চামড়ায় লোকসানের আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের-লবণের চড়ামূল্যে বেড়ে গেছে সংরক্ষণ ব্যয়

বেশি দামে চামড়া কিনে ট্যানারি মালিকদের বেঁধে দেওয়া দামে বেচতে হলে বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়তে হবে বলে চামড়া ব্যবসায়ীরা জানান। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কালের কণ্ঠের প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদনে এ বছর কোরবানির পশুর চামড়া কেনাবেচার এ চিত্রই উঠে এসেছে। এ পরিস্থিতির জন্য ট্যানারি মালিকদের দায়ী করে ব্যবসায়ীরা বলেন, ব্যাংক থেকে কম সুদে ঋণ নিয়েও প্রতিবছর কোরবানির সময় চামড়া কেনা নিয়ে টালবাহানা করেন মিলমালিকরা। আবার তাঁরাই চামড়া পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে আহাজারি করেন।


চামড়ার কেনাবেচায় সরকারি তদারকির দাবি জানিয়ে ব্যবসায়ীরা বলেন, তা না হলে চড়া সুদে ধার নিয়ে চামড়া কেনাবেচা করতে গিয়ে পথে বসবেন সারা দেশের প্রান্তিক ও মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা। এতে বিপর্যস্ত হবে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ প্রক্রিয়া, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে। তাদের হিসাবে, সারা বছরের কাঁচা চামড়ার চাহিদার ৪০ শতাংশ আসে কোরবানির পশু থেকে
আমাদের বগুড়া অফিস জানায়, বগুড়ায় কোরবানি ঈদে চামড়ার বাজারে ধস নেমেছে। গত বছরের চেয়ে প্রায় অর্ধেক দামে এবার চামড়া কেনাবেচা হয়েছে বগুড়ায়। শহরপর্যায়ে বিক্রেতারা কিছু দাম পেলেও গ্রামপর্যায়ে তা ছিল অনেক কম। ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা (খুচরা বিক্রেতা) তাঁদের বিনিয়োগ করা পুঁজিই ঘরে তুলতে পারেননি। জেলা চামড়া মালিক সমিতি বাজার ধসের জন্য ট্যানারি মালিকদের দায়ী করেছে। ট্যানারিগুলোয় বছরের পর বছর ব্যবসায়ীদের টাকা আটকে রাখার কারণেই মূলত বাজারে ধস নেমেছে বলে তাদের দাবি।
বগুড়ার চামড়ার বাজারখ্যাত বাদুড়তলা, চকসুত্রাপুর ও চকযাদু রোড় ঘুরে দেখা গেছে, বড় আকৃতির গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ এক হাজার ৮০০ টাকা থেকে দুই হাজার টাকায়, মাঝারি আকৃতির এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৭০০ টাকা এবং ছোট আকৃতির গরুর চামড়া এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকায়। এ ছাড়া ছাগলের চামড়া আকৃতিভেদে ১০০-২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
খুচরা বিক্রেতাদের অভিযোগ, ট্যানারি মালিক ও বড় ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বাজারে ধস সৃষ্টি করেছে। তা না হলে বাজারদর এত কম হওয়ার কথা নয়। বগুড়া জেলা চামড়া ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন বাজার ধসের কথা স্বীকার করে বলেন, বিশ্ব মন্দার কারণে কয়েক বছর ধরেই চামড়ার দাম কম যাচ্ছে। এ ছাড়া ট্যানারি মালিকরা কয়েক বছর ধরে চামড়ার টাকা আটকে রাখার কারণে পুঁজি সংকটে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। স্বল্প পুঁজিতে চামড়া কিনতে গিয়েই এই ধসের সৃষ্টি হয়েছে। টাকা না পাওয়ার কারণেই মূলত চামড়ার দাম কম হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
খুলনা অফিস জানায়, চাহিদা মতো কোরবানির চামড়া কিনেও স্বস্তিতে নেই খুলনার ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন মাদ্রাসার লিল্লাহ বোডিং, মৌসুমি ব্যবসায়ী ও দালালরা প্রতিযোগিতা করে ট্যানারি মালিকদের চেয়ে বেশি দামে চামড়া কিনে সম্ভাব্য লোকসানের মুখে পড়েছে তারা। তারপর প্রক্রিয়াজাত কাজে ব্যবহৃত লবণের মীল্যবৃদ্ধিতে হতাশ তারা। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, চামড়া ব্যবসার ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ নেই। একশ্রেণীর সিন্ডিকেট ও অসাধু মৌসুমি ব্যক্তির কাছে জিম্মি এ ব্যবসা।
