লোকমান হত্যার আসামিরা ধরা পড়ছে না : ভেঙে পড়েছে নরসিংদীর আইনশৃঙ্খলা : খোকনকে নতুন মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট, কাইয়ুমের ওপর হামলা by মো. মাজহারুল পারভেজ

টনার ৮ দিন অতিবাহিত হলেও নরসিংদীর জনপ্রিয় পৌর মেয়র লোকমান হত্যার কোনো কূল কিনারা হয়নি। চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের পর নরসিংদী এখন ভয় ও আতঙ্কের নগরীতে পরিণত হয়েছে। ঈদের আগের রাতেও নরসিংদীতে গুলির ঘটনা ঘটেছে। এদিকে বিনা অভিযোগে গ্রেফতারকৃত বিএনপি নেতা খায়রুল কবীর খোকনের মুক্তি নিয়েও চলছে টালবাহানা। হত্যার অভিযুক্তরা ঘুরে বেড়ালেও নির্দোষ খায়রুল কবীর খোকনকে ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় জড়ানো হয়েছে। টিঅ্যান্ডটি মন্ত্রীর ভাই ও এপিএসসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের হত্যা মামলায় আসামি করা হলেও তাদের গ্রেফতারের ব্যাপারে পুলিশের যেন কোনো মাথাব্যথা নেই।


এ নিয়ে নরসিংদীবাসীর মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।রহস্য দিন দিন বেড়েই চলছে : মেয়রের খুব কাছের লোকজন হঠাত্ করেই দূরে চলে যেতে শুরু করে। কাছে এসে ভেড়ে নতুন মুখ। তারা নানাভাবে মেয়রকে দিয়ে ফায়দা লুটতে শুরু করে। এরই মধ্যে গা ঢাকা দিয়েছে তারা। তাদের দিকেও পুলিশের নজরদারী বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই।
রায়পুরার মির্জানগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর ও তার সঙ্গী আবু তালেবসহ বেশকিছু ব্যক্তি মন্ত্রীর নানা কর্মকাণ্ডের রিপোর্ট করায় মেয়র লোকমান হোসেন এর বিরুদ্ধে অশালীন মন্তব্য করত এবং সাংবাদিকদের কাছে এসব তথ্যমূলক রিপোর্ট করার জন্য মেয়রকে দায়ী করত। শুধু তাই নয়, এই বিতর্কিত ব্যক্তিরা মন্ত্রীর আরও কাছে যাওয়ার জন্য সাংবাদিকদের হত্যার হুমকিসহ নানাভাবে শাসিয়ে দিত এবং এসব ঘটনা হত্যাকাণ্ডের আগের দিন থেকে শুরু করে হত্যার দিন পর্যন্ত চলে। এ ব্যাপারে থানায় জিডি পর্যন্ত করা হয়েছে। কিন্তু পুলিশ অ্যাকশনে যায়নি। এছাড়া মেয়রকে পুঁজি করে জমি বেচা-কেনা ও জমির প্যাঁচ দিয়ে একদল ব্যক্তি এক বছরে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তারা এখন একেবারে চুপচাপ হয়ে গেছে। মেয়রের একাউন্ট হিসেবে পরিচিত ঘনিষ্ঠ এক ব্যবসায়ী মন্ত্রীর এপিএস মুরাদকে মামলার আসামি না করার জন্য শুরু থেকেই চাপ দিতে থাকে। তার ভূমিকা নিয়েও এরই মধ্যে শহরে নানা জল্পনা কল্পনা শুরু হয়েছে।
এ ব্যাপারে মামলার আইও ডিবির ওসি মামুনুর রশীদ জানান, দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা করে মেয়রকে খুন করা হয়ে থাকতে পারে। হঠাত্ করে তাকে মেরে ফেলার মতো সিদ্ধান্ত নেয়নি খুনিরা। তাই আমরা নানা বিষয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলো খতিয়ে দেখছি। আসামিরা সজাগ হয়ে যেতে পারে সে কারণে এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে অনীহা প্রকাশ করেন তিনি।
খোকন কেন জেলে : নরসিংদীর মানুষের কাছে একটিই প্রশ্ন খায়রুল কবীর খোকন কেন জেলে? খোকনকে কেন গ্রেফতার করা হলো? লোকমানের পরিবারের পক্ষ থেকে খোকনের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করা হয়নি। নরসিংদীর ছাত্রলীগ কিংবা আওয়ামী লীগ খোকনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেনি। তাহলে খোকনকে সন্দেহটা কে করল? রাজনীতিতে খোকন ক্লিন ইমেজের নেতা। ছাত্রদল নেতা থাকাকালে আর্মড পলিটিক্সের সঙ্গে তিনি কখনও জড়িত ছিলেন না। তাহলে কিসের ভিত্তিতে তাকে গ্রেফতার করা হলো?
