টাঙ্গাইল-৩ উপনির্বাচন-আ. লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীকে বহিষ্কার, তুমুল পাল্টাপাল্টি by আবুল কাশেম, অরণ্য ইমতিয়াজ ও শাকিল আনোয়ার

টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) উপনির্বাচন কাল রবিবার। গতকাল শুক্রবার প্রচারের শেষ দিন তিন প্রার্থীর সবাই শেষবারের মতো গণসংযোগ করেন। এদিকে শেষ মুহূর্তে এসে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আমানুর রহমান খান রানাকে দল থেকে বহিষ্কার বলে ঘোষণা করা হয়েছে।


গতকাল দলীয় প্রার্থী মো. শহিদুল ইসলাম লেবুর পক্ষে শেষ নির্বাচনী জনসভায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম এ ঘোষণা দেন। তবে তিনি জানান, এখনো বহিষ্কারসংক্রান্ত চিঠি ইস্যু করা হয়নি।
নির্বাচনে শক্ত দুই প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. শহিদুল ইসলাম লেবুর পক্ষে গতকাল কেন্দ্রীয় নেতারা ঘাটাইল গণপাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জনসভা করেছেন এবং দলটির বিদ্রোহী প্রার্থী আমানুর রহমান খান রানা পাঁচটিকড়ি ও কদমতলীতে আলাদাভাবে দুটি জনসভায় অংশ নেন।
একইভাবে এলাকার বিভিন্ন অংশে গণসংযোগ করেছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী সৈয়দ আবু ইউসুফ আবদুল্লাহ তুহীন।
এদিকে গুঞ্জন উঠেছে, আগামী নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ থেকে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে সমর্থন দেবেন বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী লুৎফর রহমান খান আজাদ।
উপনির্বাচন উপলক্ষে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি। ইতিমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। সহকারী রিটার্নিং অফিসার আলীমুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ৯৬টি ভোটকেন্দ্রের ৫৩২টি কক্ষে একযোগে ভোটগ্রহণ শুরু হবে। ওই দিন উপজেলার দুই লাখ ৭১ হাজার ৩২৯ জন ভোটার প্রার্থী বাছাই করবেন।
আ. লীগ মানেই নৌকা : গতকাল দলীয় প্রার্থী শহিদুল ইসলাম লেবুর পক্ষে শেষ নির্বাচনী জনসভায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম বিদ্রোহী প্রার্থী রানাকে দল থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেন। এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ সেলিম কালের কণ্ঠকে বলেন, সিদ্ধান্তটি দলের উচ্চ পর্যায়ে নেওয়া হয়েছে। রানাকে বহিষ্কারের চিঠি শিগগিরই পাঠানো হবে বলে তিনি জানান।
রানাকে বহিষ্কারের ঘোষণা দিতে গিয়ে শেখ ফজলুল করিম সেলিম জনসভায় বলেন, 'একজন প্রার্থী আছেন, তিনি বলে বেড়াচ্ছেন, তিনিও আওয়ামী লীগের প্রার্থী। তিনি কিসের আওয়ামী লীগের প্রার্থী? আওয়ামী লীগ মানেই হলো নৌকা মার্কা। স্বতন্ত্র প্রার্থী আমানুর রহমান রানাকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হলো। আওয়ামী লীগের কোনো নেতা-কর্মী তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করবেন না। কেউ করলে তাঁর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।' রানাকে সতর্ক করে দিয়ে শেখ সেলিম বলেন, 'নির্বাচনে নৌকা মার্কা যদি হারেও, আওয়ামী লীগই তো ক্ষমতায় আছে। তাই ১৮ নভেম্বরের নির্বাচনের আগে বা পরে আওয়ামী লীগের কোনো কর্মীর গায়ে নখের আঁচড় পড়লে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
'চোর' তাড়াবেন রানা : গতকাল ঘাটাইল উপজেলার কদমতলী হাসান পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে শেষ নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে জনসভা করেন বিদ্রোহী প্রার্থী রানা। সমর্থকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, 'ঘাটাইলের ভালো-মন্দ আমরাই ভালো বুঝি। আমরা দীর্ঘদিন ধরে ন্যায় দাবি থেকে বঞ্চিত। গত চার বছরের ইতিহাস গরিবের মাল লুণ্ঠনের ইতিহাস।' তবে রানা তাঁর বক্তব্যে শেখ সেলিমের নাম উল্লেখ করে কিছু বলেননি। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মো. শহিদুল ইসলাম লেবু টিআর, কাবিখার গম আত্মসাৎ করেছেন অভিযোগ তুলে রানা বলেন, লুণ্ঠনকারীদের নেতা বানানো যায় না। ১৮ নভেম্বর ভোট-বিপ্লব হবে দাবি করে তিনি বলেন, 'ঘাটাইল থেকে চোর তাড়াতে হবে। আমি রানা ঘাটাইলের মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করলাম। আমি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। ঘাটাইলবাসীর জন্য আমার চেয়ে আপন কেউ হতে পারে না। ঘাটাইলে আমার কাছে কোনো দল নেই। এখানকার সবাই আমার আপন।'
