অবিস্মরণীয় নেতা মওলানা ভাসানী by ফকির আলমগীর
উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে এক অবিস্মরণীয় নাম মওলানা ভাসানী। উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, সেই আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণের লড়াইয়ে এ দেশের মজলুম জনমানুষের মুক্তির সংগ্রামে সব ক্ষেত্রেই মওলানা ভাসানী নিয়েছিলেন অগ্রণী ভূমিকা।
দাঁড়িয়েছিলেন সামনের কাতারে। এ আপসহীন আমৃত্যু সংগ্রামী মওলানা ভাসানীর এবার ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। বাংলাদেশের মানুষ কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবেন এই মহান জননায়ক মওলানা ভাসানীর নাম।
আসামের লাইন প্রথাবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭৬ সালের ঐতিহাসিক ফারাক্কা মার্চ মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক জীবনের এক ধারাবাহিক লড়াইয়ের ইতিহাস। ব্রিটিশের উপনিবেশবাদী শাসনের বিরুদ্ধে তার লড়াই, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে তার অবদান এবং সব শেষে স্বাধীন বাংলাদেশ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও এর স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণে তিনি যে মহান অবদান রেখে গেছেন শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, উপমহাদেশের মানুষও সে কথা স্মরণ করবেন অনাগত বহুদিন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ওই দরিদ্র জনসাধারণের মুক্তির লক্ষ্যে তিনি প্রথম মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে এসে গড়ে তুলেছিলেন বিরোধী দল। কারণ তিনি জানতেন, মুসলিম লীগ সরকার ক্ষমতার মোহে এক সময় এক অন্ধশক্তিতে পরিণত হতে পারে। আর তার ফলে এ দেশের সাধারণ মানুষই পড়বে সংকটে। মুসলিম লীগ শাসনামলে সাধারণ মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত হয়নি। ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংরক্ষণ, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন পথিকৃৎ। সেই ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনেই তিনি বিমাতাসুলভ শাসকগোষ্ঠীকে 'আসসালামু আলাইকুম' বলে বিদায় জানিয়েছিলেন, বীজ বপন করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের। মওলানা ভাসানী বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের শাসকরা ধর্ম ও জাতীয় সংহতির নামে পূর্ববাংলার মানুষকে শোষণ করছে। তাই এদের সঙ্গে একই রাষ্ট্রের বাঁধনে অবস্থান করা আর সম্ভব নয়। সে কারণে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীন স্বতন্ত্র জাতিসত্তা সম্পর্কেও মওলানা ভাসানী সম্যক অবহিত ছিলেন। এ কারণেই তিনি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তান স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৭০ সালের নভেম্বরে পল্টন ময়দানে ভাষণদানকালে এ কথাটাই বারবার উচ্চারণ করে জাতিকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন তিনি। তার স্বাধীনতার স্বপ্ন সফল হয়েছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য থেকে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
অন্যদিকে শহর তার রাজনীতির কেন্দ্র ছিল না, গ্রামে গ্রামে ঘুরতেন তিনি। সবসময় তার সংযোগ ছিল গ্রামেরই কামার-কুমার-তাঁতি-জেলে-কৃষক-শ্রমিক-মজুরের সঙ্গে। রাজধানীর প্রাসাদ রাজনীতিতে বিশ্বাস ছিল না তার। শহরের রাজনীতিকরা নিজেদের প্রয়োজনেই যেতেন মওলানা ভাসানীর কাছে, তারাই কখনও ভাসানীকে আমন্ত্রণ করে আনতেন শহরে। তিনি ছিলেন সংগ্রাম ও সংকটে বিশাল সহায়। কখনোই কোনো পদমর্যাদা, লোভ-লালসা এবং মোহ তাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। সরল-সহজ জীবনযাপন করেছেন তিনি, একই সঙ্গে সরল প্রাণের কৃষক-মজুর তার প্রিয় ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশেও যখন গণতন্ত্রের নামে এ দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছিল একের পর এক, যখন কেড়ে নেওয়া হচ্ছিল বাক-ব্যক্তিস্বাধীনতা, তখনও সিংহের মতো গর্জে উঠেছেন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী। আদর্শ থেকে কখনও তিনি বিচ্যুত হননি। তিনি লড়াই করেছেন সব কালাকানুনেরও বিরুদ্ধে। আজ যখন সারাদেশে সংঘাত, বিভেদ, বিভাজন, পরস্পর হানাহানি তখন মওলানা ভাসানী হতে পারতেন সংহতির কণ্ঠস্বর। মিলিত প্রাণের সংগ্রাম।
