হঠাত্ করেই পশুশূন্য হাট : কোরবানি দিতে পারেননি হাজার হাজার মানুষ by আলাউদ্দিন আরিফ
গরুর হাটে ক্রেতা লাখো, গরু নেই। এবার ঈদের একদিন আগে রাজধানীর কোরবানির পশুর হাটগুলোতে ছিল এই চিত্র। বলতে গেলে হাট থেকে কোরবানির পশু একদম উধাও হয়ে গিয়েছিল। পশু কিনতে না পেরে কোরবানি দিতে পারেননি বহু মানুষ। অনেকে সারাদিন সারারাত হাটে হাটে ঘুরেও পশু কিনতে পারেননি। যারা কিনতে পেরেছিলেন তাদেরও গুনতে হয়েছি দ্বিগুণ-আড়াইগুণ দাম। শেষে পরিস্থিতি এমন হয়েছে, ‘দড়ি যার গরু তার।’ অর্থাত্ একট্রাক গরু নামার সঙ্গে সঙ্গে শত শত মানুষ পশু কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন।
যিনি আগে গরুর দড়ি ধরতে পেরেছেন, বেপারিদের চাহিদামত দামে তিনিই গরু কিনেছেন। গরু না পেয়ে ঈদের নামাজ পড়ে অনেকে ছুটেছেন পশুর হাটগুলোতে। এদিনও পশুর সংখ্যা ছিল হাতেগোনা—যদিও ক্রেতার সমাগম ছিল অনেক।
যেখানে শনিবার দুপুর পর্যন্ত হাটগুলোতে পর্যাপ্ত পশু ছিল, ক্রেতার অভাবে হাটে বেপারিরা কান্নাকাটিও করেছেন; সেখানে হঠাত্ করে কেন এই পশু সঙ্কট? বেপারি, হাটের ইজারাদার ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে বেশ কিছু তথ্য। হাটগুলোতে বেপারিরা সিন্ডিকেট করে বেশি মুনাফা আদায়ের জন্য কৃত্রিমভাবে এই সঙ্কট সৃষ্টি করে। প্রথম দিকে হাটগুলোতে প্রচুর গরু তোলা হলেও শেষ দুই দিন পশু তেমন একটা আসেনি। সীমান্ত পেরিয়ে প্রচুর ভারতীয় গরু বাংলাদেশে প্রবেশ করলেও সেগুলো রাস্তায় যানজটের কারণে আটকা পড়ায় ঢাকার হাটে পৌঁছেনি। ঢাকার বেশিরভাগ ক্রেতা হাটে যান শনিবার বিকালে এবং রোববার। বিপুলসংখ্যক ক্রেতা একযোগে হাটে নামায় পশুর সঙ্কট তৈরি হয়।
গবাদিপশুর সঙ্কট ও দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে হাট ইজারাদাররা দায়ী করেন বেপারি সিন্ডিকেটকে। প্রথমে হাটে প্রচুর পশু আসে। পরে বড় বড় বেপারি সিন্ডিকেট করে পশু আনা বন্ধ করে দেয়। তারা মোবাইল ফোনে রাজশাহী, দিনাজপুর, শেরপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মেহেরপুরসহ সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে যেসব গরু আসছিল সেগুলো কিনে পথে আটকে রাখে। পরে সেগুলো হাটে নিয়ে উচ্চ দামে বিক্রি করে।
পশু সঙ্কটের নেপথ্যে আরেকটি বড় কারণ ছিল আগে থেকে পশু বিক্রি না হওয়া ও মিডিয়ায় নেতিবাচক সংবাদ প্রচার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পত্র-পত্রিকাসহ ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বার বার প্রচার হয়েছে হাটে প্রচুর গরু, কিন্তু পশুর ক্রেতা নেই। ইজারাদাররাও বার বার বলেন, যে গরু বিক্রি হচ্ছে তাতে ইজরার টাকাই উঠবে না। বেপারি ও ইজারাদারদের এমন বক্তব্য