চলছে অবৈধ ভিওআইপি- ১২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ তিন বছরে by অনিকা ফারজানা
বহাল তবিয়তে চলছে অবৈধ বৈদেশিক টেলিফোন কল আদান-প্রদান বা ভিওআইপি। গত তিন বছরে অন্তত ১২ হাজার কোটি টাকার অবৈধ ভিওআইপি হয়েছে। মূলত সরকারি কিছু কর্মকর্তা এই অবৈধ ভিওআইপির সঙ্গে জড়িত।
এর মধ্যে বৈদেশিক কল সংরক্ষণ না করে সরকারের সাত হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আত্মসাৎ করেছেন বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সঙ্গে যোগসাজশে অবৈধ ভিওআইপি (বৈদেশিক টেলিযোগাযোগ) ব্যবসা করে আত্মসাৎ করা হয়েছে আরও প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
বিটিসিএলের কর্মকর্তারা অবৈধ ভিওআইপির মূল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হলেও এর পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছেন অবসর নেওয়া সরকারি কিছু ঊর্ধ্বতন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা। তাঁরা নিয়মিত অর্থের একটি বড় অংশ পান। অথচ এসব কর্মকর্তা সরকারের উচ্চ দায়িত্বশীল পদে রয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়।
অবৈধ ভিওআইপি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করছে। ইতিমধ্যে ছয়টি মামলাও করা হয়েছে। মহাখালীর আন্তর্জাতিক টেলিফোন এক্সচেঞ্জের (আইটিএক্স-৫) ৪৫ লাখ কলের যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণের সিডিআর (কল ডিটেইল রেকর্ড) নষ্ট করে ফেলা হয়েছে বলেও প্রমাণ পেয়েছে দুদকের অনুসন্ধান দল। তদন্তে ভিওআইপির সঙ্গে জড়িত প্রায় ৩০ জন সরকারি কর্মকর্তার দুর্নীতির তথ্য পর্যায়ক্রমে বের হয়ে আসছে।
এ প্রসঙ্গে দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সরষের মধ্যেই ভূত রয়েছে। একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা যদি কোনো ধরনের অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে যান, তবে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব নয়। তিনি জানান, ইতিমধ্যে বিটিসিএলের যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাঁদের গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সিডিআরে ৫০ শতাংশ কলের তথ্য নেই: দুদকের অনুসন্ধানের তথ্য অনুযায়ী, মহাখালীর আইটিএক্স-৫ ও ৭-এর মাধ্যমে গত তিন বছরের প্রতিদিনের গড়ে ৫০ শতাংশ বৈদেশিক কল একদমই সংরক্ষণ করা হয়নি। এতে করে দিনে প্রায় দুই থেকে আড়াই কোটি কল মিনিটের কোনো হিসাব বিটিসিএলে নেই। এসব কলের রাজস্ব বাবদ প্রতি মিনিট ৩ দশমিক ৪৫ মার্কিন সেন্ট হিসাবে দিনে গড়ে ছয় কোটি টাকার রাজস্ব সরকারি কোষাগারে জমা হয়নি। এ হিসাবে গত তিন বছরে ওই দুই আইটিএক্স থেকে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। এ বিষয়ে আরও তদন্ত চলছে।
গত মে মাসের শুরুতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশে সিডিআরে কল রেকর্ড না হওয়ার বিষয়ে বিটিসিএলের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩০ মে মহাখালী আইটিএক্স-৫ ও ৭-এর কল রেকর্ড যাচাইয়ে গেলে কমিটির পক্ষে শুধু আইটিএক্স-৫-এর তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়েছে। কিন্তু আইটিএক্স-৭-এর মাধ্যমে আসা কলের তথ্য পাননি তাঁরা। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা কমিটিকে জানান, নির্ধারিত পাসওয়ার্ড কাজ করছে না। পরদিন, অর্থাৎ ৩১ মে ওই আইটিএক্সের পাসওয়ার্ড কাজ করছে জানিয়ে কমিটির কাছে কিছু তথ্য দেন প্রকৌশলীরা।
এ ঘটনায় কমিটির বক্তব্য, সিডিআরে গরমিল করছেন আইটিএক্সের কর্মকর্তারাই। এটি কোনো ধরনের কারিগরি ত্রুটি নয়। আর এ গরমিল করা হয়েছে মূল সিস্টেমে পরিবর্তন ঘটিয়ে।
