সুভাষ দত্তের প্রস্থান-অভিমান না অভিনয় by ফরিদুর রেজা সাগর
অভিমান নয়। অভিনয় নয়। এই কিছুদিন আগে সুভাষ দত্ত ফোন করেছিলেন। 'সাগর কী হলো?... ছবি করতে না দাও, নাটক তো করতে দেবে!' বললাম, 'দত্তদা, আপনি ভালো করে জানেন চ্যানেল আইয়ের দরজা আপনার জন্য সবসময়ই খোলা।'
সুভাষ দত্ত হাসলেন ওপাশ থেকে।
'হ্যাঁ। আমি একটা স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাজ করছি। শেষ হলেই চলে আসতে দেরি হবে না। '
'নিশ্চয়ই। আপনি একদমই চিন্তা করবেন না। চলে আসুন। আপনি আমাদের ভবনে চলে এলে আমরা আনন্দিত হই। আলোকিত হই সবসময়।'
দত্তদার সৃজনশীল কাজে উৎসাহের কমতি দেখিনি কখনও। কাগজে পড়েছি। লোকমুখে শুনেছি। মুখোমুখি পরিচয়ের পর সেটা প্রত্যক্ষ করেছি স্বচক্ষে। ধারণা করি, তিনি জীবনের শুরু থেকেই এই মেজাজের মানুষটি ছিলেন। তিনি শুধুই ভেবেছেন, মানুষকে কীভাবে আনন্দ দেবেন। মানুষের সঙ্গে কী করে তার কাজ দিয়ে একটা যোগাযোগ তৈরি করবেন। থাকবেন সবার কাছাকাছি। সম্ভবত সেটিই ছিল সুভাষ দত্তের একমাত্র ধ্যান ও অভ্যাস। ধারণা-জ্ঞান।
তার মধ্যে আরও একটি অ্যাঙ্গেল লক্ষ্য করেছি। তিনি যে কাজটি করবেন সেটা সিনেমায় কি নাটকে, তার মধ্যে নতুনত্ব রাখার আপ্রাণ চেষ্টা। নতুন ভাবনা। নতুন শিল্পী। নতুন প্রয়োগ। নতুন প্যাটার্ন। সে জন্য হতেন তিনি কখনও কখনও দুরন্ত সাহসী। এই অসামান্য সাহস থেকেই সম্ভবত 'সুতরাং' ছবিতে নতুন নায়িকা নিয়ে, নিজেই হয়ে বসেছিলেন নায়ক। এই নতুনত্ব দেখিয়ে প্রবল সাফল্যের পরও কেবলই নায়ক জীবন বেছে নেওয়ার কথা আর ভাবেননি। তারপরে দুর্দান্ত সাফল্য পায় তার অন্যধারার গল্প নিয়ে বানানো ছবি 'আবির্ভাব'।
তার মানে অনেক কিছু নতুন থাকতে হবে। পুনরাবৃত্তি চলবে না। কাজের মধ্যে এই অভিনবত্ব রাখার জন্য সবসময় ব্যস্ত ছিলেন। ব্যতিব্যস্ত ছিলেন একটি চিন্তাতে, কী করে আরেকটি নতুন কাজ নিয়ে দর্শকের সামনে আসা যায়। যারা সুভাষ দত্তের সঙ্গে কাজ করেছেন, যারা সুভাষ দত্তকে নিয়ে কাজ করেছেন, আমি জানি তারা সবাই এবং অনেক তরুণ নির্মাতা শিক্ষার্থী সবাই খেয়াল করেছেন, এই পরিচালক-অভিনেতা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত করে গেছেন নতুনের সন্ধান।
সুভাষ দত্তের ছবিগুলোর কথা সবাই জানেন। নাটকেও, একটা গল্পের সঙ্গে আরেকটা গল্পের কোনো রকম মিল নেই। যুদ্ধ ছিল তার নিজের সঙ্গে। নানাভাবে নিজের পুরনো চিন্তাকে ভাঙার যুদ্ধ।
আমাদের সঙ্গে দত্তদার চাক্ষুষ আলোচনা, একটি প্যাকেজ নাটক তৈরির সময়। রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে ছিল সে প্রযোজনা। কামরুন্নেছা হাসানের পরিচালনা। নাট্য রূপায়ণ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের। প্যাকেজে প্রথম সুবর্ণা-ফরীদির এক সঙ্গে অভিনয়। সেখানে একটি বিশেষ চরিত্রে ভাবা হলো সুঅভিনেতা সুভাষ দত্তকে।
