রেজওয়ানুলকে অভিযুক্ত করলেন গ্র্যান্ড জুরি- বাবাকে ফোন, ‘আমি দোষ করিনি’

যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়ার এক মাস পর প্রথমবারের মতো পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিসের। অপ্রত্যাশিতভাবে গতকাল শুক্রবার ছেলের ফোন পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন তাঁর বাবা কাজী মো. আহছানউল্লাহ।


রেজওয়ানুল ফোনে বাবাকে বলেন, ‘আমি কোনো দোষ করিনি।’
এদিকে বৃহস্পতিবার সংশ্লিষ্ট মার্কিন আদালতের গ্র্যান্ড জুরি রেজওয়ানুলের বিচার শুরুর পক্ষে মত দিয়েছেন। এতে করে তাঁর বিচার কার্যক্রম শুরুর পথ উন্মুক্ত হলো।
অন্যান্য দিনের মতোই গতকাল শুক্রবার রেজওয়ানুলের বাবা অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা কাজী মো. আহছানউল্লাহ সকালে ঘুম থেকে ওঠেন। সকাল আটটার দিকে তাঁর মুঠোফোন বেজে ওঠে। ফোন ধরেই অন্য প্রান্ত থেকে শোনেন ছেলের কণ্ঠ, ‘বাবা তুমি কেমন আছ?’ তিনিও ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কেমন আছ, বাবা? জবাবে রেজওয়ানুল বলেন, ‘আমি ভালো আছি।’ এরপর তিনি তাঁর মা রোকেয়া সিদ্দিকীর সঙ্গে কথা বলতে চান। আহছানউল্লাহ তখন স্ত্রীর হাতে ফোনটি দেন। ছেলের কণ্ঠ শুনেই হু হু করে কেঁদে ওঠেন মা। বিদেশ-বিভুঁইয়ে গ্রেপ্তার হওয়ার দীর্ঘ এক মাস পর ফোন পেয়ে আবেগ চাপতে না পারায় তিনি কোনো কথাই বলতে পারেননি। এরপর রেজওয়ানুলের বাবা আবার ছেলের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় রেজওয়ানুল বলেন, ‘বাবা, আমি কোনো দোষ করিনি।’ আহছানউল্লাহ ছেলের কাছে জানতে চান, তিনি আবার বাড়িতে ফোন করে কথা বলতে পারবেন কি না। জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার অ্যাকাউন্টে টাকা নেই।’ এর পরই ফোনের লাইন কেটে যায়। রেজওয়ানুলের বাবা জানান, সব মিলে ছেলের সঙ্গে তাঁদের প্রায় তিন মিনিট কথা হয়েছে।
রেজওয়ানুলের বাবা গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর বাসায় প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপচারিতায় এসব কথা জানান।
আহছানউল্লাহ জানান, তাঁর সঙ্গে রেজওয়ানুলের আইনজীবী হেইডি সিজারের দু-তিনবার ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ হয়েছে। হেইডি সিজার বলেছিলেন, ১৭ নভেম্বরের মধ্যে যেকোনো দিন মামলা গ্র্যান্ড জুরিতে উঠতে পারে। তবে সিজার তাঁদের সব ই-মেইলের জবাব দেন না।
মামলা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে গ্র্যান্ড জুরির সবুজ সংকেত প্রসঙ্গে রেজওয়ানুলের বাবা বলেন, ‘এটি আশা করিনি।’ এখন কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেহেতু এ ধরনের মামলার মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের নেই, তাই সরকারকেই এ বিষয়ে সহায়তার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।’
রেজওয়ানুলের বাবা আরও বলেন, ‘আমার ছেলেকে ফাঁসানো হয়েছে। এটা একটা নাটক। ভালো ভালো ছেলেদের ধরে এভাবে নষ্ট করা হচ্ছে।’
আহছানউল্লাহ মনে করেন, সরকার যদি সহযোগিতা করে, তা হলে এখনই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। তিনি বলেন, ‘আমাদের আর্থিক সামর্থ্যও নেই। সরকারের পক্ষ থেকে আমার সঙ্গে এ বিষয়ে সহায়তার জন্য এ পর্যন্ত কেউ যোগাযোগ করেননি। তবে আমি সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করেছি। তিনি আমাদের সব কথা সময় নিয়ে শুনেছেন। এ বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন এবং সব ধরনের সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন।’