খুলনা কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও আমান লেদারের স্বত্বাধিকারী মো. আমান উল্লাহ জানান, ঢাকার ট্যানারি ব্যবসায়ীরা তাঁদের গরুর চামড়াপ্রতি বর্গফুট ৬০ টাকায় কিনতে বললেও লিল্লাহ বোডিং, মাদ্রাসার লোকজন, মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ফড়িয়াদের চাপে সেই চামড়া ৭০ থেকে ৯০ টাকা বর্গফুট হিসাবে কিনতে হয়েছে। একটি ভালো মানের গরুর চামড়া এক হাজার ৫০০ টাকা কেনার কথা থাকলেও সেই মানের চামড়া এক হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার টাকায় কিনতে হয়। এ ছাড়া ১০০ থেকে ১৫০ টাকার ছাগলের চামড়া ২৫০ টাকায় কিনতে হয়।
ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আ. সালাম ঢালী জানান, একে তো চামড়া অধিক দামে কিনতে হয়েছে। অন্যদিকে লবণ মালিক ও তাদের ডিলারদের সিন্ডেকেটের শিকার হতে হয়েছে। আগে প্রতি বস্তা লবণ (৭৫ কেজি) ৩৫০ টাকা দাম থাকলেও হঠাৎ ঈদের আগের রাতে তা ৫০০ টাকা করে কিনতে হয়েছে। অথচ লবণ ছাড়া চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা যায় না। তিনি বলেন, খুলনায় নির্দিষ্ট চামড়ার একটি মার্কেট থাকলে ব্যবসায়ীদের এ অবস্থার শিকার হতে হতো না। সেখানে সিন্ডিকেট বা মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা জিম্মি থাকতেন না।
পাবনা প্রতিনিধি জানান, দাম নিয়ে জটিলতার কারণে পাবনার চামড়া ব্যবসায়ীরা বেকায়দায় পড়েছেন। ফলে ঈদের তিন দিন পেরিয়ে গেলেও তাঁরা কাঙ্ক্ষিত চামড়া কিনতে পারেননি।
পাবনা জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ইমদাদুল হক কালের কণ্ঠকে জানান, ঢাকার ট্যানারি মালিকদের বেঁধে দেওয়া দামের সঙ্গে আড়তদারদের বিক্রয়মূল্যের সামঞ্জস্য না হওয়ায় তাঁরা চামড়া কিনতে পারছেন না। তিনি জানান, এ বছর ট্যানারি মালিকরা প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ৬০ থেকে ৬৫ টাকা এবং প্রতি বর্গফুট ছাগলের চামড়ার দাম ৫০ থেকে ৫৫ টাকা বেঁধে দিয়েছেন। এর বিপরীতে তৃণমূলপর্যায়ে যাঁরা চামড়া সংগ্রহ করেছেন, তাঁরা প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৮০ থেকে ৮৫ টাকা এবং ছাগলের চামড়া প্রতি বর্গফুট ৭০ থেকে ৭৫ টাকা দাবি করায় তাঁরা চামড়া কিনতে পারছেন না।
ইমদাদুল হক জানান, আগামীকাল শুক্রবার নাটোরের চামড়া হাটের দিকে তাঁরা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছেন। নাটোরের এই হাট উত্তরবঙ্গের মধ্যে বৃহত্তম এবং দেশের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম চামড়া বিকিকিনির হাট বলে পরিচিত। ঈদের পরে আগামীকাল শুক্রবার ওই হাটে দেশের ট্যানারি মালিক ও তাঁদের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি বড় বড় চামড়া ব্যবসায়ীরা আসবেন। হাটে পাবনার ব্যবসায়ীরা তাঁদের সংগ্রহকৃত চামড়া বিক্রির পাশাপাশি কাঙ্ক্ষিত চামড়া ক্রয় করতে পারবেন বলে তাঁরা আশা করছেন। এ জন্যই এই হাটের অপেক্ষায় তাঁরা এখনো বড় আকারে চামড়া সংগ্রহ করতে পারননি।
