সিলেটের সারি নদীর উজানে ভারতের পানি বিদ্যুত্ উত্পাদন এ মাসেই by এটিএম হায়দার,

সিলেটের জৈন্তাপুর-গোয়াইনঘাট উপজেলার উজানে মাইনথ্রু-লেসাকা হাইড্রোইলেক্ট্রিক প্রজেক্টের অধীন সারি নদীতে ভারতের মেঘালয় রাজ্য সরকার বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ করলেও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদ্যুত্ উত্পাদনের সময়সীমা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের তিনটি ইউনিটের মধ্যে প্রথম ইউনিট চলতি নভেম্বর মাসে এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় ইউনিটের উত্পাদন আগামী মার্চ পর্যন্ত পিছিয়ে দেয়া হয়েছে।আগের খবর অনুযায়ী প্রকল্পটির তিনটি ইউনিটের বাণিজ্যিক উত্পাদন শুরু গত ১৫ অক্টোবর নির্ধারিত ছিল। তবে এখন বলা হচ্ছে, প্রথম ইউনিটে চলতি নভেম্বর মাস থেকেবাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদ্যুত্ উত্পাদিত হবে। অপর দুই ইউনিটে বিদ্যুত্ উত্পাদনে যাবে আগামী মার্চ মাসে।


এই প্রকল্পের প্রতি ইউনিটে ৪২ মেগাওয়াট করে তিনটি ইউনিটে মোট ১২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদিত হওয়ার কথা। মেঘালয়ের জৈন্তিয়া হিল ডিস্ট্রিক্টের আমলারিম ব্লকের পাহাড়ি খরস্রোতা মাইনথ্রু নদীর ওপর ৬৩ মিটার উঁচু ড্যাম নির্মাণ করে এই পরিমাণ বিদ্যুত্ উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। মাইনথ্রু নদী জৈন্তাপুর উপজেলার লালাখাল সীমান্ত ঘেঁষে বাংলাদেশে প্রবেশ করে সারি নাম ধারণ করেছে।
মেঘালয়ের এডিশনাল চিফ সেক্রেটারি (ইনচার্জ পাওয়ার) বি কে দেববার্মা অসমের দি সেনটিনল্ পত্রিকাকে বলেছেন, যদি পানিপ্রবাহ চলতি সপ্তাহে বৃদ্ধি পায়, তবে মাইনথ্রু-লেসাকা প্রজেক্টের প্রথম ইউনিটের বিদ্যুত্ উত্পাদন চলতি মাসে একটি পর্যায়ে উন্নীত হবে। গতকাল প্রকাশিত পত্রিকার এই খবরে তিনি বলেন, গত ১৫ মাসে বন্যা ও ভূমিধসের কারণে প্রকল্পটি বিলম্বিত হয়। প্রকল্পের শুরুতে আশা করা হয়েছিল, ২০১০ সালের জুনে ১২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনে যাবে। বি কে দেববার্মা বলেন, আমরা আশাবাদী যে, পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি পেলেই চলতি মাসে বিদ্যুত্ উত্পাদন হবে। প্রথম ইউনিটে ৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন হবে। অপর দুই ইউনিট শেষ হবে আগামী বছরের মার্চ মাসে। আশা করা হচ্ছে, তিনটি ইউনিট পুরোদমে উত্পাদনে গেলে তা ১২৮ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুত্ উত্পাদনে সক্ষম হবে, যা রাজ্যের বিদ্যুত্ ঘাটতি মেটাবে। আর্থিক ব্যয় বৃদ্ধি প্রসঙ্গে এডিশনাল সেক্রেটারি উল্লেখ করে বলেন, ১৯৯৯ সালে প্রকল্পটি গৃহীত হয় এবং ২০০৪ সালে শেষ হওয়ার কথা। সময় বেশি নেয়ায় এর ব্যয়ভার বেড়েছে।