প্রচারের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে হাটে। অন্য বছর বেপারিরা যে পরিমাণ গরু প্রথমে হাটে তোলেন, সেগুলোর বেশিরভাগ বিক্রি করে পরে আবার তারা পশু আনেন। কিন্তু এবার একদিকে যেমন সরকারি, বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেতন হতে দেরি হয়েছে, তেমনি গত বছরের মতো শেষের দিকে দাম কম হবে এ ধারণার কারণে ঢাকার মানুষ আগে থেকে গবাদিপশু কেনেননি। বেশিরভাগ মানুষ শনিবার বিকালে ও রোববার হাটে যান। এতে হঠাত্ করেই গরুর চাহিদা বেড়ে যায়। এ সুযোগে বেপারিরাও গরুর দাম বাড়িয়ে দেন। অল্প সময়ের মধ্যে বেশি গরু বিক্রি হওয়া এবং হাটে গরু না আসায় সঙ্কট সৃষ্টি হয়।
গত বছর কোরবানি ঈদের আগে গরুর দাম পড়ে যাওয়ায় বেপারিরা বিশাল লোকসানের সম্মুখীন হন। যার ফলে এবার বেপারিরা হাটে গরু কম তুলেছেন। আগারগাঁও বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন হাটের বেপারি লোকমান হোসেন জানান, গত বছর তিনি একাই এই কোরবানির হাটের জন্য ৪৬টি গরু তুলেছিলেন। তার মধ্যে ৮টি বড় আকারের গরু শেষ পর্যন্ত বিক্রি করতে পারেননি। ১২টি গরু বিক্রি করে তার লোকসান হয়েছিল দুই লাখ টাকা। বাকি ২৬টি গরু বিক্রি করে যে লাভ করেছেন, তা-ও উল্লেখ করার মতো নয়। তাই এবার আগে থেকেই কোরবানির হাটের জন্য গরু কম তোলার সিদ্ধান্ত নেন। এবার তিনি গরু তুলেছেন মাত্র ২২টি। শনিবার বেলা ৩টা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন ১৮টি। এবার যে লাভ হয়েছে, তাতে গত বছরের ক্ষতি পুষিয়ে গেছে। তিনি আরও জানান, বিকালে হাটে চাহিদা বাড়ায় অন্য চারটি গরু অনেক বেশি দামে বিক্রি করেন। এবার গরুর দাম বাড়ার আরেকটি কারণ হিসেবে তিনি বলেন, যেখান থেকে তারা সংগ্রহ করেন, সেখানেও দাম কিছুটা বেশি ছিল। আর রাজশাহী থেকে ঢাকায় আসার পথে ঘাটে ঘাটে বিভিন্ন পয়েন্টে গরুপ্রতি অনেক টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে। গরুর খাবারের দাম বেশি হওয়ায় মানুষ গরু পালন কমিয়ে দিয়েছে।
তেজগাঁও পলিটেনিক্যাল ইনস্টিটিউট মাঠে সিরাজগঞ্জের নুরু সরদার বেপারি জানান, ৪৯টি গরু হাটে তুলেছেন। এর মধ্যে ৩৫টি গরু শনিবার রাত ৮টার মধ্যে বিক্রি হয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, শনিবার আসরের পর থেকে হাটে দাম বেড়েছে ঘণ্টায় ঘণ্টায়। বিক্রিও হয়েছে বেশি। হাট পরিচালনা কমিটির সদস্য হাফিজ বলেন, হাটে তখন গরুর চেয়ে ক্রেতা বেশি। রাতে হাটের বেশিরভাগ গরু বিক্রি হয়ে গেছে। বাকি যে কয়েকটি ছিল সুযোগ বুঝে সেগুলোর দামও বাড়িয়ে দিয়েছে বেপারিরা।