নওগাঁ প্রতিনিধি জানান, নওগাঁর ব্যবসায়ীরা এবার কোরবানির পশুর চামড়া কিনতে গিয়ে পড়েছেন চরম বিপাকে। ট্যানারি মালিকদের দর বেঁধে না দেওয়ায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে চামড়া কিনে লোকসান গোনার আশঙ্কার কথা বলছেন তাঁরা। অনেক চামড়া ব্যবসায়ী বলছেন, এবার কোরবানির পশুর সংখ্যাও গত বছরের চেয়ে অনেক কম। অপরদিকে ক্রেতার সংখ্যা অনেক বেশি। তবে তাঁরা আশা করছেন, আগামী দুই-এক দিনের মধ্যে হয়তো গ্রাম থেকে চামড়া এলে কিছুটা পোষানো যাবে। এ ছাড়া অনেক ব্যবসায়ী দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়েই চামড়া কিনছেন। অপরদিকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে কোরবানির পশুর চামড়া পাচার রোধে সীমান্ত এলাকায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে নওগাঁ জেলা পুলিশ। চামড়া ব্যবসায়ীদের ক্রয় করা চামড়া যাতে শহরমুখী হয়, সেদিকেও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
চামড়া আড়তদার আবুল বাসার ভাসানী জানান, ট্যানারি মালিক প্রাথমিক পর্যায়ে চামড়ার দাম ও পরিমাণ যা দিয়েছে, তা পূরণ করা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। শুধু ধারণার ওপর দর নির্ধারণ করে বর্তমানে চামড়া কেনা হচ্ছে। ট্যানারি মালিকরা দাম বেঁধে দিলে এমন সমস্যায় পড়তে হতো না।
চামড়া ব্যবসায়ী লোকমান হোসেন জানান, গত পাঁচ বছরে ঢাকার ফাইভ স্টার, নাসির ট্যানারি, মমতাজ ট্যানারি, প্রাইমস লেদারসহ কয়েকটি ট্যানারি ও আড়তদারের কাছে তাঁর পাওনা রয়েছে প্রায় ১৫ লাখ টাকা। চড়া সুদে ঋণ নিয়ে চামড়া কিনে দিয়েছিলেন তিনি; কিন্তু দীর্ঘদিন সেই টাকা অনাদায়ী রয়ে গেছে। দাদন ব্যবসায়ীদের সুদের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে এখন প্রায় নিঃস্ব তিনি।
কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, চামড়ার দাম এ বছর কমে যাওয়ায় কিশোরগঞ্জের চামড়া ব্যবসায়ীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। এ বছর স্থানীয় ব্যবসায়ীরা গরুর চামড়া কিনেছেন প্রতিটি এক হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার টাকায়। ছাগলের চামড়া কিনেছেন প্রতিটি ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়। আজ বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক হাটের দিন ঢাকার ট্যানারি মালিকরা এসে এসব চামড়া দরদাম করে কিনে নিয়ে যাবেন। ব্যবসায়ীরা বলেন, এ বছর চামড়ার বাজার মন্দা হলেও লবণের দাম গত বছরের তুলনায় চড়া। গত বছর ৫০ কেজি ওজনের লবণের বস্তা ছিল ৩৮০ টাকা, এ বছর সেই লবণ কিনতে হচ্ছে ৬০০ টাকায়। ফলে চামড়ার পেছনে খরচ বেড়ে গেছে। বিশ্বজিৎ দাস জানান, গত বছর যে চামড়াটির দাম ছিল দুই হাজার টাকা, এ বছর সেই চামড়ার দাম এক হাজার ৪০০ টাকা। প্রতিটি চামড়ার জন্য ৮০ থেকে ১০০ টাকা খরচ পড়ে বলে তিনি জানান। গত বছর কিনেছিলেন ৮০০ পিস চামড়া। আর এ বছর ৫০০ পিস চামড়া কিনেছেন। ট্যানারি মালিকরা এখনো কোনো রেট না দিলেও বিশ্বজিৎ দাস প্রতিটি চামড়া ৭০ থেকে ৮০ টাকা বর্গফুট রেটে কিনেছেন বলে জানান।
চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, চাঁদপুরে এবার আকারভেদে এক হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত গরু এবং ২০০-৩০০ টাকা দরে ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে। কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা এই দামে পশুর চামড়া ক্রয় করছেন। কিন্তু পাইকারি অথবা ট্যানারি মালিকদের প্রতিনিধিরা কত টাকা দিয়ে চামড়া নেবেন, তা নির্ধারণ হয়নি। এতে ঈদের দুই দিন পার হলেও অনেকেই স্থানীয়ভাবে চামড়া সংরক্ষণ করছেন। নফর আলী মুন্সি নামে স্থানীয় এক চামড়া ব্যবসায়ী জানান, তিনি পাঁচ হাজার পশুর চামড়া কিনেছেন। কিন্তু সরকারিভাবে চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়নি। তাই চামড়ার প্রকৃত মূল্য পাবেন কি-না, এই নিয়ে তিনি চিন্তিত।

No comments

Powered by Blogger.