তদন্ত কর্মকর্তারাই খায়রুল কবির খোকনকে গ্রেফতার করেছে : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : নরসিংদীর জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা ও পৌর মেয়র লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা খায়রুল কবির খোকনকে গ্রেফতারের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন বলেছেন, তাকে গ্রেফতারের ব্যাপারে সরকার পুলিশের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করেনি। তদন্ত কর্মকর্তা তাকে গ্রেফতার করেছেন। এ বিষয়ে কেউ কেউ সরকারকে অন্যায়ভাবে দোষারোপ করে চলেছে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক ভালো বলে দাবি করে তিনি বলেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভালো। তিনি গতকাল সচিবালয়ে নিজ দফতরে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন।
গত ১ নভেম্বর নরসিংদীতে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে সন্ত্রাসীদের গুলিতে পৌর মেয়র ও জনপ্রিয় নেতা লোকমান হোসেন নিহত হন। এ ঘটনায় ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ভাইসহ আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতার নামে হত্যা মামলা হয়। পুলিশ এজহারভুক্ত আসামিদের গ্রেফতার না করে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও ডাকসুর সাবেক জিএস এবং সাবেক এমপি খায়রুল কবির খোকনকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করে। পুলিশের এ অতি উত্সাহী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, পুলিশ স্বাধীনভাবে কাজ করছে। কাকে গ্রেফতার করবে আর কাকে করবে না, সেটা পুলিশের ব্যাপার। তাছাড়া লোকমান হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরা যে দলেরই হোক তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। তাদের বিচারের আওতায় আনা হবেই। আসামিদের ধরা পড়তেই হবে। আসামিরা সরকারি দলের নেতা হওয়ায় পুলিশ ধরতে পারছে না বলে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য চাওয়া হলে তিনি বলেন, আসামিরা কেউই রেহাই পাবে না। গত তিন বছরে যতগুলো ঘটনা ঘটেছে তদন্তকারী কর্মকর্তারা দোষীদের চিহ্নিত করার জন্য সঠিকভাবে তদন্ত করে যাচ্ছেন।
নতুন এসপি : নরসিংদীর এসপি হিসেবে গতকালই নিয়োগ পেলেন ডিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার খ. মুহিদউদ্দিন। জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শোচনীয়। পুলিশের দুর্বল পারফরম্যান্স ও আইনশৃঙ্খলার অবনতির জন্য এ হত্যাকাণ্ডের পর নরসিংদীর পুলিশ সুপার ড. আক্কাছ উদ্দিন ভূঞা ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এনামুল কবীরকে প্রত্যাহার এবং আরেকজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিজয় বসাককে বদলি করার পর মাত্র একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দিয়ে কাজ করানোর জন্য ক্রমেই আরও অবনতির দিকে গেছে জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি।
জেলা প্রশাসক ও জেলা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সভাপতি মো. ওবায়দুল আযমও প্রায় নিষ্ক্রীয়। নবাগত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুব্রত হালদার পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পেয়ে যেন হিমশিম খাচ্ছেন এমনই জানালেন তার অধীনরা।
কিন্তু কি কারণে এত বড় একটি হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ বাহিনীকে কমান্ড ছাড়া রাখা হয়েছে তা খুঁজে পাচ্ছেন না ওয়াকিবহাল ব্যক্তিরা। জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুুল মান্নান ভূঞা ও প্রবীণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবদুুল বাছেদ ভূঞা বলেন, বর্তমান সরকারের পলিসি যে কত দুর্বল এটা তার আরেকটি প্রমাণ।
এদিকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুব্রত হালদার নরসিংদী এসেই শত্রু ভাবছেন সাংবাদিকদের। গতকাল মঙ্গলবার সকালে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে এই পুলিশ কর্মকর্তা এটিএন বাংলার নরসিংদী প্রতিনিধি বেনজির আহমেদ বেনুর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন বলে অভিযোগ করেছেন বেনু।
এদিকে মামলার বাদী কামরুজ্জামানও চান একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ পুলিশ সুপারকে নিয়োগ দিয়ে দ্রুত জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে এনে এ মামলার আসামিদের গ্রেফতার করার ব্যবস্থা করা হোক।
গ্রেফতার ৯ : নিহত পৌরমেয়র হত্যার পর এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে এ পর্যন্ত ৯ জনকে আটক করলেও এফআইয়ারভুক্ত কোনো আসামিকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। এতে করে ক্রমেই পুলিশের ওপর আস্থা হারাচ্ছে জেলাবাসী।
মামলার কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় নিহতের পরিবার ও স্বজনদের মধ্যে বিরাজ করছে চরম আতঙ্ক। ঘটনার রাতে খায়রুল কবীর খোকনসহ ৬ জন ও গতকাল ডিবি পুলিশ সেলিম নামে এক ব্যক্তিকে টঙ্গী থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে বলে জানায় পুলিশ।
সেও মামলার এফআইয়ারভুক্ত আসামি নয়। তবে মামলার আসামি শহর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ মোবারক হোসেন মোবার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ রাখার দায়ে তাকে আটক করা হয়েছে। এদিকে একটি সূত্র জানায়, সেলিম একজন ব্যবসায়ী, তাবলিক জামাতের সঙ্গে যুক্ত এবং নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের গোপালদী তার শ্বশুর বাড়ি এবং নরসিংদীর দত্তপাড়া (বেপারি পাড়ায়) তার মামা শ্বশুরের বাড়ি।
এছাড়া নিহত মেয়র লোকমান হোসেন হত্যা মামলার বাদী ও তার ছোট ভাই কামরুজ্জামানকে জড়িয়ে অপপ্রচারের দায়ে দুই সন্ত্রাসীকে আটক করেছে পুলিশ। তারা হলো শহরের বাগদী মহল্লার সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর হোসেন এবং কাউরিয়াপাড়া মহল্লার নূরে আলম। জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে প্রায় অর্ধশত ইয়াবা ট্যাবলেট পেয়েছে বলে জানায় মডেল থানার ওসি আনোয়ার হোসেন। পুলিশের ধারণা তাদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে এবং তারা একটি মিশন নিয়ে মাঠে নেমে বাদীর বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমেছে।
মেয়রের বাড়ির পাশ থেকে বোমা উদ্ধার : সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত নরসিংদী পৌরমেয়র লোকমান হোসেনের বাড়ির পাশে চার দেয়াল বেষ্টিত একটি পরিত্যক্ত জমিতে বোমা সদৃশ বস্তু পাওয়া গেছে। ঈদের আগের দিন বেলা একটার সময় লাল স্কচ টেপে মোড়ানো এই বোমা সদৃশ বস্তুগুলো দেখে স্থানীয় লোকজন পুলিশকে খবর দেয়। খবর পেয়ে এ এসপি সার্কেল হেলাল উদ্দিন ও সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন।
পরে গেটের তালা ভেঙে পুলিশ ভেতরে প্রবেশ করে বেলা ২টার দিকে বোমা সদৃশ ৪টি বস্তু উদ্ধার করে পানিভর্তি বালতির ভেতরে করে থানায় নিয়ে যায়।
এদিকে পরীক্ষা নিরীক্ষা না করে এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হয়নি পুলিশ। তবে ওসি আনোয়ার হোসেন জানায়, যেখান থেকে এই বস্তুগুলো উদ্ধার করা হয়েছে এই জমির মালিক মজিবর রহমান। চার দেয়াল দিয়ে গেটে তালাবদ্ধ করে রাখলেও ভেতরে কোনো বাড়িঘর নেই। এ ঘটনায় নতুন করে শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। এ ব্যাপারে গতকাল সদর থানায় যোগাযোগ করলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন জানান, এখনও এগুলো পানিভর্তি বালতিতে রাখা আছে।