খুব ভয়ে ভয়ে তাকে প্রস্তাব দেওয়া হলো। চলচ্চিত্রের এত বড় ডাকসাইটে পরিচালক-অভিনেতা।প্যাকেজ নাটকের ডাকে যদি বিরক্তবোধ করেন। পাণ্ডুলিপিতে চোখ বুলিয়েই সানন্দে সম্মতি দিলেন সুভাষ দত্ত। শুধু এখানেই শেষ নয়. রাত জেগে বেঙ্গল স্টুডিওতে শুটিং করলেন। ক্লান্ত দেখায়নি একবারও তাকে। পরম উৎসাহে, পরম আনন্দে কাজ করে যেতে দেখেছি। হৈচৈ আর মজার মধ্যে কাজ করে গেছেন। সে মুহূর্তে কখনও মনে হয়নি তার বয়স ষাট পার হয়ে গেছে।
এই নাটকটি করার মধ্যে দুটি ঘটনা ঘটল। আমরা চাইলাম, টেলিভিশনের ফ্রিল্যান্স নাটকে তার নিয়মিত ইনভলবমেন্ট। একই সঙ্গে তিনি নিজেও এই জগতে জড়িত হওয়ার কথা ভাবলেন মনে মনে। তাতে একে এক দুই হয়ে গেল।
বলেছিলাম, 'দত্তদা আপনি টেলিভিশনে যখন কাজ করবেন, নিশ্চয়ই আপনার এতদিনের চলচ্চিত্র জগতের শিল্পী-কুশলীদের নিয়েই করবেন। তাতে টিভি নাটকে নতুনত্ব আসবে, আমরাও সেটাতে সম্পূরক হতে চাইব, ছবির জগতের সৃষ্টিশীল সব মানুষ নিশ্চয় আপনি ডাকলে আগ্রহ দেখাবেন।
চ্যালেঞ্জ নিলেন সুভাষ দত্ত। নতুন ভূমিতে বৃক্ষরোপণের অভিযান শুরু হলো। তিনি তৈরি করলেন প্যাকেজ নাটক। নায়িকা হলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্রাভিনেত্রী শবনম।
এরপরের পর্যায়ে একে একে যে নাটকগুলো তিনি বানালেন, সেখানেও তার এই চ্যালেঞ্জিং ভাবটাতে ঘাটতি দেখলাম না। এর মধ্যে এক আশ্চর্য সুন্দর গল্প নিয়ে প্যাকেজ নাটক বানালেন। যার সহপ্রযোজক ছিলেন চিত্রগ্রাহক সমীর কুশারী। অভিনেতা হিসেবে নিলেন তরুণ পরিচালক-অভিনেতা সতীর্থ রুবেলকে।
প্রতিবন্ধী এক ছেলের কঠিন ভূমিকায় রুবেলকে হাজির করলেন সুভাষ দত্ত। লক্ষ্য পূরণ হলো। অসম্ভব আলোড়ন উঠল নাটকটি অনএয়ারে যাওয়ার পর। এই মানুষটি নিজের সফল ছবিতেই নয়, নাটকেই নয়, আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান পরিচালক মৃণাল সেনের ছবিতেও কাজ করেছেন। এমন নানা কৃতি রয়েছে তার। যার সবই পাঠকরা জানেন। এই যে নতুন কিছু করার দৌড়ে ছুটতেন সুভাষ দত্ত, সেই মানুষটির সঙ্গে আমাদের শেষ ছবি হচ্ছে 'ও আমার ছেলে'। টেস্ট টিউব বেবির কাহিনী নিয়ে ছবিটি। জটিল আর কঠিন বিষয় নিয়ে তার এই প্রয়াসে আমরা একবিন্দুও বাধা দেয়নি। প্রচুর দর্শক আকর্ষণে মনোযোগ নাও পেতে পারেন, সেই ঝুঁকির মধ্যে সুভাষ দত্ত যদি আসন নিতে পারেন আমরা 'না' বলব কোন সাহসে।
ছবিটি শেষ হলো। রিলিজ হলো। দেখলাম এখানেও তিনি বিষয়বস্তুতে শুধু নয়, নতুন কিছু শিল্পী তৈরি করতেও উদ্যোগী হয়েছেন। দেখেছি তিনি ক্রমশ যে জীবন বেছে নিয়েছিলেন, সেটা নৈর্ব্যক্তিক। সাত্তি্বক। দেখেছি সে জীবনে প্রতি সোমবার তিনি নিয়ম করে নীরবতা পালন করতেন। সোমবার সারাদিন কথা বলতেন না কারও সঙ্গে। এই মৌনব্রতের দিনে বের হতেন না ঘর থেকে। এ ছাড়া প্রতিদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত পালন করেছেন মৌনতা। যে সুভাষ দত্তকে পর্দায় প্রাঞ্জল-উৎফুল্ল আর অনেক কথা-বলা-মানুষ হিসেবে আমরা পেয়েছি, সেই সুভাষ দত্তের প্রাত্যহিক জীবনে এর ব্যত্যয় ঘটেনি একবারও।