অবিশ্বাস আর হতাশার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। আজ মনে পড়ে ফারাক্কার পানির ন্যায্য হিস্যার জন্য তিনি এক বিশাল জনতা নিয়ে ফারাক্কা বাঁধ পর্যন্ত মিছিল করেছেন, আন্তর্জাতিক নদীর পানির হিস্যা চাই আমরা। সেই দাবিও বশাল সাহসের সঞ্চার করেছে অধিকারসচেতন মানুষের মনে। কানসাট থেকে ফুলবাড়ীর আন্দোলন কিংবা তেল-গ্যাসের যে আন্দোলন সবকিছুর মূলেই রয়েছে মওলানা ভাসানীর প্রেরণা।
মওলানা ভাসানী বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সংকটগুলো সম্পর্কে পূর্বাহ্নেই অবহিত ছিলেন। তাই তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যই। আজ সেই মহান জননায়ক মওলানা ভাসানীর ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তার স্মৃতির প্রতি আমরা গভীর শ্রদ্ধা জানাই এবং স্মরণ করি তার সেই শিক্ষা, যা এ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ এবং দরিদ্র সর্বসাধারণের সঠিক মুক্তির লক্ষ্যে ছিল অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, মওলানা ভাসানীকে পুঁজি করে কিছুসংখ্যক ভণ্ড অনুসারী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ফায়দা লুটেছেন।
তার নাম ব্যবহার করেছে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য, লাইসেন্স-পারমিট হাসিল করার জন্য। তাই বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মজলুম জননেতার প্রয়োজনীয় উপলব্ধি করছে সবাই। তাই আজ তাকে রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার ঊধর্ে্ব এনে গণমানুষের কল্যাণে তার অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাকে কাজে লাগাতে হবে।
ফকির আলমগীর :গণসঙ্গীতশিল্পী
আসামের লাইন প্রথাবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭৬ সালের ঐতিহাসিক ফারাক্কা মার্চ মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক জীবনের এক ধারাবাহিক লড়াইয়ের ইতিহাস। ব্রিটিশের উপনিবেশবাদী শাসনের বিরুদ্ধে তার লড়াই, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে তার অবদান এবং সব শেষে স্বাধীন বাংলাদেশ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও এর স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণে তিনি যে মহান অবদান রেখে গেছেন শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, উপমহাদেশের মানুষও সে কথা স্মরণ করবেন অনাগত বহুদিন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ওই দরিদ্র জনসাধারণের মুক্তির লক্ষ্যে তিনি প্রথম মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে এসে গড়ে তুলেছিলেন বিরোধী দল। কারণ তিনি জানতেন, মুসলিম লীগ সরকার ক্ষমতার মোহে এক সময় এক অন্ধশক্তিতে পরিণত হতে পারে। আর তার ফলে এ দেশের সাধারণ মানুষই পড়বে সংকটে। মুসলিম লীগ শাসনামলে সাধারণ মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত হয়নি। ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংরক্ষণ, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন পথিকৃৎ। সেই ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনেই তিনি বিমাতাসুলভ শাসকগোষ্ঠীকে 'আসসালামু আলাইকুম' বলে বিদায় জানিয়েছিলেন, বীজ বপন করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের। মওলানা ভাসানী বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের শাসকরা ধর্ম ও জাতীয় সংহতির নামে পূর্ববাংলার মানুষকে শোষণ করছে। তাই এদের সঙ্গে একই রাষ্ট্রের বাঁধনে অবস্থান করা আর সম্ভব নয়। সে কারণে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীন স্বতন্ত্র জাতিসত্তা সম্পর্কেও মওলানা ভাসানী সম্যক অবহিত ছিলেন। এ কারণেই তিনি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তান স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৭০ সালের নভেম্বরে পল্টন ময়দানে ভাষণদানকালে এ কথাটাই বারবার উচ্চারণ করে জাতিকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন তিনি। তার স্বাধীনতার স্বপ্ন সফল হয়েছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য থেকে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
অন্যদিকে শহর তার রাজনীতির কেন্দ্র ছিল না, গ্রামে গ্রামে ঘুরতেন তিনি। সবসময় তার সংযোগ ছিল গ্রামেরই কামার-কুমার-তাঁতি-জেলে-কৃষক-শ্রমিক-মজুরের সঙ্গে। রাজধানীর প্রাসাদ রাজনীতিতে বিশ্বাস ছিল না তার। শহরের রাজনীতিকরা নিজেদের প্রয়োজনেই যেতেন মওলানা ভাসানীর কাছে, তারাই কখনও ভাসানীকে আমন্ত্রণ করে আনতেন শহরে। তিনি ছিলেন সংগ্রাম ও সংকটে বিশাল সহায়। কখনোই কোনো পদমর্যাদা, লোভ-লালসা এবং মোহ তাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। সরল-সহজ জীবনযাপন করেছেন তিনি, একই সঙ্গে সরল প্রাণের কৃষক-মজুর তার প্রিয় ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশেও যখন গণতন্ত্রের নামে এ দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছিল একের পর এক, যখন কেড়ে নেওয়া হচ্ছিল বাক-ব্যক্তিস্বাধীনতা, তখনও সিংহের মতো গর্জে উঠেছেন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী। আদর্শ থেকে কখনও তিনি বিচ্যুত হননি। তিনি লড়াই করেছেন সব কালাকানুনেরও বিরুদ্ধে। আজ যখন সারাদেশে সংঘাত, বিভেদ, বিভাজন, পরস্পর হানাহানি তখন মওলানা ভাসানী হতে পারতেন সংহতির কণ্ঠস্বর। মিলিত প্রাণের সংগ্রাম।
অবিশ্বাস আর হতাশার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। আজ মনে পড়ে ফারাক্কার পানির ন্যায্য হিস্যার জন্য তিনি এক বিশাল জনতা নিয়ে ফারাক্কা বাঁধ পর্যন্ত মিছিল করেছেন, আন্তর্জাতিক নদীর পানির হিস্যা চাই আমরা। সেই দাবিও বশাল সাহসের সঞ্চার করেছে অধিকারসচেতন মানুষের মনে। কানসাট থেকে ফুলবাড়ীর আন্দোলন কিংবা তেল-গ্যাসের যে আন্দোলন সবকিছুর মূলেই রয়েছে মওলানা ভাসানীর প্রেরণা।
মওলানা ভাসানী বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সংকটগুলো সম্পর্কে পূর্বাহ্নেই অবহিত ছিলেন। তাই তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যই। আজ সেই মহান জননায়ক মওলানা ভাসানীর ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তার স্মৃতির প্রতি আমরা গভীর শ্রদ্ধা জানাই এবং স্মরণ করি তার সেই শিক্ষা, যা এ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ এবং দরিদ্র সর্বসাধারণের সঠিক মুক্তির লক্ষ্যে ছিল অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, মওলানা ভাসানীকে পুঁজি করে কিছুসংখ্যক ভণ্ড অনুসারী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ফায়দা লুটেছেন।
তার নাম ব্যবহার করেছে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য, লাইসেন্স-পারমিট হাসিল করার জন্য। তাই বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মজলুম জননেতার প্রয়োজনীয় উপলব্ধি করছে সবাই। তাই আজ তাকে রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার ঊধর্ে্ব এনে গণমানুষের কল্যাণে তার অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাকে কাজে লাগাতে হবে।
ফকির আলমগীর :গণসঙ্গীতশিল্পী
No comments