সীমান্ত থেকে ব্যাপক গরু দেশে প্রবেশ করলেও বেপারিরা এসব গরু এবার ঢাকায় এনেছে কম। এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, ঢাকার বাইরে জেলায় জেলায় কোরবানিদাতার সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে গরুর চাহিদাও। চুয়াডাঙ্গা সীমান্তবর্তী শিয়ালমারি হাটের বেপারি আবদুস সোবহান জানান, ভারত থেকে প্রচুর গরু এসেছে ঠিকই; তার অর্ধেক গরুও ঢাকায় যায়নি। অন্যান্য বছর প্রায় সব গরুই ঢাকায় যেত। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, স্থানীয় ভাবেই গরুর চাহিদা বেড়েছে। গ্রামে কোরবানিদাতার সংখ্যা বেড়েছে।
ঢাকার সবচেয়ে বড় গাবতলী গরুর হাটের পরিচালক মো. সোহেল জানান, শুক্রবার পর্যন্ত হাটে যে পরিমাণ পশু তোলা হয়েছিল তাতে পশু সঙ্কট হওয়ার কথা নয়। কিন্তু গরুর চাহিদা ধারণার চেয়ে বেশি ছিল। রাস্তাঘাটের বেহাল দশা, যানজট, স্কুলগুলোর বার্ষিক পরীক্ষা, অষ্টম ও পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষাসহ নানা কারণে মানুষ এবার গ্রামের বাড়িতে কম গেছে। ঢাকায় এবার অন্য বছরের তুলনায় পশুর চাহিদা বেড়েছে। এই চাহিদা জোগানো সম্ভব হতো, যদি রাস্তায় ঝামেলা এবং যানজট না থাকত। কিন্তু আগে থেকে গরু বিক্রি না করায় বেপারিরা ফের গরু আনেনি। ঈদের আগের দিন যখন গরুর সঙ্কট তৈরি হয়েছে তখন নতুন করে আর গরু আনা সম্ভব ছিল না। যেসব গরু রাস্তায় ছিল সেগুলো মোবাইলে ঢাকার বেপারিরা মাঝ রাস্তায়ই কিনে নেন। ফলে হাটে গরুর সঙ্কট দেখা দেয়।
রোববারও যারা গরু কিনতে পারেননি সোমবার সকালে ঈদের নামাজ পড়ে তাদের অনেকেই আবার হাটে যান। রাজধানীর ১৩টি অস্থায়ী পশুর হাট ভোরের দিকেই গুটিয়ে যাওয়ায় ক্রেতারা ছোটেন গাবতলীর স্থায়ী হাটে। বেলা ১২টার দিকে সেখানে গিয়ে দেখা যায় বহু ক্রেতা প্রায়শূন্য হাটে কোরবানির পশু খুঁজছেন। লালবাগ থেকে হাটে যাওয়া ব্যবসায়ী আসাদুজ্জামান নাকি শুনেছেন কয়েকটি গরুর ট্রাক গাবতলী হাটের দিকে আসছে, তাই অপেক্ষা করছেন তিনি। হাট পরিচালক সোহেল আরও জানান, ঈদের আগের দিন গভীর রাত পর্যন্ত বেচাকেনা হয়। ঈদের দিন সারাদিন এমনকি ঈদের পরদিনও কোরবানির জন্য বিপুলসংখ্যক মানুষ পশু কেনেন। যেহেতু ঈদের পরেও আরও দুই দিন কোরবানি করা যায়, তাই যারা আগে পারেননি তারা ঈদের পরদিন পশু আসার পর কোরবানি করেন।
গরু না পেয়ে অনেকে খাসি কিনে বাড়ি ফিরেছেন। কেউ কেউ খাসিও কিনতে পারেননি। গরু কেনার জন্য বাড্ডা, বনরূপাসহ কয়েকটি হাট ঘুরে ব্যবসায়ী এসএম রহমান গিয়েছিলেন বনানী হাটে। সেখানে গরু পছন্দ হলেও দামে না বনায় ১৯ হাজার টাকায় দুটো খাসি কিনে বাড়ি ফেরেন। বনানী হাট পরিচালনা কমিটির সদস্য খায়রুল ইসলাম বলেন, গরুর অভাবে খাসির কাস্টমার এখন বেশি, দামও বেশি। ৫ হাজারের খাসি এখন বিক্রি হচ্ছে আট-দশ হাজারে। শেষ দিকে হাটে খাসিও ছিল না।
