রাজনীতি-বিএনপি জোটের রাজনৈতিক হারাকিরি? by এম আবদুল হাফিজ

রাজনীতির ঈশান কোণে কালো মেঘের আনাগোনা, যা বহন করে ঝড়ের সংকেত। এই ঝড়কে ঘনীভূত করে দেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর তিক্ত পারস্পরিক সম্পর্ক ও তাদের পরস্পরের মধ্যে বিরাজমান সাংঘর্ষিক অবস্থান।


এ মুহূর্তে এর কোনোটারই ঘাটতি নেই। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা যেভাবে তাদের পরস্পরের প্রতি কটাক্ষের বাণ হেনে যাচ্ছেন এবং অদৃশ্য ষড়যন্ত্রে প্রতিপক্ষকে অভিযুক্ত করে যাচ্ছেন, তাতে উত্তাপ-উত্তেজনার পারদ ঊর্ধ্বগামীই হয়ে চলেছে। ইদানীং জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব রাজনৈতিক অস্থিরতায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন, বিশেষ করে ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য তো আড়েই ছিল এবং তার কারণও বিভিন্ন মহলের কাছে স্পষ্টই ছিল। সবাই জানত কার সহযোগিতায় এবং কী কৌশলে তারা দুর্বৃত্তায়নে লিপ্ত হলো, চাঁদাবাজি করত, ছিনতাই করত এবং প্রয়োজনে হত্যা-গুম, অপহরণেও সিদ্ধহস্ত ছিল এবং এখনও আছে।
কিন্তু হঠাৎ করে জামায়াত-শিবিরের কী হলো? কেন তারা এমন বেপরোয়া হয়ে এমনকি পুলিশকেও টার্গেট করে প্রচণ্ড ঝড়ের মতো সারাদেশকে কাঁপিয়ে দিল এবং এখনও দিচ্ছে। অনেকে বলছেন, এটা তাদের অস্তিত্বের লড়াই। কিন্তু তাদের সুসংহত সংগঠনের না জানার কোনো কারণ নেই যে, তাদের এই দুঃসাহস তাদের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করবে। জনগণ ইতিমধ্যেই একটি ব্যর্থ সরকারকে দেখেছে এবং নাগরিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের অপারগতার কুৎসিত ছাপগুলো এ দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। যদিও তারা ক্ষমতাসীনদের পরিকল্পিত শোষণ, ব্যর্থতা, অনিয়ম, অযোগ্যতা ও সীমাহীন দুর্নীতি থেকে বাঁচতে চায়, কিন্তু জামায়াত-শিবিরের এই তাণ্ডবে তো মানুষের কাঙ্ক্ষিত নিষ্কৃতি আসবে না।
উদ্দেশ্য যা-ই থাকুক_ এতে করে জামায়াত-শিবির তো তাদের মিশনে সাফল্য পাবে না। একে তো এমন জনবিচ্ছিন্ন আক্রমণাত্মক আন্দোলন কর্মসূচিতে সংগঠনটি আরও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে; তা ছাড়া একটি রাষ্ট্রীয় শক্তিকে মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে না তারা_ যখন আপাতদৃষ্টিতে তাদের কোনো নেপথ্য সহায়ক শক্তিও নেই। একমাত্র জামায়াতই হয়তো তাদের পেছনে দাঁড়াত, যদি না জামায়াতেরই এখন এমন দুরবস্থা না থাকত। জামায়াতের সব শীর্ষ নেতাই এখন যুদ্ধাপরাধ বিচারের কাঠগড়ায়। জামায়াতকে এ দেশের প্রবল 'সেক্যুলার শক্তি'গুলো সুনজরে না দেখলেও জামায়াতের অনেক অর্থকরী প্রতিষ্ঠানের ওপর লোলুপ দৃষ্টি আছে বলে জনশ্রুতি। শোনা যায়, জামায়াতের দুর্দিনে তাদের সম্পদ হাতিয়ে নেওয়ার জন্য নাকি অন্তরালে নানা দরকষাকষি চলছে।
তবে একটি ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে বিরোধীদলীয়দের মিল আছে। তা হলো, ক্ষমতাসীনদের বেলায় জামায়াতকে স্থায়ীভাবে বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার প্রয়াস। কাকতালীয়ভাবে হলেও খালেদা জিয়ার বিতর্কিত 'ভারতদর্শনের পর' থেকে জামায়াতের সংস্পর্শ থেকে বিএনপিকে গুটিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা বিএনপির তরুণ মহল থেকে সক্রিয়। এমনও শোনা যায় যে, 'তত্ত্বাবধায়ক' ইস্যুতে যদি বিএনপির নির্বাচন বর্জনের সম্ভাবনা দেখা দেয়_ চাই কি জামায়াতকে দিয়ে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার জন্য ক্ষমতাসীনরা জামায়াতের সাহায্য-সহযোগিতায় সেই বৈধতার সংকট কাটিয়ে উঠতে পারে। জামায়াতের একটি বিরাট ভোটব্যাংক আছে এ দেশে। তাই আওয়ামী লীগের বিপরীতে না জিতলেও জামায়াত অন্য ছোট ইসলামী দলগুলোর সমন্বয়ে বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