এ ছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) তথ্য এবং বিটিসিএলের গেটওয়ে দিয়ে আসা বিদেশি কলের তথ্যে প্রচুর গরমিল পেয়েছে তদন্ত কমিটি। কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পার্থক্যের পরিমাণ এত বেশি যে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে।
ক্যারিয়ার রহস্য: এক দেশ থেকে অন্য দেশে কল আনা-নেওয়ার প্রতিষ্ঠানকে ক্যারিয়ার বলে। বিটিসিএলের তালিকায় এ ধরনের ক্যারিয়ারের সংখ্যা ১৯টি। কিন্তু কল আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বেনামি ক্যারিয়ার বিল দেখিয়ে অর্থ তুলে নেওয়া হয়। বৈধ ক্যারিয়ারের কল নেওয়ার যন্ত্রপাতিতে (এসটিএম-১ ও ই-১) কৌশল করেই ওই সব অবৈধ ক্যারিয়ারের কল বাংলাদেশে আনা-নেওয়া করেন বিটিসিএলের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
বর্তমানে বিদেশি ক্যারিয়ারগুলোর অধিকাংশই ভুয়া নাম-ঠিকানা দিয়ে এসটিএম বা ই-১-এর সংযোগ নিয়েছে। বিটিসিএল কর্তৃপক্ষের কাছেও এদের কোনো নাম-ঠিকানা নেই। এর সঙ্গেও জড়িত বিটিসিএলের কর্মকর্তারাই। দুদক অনুসন্ধান করে এসব অবৈধ ক্যারিয়ার ও তাদের মাধ্যমে পাঠানো মাত্র ৩০ শতাংশ কলের রেকর্ড থেকে ইতিমধ্যে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা সরকারি অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে।
দুদকের মামলা: ইতিমধ্যে ২০৫ কোটি টাকা সরকারি রাজস্ব ক্ষতি ও আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বিটিসিএলের সদস্য (রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা) মোহাম্মদ তৌফিকসহ ছয়জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পৃথক পাঁচটি মামলা করেছে দুদক। অন্য আসামিরা হচ্ছেন: বিটিসিএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সাঈদ খান, বর্তমান পরিচালক মাহবুবুর রহমান, বিভাগীয় প্রকৌশলী এ কে এম আসাদুজ্জামান, সাবেক বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আবদুল হালিম এবং বিটিসিএলের সাবেক পরিচালক ও টেলিটকের বর্তমান মহাব্যবস্থাপক মাহফুজার রহমান।
পাঁচ মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, প্রাইভেট ক্যারিয়ার সিঙ্গাপুরের ডিজিটেক ৯৬ কোটি ৪১ লাখ ৯৯ হাজার ৪৬৪ টাকা ও আই পাওয়ার ৪৪ কোটি ৯৬ লাখ ৯৪ হাজার ১৭৭ টাকা, আমেরিকার এরিস্টো কল ১৫ কোটি ৫১ লাখ চার হাজার ১০৭ টাকা, সিঙ্গাপুরের এনটিএস গ্লোবাল ২৪ কোটি ৩৯ লাখ ৫৩ হাজার ৩২৮ টাকা এবং ব্রিটেনের সিম্পল টেলিকম ২৩ কোটি ৬৯ লাখ ৬০ হাজার ২৯২ টাকা আত্মসাৎ করেছে।
দুদকের অনুসন্ধান দলের প্রধান ও দুদকের উপপরিচালক এস এম সাহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অনুসন্ধানের প্রাথমিক পর্যায়ে অবৈধ ভিওআইপির মাধ্যমে কত কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। নথিপত্র দেখে ধারণা করা হচ্ছে, ইতিমধ্যে চার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। মাত্র ৩০ শতাংশ কলের রেকর্ড ও নথিপত্রের মাধ্যমে ২০৫ কোটি টাকা আত্মসাতের তথ্য পাওয়া গেছে। বিটিসিএলের এ চক্র প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ জনের। তিনি আরও বলেন, এ প্রক্রিয়ায় কমপক্ষে পাঁচ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি ও সরকারি অর্থ লোপাটের তথ্য বের হয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি এই অনিয়মের সঙ্গে বিটিসিএলের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের যোগসাজশের বিষয়টিও ধীরে ধীরে সামনে চলে আসছে।
অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার রমরমা অবস্থা শুরু হয়েছিল বিগত বিএনপি সরকারের সময় থেকেই। ওই সময় তৎকালীন টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিফোন অ্যান্ড টেলিগ্রাফ বোর্ড (বিটিটিবি, বর্তমানে বিটিসিএল) একাই বিদেশি কল আদান-প্রদান করত। ২০০৩ সালে বিটিটিবির পক্ষ থেকে অবৈধ ভিওআইপির অভিযোগ উঠেছিল তখনকার বিভিন্ন প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নামে।
এর পরে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তৎকালীন বিটিআরসি অবৈধ ভিওআইপির বিরুদ্ধে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে। সে সময় অবৈধ ভিওআইপির পরিমাণও অনেক কমে যায়।
এরপর ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম বছরেই দিনপ্রতি প্রায় আড়াই কোটি মিনিট বিদেশি কলের কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ওই আড়াই কোটি মিনিট বিদেশি কল হয়েছে অবৈধ পথে। বিটিআরসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১০ ও ২০১১—এ দুই বছর অবৈধ ভিওআইপির ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে সরকারি দুই টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান বিটিসিএল ও মুঠোফোন অপারেটর টেলিটক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভিওআইপি উন্মুক্ত করে দিলে এই অনিয়ম বন্ধ হবে। এ জন্য বিটিআরসি ভিওআইপি সার্ভিস প্রোভাইডার (ভিএসপি) নামে একটি নীতিমালাও করেছে। এ জন্য আবেদনপত্রও আহ্বান করা হয়। কিন্তু এরপর কোনো অগ্রগতি নেই। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অবৈধ অর্থের উৎস বন্ধ হবে বলেই নীতিমালা করেও সহসা ভিওআইপি উন্মুক্ত করা হচ্ছে না বলে সূত্রগুলো বলছে।
এ বিষয়ে বিটিআরসির চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি বোস বলেন, ভিওআইপি বন্ধের একটাই উপায়—এটি উন্মুক্ত করে দেওয়া। এতে ভিওআইপিও বন্ধ হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, এ বিষয়ে কাজ চলছে। বিটিসিএলের ভিওআইপি বন্ধ করা নিয়ে তিনি বলেন, শিগগির এ বিষয়ে কিছু কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বিটিসিএলের কর্মকর্তারা অবৈধ ভিওআইপির মূল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হলেও এর পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছেন অবসর নেওয়া সরকারি কিছু ঊর্ধ্বতন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা। তাঁরা নিয়মিত অর্থের একটি বড় অংশ পান। অথচ এসব কর্মকর্তা সরকারের উচ্চ দায়িত্বশীল পদে রয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়।
অবৈধ ভিওআইপি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করছে। ইতিমধ্যে ছয়টি মামলাও করা হয়েছে। মহাখালীর আন্তর্জাতিক টেলিফোন এক্সচেঞ্জের (আইটিএক্স-৫) ৪৫ লাখ কলের যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণের সিডিআর (কল ডিটেইল রেকর্ড) নষ্ট করে ফেলা হয়েছে বলেও প্রমাণ পেয়েছে দুদকের অনুসন্ধান দল। তদন্তে ভিওআইপির সঙ্গে জড়িত প্রায় ৩০ জন সরকারি কর্মকর্তার দুর্নীতির তথ্য পর্যায়ক্রমে বের হয়ে আসছে।
