মানবাধিকার পরিস্থিতি-সরকারের আন্তরিক উদ্যোগ জরুরি
মানবাধিকার বিষয়ক ১৯টি বেসরকারি সংগঠনের মোর্চা হিউম্যান রাইটস ফোরাম গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সর্বজনীন মানবাধিকার পুনর্বীক্ষণ পদ্ধতির আওতায় প্রতিবেদনটি জাতিসংঘে জমা দেওয়া হয়েছে।
অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতির স্বীকৃতি যেমন প্রতিবেদনে উলি্লখিত হয়েছে, তেমনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সরকারি উদ্যোগের প্রশংসাও করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও গুপ্তহত্যা নিয়ে উদ্বেগ এবং হতাশার কথা এতে গুরুত্ব সহকারে উত্থাপিত হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও গুপ্তহত্যা নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশের ঘটনা নতুন নয়। নিয়মিতভাবেই সরকারকে এসব নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। শুধু মানবাধিকার সংগঠন নয়, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমও বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। দায়িত্ব গ্রহণের পর ক্ষমতাসীন সরকার এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। বলা হয়েছিল, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসবে। কিন্তু সরকারের গত চার বছরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও গুপ্তহত্যা নতুন মাত্রা পেয়েছে বলেই অভিযোগ। অনেক ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রীয় নানা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল উঠেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেও গুম-অপহরণের মতো অপরাধ দমনে দায়িত্বশীল বাহিনীগুলোর ব্যর্থতার কথাও আলোচনায় এসেছে। এ কথা সকলেই স্বীকার করেন যে, আইনের শাসনের স্বার্থে রাষ্ট্রীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোতে বিধিসম্মত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক পদ্ধতিতে অপরাধ দমনে পারদর্শী হতে হবে। এসব ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটলে খোদ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে অপরাধপ্রবণতা তৈরি হয়। আইনকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের প্রবণতাও এতে বেড়ে যায়। ফলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গ্রহণযোগ্যতা ও কার্যকারিতার স্বার্থেই আইনবহির্ভূত অভিযানের কার্যক্রম দীর্ঘকাল ধরে প্রশ্নহীনভাবে চলা উচিত নয়। যুগের প্রয়োজনেই আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আধুনিক, প্রশিক্ষিত বাহিনীর প্রয়োজন আছে। আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে এমন বাহিনীকে সুসজ্জিতও করা দরকার। কিন্তু অপরাধীদের শাস্তি ও বিচারের এখতিয়ার বিচার বিভাগের ওপরই অর্পিত। অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য আইনের ফাঁকফোকর নিশ্চয় বন্ধ করতে হবে। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো বিচারের ভার নিলে তা কার্যত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকেই দুর্বল করে দেবে। ফলে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, গুপ্তহত্যা দ্রুত বন্ধ হওয়া উচিত। এ জন্য সরকারের আন্তরিকতার পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সহযোগিতামূলক মনোভাবও দরকার। বিচার প্রক্রিয়াকে অক্ষুণ্ন রেখে অপরাধ দমনের দক্ষতা আমাদের অবশ্যই রপ্ত করতে হবে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার জন্য মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে মনোযোগ প্রত্যাশিত। এসব কাজ সহজ করে দিতে পারে সাংবিধানিক ও স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া। দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকতর কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে। বিচার বিভাগ যাতে আরও কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে সে জন্য বিচারপতিদের নিয়োগ-পদোন্নতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার। অধিকতর দায়িত্বশীল রাষ্ট্রীয় নীতি কার্যকর করার সময় এসেছে। কেননা শ্রেণী, বর্ণ, জাতি, জেন্ডার নির্বিশেষে সকলের জন্য স্বস্তিকর ও বাসযোগ্য একটি দেশই আমরা কামনা করি। অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক উন্নয়নকে দীর্ঘস্থায়ী ও শান্তিদায়ক করতে হলে এর বিকল্প নেই। তাই প্রত্যাখ্যান নয়_ হিউম্যান রাইটস ফোরামের প্রতিবেদন আমলে নিয়ে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলেই আমরা আশা করি।
No comments