এদিকে লেসাকা তৃতীয় ইউনিট মেঘালয়া ইলেক্ট্রিক কোম্পানি লিমিটেডের আর্থিক অসঙ্গতি তুলে ধরে অ্যাসোসিয়েশন অব পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ার্স এবং অ্যাসোসিয়েশন কো-অর্ডিনেশন কমিটি (এসিসি) সেক্রেটারি এ ডাকার শিলং টাইমসকে বলেছেন, মাইনথু্র-লেসাকা প্রজেক্টে তৃতীয় বিদুত্ ইউনিট জুড়ে দেয়ায় ব্যয় বৃদ্ধি এবং অপর দুই ইউনিটের উত্পাদনকে বাধাগ্রস্ত করেছে। তিনি বলেন, এর প্রারম্ভিক ডিজাইনে তৃতীয় ইউনিটটি ছিল না। এতে ব্যয় ৩৬০ কোটি থেকে ৯৬৫ কোটি রুপি অর্থাত্ তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি তা ১২০০ কোটি রুপিতে উন্নীত হতে পারে। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে যে অর্থ আনা হয়েছে তার সুদ কেবল বার্ষিক ৩০ কোটি টাকা দিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ১২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন অসম্ভব। এখানে সর্বোচ্চ ৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদিত হবে বৃষ্টির সময়। ছোট ড্যাম এবং পানিপ্রবাহ সীমিত। তাই ১২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ প্রাপ্তির কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, প্রশ্ন এসেছে সেন্ট্রাল ইলেকট্রিসিটি অথরিটি (সিইএ) তৃতীয় ইউনিটটি কিভাবে অনুমোদন দিয়েছে। গত ১৫ অক্টোবর প্রথম ইউনিট উত্পাদনে যাবার তারিখ নির্ধারিত ছিল। তা আবার বিলম্বিত হয়। সরকার বলছে, আগামী মার্চ মাসে তিনটি ইউনিট উত্পাদনে যাবে।
এর আগে গত মাসে শিলং টাইমস-এর খবরে বলা হয়, রাজ্য সরকারের চিফ সেক্রেটারি ডব্লিউএমএস পারাইট বলেছেন, একটি ইউনিটের টেস্টিং চললেও বাণিজ্যিক উত্পাদন আবার পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি একথাও বলেন যে, প্রথম ইউনিট শিগগিরই স্বল্প সময়ের জন্য বাণিজ্যিক উত্পাদনে যাবে। তবে রাজ্য সরকার তিনটি ইউনিটের বাণিজ্যিক উত্পাদনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে আগামী বছর অর্থাত্ ২০১২ সালের মার্চ মাসে। অপর দুটি ইউনিটসহ তিনটি ইউনিটই চলতি বছরের অক্টোবরের মধ্যে বাণিজ্যিক উত্পাদনে যাওয়ার কথা ছিল। সরকার নির্ধারিত সময়সূচি গত ১৫ অক্টোবর অতিক্রান্ত হওয়ার পর পুনরায় নতুন তারিখ নির্ধারিত হলো। বিলম্বের কারণ সম্পর্কে শিলং টাইম্সকে প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা মেঘালয়া এনার্জি কর্পোরেশন লিমিটেড এমইসিএল চেয়ারম্যান-কাম-এমডি এবং রাজ্যের চিফ সেক্রেটারি ডবিম্লউএমএস পারাইট ব্যাখ্যা প্রদান করে বলেন, প্রথম ইউনিটের টেস্টিং চলছে, আমরা নির্ধারিত টার্গেট অনুযায়ী এগিয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন, প্রজেক্ট প্রস্তুত হয় ২০০২ সালে এবং ২০০৪ সালে সরকার তার সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিল। কিন্তু তা রক্ষা করা যায়নি। আশা করা হচ্ছে, প্রথম ইউনিটের ৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ রাজ্যের ঘাটতি অনেকাংশে মেটাবে।