আমাদের অফিসে যেদিন আসতেন শুধু শসা খেতেন। ওটাই ছিল তার একমাত্র পছন্দ। নির্লোভ এই মানুষটিকে দুবাইয়ের এক অনুষ্ঠানে আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। মঞ্চে উঠে যা উপস্থাপনা করলেন, মনে হয়েছিল তার বয়স একটুও বাড়েনি। আঠারোতেই থেমে আছেন তরুণ হিসেবে। সুন্দর সুন্দর শিশুতোষ সংলাপ আর শরীরী ভাষায় সত্তর বয়সী মানুষটি যা দেখালেন তিরিশ বছরের যুবক অভিনেতারও চমকে যাওয়ার মতো।
চিরসবুজ মানুষটি সেই মঞ্চের বাইরেও কখনও আমাদের বুঝতে দেননি তার বয়স আশির দিকে এগোচ্ছে। তিনি 'নতুন সুভাষ দত্ত' হওয়ার চেষ্টা করেছেন নিরন্তর। সাধক সুভাষ দত্ত হওয়ার চেষ্টা করেছেন। নৈর্ব্যক্তিক সুভাষ দত্ত হওয়ার অনুশীলন করেছেন ।
তাতে তার মনের মতো শিল্পী, কলাকুশলী, পাণ্ডুলিপি যখন পেতেন না তখন তার মধ্যে প্রচণ্ড 'অভিমান' কাজ করতেও দেখেছি। তাই তিনি যখন আজ চলে গেলেন না-ফেরার দেশে, তখন আমার মনে হচ্ছে তিনি শেষ দিকে ব্যক্তিজীবনে যে মৌনব্রত নিয়েছিলেন, এটাকেই যেন দীর্ঘায়িত করলেন। প্রচণ্ড অভিমান নিয়ে এক কিশোর যেন চিরদিনের জন্য মৌন হয়ে গেল!
আমরা যদি তার মতো সৃজনশীল মানুষটিকে চলচ্চিত্রে-টেলিভিশনে সত্যিকার জায়গাটা দিতে পারি, দিতে পারি সম্মান, তা হলেই হয়তো অন্যলোকে তার অভিমান ভাঙবে।
ফরিদুর রেজা সাগর :মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চ্যানেল আই
'হ্যাঁ। আমি একটা স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাজ করছি। শেষ হলেই চলে আসতে দেরি হবে না। '
'নিশ্চয়ই। আপনি একদমই চিন্তা করবেন না। চলে আসুন। আপনি আমাদের ভবনে চলে এলে আমরা আনন্দিত হই। আলোকিত হই সবসময়।'
দত্তদার সৃজনশীল কাজে উৎসাহের কমতি দেখিনি কখনও। কাগজে পড়েছি। লোকমুখে শুনেছি। মুখোমুখি পরিচয়ের পর সেটা প্রত্যক্ষ করেছি স্বচক্ষে। ধারণা করি, তিনি জীবনের শুরু থেকেই এই মেজাজের মানুষটি ছিলেন। তিনি শুধুই ভেবেছেন, মানুষকে কীভাবে আনন্দ দেবেন। মানুষের সঙ্গে কী করে তার কাজ দিয়ে একটা যোগাযোগ তৈরি করবেন। থাকবেন সবার কাছাকাছি। সম্ভবত সেটিই ছিল সুভাষ দত্তের একমাত্র ধ্যান ও অভ্যাস। ধারণা-জ্ঞান।
তার মধ্যে আরও একটি অ্যাঙ্গেল লক্ষ্য করেছি। তিনি যে কাজটি করবেন সেটা সিনেমায় কি নাটকে, তার মধ্যে নতুনত্ব রাখার আপ্রাণ চেষ্টা। নতুন ভাবনা। নতুন শিল্পী। নতুন প্রয়োগ। নতুন প্যাটার্ন। সে জন্য হতেন তিনি কখনও কখনও দুরন্ত সাহসী। এই অসামান্য সাহস থেকেই সম্ভবত 'সুতরাং' ছবিতে নতুন নায়িকা নিয়ে, নিজেই হয়ে বসেছিলেন নায়ক। এই নতুনত্ব দেখিয়ে প্রবল সাফল্যের পরও কেবলই নায়ক জীবন বেছে নেওয়ার কথা আর ভাবেননি। তারপরে দুর্দান্ত সাফল্য পায় তার অন্যধারার গল্প নিয়ে বানানো ছবি 'আবির্ভাব'।