বিচার শুরু হচ্ছে
প্রথম আলোর নিউইয়র্ক প্রতিনিধি ইব্রাহীম চৌধুরী জানান, আদালতের গ্র্যান্ড জুরি বিচার শুরুর পক্ষে মত দেওয়ায় রেজওয়ানুলের বিচারকাজ শুরু হতে যাচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে ফেডারেল কোর্টে গ্র্যান্ড জুরির পক্ষ থেকে রেজওয়ানুলের বিরুদ্ধে তিন পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র উপস্থাপন করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া এবং বিদেশি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যোগসূত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে। তবে রেজওয়ানুলের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনার দিন-তারিখ এখনো ঠিক হয়নি বলে জানিয়েছেন ব্রুকলিন অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের মুখপাত্র রবার্ট নার্ডোজা।
গত ১৭ অক্টোবর মার্কিন গোয়েন্দাদের পাতা ফাঁদে গ্রেপ্তার হন রেজওয়ানুল। পুলিশের অভিযোগ, রেজওয়ানুল গোয়েন্দাদের সরবরাহ করা ভুয়া বিস্ফোরক সত্যি মনে করে তা দিয়ে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ভবন উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। ছাত্র ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া বাংলাদেশি এই যুবকের ওপর গোয়েন্দারা কয়েক মাস ধরে নজর রাখছিল বলে দাবি করেছে কর্তৃপক্ষ।
মার্কিন আইন অনুযায়ী গুরুতর অভিযোগের ক্ষেত্রে বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপে অভিযোগপত্র কয়েকজন সদস্যের গ্র্যান্ড জুরির বিবেচনার জন্য দেওয়া হয়। অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে বিচারযোগ্য না মনে করলে গ্র্যান্ড জুরিই আসামিকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে পারেন। রেজওয়ানুলের ক্ষেত্রে গ্র্যান্ড জুরি মামলার কার্যক্রম শুরুর পক্ষে মত দেওয়ায় আদালতে এখন তাঁর বিরুদ্ধে বিস্তারিত অভিযোগ উপস্থাপন করা হবে।
গ্র্যান্ড জুরির অভিযোগ উত্থাপনকালে রাষ্ট্রপক্ষ ছাড়াও রেজওয়ানুলের পক্ষে আদালত কর্তৃক নিয়োজিত আইনজীবী হেইডি সিজার উপস্থিত ছিলেন। তবে তিনি মামলার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলে রেজওয়ানুলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করতে হতে পারে। ২০০১ সালে টুইন টাওয়ার হামলার পর থেকে এ পর্যন্ত আরও তিনজন বাংলাদেশি মার্কিন গোয়েন্দাদের পাতা ফাঁদে গ্রেপ্তার হন। তাঁদের প্রত্যেকেই বিভিন্ন মেয়াদের দণ্ড ভোগ করছেন।
সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের পরামর্শ এমনকি প্রত্যক্ষ সহায়তা দিয়ে ফাঁদে ফেলে গ্রেপ্তারের এ পদ্ধতি ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে।
গ্রেপ্তারের পর থেকে এর আগে রেজওয়ানুলের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের উদ্যোগ নিলেও মার্কিন কর্তৃপক্ষ জানায়, রেজওয়ানুল দূতাবাস কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাতে অনীহা প্রকাশ করেছেন।
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অ্যাটর্নি মঈন চৌধুরী বলেন, আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনার আগেই রেজওয়ানুলের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ করা প্রয়োজন। পরিবারের পক্ষ থেকে বা যুক্তরাষ্ট্রে থাকা তাঁর আত্মীয়স্বজন আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারেন। পাশাপাশি ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসও চাইলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.