বিএনপি নেতা কার পক্ষে : রানাকে হারাতে বিএনপির সাবেক এমপি লুৎফর রহমান খান আজাদ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর পক্ষ নিয়েছেন বলে জোর গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। তিনি সম্পর্কে রানার চাচা এবং আগামী নির্বাচনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী। এ বিষয়ে লুৎফর রহমান খান আজাদের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ বিষয়ে আমার মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। আমি পরে ফোন করে কথা বলব।' এরপর তাঁকে একাধিকবার মোবাইল ফোন করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। গুঞ্জনের সত্যতা রয়েছে দাবি করে দেওপাড়া ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কামাল ভুঁইয়া বলেন, 'জাতীয় রাজনীতি যা-ই হোক, স্থানীয় রাজনীতির কথা বিবেচনা করে আমাদের নেতা লুৎফর রহমান খান আজাদ আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই আশা করছি, বিএনপির বেশির ভাগ নেতা-কর্মীর ভোট আওয়ামী লীগ প্রার্থী পাবেন।'
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে উপজেলা বিএনপির এক নেতা বলেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থী যদি জয়লাভ করেনও তবু আগামী নির্বাচনে বিএনপি (যদি নির্বাচনে যায়) প্রার্থীর পক্ষে তাঁকে হারানো কঠিন হবে না। কিন্তু বিএনপির নেতা রানা জয়লাভ করলে হিসাব পাল্টে যেতে পারে। এ জন্যই এ কৌশল নিয়েছেন আজাদ।
সহিংসতার আশঙ্কা : আগামীকালের উপনির্বাচনকে সামনে রেখে তিনজন প্রার্থী ও ভোটার সবার মধ্যেই উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার আশঙ্কা কাজ করছে। ভোটাররা বলছেন, গত ২ নভেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পর থেকেই প্রার্থীরা পরস্পর কাদা ছোড়াছুড়ি করছেন। তাই নির্বাচনের দিন গণ্ডগোল হতেই পারে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শহিদুল ইসলাম লেবু কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বহিরাগত সন্ত্রাসীরা সব সময় এলাকায় ঘোরাঘুরি করছে। তাদের মধ্যে মামলার আসামিও আছে। তারা অবশ্যই নির্বাচনের দিনও থাকবে। সে ক্ষেত্রে গণ্ডগোল হতে পারে। আমার নেতা-কর্মীসহ ভোটাররা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। কোনো কোনো ভোটার বলছেন, ভোটের চেয়ে জীবনের দাম বেশি।'
তবে আমানুর রহমান খান রানা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শহিদুল ইসলাম লেবু প্রশাসনকে ব্যবহার করে আমার নেতা-কর্মীদের ভয়-ভীতি দেখাচ্ছেন এবং এ পর্যন্ত সাত নেতাকে গ্রেপ্তার করানো হয়েছে। এতে ঘাটাইলবাসীর মধ্যে ভীতির সৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারে। তখন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে।'
উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার আশঙ্কা করছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী সৈয়দ আবু ইউসুফ আবদুল্লাহ তুহীনও। তিনি বলেন, 'দুটি পক্ষের লোকজন যেভাবে প্রভাব বিস্তার করে প্রচারণা চালাচ্ছে, তাতে গণ্ডগোল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরাসহ ভোটাররাও ভয়ে আছেন।'
হামিদপুর বাজারের ব্যবসায়ী আবদুল হাকিমসহ বেশ কয়েকজন ভোটারের সঙ্গে কথা বলে বোঝা যায়, তাঁদের মধ্যে সহিংসতার আশঙ্কা কাজ করছে।

No comments

Powered by Blogger.