হৃদয়নন্দন বনে-আগামী প্রজন্মকে সৎ চিন্তায় দীক্ষিত করার এখনই সময় by আলী যাকের

বয়স যখন বাড়ে, মানুষের কর্মক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে, তখন স্বভাবতই মানুষ পেছনের দিকে তাকায়। অনেকে মানুষের এই অতি স্বাভাবিক আচরণকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। অথচ এটাই মানুষের ধর্ম।


বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ কেন স্মৃতির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে সে সম্পর্কে অনেকে অনেক রকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আমি নিজের মতো করে বিষয়টি নিয়ে ভাবার চেষ্টা করেছি এবং এ বিষয়ে আমার নিজেরও একটি ব্যাখ্যা আছে। আমি মনে করি, মানুষ যখন দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে, বয়সের ভারে ন্যুব্জ দেহ, তখন সে অতীতের স্মৃতি থেকে, তার যৌবন থেকে শক্তি সঞ্চয় করার চেষ্টা করে। এতে আমি অন্যায়ের কিছু দেখি না। আমি মনে করি, এটাই স্বাভাবিক। এই যে পেছনে ফিরে তাকানো, এই যে স্মৃতির মেলা ভিড় করে আসা আমাদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, এর সঙ্গে কিন্তু এমন অনেক কিছুই খুঁজে পাই স্মরণে, যা থেকে আমরা বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জন্য অনেক দিকনির্দেশনা পেতে পারি। আমার মনে পড়ে, বেশ কিছুকাল আগে আমি এই বিষয়ের ওপর ইংরেজি একটি কলাম লিখেছিলাম। তার শিরোনাম ছিল 'ণবংঃবৎফধু, ড়হপব সড়ৎব!' এই শিরোনামটি অনেক বছর আগের একটি ইংরেজি গান থেকে নেওয়া। এই গানটি আমাদের তারুণ্যে আমরা গুনগুন করে গাইতাম। ইংরেজিতে একটি শব্দ আছে 'নস্টালজিয়া'। এর কোনো জুতসই বাংলা আমি খুঁজে পাইনি। 'স্মৃতিনির্ভরতা' বোধহয় এর সবচেয়ে কাছাকাছি শব্দ। তবে গোল বাধিয়েছে 'নির্ভরতা' শব্দটি। নস্টালজিয়া বলতে মনে যে ভাবের সঞ্চার হয়, সেটিকে একটি বাক্যে আমরা বর্ণনা করতে পারি এভাবে যে, 'স্মৃতি সততই সুখের।' এই সুখস্মৃতি সব বয়সের সব মানুষের জন্যই সমান আবেদন সৃষ্টি করে বলে আমার মনে হয়।
আমার মনে আছে, আমি অত্যন্ত অপরিণত বয়স থেকে স্মৃতিস্পৃষ্ট। আমার প্রিয় একটি নীল তোয়ালে ছিল। একবার মায়ের সঙ্গে কলকাতায় নানাবাড়ি যাওয়ার সময় ট্রেন থেকে জানালা গলে ওই তোয়ালেটা বাতাসে উড়ে যায়। আমার ইচ্ছা হচ্ছিল চেইন টেনে ট্রেন থামিয়ে তোয়ালেটা খুঁজে নিয়ে আসি। এই কাজটি করা থেকে মা আমাকে নিবৃত্ত করেন। যা ছিল, এখন নেই, তার প্রতি মানুষের আকর্ষণ সর্বদাই সবচেয়ে বেশি। এই কারণেই বোধহয় চিন্তাশীল মানুষের কাছে স্মৃতি বিষয়টি এত হৃদয়ের কাছাকাছি এসে যায়। এরকম বেশকিছু স্মৃতি আছে অতীতের, যা কখনোই ভুলে যাওয়া যায় না। মুক্তিযুদ্ধের কথাই ধরা যাক। আমাদের প্রজন্মের যারা ওই যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছে কিংবা তাতে অংশগ্রহণ করেছে, তাদের পক্ষে সেই সময়কার