ডাক দেয় হিজল-করচ by শেখ রোকন

দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত জেলায়_ সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া_ কমবেশি বত্রিশ হাজার বর্গকিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত হাওরাঞ্চলের প্রসঙ্গ উঠলে প্রথমে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথাই মনে পড়ে।


দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি; দ্বীপের মতো ভেসে থাকা গ্রামীণ জনপদ; আকাশের গায়ে হেলান দেওয়া খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়; তার ফাঁকে কুলকুল করে নেমে আসা ছোট্ট ছোট্ট নদী ও ছড়া; আকাশে সাদা মেঘের ওড়াউড়ি; হাজার হাজার অতিথি পাখির কোলাহল; আর হিজল-করচ-বরুণ বীথি। হাওরাঞ্চল এক স্বতন্ত্র ভূমি_ না পাহাড়ি, না সমতল, না উপকূলীয়। হাওরাঞ্চলের রূপ পাল্টে যায় মৌসুমে মৌসুমে। বর্ষায় যেখানে অথৈ পানি; শুকনোয় সেখানে হিল্লোলিত ধানক্ষেত।
কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়; প্রাকৃতিক সম্পদেও সমৃদ্ধ হাওরাঞ্চল। দেশের মোট ধানের এক-পঞ্চমাংশ আসে এই এলাকা থেকে। এখানেই রয়েছে মিঠা পানির মাছের সর্ববৃহৎ দেশীয় ভাণ্ডার। এখানকার খনিজ ও বনজসম্পদ আমাদের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সহায়। রফতানি পণ্য চায়ের সিংহভাগ উৎপাদিত হয় এখান থেকে। এখানকার ধান, মাছ, বন, পাহাড়, নদী-খাল হচ্ছে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর জীবিকাস্থল। কৌশলগত গুরুত্বও কম নয়। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের অভিন্ন ৫৭ নদী রয়েছে, তার ২৩টিও প্রবাহিত হাওরাঞ্চল দিয়ে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমরা যে 'লুক ইস্ট' নীতির কথা বলে থাকি; হাওরাঞ্চল বাদ দিয়ে তা কীভাবে সম্ভব?
দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, হাওরের এই বিপুল সৌন্দর্য, সম্ভাবনা ও কৌশলগত গুরুত্ব নীতিনির্ধারকদের কাছে বরাবর উপেক্ষিতই থেকেছে। এর পর্যটন সম্ভাবনা একেবারে উন্মোচিত হয়নি। যোগাযোগ ও আবাসনের দুর্গমতা কাটাতে পারলে বিলিয়ন ডলারের ওই বৈশ্বিক শিল্পের উল্লেখযোগ্য অংশ নিজেদের ভাগে আনা যেত। উপযুক্ত বাঁধ ব্যবস্থাপনার অভাবে ধান ও অন্যান্য শস্য উৎপাদন বারবারই মার খেয়ে আসছে আকস্মিক বন্যার কাছে। মৎস্যসম্পদও ক্রমে জিম্মি হয়ে পড়ছে ওয়াটার লর্ডদের কাছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জনঅধিকারের প্রশ্নে অঞ্চলটি এখনও পশ্চাৎপদ। এসবের জের ধরে হাওরাঞ্চলে বসবাসকারী পঞ্চাশ লক্ষাধিক মানুষের জীবন-জীবিকা ক্রমে সংকটাপন্ন হয়ে পড়ছে। হাওরের প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর হুমকি নিয়ে হাজির হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। হাওরাঞ্চলের প্রাণপ্রবাহ বিবেচিত কয়েকটি অভিন্ন নদীর উজানে ইতিমধ্যেই বাঁধ নির্মিত হয়েছে। প্রধান ধারা সুরমা-কুশিয়ারার উজানে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের তোড়জোড় চলছে। যত দিন যাচ্ছে, হাওরের নানামুখী সংকটে যোগ হচ্ছে নতুন মাত্রা।
আশার কথা হচ্ছে, হাওরাঞ্চলের অধিকার আদায় ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বেশ কয়েক বছর ধরে একটি ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ গ্রহণের চেষ্টাও চলছিল। এই লক্ষ্যেই ২০০৮ সালের ৬-৭ মার্চ ঢাকায় প্রথম জাতীয় হাওর সম্মেলন আয়োজিত হয়েছিল। সেই সম্মেলনে বিভিন্ন জনসংগঠনের প্রতিনিধি এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ ঐকমত্যের ভিত্তিতে 'হাওর ঘোষণা-২০০৮' চূড়ান্ত করে। প্রথম জাতীয় হাওর ঘোষণার অগ্রগতি পর্যালোচনা ও হাওরাঞ্চলের উন্নয়নের ডাক দিতে আজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে 'দ্বিতীয় জাতীয় হাওর সম্মেলন'।
রাজধানীর ফার্মগেটে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা উন্নয়ন কেন্দ্র (বিএআরসি) মিলনায়তন ও সংলগ্ন এলাকায় আজ রয়েছে দিনব্যাপী আয়োজন। বিপন্ন হিজল-করচের ডাকে সাড়া দিয়ে হাওরাঞ্চলের অধিবাসী, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, গবেষক, সাংবাদিক, উন্নয়ন কর্মী ছাড়াও আগ্রহীরা সেখানে উপস্থিত থাকবেন। সেখানে হাওর ও জলাভূমি সম্পর্কে তথ্য, গবেষণা তুলে ধরা হবে; বিনিময় হবে হাওরের মানুষের প্রত্যাশা ও চিন্তা-ভাবনা; দিকনির্দেশনা মিলবে কীভাবে হাওরাঞ্চলের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মানুষ সচেতন ও সংগঠিত হতে পারে।
দ্বিতীয় জাতীয় হাওর সম্মেলন থেকে প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীবন-জীবিকা রক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগের ডাকে সংশ্লিষ্টরা সাড়া দেবেন আশা করা যায়।
skrokon@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.