তিলপাপাড়ার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ানের টার্গেট ছিল, এক লাখ টাকায় দুটি গরু কিনবেন। শনিবার হাটে গরুর দাম মোটামুটি স্বাভাবিক ছিল। একটি বিশাল আকারের গরুর দাম চান বেপারি ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ১ লাখ টাকা হলে ওই গরু কেনা যেত। আবু সুফিয়ান ভাবেন, পরদিন দাম আরও কমলে কিনবেন। কিন্তু পরের দিন বাজারে গিয়ে দেখেন বাজার গরুশূন্য। আফতাবনগর, গাবতলী ও উত্তরা-আজমপুর হাট ঘুরে গরু কিনতে পারেননি। পরে মহল্লার আরও দুই বন্ধুসহ পিকআপ ভাড়া করে শেরপুরের ঝিনাইগাতি থেকে গরু কিনে ঢাকায় ফেরেন ঈদের দিন বেলা ১১ টায়।
গত শুক্রবার জুমার পরে গরুর দাম বেশি থাকলেও শনিবার সকালে দাম কিছুটা সহনীয় ছিল। কিন্তু দুপুরের পর ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ও একযোগে সব ক্রেতা হাটে নামায় হাটে পশুর সঙ্কট দেখা দেয়। আর এই সুযোগে বিশাল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেন বেপারিরা।
ঈদের দিন বিকালে ঢাকার আগারগাঁও তালতলার একটি মৌসুমি পশুর হাটে গিয়ে দেখা যায় সেখানে বেচাকেনা চলছে। ঢাকায় এ ধরণের মৌসুমি হাট মূলত ঈদের দিন ভোর পর্যন্ত চলে এবং তারপর গুটিয়ে ফেলা হয়।
কিন্তু তালতলার এই হাটে দেখা গেল, বিকালেও চলছে। তবে ভেতরে মাত্র চারটি গরু। এগুলোকে ঘিরে দরদাম করে কেনার চেষ্টা করছিলেন ২০-২৫ জন আগ্রহী ক্রেতা। সেখানে একজন ক্রেতা সরকারি চাকুরে বজলুর রহমান বলেন, সামর্থ্য হয় না বলেই ঘোরাঘুরি করে কিনতে হয়।
‘ঈদের আগের দিন গরু পাইনি। মনে করেছিলাম আজ পাব, এজন্য আবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু যা আছে, তা সামর্থ্যের বাইরে। তাই কেনা সম্ভব নয়’, তিনি বললেন।
এ বাজার থেকে ষাট হাজার টাকায় একটি গরু কিনে নিয়ে যাচ্ছিলেন মিরপুরের ব্যাবসায়ী মোজাম্মেল হক।
তিনি বলেন, ‘ঈদের আগের রাতেও হাটে ছিলাম। আজ ভোরেই এসেছি। দুপুরে টঙ্গী থেকে ঘুরে এই তালতলায় এসে কিনতে পারলাম। যে গরুটি কিনেছি, তার দাম মোটেও ৩০ হাজার টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়’, তিনি বলেন।
তালতলার হাটে বিকাল নাগাদ যে চারটি গরু ছিল তার মধ্যে তিনটির মালিক কফিলউদ্দীন বেপারি।
তিনি জানান, ঈদের আগের দিন হাটে ২২টি গরু নিয়ে এসেছিলেন। এর মধ্যে ওই তিনটিই তখন পর্যন্ত বিক্রি বাকি।
হাটটির ইজারাদার শাহাবুল বাসার জানান, বেপারিরা বলেছেন, গরু পালন করার খরচ এতটাই বেড়ে গেছে যে তারা এ ব্যবসা এখন অনেক কমিয়ে দিয়েছেন।
মূলত ঈদের তৃতীয় দিন পর্যন্ত গাবতলীতে রাজধানীর সবচেয়ে বড় হাটে শুধু কোরবানির পশু বেচাকেনা হয়। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা যায় পশুর সংখ্যা হাতেগোনা। তবে ক্রেতা গিজগিজ করছে।
অগণিত নারী-পুরুষ ঈদের দিনেও এখানে এসে অপেক্ষা করছেন একটা ভালো কোনো পশু কিনতে পারবেন, এই আশায়।