স্মৃতি ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। এরকম আরও অনেক বিষয় আছে। ভুলে যাওয়া সম্ভব নয় বাল্যকালের দিনগুলো। আমি নিশ্চিত যে, প্রত্যেকেরই বাল্যকাল নিয়ে মধুর সব স্মৃতি রয়েছে। অনেক দুঃখজনক স্মৃতিও থাকতে পারে। কিন্তু মানুষ দুঃখের কথা ভাবতে চায় না। সে সুখস্মৃতিগুলো ধরে রাখে হৃদয়ে। আমার বাল্যকালের অধিকাংশ সময় কেটেছে খুলনা এবং কুষ্টিয়ায়। থাকার জন্য খুলনায় বাবা একটা ছোট্ট কিন্তু সুন্দর বাড়ি পেয়েছিলেন। খুলনা পুলিশ লাইনের ঠিক উল্টোদিকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় যে, সেই বাল্যকালের পর অনেকবারই যেতে হয়েছে খুলনায় এবং ওই শহরে গিয়ে যে ঠিকানাতেই থাকি না কেন রিকশা করে কিংবা পায়ে হেঁটে একাধিকবার ওই বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়া-আসা করেছি এবং প্রতিবারই যেন ফিরে গেছি সেই বাল্যকালে। অনেক খণ্ড খণ্ড স্মৃতি মনে এসেছে। যেন কোনো নিশ্ছিদ্র অন্ধকার থেকে লাফিয়ে উঠে এসে উপস্থিত হয়েছে একেবারে দুই চোখের সামনে। ওই বাড়ির সামনেই পুলিশ লাইন সংলগ্ন একটা গলি চলে গিয়েছিল ভেতর দিকে। সেই গলির মুখে একটা ছোট্ট মুদি দোকান ছিল। সেই দোকানে এক আনা পয়সা দিলে এক টুকরো গুড় পাওয়া যেত। কোনো সময় মা আমার কোনো কাজে খুশি হয়ে যদি এক আনা পয়সা আমায় বকশিশ দিতেন, দৌড়ে চলে যেতাম সেই দোকানে, এক টুকরো গুড় কিনতাম, খেতে খেতে চোখ বুজে আসত। স্বর্গসুখ কাকে বলে সেই স্বাদ যেন পেতাম ওই গুড়ের টুকরোর মধ্যে। অমন মিষ্টি আর জীবনে কখনও খেয়েছি বলে মনে পড়ে না। প্রাসঙ্গিকভাবে চলে আসে আমার মিষ্টির প্রতি দুর্বলতার কথা। ইংরেজিতে যাকে বলে ঝবিবঃ ঞড়ড়ঃয, আমার ছিল তা-ই বাল্যকাল থেকে। আরও অনেক পরে আমাদের দল যখন নাটক করতে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন শহরে গিয়েছে, সেখানকার নাট্যবন্ধুদের প্রথমেই জিজ্ঞেস করতাম, আচ্ছা তোমাদের শহরের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মিষ্টি কী? তারপর হৈ-হুল্লোড় করতে করতে সবাই মিষ্টি খাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়তাম রাস্তায়। এখন অবশ্য মিষ্টি খাওয়ার কথা ভাবাও প্রায় পাপ। আমার রক্তে মিষ্টির আধিক্যে আমি আজ মিষ্টিহীন জীবনযাপন করছি। যাকগে সে কথা। ফিরে যাই খুলনার গুড়ের টুকরোয়। ওই মিষ্টি ছিল আমার খাওয়া শ্রেষ্ঠ মিষ্টি।
খুলনায় আমরা অর্থাৎ আমি, আমার ছোট বোন এবং পাশের বাড়ির নাজমা সারাদিন নানা রকম দুষ্টুমি করতাম। সেটা মোরব্বা চুরি থেকে শুরু করে পাশের বাড়ির কিচেন গার্ডেন থেকে গাজর এবং মুলো চুরি, পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে সাতচাড়া খেলা নিয়ে ফাইট, কিং-কং খেলায় সহ-খেলোয়াড়দের পিঠে ভীষণ জোরে টেনিস বল ছুড়ে দেওয়া এসব। খুলনায় পুরনো একটা সার্কিট হাউস বিল্ডিং ছিল যশোর রোডের ধারে বিশাল মাঠের একপাশে। সেই সার্কিট