অধুনা বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে যে একটি দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তার প্রকাশ ঘটেছে খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে আঠারো দলের বৈঠকে। ওই বৈঠকে বিএনপি নেত্রী জামায়াত-শিবিরের ঝটিকা তাণ্ডব, পুলিশ পেটানো এবং ব্যাপক ভাংচুরের কোনো দায়ভার তার দল বহন করবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মির্জা ফখরুল ইসলামও বিএনপি নেত্রীর উক্তির প্রতিধ্বনি করেছেন। দেশবাসী কিছু অবাক হয়েই জানছে বিএনপির জামায়াত-শিবিরের কর্মকাণ্ডে এই বিদ্বেষের কথা। অথচ ক'মাস আগে পর্যন্ত দুই দলই যৌথভাবে রাজপথ কাঁপিয়েছে; সচিবালয়ে ককটেল ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে গাড়ি পোড়ানোর মতো দুর্ধর্ষ কাজ করেছে এবং একসঙ্গেই সরকারের মামলা-হামলা মোকাবেলা করেছে।
অতঃপর গ্রীষ্মের দাবদাহ প্রচণ্ড হতে থাকলে আন্দোলনে ভাটা পড়তে থাকে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন আঠারোদলীয় জোট তখন সঙ্গতভাবেই বলেছিল যে, রোজার মাস পার হলেই জোট কঠোর কর্মসূচি দেবে। বিএনপির সমর্থকরা তখন আশায় বুক বেঁধেছিল, ঈদ-পূজা ইত্যাদি পার হয়ে গেলেই আন্দোলনে আবার জোয়ার আসবে। কিন্তু সব উৎসব-পার্বণ শেষ হয়ে গেলেও এবং মৌসুমে আন্দোলনবান্ধব হেমন্তের হাওয়া লাগলেও বিএনপি সেই যে বসে পড়ল, আর তারা কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। এখন যেটা দেখা যাচ্ছে, সেটা হলো আন্দোলনের শুধু আবহটাকে বাঁচিয়ে রাখতে বিএনপিদলীয় অফিস, প্রেস ক্লাব বা এ জাতীয় আরও কিছু ভেন্যুতে কিছু মৌসুমি বক্তব্য দিয়ে চলেছে। কিন্তু 'কঠোর' আন্দোলনের এখন আর কোনো নাম-নিশানা নেই। যাকগে, কোন দল কী করবে তা আমাদের মতো সাধারণ্যের বিষয় নয়।
তবে রণাঙ্গনেই হোক বা রাজনীতির অঙ্গনেই হোক, প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যে শক্তির একটা ভারসাম্য না থাকলে এবং একটি দলই প্রবল হলে_ এক প্রকার অচলাবস্থার (উবধফষড়পশ) সৃষ্টি হয়। তাতে ইন্ধন জোগায় অনেক ধরনের কায়েমি স্বার্থবাদীরা। তেমনই একটি রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন বাংলাদেশে বিরাজ করছে, যা একেবারেই অনভিপ্রেত। একটি দেশ শাসনে ব্যর্থ সরকার শুধু ক্ষমতায় থাকার সুবাদেই ক্ষমতা কুক্ষিগত ও প্রলম্বিত করার কলকাঠি আয়ত্তে নিয়েছে। আমজনতা সেটা পছন্দ না করলেও ক্ষমতাসীনদের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক শক্তি দুর্বল ও বিভক্ত হওয়ার কারণে দেশব্যাপী অসন্তোষ পুঞ্জীভূত হয়েই চলেছে। এটা অবশ্যই কোনো সুলক্ষণ নয়। রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মতে চুলচেরা সমতা থাক, অন্তত প্রতিপক্ষ এবং তার দুষ্কার্যগুলো ঠেকাতে বিরোধী দলের এককভাবেই হোক বা যৌথভাবেই অন্তত একটি রক্ষণভাগের যুদ্ধ লড়ার ক্ষমতা থাকতেই হবে।
কী ভাবছেন একসময়ের আপসহীন নেত্রী খালেদা জিয়া এবং কেনই-বা তার মিত্র জামায়াত-শিবিরের মধ্যে আজকের এই আত্মঘাতী প্রবণতা? দেশের অনেক মানুষ তাকিয়ে আছে বর্তমান প্রশাসনের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে। অন্তত তাদের খাতিরে সমমনাদের নিয়ে একটি কৌশল ও নীতিনির্ধারণের সময় আজ। মনে রাখতে হবে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তগত না হয়, একটি রাজপথের আন্দোলন তাকে কঠোরই বলুন আর নরম, তাতে পারঙ্গমতাই নির্ধারণ করবে জয়ের মুকুট কে পরবে ২০১৪ সালে দশম সংসদের নির্বাচনে। সামনে যত বাধাই প্রতীয়মান হোক, দলের বা ব্যক্তির সাহসের কাছে সেসব বাধার অন্তরায় টিকতে পারবে না। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস সে কথাই বলে। শুধু ক্ষমতার দম্ভে যারা চিবিয়ে চিবিয়ে দুর্বল পক্ষের জন্য কটুকাটব্য করে তারা নৈতিক কর্তৃত্বহীন।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস ও
কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.