হাটে আসা এক গৃহিণী মিসেস তাবাসসুম বলছিলেন, তিনি ঈদের আগের দিন অনেক জায়গায় চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু একদমই গরু ছিল না কোথাও।
একজন ক্রেতা ২২ হাজার টাকায় বাছুরসদৃশ একটি গরু কিনে নিয়ে যাচ্ছিলেন গাবতলীর হাট থেকে।
তার ভাষায়, অনেক ঠকেছি ভাই। এই গরুটার দাম কোনোমতেই ৭-৮ হাজার টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়।
যেখানে শনিবার দুপুর পর্যন্ত হাটগুলোতে পর্যাপ্ত পশু ছিল, ক্রেতার অভাবে হাটে বেপারিরা কান্নাকাটিও করেছেন; সেখানে হঠাত্ করে কেন এই পশু সঙ্কট? বেপারি, হাটের ইজারাদার ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে বেশ কিছু তথ্য। হাটগুলোতে বেপারিরা সিন্ডিকেট করে বেশি মুনাফা আদায়ের জন্য কৃত্রিমভাবে এই সঙ্কট সৃষ্টি করে। প্রথম দিকে হাটগুলোতে প্রচুর গরু তোলা হলেও শেষ দুই দিন পশু তেমন একটা আসেনি। সীমান্ত পেরিয়ে প্রচুর ভারতীয় গরু বাংলাদেশে প্রবেশ করলেও সেগুলো রাস্তায় যানজটের কারণে আটকা পড়ায় ঢাকার হাটে পৌঁছেনি। ঢাকার বেশিরভাগ ক্রেতা হাটে যান শনিবার বিকালে এবং রোববার। বিপুলসংখ্যক ক্রেতা একযোগে হাটে নামায় পশুর সঙ্কট তৈরি হয়।
গবাদিপশুর সঙ্কট ও দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে হাট ইজারাদাররা দায়ী করেন বেপারি সিন্ডিকেটকে। প্রথমে হাটে প্রচুর পশু আসে। পরে বড় বড় বেপারি সিন্ডিকেট করে পশু আনা বন্ধ করে দেয়। তারা মোবাইল ফোনে রাজশাহী, দিনাজপুর, শেরপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মেহেরপুরসহ সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে যেসব গরু আসছিল সেগুলো কিনে পথে আটকে রাখে। পরে সেগুলো হাটে নিয়ে উচ্চ দামে বিক্রি করে।
পশু সঙ্কটের নেপথ্যে আরেকটি বড় কারণ ছিল আগে থেকে পশু বিক্রি না হওয়া ও মিডিয়ায় নেতিবাচক সংবাদ প্রচার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পত্র-পত্রিকাসহ ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বার বার প্রচার হয়েছে হাটে প্রচুর গরু, কিন্তু পশুর ক্রেতা নেই। ইজারাদাররাও বার বার বলেন, যে গরু বিক্রি হচ্ছে তাতে ইজরার টাকাই উঠবে না। বেপারি ও ইজারাদারদের এমন বক্তব্য প্রচারের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে হাটে। অন্য বছর বেপারিরা যে পরিমাণ গরু প্রথমে হাটে তোলেন, সেগুলোর বেশিরভাগ বিক্রি করে পরে আবার তারা পশু আনেন। কিন্তু এবার একদিকে যেমন সরকারি, বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেতন হতে দেরি হয়েছে, তেমনি গত বছরের মতো শেষের দিকে দাম কম হবে এ ধারণার কারণে ঢাকার মানুষ আগে থেকে গবাদিপশু কেনেননি। বেশিরভাগ মানুষ শনিবার বিকালে ও রোববার হাটে যান। এতে হঠাত্ করেই গরুর চাহিদা বেড়ে যায়। এ সুযোগে বেপারিরাও গরুর দাম বাড়িয়ে দেন। অল্প সময়ের মধ্যে বেশি গরু বিক্রি হওয়া এবং হাটে গরু না আসায় সঙ্কট সৃষ্টি হয়।
