বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৫৭১ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শহীদ নূরুল হক
বীর প্রতীক বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন তিনি পঞ্চগড় জেলার সদর উপজেলার অন্তর্গত অমরখানা-জগদলহাট।


পঞ্চগড়-তেঁতুলিয়া সড়কের পূর্ব পাশে অমরখানা-জগদলহাট এলাকা দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে চাওই নদ প্রবহমান। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে নদের পূর্ব পাশে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুটি ঘাঁটি। একটি অমরখানায়, অপরটি জগদলহাটে। নদের পশ্চিম পাশে ছিল মুক্তিবাহিনীর অবস্থান। সেখানে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল। একটি দলে ছিলেন নূরুল হক।
২২ নভেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অমরখানা অবস্থানে আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে নূরুল হকের দলসহ মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি দল (কোম্পানি) অংশ নেয়। আক্রমণের আগে ভারতীয় সেনাবাহিনীর আর্টিলারি দল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটিতে গোলাবর্ষণ করে। এর সহায়তায় নূরুল হকসহ মুক্তিযোদ্ধারা বিপুল বিক্রমে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁদের তীব্র আক্রমণের মুখে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পিছু হটে যায়। অমরখানা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে।
অমরখানা দখলের মধ্য দিয়ে ওই এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের মোড় দারুণভাবে ঘুরে যায়। অধিনায়কের নির্দেশে নূরুল হকসহ উদ্দীপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা পরদিনই (২৩ নভেম্বর) জগদলহাটে আক্রমণ করেন। এবারও ভারতীয় সেনাবাহিনী তাঁদের সহযোগিতা করে। কিন্তু এদিন মুক্তিযোদ্ধারা সফলতা অর্জন করতে পারেননি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তীব্রভাবে তাঁদের প্রতিরোধ করে। তখন সেখানে দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়।
এ যুদ্ধে নূরুল হকসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জগদলহাটের ঘাঁটি ছিল বেশ শক্ত। চারপাশে ছিল বাংকার। সেগুলো আর্টিলারি শেলপ্রুফ করা। আবার কিছু এলাকা কাঁটা তার দিয়ে ঘেরা ছিল। চারদিকে বিছানো ছিল অসংখ্য মাইন ও বুবিট্র্যাপ।
নূরুল হকসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুর্ভেদ্য ওই প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে মূল প্রতিরক্ষায় ঢুকে পড়েন। এ সময় তাঁর দুই পাশের দু-তিনজন সহযোদ্ধা মাইন ও গুলির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এতে তিনি দমেননি। থেমেও যাননি। পাকিস্তানিদের প্রতিরোধ ভাঙার জন্য তিনি গুলি করতে করতে সামনে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
দেশমাতৃকার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ও প্রতিশোধের নেশায় সাহসী নূরুল হক এগিয়ে যান, কিন্তু সফল হতে পারেননি। একপর্যায়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। বুকে গুলি লাগে তাঁর। নিমেষে নিভে যায় তাঁর জীবনপ্রদীপ। হেরে গিয়েও দেশমাতৃকার ভালোবাসায় জেতেন তিনি।
সেদিন যুদ্ধে নূরুল হকসহ কয়েকজন সহযোদ্ধার শহীদ হওয়ার ঘটনা মুক্তিযোদ্ধাদের মনে প্রতিশোধের স্পৃহা আরও বেশি করে জাগিয়ে তোলে। তাঁরা পরদিন (২৪ নভেম্বর) নতুন উদ্যমে জগদলহাটে আক্রমণ চালান। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১২ রাজপুত রেজিমেন্টের একটি দল (কোম্পানি) তাঁদের সহযোগিতা করে। সম্মিলিত আক্রমণে দিশেহারা পাকিস্তানি সেনারা পঞ্চগড়ে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়।
তিন দিনের যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। মুক্তিযোদ্ধারা অনেক অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে নূরুল হকসহ পাঁচ-ছয়জন শহীদ এবং প্রায় ৩৭ জন আহত হন। নূরুল হকসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে যুদ্ধক্ষেত্রের পাশেই সমাহিত করা হয়। তবে তাঁর সমাধি চিহ্নিত করা ছিল না।
শহীদ নূরুল হক চাকরি করতেন ইপিআরে। ১৯৭১ কর্মরত ছিলেন দিনাজপুর সেক্টরের ঠাকুরগাঁও উইংয়ের অধীনে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে পুনঃসংগঠিত হওয়ার পর ৬ নম্বর সেক্টরের ভোজনপুর সাব-সেক্টরে যুদ্ধ করেন। বিভিন্ন যুদ্ধে তিনি যথেষ্ট সাহস, দক্ষতা ও কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ নূরুল হককে মরণোত্তর বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ২৫২।
শহীদ নূরুল হকের পৈতৃক বাড়ি চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার (ডাক সাহেদারপুর) আকানিয়া গ্রামে। অবিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম আবদুস সোবহান, মা রায়েতুন নেছা। শহীদ নূরুল হকের ছবি পাওয়া যায়নি।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক, জাহিদ রহমান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৬।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.