তার মানে অনেক কিছু নতুন থাকতে হবে। পুনরাবৃত্তি চলবে না। কাজের মধ্যে এই অভিনবত্ব রাখার জন্য সবসময় ব্যস্ত ছিলেন। ব্যতিব্যস্ত ছিলেন একটি চিন্তাতে, কী করে আরেকটি নতুন কাজ নিয়ে দর্শকের সামনে আসা যায়। যারা সুভাষ দত্তের সঙ্গে কাজ করেছেন, যারা সুভাষ দত্তকে নিয়ে কাজ করেছেন, আমি জানি তারা সবাই এবং অনেক তরুণ নির্মাতা শিক্ষার্থী সবাই খেয়াল করেছেন, এই পরিচালক-অভিনেতা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত করে গেছেন নতুনের সন্ধান।
সুভাষ দত্তের ছবিগুলোর কথা সবাই জানেন। নাটকেও, একটা গল্পের সঙ্গে আরেকটা গল্পের কোনো রকম মিল নেই। যুদ্ধ ছিল তার নিজের সঙ্গে। নানাভাবে নিজের পুরনো চিন্তাকে ভাঙার যুদ্ধ।
আমাদের সঙ্গে দত্তদার চাক্ষুষ আলোচনা, একটি প্যাকেজ নাটক তৈরির সময়। রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে ছিল সে প্রযোজনা। কামরুন্নেছা হাসানের পরিচালনা। নাট্য রূপায়ণ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের। প্যাকেজে প্রথম সুবর্ণা-ফরীদির এক সঙ্গে অভিনয়। সেখানে একটি বিশেষ চরিত্রে ভাবা হলো সুঅভিনেতা সুভাষ দত্তকে।
খুব ভয়ে ভয়ে তাকে প্রস্তাব দেওয়া হলো। চলচ্চিত্রের এত বড় ডাকসাইটে পরিচালক-অভিনেতা।প্যাকেজ নাটকের ডাকে যদি বিরক্তবোধ করেন। পাণ্ডুলিপিতে চোখ বুলিয়েই সানন্দে সম্মতি দিলেন সুভাষ দত্ত। শুধু এখানেই শেষ নয়. রাত জেগে বেঙ্গল স্টুডিওতে শুটিং করলেন। ক্লান্ত দেখায়নি একবারও তাকে। পরম উৎসাহে, পরম আনন্দে কাজ করে যেতে দেখেছি। হৈচৈ আর মজার মধ্যে কাজ করে গেছেন। সে মুহূর্তে কখনও মনে হয়নি তার বয়স ষাট পার হয়ে গেছে।
এই নাটকটি করার মধ্যে দুটি ঘটনা ঘটল। আমরা চাইলাম, টেলিভিশনের ফ্রিল্যান্স নাটকে তার নিয়মিত ইনভলবমেন্ট। একই সঙ্গে তিনি নিজেও এই জগতে জড়িত হওয়ার কথা ভাবলেন মনে মনে। তাতে একে এক দুই হয়ে গেল।
বলেছিলাম, 'দত্তদা আপনি টেলিভিশনে যখন কাজ করবেন, নিশ্চয়ই আপনার এতদিনের চলচ্চিত্র জগতের শিল্পী-কুশলীদের নিয়েই করবেন। তাতে টিভি নাটকে নতুনত্ব আসবে, আমরাও সেটাতে সম্পূরক হতে চাইব, ছবির জগতের সৃষ্টিশীল সব মানুষ নিশ্চয় আপনি ডাকলে আগ্রহ দেখাবেন।
চ্যালেঞ্জ নিলেন সুভাষ দত্ত। নতুন ভূমিতে বৃক্ষরোপণের অভিযান শুরু হলো। তিনি তৈরি করলেন প্যাকেজ নাটক। নায়িকা হলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্রাভিনেত্রী শবনম।
এরপরের পর্যায়ে একে একে যে নাটকগুলো তিনি বানালেন, সেখানেও তার এই চ্যালেঞ্জিং ভাবটাতে ঘাটতি দেখলাম না। এর মধ্যে এক আশ্চর্য সুন্দর গল্প নিয়ে প্যাকেজ নাটক বানালেন। যার সহপ্রযোজক ছিলেন চিত্রগ্রাহক সমীর কুশারী। অভিনেতা হিসেবে নিলেন তরুণ পরিচালক-অভিনেতা সতীর্থ রুবেলকে।