এস এম কাইয়ুমের ওপর হামলা : বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ সভাপতি ও সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত পৌর মেয়র লোকমান হোসেনের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী এস এম কাইয়ুমের ওপর হামলা হয়েছে। অভিযোগ রোববার রাত সাড়ে ১১টায় মেয়রের বাড়ির সামনে কাইয়ুমের ওপর এ হামলার ঘটনা ঘটে। পরদিন সোমবার বিকালে নরসিংদী পৌর এলাকার রাঙ্গামাটি মহল্লায় তার নিজ বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন করে স্বরাষ্ট্র ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ হামলার বিচার চেয়েছেন এস এম কাইয়ুম।
এদিকে এস এম কাইয়ুম তার ওপর হামলার জন্য র্যাবকে দায়ী করলেও টেলিফোনে র্যাব ১১ এর নরসিংদীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এএসপি আহসান হাবিব জানান এ ঘটনার সঙ্গে র্যাবের কোনো সম্পৃক্তা নেই। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ সুব্রত হালদার বলেন ভিন্ন কথা। এটা কোনো সন্ত্রাসী ঘটনা নয় স্বীকার করে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একদল সদস্যের সঙ্গে কাইয়ুমের ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। তবে তারা পুলিশের সদস্য নয়।
এদিকে এস এম কাইয়ুমের ওপর এ হামলায় জেলাব্যাপী নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। এর একদিন পর অর্থাত্ মঙ্গলবার বিকালে কাইয়ুম বাদী হয়ে সদর মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ১৪। মামলায় তিনি অভিযোগ করেন, ঘটনার দিন মেয়রের বাড়ির সামনে দুইজন অজ্ঞাত আগ্নেয়াস্ত্রধারী তার গতিরোধ করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুটি মাইক্রোবাসে উঠতে বললে তিনি আপত্তি জানান। সঙ্গে সঙ্গেই তারা বুকে আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে টিগার টিপতে থাকে। গুলি বের না হওয়ায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এ সময় প্রাণে বাঁচার জন্য তাদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়। সন্ত্রাসীরা অবস্থা বেগতিক দেখে মাথায় আঘাত করলে তার দুই সহকর্মী গুরুতর আহত হয়।
নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগ খণ্ড-বিখণ্ড : পৌর মেয়র লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগ খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে পড়েছে। জেলায় সরকার দলীয় চার এমপি ও সাবেক ছাত্রনেতা এস এম কাইয়ুম এ হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করে হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে প্রতিবাদ সভা-সমাবেশ অব্যাহত রাখলেও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এড. আসাদুজ্জামান এবং সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভূঞা মামলার প্রধান আসামি মন্ত্রীর ভাই সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুর পক্ষে নিহত মেয়রের বাড়ির আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে সাফাই গেয়েছেন। মামলা রুজু হওয়ার পরদিন মন্ত্রী ও মন্ত্রীর ভাইয়ের পক্ষে সাংবাদিকদের কাছে এ সাফাই গান। এ সময় সাংবাদিকরা আরও প্রশ্ন করতে চাইলে একরকম জোর করে কথা না বলে তিনি স্থান ত্যাগ করেন। এরপর গত ৪ দিন ধরে তিনি আর মেয়রের বাসায় আসেনি বলে জানা গেছে।
এছাড়া ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজি উদ্দিন আহমেদ রাজু মামলার প্রধান আসামি তার ভাই
বাচ্চুসহ বেশ কয়েকজন আসামিকে তার বনানীর বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন বলে জানা গেছে। পুলিশ ওই বাড়িতে এখন পর্যন্ত কোনো অভিযান চালায়নি। এদিকে মনোহরদীর বেলাব থেকে নির্বাচিত প্রবীণ রাজনীতিক অ্যাডভোকেট নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুনের রাজনৈতিক ছাত্র ছিলেন লোকমান হোসেন। এ ঘটনার পর তিনি অনেকটা ভেঙে পড়েছেন বলে জানা গেছে।