গত বছর কোরবানি ঈদের আগে গরুর দাম পড়ে যাওয়ায় বেপারিরা বিশাল লোকসানের সম্মুখীন হন। যার ফলে এবার বেপারিরা হাটে গরু কম তুলেছেন। আগারগাঁও বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন হাটের বেপারি লোকমান হোসেন জানান, গত বছর তিনি একাই এই কোরবানির হাটের জন্য ৪৬টি গরু তুলেছিলেন। তার মধ্যে ৮টি বড় আকারের গরু শেষ পর্যন্ত বিক্রি করতে পারেননি। ১২টি গরু বিক্রি করে তার লোকসান হয়েছিল দুই লাখ টাকা। বাকি ২৬টি গরু বিক্রি করে যে লাভ করেছেন, তা-ও উল্লেখ করার মতো নয়। তাই এবার আগে থেকেই কোরবানির হাটের জন্য গরু কম তোলার সিদ্ধান্ত নেন। এবার তিনি গরু তুলেছেন মাত্র ২২টি। শনিবার বেলা ৩টা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন ১৮টি। এবার যে লাভ হয়েছে, তাতে গত বছরের ক্ষতি পুষিয়ে গেছে। তিনি আরও জানান, বিকালে হাটে চাহিদা বাড়ায় অন্য চারটি গরু অনেক বেশি দামে বিক্রি করেন। এবার গরুর দাম বাড়ার আরেকটি কারণ হিসেবে তিনি বলেন, যেখান থেকে তারা সংগ্রহ করেন, সেখানেও দাম কিছুটা বেশি ছিল। আর রাজশাহী থেকে ঢাকায় আসার পথে ঘাটে ঘাটে বিভিন্ন পয়েন্টে গরুপ্রতি অনেক টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে। গরুর খাবারের দাম বেশি হওয়ায় মানুষ গরু পালন কমিয়ে দিয়েছে।
তেজগাঁও পলিটেনিক্যাল ইনস্টিটিউট মাঠে সিরাজগঞ্জের নুরু সরদার বেপারি জানান, ৪৯টি গরু হাটে তুলেছেন। এর মধ্যে ৩৫টি গরু শনিবার রাত ৮টার মধ্যে বিক্রি হয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, শনিবার আসরের পর থেকে হাটে দাম বেড়েছে ঘণ্টায় ঘণ্টায়। বিক্রিও হয়েছে বেশি। হাট পরিচালনা কমিটির সদস্য হাফিজ বলেন, হাটে তখন গরুর চেয়ে ক্রেতা বেশি। রাতে হাটের বেশিরভাগ গরু বিক্রি হয়ে গেছে। বাকি যে কয়েকটি ছিল সুযোগ বুঝে সেগুলোর দামও বাড়িয়ে দিয়েছে বেপারিরা।
সীমান্ত থেকে ব্যাপক গরু দেশে প্রবেশ করলেও বেপারিরা এসব গরু এবার ঢাকায় এনেছে কম। এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, ঢাকার বাইরে জেলায় জেলায় কোরবানিদাতার সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে গরুর চাহিদাও। চুয়াডাঙ্গা সীমান্তবর্তী শিয়ালমারি হাটের বেপারি আবদুস সোবহান জানান, ভারত থেকে প্রচুর গরু এসেছে ঠিকই; তার অর্ধেক গরুও ঢাকায় যায়নি। অন্যান্য বছর প্রায় সব গরুই ঢাকায় যেত। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, স্থানীয় ভাবেই গরুর চাহিদা বেড়েছে। গ্রামে কোরবানিদাতার সংখ্যা বেড়েছে।
