকল্পের আওতায় আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ৯ কোটি মানুষের হাতে স্মার্টকার্ড তুলে দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে ৪ হাজার ফিঙ্গার প্রিন্ট ও আইরিশ স্ক্যানার কেনার জন্য কমিশনের কাছে অনুমোদন চেয়ে প্রস্তাব করেছে (এনআইডিডব্লিউ)। ওই প্রস্তাবে বিশ্বব্যাংকের বদলে সরকারি তহবিল থেকে টাকা সংস্থানের জন্য বলা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার কমিশনের ষষ্ঠ সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা আছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, দেশের দশ সিটি কর্পোরেশন এলাকার নাগরিকদের স্মার্টকার্ড ইতিমধ্যে প্রিন্ট করা হয়েছে। বর্তমানে ঢাকার অদূরবর্তী সাভার উপজেলাসহ জেলা শহরের সদর উপজেলার ভোটারদের কার্ড প্রিন্টিংয়ের কাজ চলছে। সব মিলিয়ে এক কোটি ২০ লাখ ভোটারের স্মার্টকার্ড তৈরি হয়েছে। ঢাকার দুই সিটি, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ধাপে ধাপে বিতরণ করা হয়েছে ২৩ লাখ স্মার্টকার্ড। রোববার বরিশাল সিটি কর্পোরেশন এলাকায় স্মার্টকার্ড বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়েছে। তবে সাধারণ মানুষের হাতে কার্ড তুলে দেয়ার কাজ শুরু হয়নি। বাকি ৯৭ লাখ স্মার্টকার্ড প্রস্তুত হলেও তা বিতরণ শুরু করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। এর কারণ হিসেবে তারা বলেন, স্মার্টকার্ড সংগ্রহের সময়ে প্রত্যেক নাগরিকের হাতের দশ আঙ্গুলের ছাপ ও চোখের কনীনিকার প্রতিচ্ছবি (আইরিশ) নেয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু ফিঙ্গার প্রিন্ট ও আইরিশ নেয়ার জন্য কমিশনের কাছে পর্যাপ্ত সংখ্যক ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যানার ও আইরিশ স্ক্যানার নেই। কমিশনের কাছে রয়েছে মাত্র ২০০টির মতো। এর মধ্যে কয়েকটি নষ্ট হয়ে আছে। প্রয়োজন কয়েক হাজার মেশিন স্ক্যানার মেশিন। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকার কারণে ধাপে ধাপে স্মার্টকার্ড বিতরণ কার্যক্রম চালাচ্ছে কমিশন। ঢাকা জেলায় কর্মরত নির্বাচন কমিশনের একজন কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে জানান, গত বছরের ৩ অক্টোবর রাজধানীতে স্মার্টকার্ড বিতরণ শুরু হয়। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকাভুক্ত ১৫টি থানা নির্বাচন অফিসের আওতায় ৫২ লাখ ৬৬ হাজার স্মার্টকার্ড বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এ পর্যন্ত ৯টি থানার কার্ড বিতরণ শেষ হয়েছে। বাকি ছয়টি থানা- লালবাগ, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, পল্লবী, ক্যান্টনমেন্ট ও তেজগাঁও স্মার্টকার্ড বিতরণ চলছে। প্রকল্প ঝুঁকি বিবেচনায় জরুরি ভিত্তিতে যন্ত্রপাতি কেনার প্রস্তাব : সংশ্লিষ্টরা জানান, স্মার্টকার্ড সংক্রান্ত প্রকল্পের মেয়াদ আগামী ডিসেম্বরে শেষ হচ্ছে। ওই সময়ের পর প্রকল্পে অর্থছাড় না করার বিষয়ে ইসিকে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এমন পরিস্থিতিতে বাকি স্মার্টকার্ড বিতরণ কার্যক্রম জোরদার করতে দুই হাজার আইরিশ স্ক্যানার এবং একই সংখ্যক দশ ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যানার কেনার প্রস্তাব কমিশনে তুলছে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ। সোমবার এ সংক্রান্ত কার্যপত্র কমিশনারদের কাছে দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, প্রকল্পের অধীনে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল কম্পিটিটিভ বিডিং (আইসিবি) পদ্ধতির আওতায় দুই দফায় টেন্ডার আহ্বান করা হয়। প্রথম দফায় চারটি কোম্পানি ও দ্বিতীয় দফায় পাঁচটি কোম্পানি দরপত্রে অংশ নেয়। কিন্তু দুই দফায় দরপত্র মূল্যায়নে ওই সব দরপত্র অগ্রহণযোগ্য হওয়ায় তা বাতিল করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে পুনরায় টেন্ডারের মাধ্যমে এসব যন্ত্রপাতি কিনতে অন্তত ৩৩৬ দিন বা ১১ মাস ৬ দিন সময় লাগবে। প্রকল্পের মেয়াদ আগামী ৩১ ডিসেম্বর শেষ হবে। অর্থাৎ আগামী ৭ মাসের মধ্যে এসব ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ করা কষ্টসাধ্য হবে। এতে আরও বলা হয়েছে, আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ৯ কোটি স্মার্টকার্ড বিতরণের লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় জরুরি প্রয়োজনে এবং জনস্বার্থে সময়স্বল্পতা বিবেচনায় এবং জটিলতা এড়ানোর জন্য সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির মাধ্যমে এসব যন্ত্রপাতি ক্রয় করা যেতে পারে।
No comments