রোহিঙ্গা : ওবামা চাপ দেবেন মিয়ানমারকে

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যুতে কয়েক দিন আগেও আন্তর্জাতিক মহলের দৃশ্যত চাপ ছিল বাংলাদেশের ওপর। এবার সেই চাপ যাচ্ছে সমস্যার মূল কেন্দ্র মিয়ানমারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আজ শনিবার থেকে শুরু করছেন তাঁর 'ঐতিহাসিক এশিয়া সফর'। এ সফরের অংশ হিসেবে প্রথমবারের মতো মিয়ানমার যাচ্ছেন তিনি।


হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা গত বৃহস্পতিবার নিশ্চিত করেছেন, এ সফরে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে মিয়ানমারকে চাপ দেবেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। এ চাপের কিছুটা আসবে প্রকাশ্যে, আবার কিছুটা আড়ালে।
এদিকে বাংলাদেশ সফররত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও বেসামরিক জনগণের নিরাপত্তা বিষয়ক বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি মারিও ওটেরোও গতকাল শুক্রবার কক্সবাজারে সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন, প্রেসিডেন্ট ওবামার মিয়ানমার সফরে অন্য ইস্যুগুলোর মধ্যে রোহিঙ্গা ইস্যুও থাকছে। গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকেও তিনি এমন কথা বলেছিলেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের 'ওবামা টু প্রেস মিয়ানমার লিডারস অন এথনিক ভায়োলেন্স' শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা গত বৃহস্পতিবার বলেছেন, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁর আসন্ন মিয়ানমার সফরে ওই দেশের পশ্চিমাঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনা এবং জাতিগত সংঘাতে উসকানি ও মদদদাতাদের বিচারের আওতায় আনতে দেশটির নেতাদের চাপ দেবেন। ওবামার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা টম ডনিলন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বড় উদ্বেগের কারণ মিয়ানমারে সাম্প্রদায়িক সংঘাত। মিয়ানমার সরকার সংঘাতে মদদদাতাদের বিচারের অঙ্গীকার করেছে এবং সংঘাতপূর্ণ এলাকায় মানবিক সহায়তা প্রদানকারীদের কাজ করার সুযোগ দেওয়াসহ শান্তি পুনঃ প্রতিষ্ঠায় গঠনমূলক উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি বলেন, তাদের (মিয়ানমার সরকার) ওই উদ্যোগগুলোর প্রতিটি চালিয়ে যাওয়া উচিত। তিনি আরো বলেন, মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে (বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী) জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত কিভাবে করা যায়, সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকরা মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে কাজ করছে।
টম ডনিলন বলেন, 'আমি আশা করছি, প্রেসিডেন্ট (বারাক ওবামা) যখন সেখানে যাবেন, তখনো তিনি মিয়ানমারের নেতাদের সঙ্গে এ বিষয়টি সরাসরি তুলবেন।'
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গারা মুসলমান। তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মিয়ানমারের পশ্চিম উপকূলের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করছে। তবে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইন ও মিয়ানমারের অন্য নাগরিকরা মনে করে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে গেছে। এ কারণে তারা রোহিঙ্গাদের কোনো অধিকার দিতে চায় না, সহানুভূতিও দেখাতে চায় না। গত মাসে রাখাইন রাজ্যে জাতিগত সংঘাতে সরকারি হিসাবেই ৮৯ জন নিহত হয়েছে। হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা বলেছেন, রোহিঙ্গারা জাতিগত সহিংসতার শিকার হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের জাতীয় উপনিরাপত্তা উপদেষ্টা বেন রোডস সাংবাদিকদের বলেছেন, 'প্রেসিডেন্ট ওবামা মিয়ানমারে বৃহৎ পরিসরে জাতিগত পুনর্মিলন এবং জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানাবেন। বিশেষ করে, আমরা দেখতে চাই পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার কাজ অব্যাহত রয়েছে, পাশাপাশি উত্তেজনার মাত্রা ও ঝুঁকিও কমেছে।'
ওবামার অন্যতম শীর্ষ মানবাধিকার বিষয়ক উপদেষ্টা সামান্থা পাওয়ার গত বৃহস্পতিবার বলেছেন, আগামী সোমবার মিয়ানমারের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ওবামা যে ভাষণ দেবেন, তা এখনো লেখা শেষ হয়নি। তবে ওবামা তাঁর সফরে রোহিঙ্গা ইস্যুর ওপর কোনো না কোনোভাবে আলোকপাত করবেন। তিনি বলেন, 'সর্বোপরি ওই দেশে (মিয়ানমার) ও অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের আইনি স্ট্যাটাসের সমাধান হওয়া উচিত। আর এ কারণে আমি নিশ্চিত, আমরা কিছুটা প্রকাশ্যে এবং কিছুটা আড়ালে এ নিয়ে আলোচনা করব।'