এ প্রসঙ্গে দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সরষের মধ্যেই ভূত রয়েছে। একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা যদি কোনো ধরনের অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে যান, তবে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব নয়। তিনি জানান, ইতিমধ্যে বিটিসিএলের যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাঁদের গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সিডিআরে ৫০ শতাংশ কলের তথ্য নেই: দুদকের অনুসন্ধানের তথ্য অনুযায়ী, মহাখালীর আইটিএক্স-৫ ও ৭-এর মাধ্যমে গত তিন বছরের প্রতিদিনের গড়ে ৫০ শতাংশ বৈদেশিক কল একদমই সংরক্ষণ করা হয়নি। এতে করে দিনে প্রায় দুই থেকে আড়াই কোটি কল মিনিটের কোনো হিসাব বিটিসিএলে নেই। এসব কলের রাজস্ব বাবদ প্রতি মিনিট ৩ দশমিক ৪৫ মার্কিন সেন্ট হিসাবে দিনে গড়ে ছয় কোটি টাকার রাজস্ব সরকারি কোষাগারে জমা হয়নি। এ হিসাবে গত তিন বছরে ওই দুই আইটিএক্স থেকে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। এ বিষয়ে আরও তদন্ত চলছে।
গত মে মাসের শুরুতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশে সিডিআরে কল রেকর্ড না হওয়ার বিষয়ে বিটিসিএলের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩০ মে মহাখালী আইটিএক্স-৫ ও ৭-এর কল রেকর্ড যাচাইয়ে গেলে কমিটির পক্ষে শুধু আইটিএক্স-৫-এর তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়েছে। কিন্তু আইটিএক্স-৭-এর মাধ্যমে আসা কলের তথ্য পাননি তাঁরা। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা কমিটিকে জানান, নির্ধারিত পাসওয়ার্ড কাজ করছে না। পরদিন, অর্থাৎ ৩১ মে ওই আইটিএক্সের পাসওয়ার্ড কাজ করছে জানিয়ে কমিটির কাছে কিছু তথ্য দেন প্রকৌশলীরা।
এ ঘটনায় কমিটির বক্তব্য, সিডিআরে গরমিল করছেন আইটিএক্সের কর্মকর্তারাই। এটি কোনো ধরনের কারিগরি ত্রুটি নয়। আর এ গরমিল করা হয়েছে মূল সিস্টেমে পরিবর্তন ঘটিয়ে।
এ ছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) তথ্য এবং বিটিসিএলের গেটওয়ে দিয়ে আসা বিদেশি কলের তথ্যে প্রচুর গরমিল পেয়েছে তদন্ত কমিটি। কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পার্থক্যের পরিমাণ এত বেশি যে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে।
ক্যারিয়ার রহস্য: এক দেশ থেকে অন্য দেশে কল আনা-নেওয়ার প্রতিষ্ঠানকে ক্যারিয়ার বলে। বিটিসিএলের তালিকায় এ ধরনের ক্যারিয়ারের সংখ্যা ১৯টি। কিন্তু কল আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বেনামি ক্যারিয়ার বিল দেখিয়ে অর্থ তুলে নেওয়া হয়। বৈধ ক্যারিয়ারের কল নেওয়ার যন্ত্রপাতিতে (এসটিএম-১ ও ই-১) কৌশল করেই ওই সব অবৈধ ক্যারিয়ারের কল বাংলাদেশে আনা-নেওয়া করেন বিটিসিএলের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
বর্তমানে বিদেশি ক্যারিয়ারগুলোর অধিকাংশই ভুয়া নাম-ঠিকানা দিয়ে এসটিএম বা ই-১-এর সংযোগ নিয়েছে। বিটিসিএল কর্তৃপক্ষের কাছেও এদের কোনো নাম-ঠিকানা নেই। এর সঙ্গেও জড়িত বিটিসিএলের কর্মকর্তারাই। দুদক অনুসন্ধান করে এসব অবৈধ ক্যারিয়ার ও তাদের মাধ্যমে পাঠানো মাত্র ৩০ শতাংশ কলের রেকর্ড থেকে ইতিমধ্যে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা সরকারি অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে।
দুদকের মামলা: ইতিমধ্যে ২০৫ কোটি টাকা সরকারি রাজস্ব ক্ষতি ও আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বিটিসিএলের সদস্য (রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা) মোহাম্মদ তৌফিকসহ ছয়জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পৃথক পাঁচটি মামলা করেছে দুদক। অন্য আসামিরা হচ্ছেন: বিটিসিএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সাঈদ খান, বর্তমান পরিচালক মাহবুবুর রহমান, বিভাগীয় প্রকৌশলী এ কে এম আসাদুজ্জামান, সাবেক বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আবদুল হালিম এবং বিটিসিএলের সাবেক পরিচালক ও টেলিটকের বর্তমান মহাব্যবস্থাপক মাহফুজার রহমান।