হাউসের সামনে একটা অ্যারোপ্লেনের কঙ্কাল পড়ে ছিল। ওই প্লেন নাকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিধ্বস্ত হয়েছিল কাছেপিঠে কোথাও। ব্রিটিশরা ওইখানে ফেলে রেখে গিয়েছিল। আমরা যখন সেই প্লেনের কঙ্কাল আবিষ্কার করি তখনও তার হাড়গোড় সব ক্ষয়ে যায়নি। গদিহীন সিটের খাঁচা ছিল তখনও। তারই ওপর বসে প্লেন চালানোয় মগ্ন হতাম কত বিকেলে। মনে হতো সারাবিশ্ব যেন ঘুরে বেড়াচ্ছি প্লেনে চড়ে। সেই প্লেনের ফাঁকফোকর দিয়ে নানারকমের বুনো লতাগুল্ম মাথা উঁচিয়ে তাকাত আকাশের দিকে। মনে পড়ে, সেই লতাগুল্মের মধ্যে একটা ঝকঝকে হলুদ কচু ফুল ফুটেছিল। রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোতে ইটের পাঁজার মধ্য দিয়ে মাথা উঁচিয়ে ওঠা রক্তকরবী ফুল আবিষ্কার করেছিলেন। সেই আবিষ্কারের অনুপ্রেরণা আমাদের এক অসাধারণ নাটক দিয়েছে ওই ফুলের নামেই। আমার কিন্তু ওই গাঢ় ঝকঝকে হলুদ কচু ফুল দেখলেই তা খেতে ইচ্ছা করত। ওই প্লেনের কঙ্কালের ভেতরে বসে খেলায় আমার নিত্যসঙ্গী ছিল আমার বোন ঝুনু। ঝুনুর অনুপ্রেরণায় এবং আমার লোভের বশবর্তী হয়ে কচরমচর করে ওই ফুল খেয়েছিলাম একবার। মনে আছে, গলা ফুলে ঢোল হয়ে গিয়েছিল। লেবু, তেঁতুল ইত্যাদির সঙ্গে মায়ের হাতে মারও খেতে হয়েছিল প্রচুর। সেই মারের চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিল কচু ফুলের কণ্ঠরোধ করা সেই বেদনা। মনে পড়ে, বাবা-মার সঙ্গে সরকারি লঞ্চে সুন্দরবনে গিয়েছিলাম একবার। বাবা পাকা শিকারি ছিলেন। তার ছিল একটা অত্যন্ত নামজাদা বিলেতি কোম্পানির তৈরি দোনলা বন্দুক। বাবা অনেকগুলো হরিণ শিকার করেছিলেন সেই যাত্রায়। হরিণ শিকার বোধহয় বৈধ ছিল তখন। আমার মনে পড়ে, দারুণ উল্লসিত হয়েছিলাম আমরা সবাই। আজ যখন জীবনানন্দ দাশের 'ক্যাম্পে' কবিতাটি পড়ি, 'ক্যাম্পে শুয়ে, শুয়ে কোন এক হরিণীর ডাক শুনি, কাহারে সে ডাকে!' হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। হরিণের জন্য প্রাণ কাঁদে। হরিণীর জন্য প্রাণ কাঁদে। জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ পেরিয়ে এসে অনেক অতীত ভাবনা অথবা কাজ নিয়ে গ্গ্নানিবোধ হয়। এটাই বোধহয় নিয়ম।
বাবা কুষ্টিয়ায় এলেন এরপর। কুষ্টিয়ায় আমার বোধবুদ্ধির উন্মেষ ঘটে বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। এই একটি ব্যাপার আছে, যা সবার বেলায় এক সময়ে বা একই পরিস্থিতিতে হয় কি-না বলা মুশকিল। বুদ্ধির সঙ্গে হয়তো মানুষের বয়সের একটা সম্পর্ক থাকতে পারে, কিন্তু বোধের সম্পর্ক? মনে হয় সেটা সম্ভব নয়। প্রসঙ্গ যখন উঠলই তখন বিষয়টি সম্পর্কে আরও দু'চারটি কথা বলতে চাই। সুকান্তের সেই বিখ্যাত লাইন নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে, 'ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়।' তাই তার কাছে পূর্ণিমার চাঁদকে মনে হয়েছিল ঝলসানো রুটি। বোধের