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র যে জাতিগত সংঘাতের কথা বলছে, সে সংঘাতের কারণেই মিয়ানমার থেকে বিপুলসংখ্যক বাসিন্দা বাংলাদেশে আশ্রয় চাইছে। স্থানীয়ভাবে তারা রোহিঙ্গা নামে পরিচিত। বর্তমানে এ দেশে প্রায় ২৮ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। এর বাইরে আছে আরো কয়েক লাখ অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা, যাদের শরণার্থী মর্যাদা দেওয়া হয়নি।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, মিয়ানমারের কয়েক লাখ বাসিন্দা বাংলাদেশে বছরের পর বছর অননুমোদিতভাবে অবস্থান করে পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করছে। আন্তর্জাতিক সনদ অনুযায়ী, শরণার্থীদের জোর করে ফেরত পাঠানো যায় না। তারা স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে পারে। কিন্তু মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তাদের অনুকূল পরিবেশ না থাকায় তারা ফিরে যেতে আগ্রহ দেখায় না। অন্যদিকে অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের জোর করে ফেরত পাঠানোর সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশের নীতি নিবর্তনমূলক নয়।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ঢাকা সফরের পরপরই রোহিঙ্গা ইস্যুকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় ওয়াশিংটন। ৫ মে ঢাকায় বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র বৈঠকেও রোহিঙ্গা ইস্যু স্থান পায়। বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে হিলারি তাঁর বক্তৃতায় বলেন, 'বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বিষয়ে চলমান চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। সম্ভবত বার্মায় (মিয়ানমার) এখন সংস্কার চলছে। আমরা সমাধান খোঁজা শুরু করতে পারি।'
মে মাসের শেষ দিকেই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আবারও বড় ধরনের সংঘাত শুরু হলে সেখান থেকে আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য সীমান্ত খুলে দিতে বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র আহ্বান জানায়। কিন্তু বাংলাদেশ রূঢ় বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরে জানিয়েছে, নতুন করে শরণার্থী নেওয়া এ দেশের পক্ষে সম্ভব নয়। সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারকে চাপ দিতে বাংলাদেশ পাল্টা আহ্বান জানায় বিভিন্ন ফোরামে।
এরপর যুক্তরাষ্ট্র স্বীকার করে, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান মিয়ানমারেই। গত সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন রোহিঙ্গা সমস্যা সরেজমিনে দেখতে চারজন উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে (ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি) মিয়ানমার ও বাংলাদেশে পাঠান। তাঁদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই যুক্তরাষ্ট্র এ ইস্যুতে কাজ করছে।
বাংলাদেশেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল : আমাদের কক্সবাজার অফিস ও উখিয়া প্রতিনিধি জানান, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও বেসামরিক জনগণের নিরাপত্তা বিষয়ক দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি মারিও ওটেরোর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল গতকাল শনিবার কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেছে। এ সময় উখিয়া উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এস এম শাহ আলম রোহিঙ্গাদের কারণে সৃষ্ট সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত প্রভাবের কথা উল্লেখ করেন।
বিকেলে কক্সবাজার বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের ওটেরো বলেন, 'রোহিঙ্গা বিষয়ে আমরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিগত সহিংসতা ও টানাপড়েন পর্যবেক্ষণ অব্যাহত রেখেছি এবং শান্তির পরিবেশ বজায় রাখতে, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা পুনর্বহাল করতে এবং আইনের শাসন অনুসরণে ন্যায়সংগত ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার আওতায় এই সহিংসতার জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার জন্য পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে আমরা ওই দেশটির সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি।'
তিনি বলেন, 'আমরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতিও হয়রানিকারীদের কাছে আশ্রয়প্রার্থীদের ফিরিয়ে না দেওয়ার নীতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের আহ্বান জানাই। কারণ, মিয়ানমারে সহিংসতা থেকে পালিয়ে আসা ব্যক্তি একজন শরণার্থী হতে পারে কিংবা তার নিরাপত্তার প্রয়োজন হতে পারে।' বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমার থেকে আশ্রয়প্রার্থী এবং বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীদের নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে কাজ করার অনুমতি দিতেও তিনি এ দেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
মারিও ওটেরো বলেন, 'রোহিঙ্গা ইস্যুটি জটিল এবং এর সঙ্গে একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটও জড়িত। এ ক্ষেত্রে এই অঞ্চলের যেসব রাষ্ট্রের ওপর এর প্রভাব পড়তে পারে, তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন রয়েছে। রোহিঙ্গাদের সমস্যার একটি সমন্বিত, টেকসই ও ন্যায়সংগত সমাধানে পৌঁছতে আমরা মিয়ানমার, বাংলাদেশসহ রোহিঙ্গা উচ্ছেদের কারণে প্রভাবিত রাষ্ট্রগুলোকে সাহায্য করতে প্রস্তুত।'

No comments

Powered by Blogger.