গত আগস্ট মাসে প্রথম ইউনিট পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হলেও অপর দুই ইউনিট চালুর সময়সীমা গত ১৫ অক্টোবর অতিক্রান্ত হলেও তা চালু হয়নি। এই দুই ইউনিটসহ তিনটি ইউনিটের বাণ্যিজিক উত্পাদনের সময়সীমা ৫ মাস পিছিয়ে আগামী মার্চ নির্ধারণ করা হয়েছে। আগের খবর অনুযায়ী গত মে মাসে প্রথম ইউনিট, জুন মাসে দ্বিতীয় ইউনিট এবং অক্টোবরে তৃতীয় ইউনিট চালুর কথা ছিল।
জানা যায়, প্রথম ইউনিটটির বাণিজ্যিক উত্পাদন বিলম্বিত হওয়ার নানা কারণ থাকলেও মূল কারণ হচ্ছে অপ্রত্যাশিত ব্যয়ভার কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়া। প্রকল্পের শুরুতে এর ব্যয়ভার ভারতীয় মুদ্রায় ৩৬০ কোটি রুপি ধরা হলেও বর্তমানে তা তিনগুণ বেড়ে ৯৬৫ কোটি রুপিতে দাঁড়িয়েছে। তিনটি ইউনিটে প্রজেক্টের বিদ্যুত্ উত্পাদন ক্ষমতা ১২৬ মেগাওয়াট। মাইনথ্রু-লেসাকা হাইড্রো ইলেকট্রিক প্রজেক্ট ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২০০৯ সালের অক্টোবরে ঢলে প্রথম দফা এবং ২০১০ সালের মে মাসে লাইরিয়াং নদীর বানের পানিতে দ্বিতীয় দফা যন্ত্রপাতি বিনষ্ট হওয়ায় এর কাজ বিলম্বিত হয়।
উল্লেখ্য, গত ১৬ আগস্ট দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় প্রথম উত্তর সিলেটের অন্যতম পাহাড়ি নদী সারির উজানে জৈন্তিয়া হিল ডিস্ট্রিক্টের মাইনথ্রু নদীতে ভারতের মেঘালয় সরকার কর্তৃক বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য ড্যাম তৈরির কাজ শেষের খবর প্রথম প্রকাশিত হয়। পরিবেশবিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, ছোট বা বড় যে কোনো নদীর উজানে পানির গতিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করা হলে তার প্রতিক্রিয়া ভাটির জনপদের জন্য ক্ষতিকর—এটাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে আনুমানিক ৩০-৩৫ কিলোমিটার দূরে ডাউকিচ্যুতির কাছাকাছি মাইনথ্রু-লেসাকা হাইড্রো ইলেকট্রিক ড্যামটির অবস্থান। প্রকল্পটি মাইনথ্রু ও অপর দুই উত্স লামু নদী এবং উমসরিয়াং নদীর ত্রিমুখ সঙ্গমে অবস্থিত। প্রকল্প শুরুর সময় সারপত্রে বলা হয়েছিল, মাইনথ্রু-লেসাকা হাইড্রো ইলেকট্রিক প্রজেক্ট (২ >< ৪২ + ৪২) মেগাওয়াট রান অব রিভার (আরওআর) স্কিম। এটি মেঘালয়ের জৈন্তিয়া পাহাড়ি জেলায় অবস্থিত। মাইনথ্রু নদীর ওপর ৬৩ মিটার উঁচু ড্যাম হবে—যা অপর দুই উত্স দুই নদী লামু এবং উমসরিয়াং নদীর ত্রিমুখ সঙ্গমে। মেঘালয় ইলেকট্রিসিটি বোর্ড (এমইবি) ১৯৭৫-৭৬ সালে মাইনথ্রু-লেসাকা স্টেজ-১ হাইড্রো ইলেকট্রিক প্রজেক্ট (২ ><৪২ ) মেগাওয়াট প্রকল্পটি গ্রহণ করে। সার্ভের পর প্রকল্পের সারপত্র অক্টোবর ১৯৯৮ সালে সেন্ট্রাল ইলেকট্রিসিটি অথরিটির ছাড়পত্রের জন্য দাখিল করা হয়। মেঘালয় পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড কর্তৃক গণশুনানি হয় মার্চ ১৯৯৯ সালে। পরিবেশ ও বন বিভাগ ১৯৯৯ সালের আগস্টে এ সংক্রান্ত ছাড়পত্র প্রদান করে। প্রকল্পের অর্থনৈতিক ও কারিগরি ছাড়পত্র মেঘালয় সরকারের পত্র নং-২/মেঘা/২/৯৯-পিএসি/৯৪৯৯-৯৫২২/৭০২ তারিখ ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ সালে দেয়া হয়। কিছু শর্তে বন বিভাগের ছাড়পত্র পত্র নং৮-৩৩/২০০০-পিসি তারিখ ১৯.