প্রতিবন্ধী এক ছেলের কঠিন ভূমিকায় রুবেলকে হাজির করলেন সুভাষ দত্ত। লক্ষ্য পূরণ হলো। অসম্ভব আলোড়ন উঠল নাটকটি অনএয়ারে যাওয়ার পর। এই মানুষটি নিজের সফল ছবিতেই নয়, নাটকেই নয়, আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান পরিচালক মৃণাল সেনের ছবিতেও কাজ করেছেন। এমন নানা কৃতি রয়েছে তার। যার সবই পাঠকরা জানেন। এই যে নতুন কিছু করার দৌড়ে ছুটতেন সুভাষ দত্ত, সেই মানুষটির সঙ্গে আমাদের শেষ ছবি হচ্ছে 'ও আমার ছেলে'। টেস্ট টিউব বেবির কাহিনী নিয়ে ছবিটি। জটিল আর কঠিন বিষয় নিয়ে তার এই প্রয়াসে আমরা একবিন্দুও বাধা দেয়নি। প্রচুর দর্শক আকর্ষণে মনোযোগ নাও পেতে পারেন, সেই ঝুঁকির মধ্যে সুভাষ দত্ত যদি আসন নিতে পারেন আমরা 'না' বলব কোন সাহসে।
ছবিটি শেষ হলো। রিলিজ হলো। দেখলাম এখানেও তিনি বিষয়বস্তুতে শুধু নয়, নতুন কিছু শিল্পী তৈরি করতেও উদ্যোগী হয়েছেন। দেখেছি তিনি ক্রমশ যে জীবন বেছে নিয়েছিলেন, সেটা নৈর্ব্যক্তিক। সাত্তি্বক। দেখেছি সে জীবনে প্রতি সোমবার তিনি নিয়ম করে নীরবতা পালন করতেন। সোমবার সারাদিন কথা বলতেন না কারও সঙ্গে। এই মৌনব্রতের দিনে বের হতেন না ঘর থেকে। এ ছাড়া প্রতিদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত পালন করেছেন মৌনতা। যে সুভাষ দত্তকে পর্দায় প্রাঞ্জল-উৎফুল্ল আর অনেক কথা-বলা-মানুষ হিসেবে আমরা পেয়েছি, সেই সুভাষ দত্তের প্রাত্যহিক জীবনে এর ব্যত্যয় ঘটেনি একবারও।
আমাদের অফিসে যেদিন আসতেন শুধু শসা খেতেন। ওটাই ছিল তার একমাত্র পছন্দ। নির্লোভ এই মানুষটিকে দুবাইয়ের এক অনুষ্ঠানে আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। মঞ্চে উঠে যা উপস্থাপনা করলেন, মনে হয়েছিল তার বয়স একটুও বাড়েনি। আঠারোতেই থেমে আছেন তরুণ হিসেবে। সুন্দর সুন্দর শিশুতোষ সংলাপ আর শরীরী ভাষায় সত্তর বয়সী মানুষটি যা দেখালেন তিরিশ বছরের যুবক অভিনেতারও চমকে যাওয়ার মতো।
চিরসবুজ মানুষটি সেই মঞ্চের বাইরেও কখনও আমাদের বুঝতে দেননি তার বয়স আশির দিকে এগোচ্ছে। তিনি 'নতুন সুভাষ দত্ত' হওয়ার চেষ্টা করেছেন নিরন্তর। সাধক সুভাষ দত্ত হওয়ার চেষ্টা করেছেন। নৈর্ব্যক্তিক সুভাষ দত্ত হওয়ার অনুশীলন করেছেন ।
তাতে তার মনের মতো শিল্পী, কলাকুশলী, পাণ্ডুলিপি যখন পেতেন না তখন তার মধ্যে প্রচণ্ড 'অভিমান' কাজ করতেও দেখেছি। তাই তিনি যখন আজ চলে গেলেন না-ফেরার দেশে, তখন আমার মনে হচ্ছে তিনি শেষ দিকে ব্যক্তিজীবনে যে মৌনব্রত নিয়েছিলেন, এটাকেই যেন দীর্ঘায়িত করলেন। প্রচণ্ড অভিমান নিয়ে এক কিশোর যেন চিরদিনের জন্য মৌন হয়ে গেল!
আমরা যদি তার মতো সৃজনশীল মানুষটিকে চলচ্চিত্রে-টেলিভিশনে সত্যিকার জায়গাটা দিতে পারি, দিতে পারি সম্মান, তা হলেই হয়তো অন্যলোকে তার অভিমান ভাঙবে।
ফরিদুর রেজা সাগর :মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চ্যানেল আই
No comments