শিবপুর থেকে নির্বাচিত এমপি জহিরুল হক মোহন, পলাশ থেকে নির্বাচিত ড. আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলিপ ও নরসিংদী সদর থেকে নির্বাচিত লেং কর্নেল (অব.) নজরুল ইসলাম হীরু এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেছেন।
খায়রুল কবীর খোকন দুই মামলায় শোন অ্যারেস্ট : দীর্ঘ সোয়া এক ঘণ্টা শুনানি শেষে বিএনপির কেন্দ্রীয় শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক ও নরসিংদী জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবীর খোকনের জামিন না মঞ্জুর করে আবারও তাকে জেলা কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
গতকাল সকাল পৌনে ১১টার দিকে পুলিশের কড়া পাহারায় নরসিংদী জেলা কারাগার থেকে নরসিংদীর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিতাই চন্দ্র সাহার আদালতে তাকে আনা হয়। এ সময় পূর্বনির্ধারিত পুলিশের শুনানি শেষে রিমান্ড আবেদন বাতিল করেন বিচারক। কিন্তু এরই মধ্যে নরসিংদী সার্কিট হাউস ও রেলস্টেশন ভাংচুর এবং অগ্নিসংযোগ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে তাকে অ্যারেস্ট দেখানোর আবেদন জানায়। রাষ্ট্রপক্ষের এ আবেদনের প্রেক্ষিতে দীর্ঘ শুনানি শেষে আদালত বেলা ১২টার দিকে তাকে অ্যারেস্ট দেখানোর নির্দেশ দেন। এ সময় খোকনের আইনজীবীরা এ মামলায় জামিন চাইলে মামলাটি এ আদালতের এখতিয়ারের বাইরে উল্লেখ করে জামিন নামঞ্জুর করে খোকনকে জেলা কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
খায়রুল কবীর খোকনের পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া, ঢাকা বারের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট ইকবাল হোসেন ও অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদারের নেতৃত্বে শতাধিক আইনজীবী আদালতে উপস্থিত হন। পরে আইনজীবীরা আদালতের বাইরে এসে সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশ প্রথম খায়রুল কবীর খোকনকে লোকমান হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখায়। লোকমানের পরিবার তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেনি এবং কোনো অভিযোগ করেনি। লোকমান হত্যার প্রতিবাদে যে ভাংচুর হয়েছে সেই মামলায় অ্যারেস্ট দেখিয়ে ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের পরিচয় দিল সরকার।
এ আদেশ শুনে আদালতের ভিতরে আইনজীবী ও বাইরে দলীয় নেতাকর্মীরা ব্যাপক হৈচৈ ও হাঙ্গামা শুরু করে। ডিসি রোডের দু’পাশে অবস্থান নেয়া শত শত নেতাকর্মী মুহূর্তেই জজ কোর্টের প্রধান ফটকে অবস্থান নেয় ও মিছিল শুরু করে। বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের ওপর চড়াও হয় পুলিশ। পরে পুলিশ খায়রুল কবীর খোকনকে নিয়ে দ্রুত পিকআপে জেলা কারাগারের দিকে চলে যায়।
উল্লেখ্য, সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হত্যার রাতেই খায়রুল কবীর খোকনকে ঢাকার বাসা থেকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। পরে গত ৩ নভেম্বর আদালতে নেয়ার পর রিমান্ড চায়। আদালত রিমান্ডের শুনানির জন্য ৯ নভেম্বর ধার্য করেন।
হত্যার প্রতিবাদে সভা-সমাবেশ ও সংবাদ সম্মেলন অব্যাহত : লোকমান হত্যার প্রতিবাদে ও খুনিদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবিতে সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত মঙ্গলবার বিকালে নিহত মেয়রের শহরের বাসাইল মহল্লার বাসভবনে এ সভায় বক্তব্য রাখেন নরসিংদী-১ থেকে নির্বচিত এমপি লে. কর্নেল (অব.) নজরুল ইসলাম হীরু বীর প্রতীক, নরসিংদী-২ থেকে নির্বাচিত ডা. আনোয়ার আশ্রাফ খান দিলিপ ও তিন আসন থেকে নির্বাচিত জহিরুল হক মোহন। এছাড়া আরও বক্তব্য রাখেন নিহত মেয়রের ছোট ভাই ও মামলার বাদী কামরুজ্জামান এবং নরসিংদী জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, নরসিংদী সরকারি কলেজের ভিপি শামীম নেওয়াজ।