৬.২০০১ ছাড়পত্র প্রদান করে। পরিবেশ ছাড়পত্র পত্র নং জে-১.২০০১/৪/৯৯-আইএ-তারিখ ২০/৯/২০০১ এবং পত্র নং ইউ/ও নং জিএপি/২৫৮/৯৭/ভলি.১/১৫২ তারিখ ১২/৬/২০০২-এর মাধ্যমে প্রকল্পটির অনুমোদন হয়। এতে মোট নির্মাণব্যয় ধরা হয় সুদসহ ৩৬৩ কোটি ৮ লাখ রুপি। ২০০৪ সালের মে মাসে প্রকল্পের চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। ডাউকি ফল্টের কাছাকাছি এর অবস্থান হওয়ায় ওই ফল্টের বিষয়টি মাথায় রেখে প্রকল্পটি ৯+ মাত্রার ভূমিকম্প প্রতিরোধক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এমনকি কয়লা খনির এসিড পানি থেকে স্থাপনা রক্ষায় বিশেষ স্টিল ও লৌহ সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিটি ইউনিটে ৪২ মেগাওয়াট করে মোট তিনটি ইউনিটে ১২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন হবে। মেঘালয় সরকারের বিদ্যুত্ উত্পাদন, পরিবহন ও বিতরণের দায়িত্বে নিয়োজিত মেঘালয় এনার্জি করপোরেশন লিমিটেড প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। সরকারের নিজ অর্থ এবং কোম্পানির বাজারে ছাড়া বন্ড থেকে প্রকল্পের অর্থ সংগ্রহ করা হয়। প্রাকৃতিক ও তহবিল স্বল্পতার কারণে শুরু থেকেই প্রকল্পটির কাজ ধীরগতিতে চলছিল। ফলে বেশ কয়েকবার কাজ সমাপ্তির মেয়াদ নির্ধারিত থাকলেও প্রকল্পটি শেষ করা যায়নি। গত বছর অতিরিক্ত বৃষ্টিতে প্রকল্পের সাইটে পূর্ত কাজে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও তা আরেক দফা বিলম্বিত ও ব্যয়ভার বেড়ে যায়।
প্রসঙ্গত, মেঘালয়ের পাহাড়ে সৃষ্ট খাসিয়া মাইনথ্রু নদীই গোটা জৈন্তিয়া পাহাড়ি জেলা ঘুরে জৈন্তাপুরের কাছে সীমান্তঘেঁষে বাংলাদেশ প্রবেশ করে সারি নাম ধারণ করেছে। সারি নদী পরে গোয়াইন নাম ধারণ করে গোয়াইনঘাট সদর হয়ে হাওর বিল হয়ে সিলেট সদর সীমান্তে চেঙেরখাল নদী নাম ধারণ করে সিলেট সদর উত্তরের কয়েকটি ইউনিয়ন দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ছাতকে সুরমা নদীর সঙ্গে মিশেছে। এই নদী থেকে প্রসিদ্ধ সারি বালু উত্তোলন করা হয়ে থাকে এবং পাথর ও বালুবাহী কার্গোগুলো চলাচল করে থাকে। পৃথিবীর সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল এলাকা হিসেবে খ্যাত চেরাপুঞ্জির কাছে অবস্থিত জৈন্তা পাহাড়ে একই মাত্রায় অতিবৃষ্টি নিয়মিত হয়ে থাকে। ফলে প্রতিনিয়ত রিজার্ভার পানিতে পূর্ণ হবে এবং স্বাভাবিক মাত্রার বেশি পানি ছাড়া হবে। এরই মধ্যে সীমান্ত এলাকার নদীগুলোর পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে। এ অবস্থায় প্রকল্পের অতিরিক্ত পানি ছাড়া হলে এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে।

No comments

Powered by Blogger.