সঙ্গে মনের যেমন একটি প্রগাঢ় সম্পর্ক আছে, তেমনি দেহেরও একটি সম্পর্ক আছে অবশ্যই। কিন্তু লক্ষ্য করা সম্ভব হবে যে চাঁদ যতই ঝলসানো রুটি বলে তার কাছে মনে হোক না কেন, ঝলসানো রুটির কথা মনে করে কবিতাকে 'ছুটি' দেওয়ার অন্ত্যমিল সম্পর্কে কিন্তু তিনি সচেতন ছিলেন ঠিকই। অর্থাৎ তার দারিদ্র্য বা ক্ষুধা তাকে কাব্যবিমুখ করতে পারেনি। তবুও বলব, কুষ্টিয়ায় আমার সেই বাল্যকালে নিসর্গের সৌন্দর্যের প্রতি আকর্ষণ ওই তীব্রতা পেত না, যদি আমার উদর পূর্ণ না থাকত। বয়সের তোয়াক্কা না করেই বোধের উন্মেষ হতে পারে, তবে বুদ্ধির স্ফুরণ হয় কি-না তা বলতে পারব না। বাল্যকালের এসব স্মৃতি আমাকে আজকের এই জায়গায় আসতে সাহায্য করেছে। যদিও আমি স্বীকার করি যে, আমার জীবনে যদি ভালো কোনো কাজ করে থাকি, সেটা যে যা-ই বলুক না কেন অকিঞ্চিৎকর কাজ।
যা হোক, এই কলামে আমি ব্যক্তিগত কথাগুলো বললাম এ কারণে যে, আমাদের অতীত আমাদের সবার জীবনকে কোনো না কোনোভাবে স্পর্শ করে যায়। একটু চিন্তা করলে দেখা যাবে, আমাদের সবারই জীবন কিছু মূল্যবোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। এই মূল্যবোধগুলো নিয়ে কথাবার্তা হয় প্রায়ই এবং দুঃখজনক হলেও সত্য আমরা বুঝতে পারি, আমাদের জীবনে মূল্যবোধের অবক্ষয় এত সর্বগ্রাসী হয়েছে যে, আমরা একটা বিপজ্জনক অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছি। সেদিন কোনো একটা টেলিভিশন চ্যানেলে একটি আলোচনাচক্রে আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আমাদের সমাজে ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা, দুর্নীতি এবং সংঘাতের পেছনে যে পথভ্রষ্ট তরুণ সমাজ আজকে ব্যাপৃত আছে, এর কারণটি কী এবং এখান থেকে কীভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যায়? আমি বলেছিলাম, এই পথ হারানো তরুণদের পথ দেখানোর দায়িত্ব যাদের ছিল, অর্থাৎ আমাদের প্রজন্ম, তারা তাদের কাজটি ঠিকভাবে সম্পন্ন করেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আমাদের প্রজন্ম কেবল অর্থ উপার্জনে নিজেদের সম্পূর্ণভাবে ব্যতিব্যস্ত রেখেছে। পরবর্তী প্রজন্মকে কখনোই তারা সঠিক পথ দেখায়নি। এই অপরাধের মাসুল আজ দেশ ও জাতিকে দিতে হচ্ছে। এখনও যদি আমরা আমাদের কর্তব্যের প্রতি উদাসীন থাকি, তাহলে দুই প্রজন্ম পরে এ দেশে ভালো মানুষ আর থাকবে না। অথচ আমাদের প্রজন্মের সবাই তাদের গুরুজনদের তত্ত্বাবধানে সব মূল্যবোধ সম্পৃক্ত একটি সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে শুনে এসেছেন, প্রত্যক্ষও করেছেন; আমরা কেন এখনও সেই মূল্যবোধকে পুনরুজ্জীবিত করে একটি সুস্থ-সুন্দর সমাজ, যেখানে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম সৎ চিন্তা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে, সেই কাজে ব্রতী হই না?

আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.