জেলার সরকার দলীয় তিন এমপি এই হত্যার তীব্র নিন্দা করে বলেন, এরই মধ্যে এ ব্যাপরে তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেছন। প্রধানমন্ত্রী খুনিদের দ্রুত গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার নির্দেশ ছাড়াও নিজেই সার্বিক খোঁজ-খবর রাখছেন বলে জানান এমপিরা।
পাশাপাশি ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু ও তার ভাইয়ের দিকে সন্দেহের তীর থাকলেও মন্ত্রী রাজু প্রকৃত হত্যাকারী যারাই হোক না কেন তাদের বিচার দাবি করেছেন বলে সভায় জানানো হয়।
নিহতের ছোট ভাই ও মামলার বাদী কামরুজ্জামান বলেন, ১৯৯২ সনে তিনি বাবা হারালেও এতিম হননি। কিন্তু ভাইকে হারিয়ে তিনি এতিম হয়ে গেছেন বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তার ছোট ভাই শামীম নেওয়াজ মেয়রের ডায়েরি থেকে তার নিজের হাতে লেখা ‘বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি, আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম’ কবিতাটি পাঠ করলে উপস্থিত শত শত শোকাহত মানুষ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি।
খোকনের মুক্তির দাবিতে সংবাদ সম্মেলন : পুলিশি হয়রানি থেকে বিএনপি নেতা খায়রুল কবীর খোকনের মুক্তি ও পৌর মেয়র লোকমান হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও নরসিংদী জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মঞ্জুর এলাহী। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে নরসিংদীর ব্রাহ্মন্দীতে উপজেলা চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলন হয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপজেলা চেয়ারম্যান তার লিখিত বক্তব্যে বলেন, পুলিশ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক এমপি খায়রুল কবীর খোকনকে অন্যায়ভাবে আটক করে রেখেছে। যেখানে নিহত মেয়রের পরিবার থেকে মামলায় খোকনের নাম দেয়া হয়নি সেখানে পুলিশ অতি উত্সাহী হয়ে খোকনকে গ্রেফতার করেছে। এতে প্রমাণিত হয় বর্তমান সরকার বিএনপিকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে এসব কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। অনতিবিলম্বে বিএনপি নেতা খোকনের মুক্তির দাবি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, লোকমান হত্যাকাণ্ড নরসিংদীর ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। তিনি অনতিবিলম্বে হত্যাকারীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি জানান।
ঈদ নেই দুই পরিবারে : নিহত পৌর মেয়র লোকমান হোসেন ও খায়রুল কবীর খোকনের পরিবারে ঈদের আনন্দ নেই। ঈদের দিন সকালে মেয়রের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় স্বজন হারানোয় তাদের ঈদের আনন্দ মাটি হয়ে গেছে। চুলায় জ্বলছে না আগুন। পরিবারের সদস্যরা সকাল ১০টার দিকে পৌর কবরস্থানে লোকমান হোসেনের কবরের পাশে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় তার বৃদ্ধা মা সেখান থেকে আসতে চাননি। তিনি তার ছেলের সঙ্গেই ঘুমিয়ে থাকতে চান বলে চিত্কার করতে থাকেন।
এদিকে জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবীর খোকন কারাগারে থাকায় তার স্ত্রী শিশুপুত্রকে নিয়ে ঈদের দিন কাটিয়েছেন। অবুঝ ছেলে বারবার বাবার কথা বললেও জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা তাকে সান্ত্বনা দিতে পারেননি। শিরিন সুলতানা বলেন, আমি এমন এক হতভাগা, আমার নির্দোষ স্বামীকে পুলিশ হয়রানি করছে অথচ তাকে মুক্ত করতে পারছি না।

No comments

Powered by Blogger.