ঢাকার সবচেয়ে বড় গাবতলী গরুর হাটের পরিচালক মো. সোহেল জানান, শুক্রবার পর্যন্ত হাটে যে পরিমাণ পশু তোলা হয়েছিল তাতে পশু সঙ্কট হওয়ার কথা নয়। কিন্তু গরুর চাহিদা ধারণার চেয়ে বেশি ছিল। রাস্তাঘাটের বেহাল দশা, যানজট, স্কুলগুলোর বার্ষিক পরীক্ষা, অষ্টম ও পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষাসহ নানা কারণে মানুষ এবার গ্রামের বাড়িতে কম গেছে। ঢাকায় এবার অন্য বছরের তুলনায় পশুর চাহিদা বেড়েছে। এই চাহিদা জোগানো সম্ভব হতো, যদি রাস্তায় ঝামেলা এবং যানজট না থাকত। কিন্তু আগে থেকে গরু বিক্রি না করায় বেপারিরা ফের গরু আনেনি। ঈদের আগের দিন যখন গরুর সঙ্কট তৈরি হয়েছে তখন নতুন করে আর গরু আনা সম্ভব ছিল না। যেসব গরু রাস্তায় ছিল সেগুলো মোবাইলে ঢাকার বেপারিরা মাঝ রাস্তায়ই কিনে নেন। ফলে হাটে গরুর সঙ্কট দেখা দেয়।
রোববারও যারা গরু কিনতে পারেননি সোমবার সকালে ঈদের নামাজ পড়ে তাদের অনেকেই আবার হাটে যান। রাজধানীর ১৩টি অস্থায়ী পশুর হাট ভোরের দিকেই গুটিয়ে যাওয়ায় ক্রেতারা ছোটেন গাবতলীর স্থায়ী হাটে। বেলা ১২টার দিকে সেখানে গিয়ে দেখা যায় বহু ক্রেতা প্রায়শূন্য হাটে কোরবানির পশু খুঁজছেন। লালবাগ থেকে হাটে যাওয়া ব্যবসায়ী আসাদুজ্জামান নাকি শুনেছেন কয়েকটি গরুর ট্রাক গাবতলী হাটের দিকে আসছে, তাই অপেক্ষা করছেন তিনি। হাট পরিচালক সোহেল আরও জানান, ঈদের আগের দিন গভীর রাত পর্যন্ত বেচাকেনা হয়। ঈদের দিন সারাদিন এমনকি ঈদের পরদিনও কোরবানির জন্য বিপুলসংখ্যক মানুষ পশু কেনেন। যেহেতু ঈদের পরেও আরও দুই দিন কোরবানি করা যায়, তাই যারা আগে পারেননি তারা ঈদের পরদিন পশু আসার পর কোরবানি করেন।
গরু না পেয়ে অনেকে খাসি কিনে বাড়ি ফিরেছেন। কেউ কেউ খাসিও কিনতে পারেননি। গরু কেনার জন্য বাড্ডা, বনরূপাসহ কয়েকটি হাট ঘুরে ব্যবসায়ী এসএম রহমান গিয়েছিলেন বনানী হাটে। সেখানে গরু পছন্দ হলেও দামে না বনায় ১৯ হাজার টাকায় দুটো খাসি কিনে বাড়ি ফেরেন। বনানী হাট পরিচালনা কমিটির সদস্য খায়রুল ইসলাম বলেন, গরুর অভাবে খাসির কাস্টমার এখন বেশি, দামও বেশি। ৫ হাজারের খাসি এখন বিক্রি হচ্ছে আট-দশ হাজারে। শেষ দিকে হাটে খাসিও ছিল না।
তিলপাপাড়ার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ানের টার্গেট ছিল, এক লাখ টাকায় দুটি গরু কিনবেন। শনিবার হাটে গরুর দাম মোটামুটি স্বাভাবিক ছিল। একটি বিশাল আকারের গরুর দাম চান বেপারি ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ১ লাখ টাকা হলে ওই গরু কেনা যেত। আবু সুফিয়ান ভাবেন, পরদিন দাম আরও কমলে কিনবেন। কিন্তু পরের দিন বাজারে গিয়ে দেখেন বাজার গরুশূন্য। আফতাবনগর, গাবতলী ও উত্তরা-আজমপুর হাট ঘুরে গরু কিনতে পারেননি। পরে মহল্লার আরও দুই বন্ধুসহ পিকআপ ভাড়া করে শেরপুরের ঝিনাইগাতি থেকে গরু কিনে ঢাকায় ফেরেন ঈদের দিন বেলা ১১ টায়।