পাঁচ মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, প্রাইভেট ক্যারিয়ার সিঙ্গাপুরের ডিজিটেক ৯৬ কোটি ৪১ লাখ ৯৯ হাজার ৪৬৪ টাকা ও আই পাওয়ার ৪৪ কোটি ৯৬ লাখ ৯৪ হাজার ১৭৭ টাকা, আমেরিকার এরিস্টো কল ১৫ কোটি ৫১ লাখ চার হাজার ১০৭ টাকা, সিঙ্গাপুরের এনটিএস গ্লোবাল ২৪ কোটি ৩৯ লাখ ৫৩ হাজার ৩২৮ টাকা এবং ব্রিটেনের সিম্পল টেলিকম ২৩ কোটি ৬৯ লাখ ৬০ হাজার ২৯২ টাকা আত্মসাৎ করেছে।
দুদকের অনুসন্ধান দলের প্রধান ও দুদকের উপপরিচালক এস এম সাহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অনুসন্ধানের প্রাথমিক পর্যায়ে অবৈধ ভিওআইপির মাধ্যমে কত কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। নথিপত্র দেখে ধারণা করা হচ্ছে, ইতিমধ্যে চার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। মাত্র ৩০ শতাংশ কলের রেকর্ড ও নথিপত্রের মাধ্যমে ২০৫ কোটি টাকা আত্মসাতের তথ্য পাওয়া গেছে। বিটিসিএলের এ চক্র প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ জনের। তিনি আরও বলেন, এ প্রক্রিয়ায় কমপক্ষে পাঁচ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি ও সরকারি অর্থ লোপাটের তথ্য বের হয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি এই অনিয়মের সঙ্গে বিটিসিএলের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের যোগসাজশের বিষয়টিও ধীরে ধীরে সামনে চলে আসছে।
অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার রমরমা অবস্থা শুরু হয়েছিল বিগত বিএনপি সরকারের সময় থেকেই। ওই সময় তৎকালীন টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিফোন অ্যান্ড টেলিগ্রাফ বোর্ড (বিটিটিবি, বর্তমানে বিটিসিএল) একাই বিদেশি কল আদান-প্রদান করত। ২০০৩ সালে বিটিটিবির পক্ষ থেকে অবৈধ ভিওআইপির অভিযোগ উঠেছিল তখনকার বিভিন্ন প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নামে।
এর পরে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তৎকালীন বিটিআরসি অবৈধ ভিওআইপির বিরুদ্ধে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে। সে সময় অবৈধ ভিওআইপির পরিমাণও অনেক কমে যায়।
এরপর ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম বছরেই দিনপ্রতি প্রায় আড়াই কোটি মিনিট বিদেশি কলের কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ওই আড়াই কোটি মিনিট বিদেশি কল হয়েছে অবৈধ পথে। বিটিআরসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১০ ও ২০১১—এ দুই বছর অবৈধ ভিওআইপির ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে সরকারি দুই টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান বিটিসিএল ও মুঠোফোন অপারেটর টেলিটক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভিওআইপি উন্মুক্ত করে দিলে এই অনিয়ম বন্ধ হবে। এ জন্য বিটিআরসি ভিওআইপি সার্ভিস প্রোভাইডার (ভিএসপি) নামে একটি নীতিমালাও করেছে। এ জন্য আবেদনপত্রও আহ্বান করা হয়। কিন্তু এরপর কোনো অগ্রগতি নেই। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অবৈধ অর্থের উৎস বন্ধ হবে বলেই নীতিমালা করেও সহসা ভিওআইপি উন্মুক্ত করা হচ্ছে না বলে সূত্রগুলো বলছে।
এ বিষয়ে বিটিআরসির চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি বোস বলেন, ভিওআইপি বন্ধের একটাই উপায়—এটি উন্মুক্ত করে দেওয়া। এতে ভিওআইপিও বন্ধ হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, এ বিষয়ে কাজ চলছে। বিটিসিএলের ভিওআইপি বন্ধ করা নিয়ে তিনি বলেন, শিগগির এ বিষয়ে কিছু কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
No comments