গত শুক্রবার জুমার পরে গরুর দাম বেশি থাকলেও শনিবার সকালে দাম কিছুটা সহনীয় ছিল। কিন্তু দুপুরের পর ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ও একযোগে সব ক্রেতা হাটে নামায় হাটে পশুর সঙ্কট দেখা দেয়। আর এই সুযোগে বিশাল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেন বেপারিরা।
ঈদের দিন বিকালে ঢাকার আগারগাঁও তালতলার একটি মৌসুমি পশুর হাটে গিয়ে দেখা যায় সেখানে বেচাকেনা চলছে। ঢাকায় এ ধরণের মৌসুমি হাট মূলত ঈদের দিন ভোর পর্যন্ত চলে এবং তারপর গুটিয়ে ফেলা হয়।
কিন্তু তালতলার এই হাটে দেখা গেল, বিকালেও চলছে। তবে ভেতরে মাত্র চারটি গরু। এগুলোকে ঘিরে দরদাম করে কেনার চেষ্টা করছিলেন ২০-২৫ জন আগ্রহী ক্রেতা। সেখানে একজন ক্রেতা সরকারি চাকুরে বজলুর রহমান বলেন, সামর্থ্য হয় না বলেই ঘোরাঘুরি করে কিনতে হয়।
‘ঈদের আগের দিন গরু পাইনি। মনে করেছিলাম আজ পাব, এজন্য আবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু যা আছে, তা সামর্থ্যের বাইরে। তাই কেনা সম্ভব নয়’, তিনি বললেন।
এ বাজার থেকে ষাট হাজার টাকায় একটি গরু কিনে নিয়ে যাচ্ছিলেন মিরপুরের ব্যাবসায়ী মোজাম্মেল হক।
তিনি বলেন, ‘ঈদের আগের রাতেও হাটে ছিলাম। আজ ভোরেই এসেছি। দুপুরে টঙ্গী থেকে ঘুরে এই তালতলায় এসে কিনতে পারলাম। যে গরুটি কিনেছি, তার দাম মোটেও ৩০ হাজার টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়’, তিনি বলেন।
তালতলার হাটে বিকাল নাগাদ যে চারটি গরু ছিল তার মধ্যে তিনটির মালিক কফিলউদ্দীন বেপারি।
তিনি জানান, ঈদের আগের দিন হাটে ২২টি গরু নিয়ে এসেছিলেন। এর মধ্যে ওই তিনটিই তখন পর্যন্ত বিক্রি বাকি।
হাটটির ইজারাদার শাহাবুল বাসার জানান, বেপারিরা বলেছেন, গরু পালন করার খরচ এতটাই বেড়ে গেছে যে তারা এ ব্যবসা এখন অনেক কমিয়ে দিয়েছেন।
মূলত ঈদের তৃতীয় দিন পর্যন্ত গাবতলীতে রাজধানীর সবচেয়ে বড় হাটে শুধু কোরবানির পশু বেচাকেনা হয়। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা যায় পশুর সংখ্যা হাতেগোনা। তবে ক্রেতা গিজগিজ করছে।
অগণিত নারী-পুরুষ ঈদের দিনেও এখানে এসে অপেক্ষা করছেন একটা ভালো কোনো পশু কিনতে পারবেন, এই আশায়।
হাটে আসা এক গৃহিণী মিসেস তাবাসসুম বলছিলেন, তিনি ঈদের আগের দিন অনেক জায়গায় চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু একদমই গরু ছিল না কোথাও।
একজন ক্রেতা ২২ হাজার টাকায় বাছুরসদৃশ একটি গরু কিনে নিয়ে যাচ্ছিলেন গাবতলীর হাট থেকে।
তার ভাষায়, অনেক ঠকেছি ভাই। এই গরুটার দাম কোনোমতেই ৭-৮ হাজার টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়।
No comments