সেঁজুতির আত্মার আর্তনাদ by মান্নান মারুফ
আসামিরা ঘুরে বেড়ালেও মুখ খুলতে পারছেন না সেঁজুতির মা ও গ্রামের সাধারণ মানুষ। তারা এখনও শুনতে পান সেঁজুতির আর্তনাদ। মায়ের চোখে ক্ষণে ক্ষণেই ভেসে ওঠে সেঁজুতির সুন্দর মুখখানি। মা হাফেজা বেগম মেয়ের ছবি নিয়ে বসে থাকছেন ঘরের কোণে। মানুষ দেখলেই হাউমাউ করে কাঁদছেন। মেয়ে হত্যার বিচার চাচ্ছেন। কিন্তু কে করবে বিচার- এ প্রশ্ন এলাকাবাসীর।
ধর্ষণের শিকার হয়েও বিচার না পেয়ে অভিমান ও তীব্র ঘৃণায় আত্মহত্যা করে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন সেঁজুতি।
পুলিশের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। কাঁদছে সেঁজুতির স্কুলের সহপাঠিরা। ক্ষোভে দুঃখে জ্বলছেন সেঁজুতির স্কুলশিক্ষকরা। বড় বড় নেতারা ও পুলিশের বড় কর্তারা আশ্বাস দিলেও বিচার পাবে কি-না, এ নিয়ে সেঁজুতির পরিবার ও গ্রামবাসীর সন্দেহ আস্তে আস্তে ঘনীভূত হচ্ছে।
কারণ এখনও গ্রেপ্তার হয়নি আসামিরা। ফলে আতঙ্কিত সেঁজুতির মা ও তার আত্মীয় স্বজন।
আসামি গ্রেপ্তার না হওয়ায় গ্রামবাসীর সন্দেহ
সেঁজুতির ধর্ষিত হওয়ার ২১ দিন ও আত্মহত্যার ১৪দিন পরও দু‘টি মামলার একজন আসামিও গ্রেপ্তার না হওয়ায় গ্রামবাসী ও সেঁজুতির মা-বাবার মনে সংশয় দানা বেঁধেছে।
গ্রামের জমির উদ্দিন মনে করেন পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তার করছে না। তার সন্দেহ, বাখেরগঞ্জ থানার বরখাস্তকৃত ওসি রবিউলের মতো বর্তমান দায়িত্বরত তদন্তকারী কর্মকর্তাও অর্থের বিনিময়ে বিক্রি হয়ে গেছেন।
তিনি মনে করেন, পুলিশ ইচ্ছা করলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পারে।
বাংলানিউজকে একই কথা বললেন, সেঁজুতির বাড়ির পার্শ্ববর্তী মহল্লার আলম।
তার মতে, পুলিশের টালবাহানার কারণেই সেঁজুতিকে ধর্ষণকারী ও হত্যায় প্ররোচনাকারীরা গ্রেপ্তার হচ্ছে না।
বরখাস্তকারী ওসি রবিউল ও বারেক মৃধা, ফারুক মৃধাসহ যারা সেঁজুতিকে অশ্লীল গালাগাল করেছেন তাদের গ্রেপ্তার না করায় একই সন্দেহ কাজ করছে।
বাঁচতে চেয়েছিল সেঁজুতি
সেঁজুতি বাচঁতে চেয়েছিল। সে আশা করেছিল গ্রামের মাতব্বররা যখন বিচার করেনি, তখন থানায় গেলে হয়তো বিচার পাওয়া যাবে। কিন্তু থানায় মামলা করতে গেলে ওসি রবিউলের অকথ্য গালাগাল ও বাড়িতে ঢুকে আসামিদের আত্মীয়দের অকথ্য গালাগালে ক্ষুব্ধ অপমানিত সেঁজুতি আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
এ ব্যাপারে সেঁজুতির মা বাংলানিউজকে বলেন, ‘ওসি রবিউলের কাছে আমি মামলা করতে গেলে ওসি আমাকে নষ্টা মেয়ের নষ্টা মা বলে গালি দেয়। ওসি বলে তুই নষ্ট, তোর মেয়েও নষ্ট।’
একইভাবে সেঁজুতির বাড়িতে গিয়ে ধর্ষকদের মা-বাবারাও অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে যায় বলে জানান সেঁজুতির মা।
লজ্জা, ঘৃণায় আর তীব্র অপমানে গত ২১ অক্টোবর নিজ ঘরের আড়ার সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে সেঁজুতি আত্মহত্যা করেন বলে জানান তার মা।
তিনি আরও বলেন, ‘বাঁচতে চেয়েও বাঁচতে পারলো না সেঁজুতি। ওর অনেক স্বপ্ন ছিল। লেখা পড়া করে অনেক বড় হবে। মৃত্যুর আগের দিনও রিকশাচালক মোতালেবকে সেঁজুতি বলেছিল, চাচা বিচার পাইলেই আমি খুশি। আমি পড়াশুনা করে বড় হয়ে এর প্রতিশোধ নেব। যে যাই বলুক আমি বাঁচতে চাই।‘
যেভাবে ধর্ষিত হল সেঁজুতি
গত অক্টোবর মাসের ১৩ তারিখ। রাত ৮টা। সেঁজুতিকে ঘর থেকে উঠানে ডেকে নেয় নয়ন। সেঁজুতি উঠানে নামতেই তাকে সাইফুল, সবুজ, নেছার, নয়ন, রজিব, নাছির ও শামীম টেনে হেঁচড়ে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়।
মেয়েকে না দেখে সেঁজুতির মা তাকে খুঁজতে থাকেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর সেঁজুতিকে রাস্তায় ফেলে চলে যায় ধর্ষণকারীরা।
পরে অজ্ঞান অবস্থায় সেঁজুতিকে উদ্ধার করেন তার মা। প্রায় এক ঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরলে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে সেঁজুতি। কী হয়েছে, বার বার জিজ্ঞাসা করেও কোনও উত্তর মেলেনি।
বাবা মায়ের আর্তনাদ
সেঁজুতির মা গত তিন সপ্তাহ ধরেই কাঁদছেন। গত ৭ নভেম্বর ঈদের দিন সেঁজুতির ছবি নিয়ে কেঁদেছেন। খাওয়া দাওয়া ছিল বন্ধ। পাড়া প্রতিবেশী খাবার নিয়ে গেলেও কোনও খাবারই মুখে তোলেননি।
সেঁজুতির মা বাংলানিউজকে বলেন, ‘ওসি রবিউলের অশ্লীল ব্যাবহার ও সন্ত্রাসীদের স্বজনদের গালাগালির কারণে ঘৃণায় আমার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে।’
তিনি তার মেয়ের এ করুণ পরিণতির জন্য যারা দায়ী, তাদের বিচার চেয়েছেন।
এদিকে সৌদি আরব প্রবাসী সেঁজুতির বাবা সাদেক মৃধা ফোনে (০০৯৬৬৫৫৩২৫৭০৮৮) বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমি সন্তানহারা পিতা। আমি বেঁচে থাকতে আমার মেয়েকে সন্ত্রাসীরা ধরে নিয়ে...বলেই তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
কিছুক্ষণ পর তিনি ফের বলেন, ‘আমি এর বিচার চাই।’ আবারও কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সাদেক।
গ্রাম্য মাতব্বরদের ভূমিকা
সেঁজুতি ধর্ষিত হওয়ার পর গ্রামের মাতব্বরদের ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। আর এ কারণেই সেঁজুতি বিচার না পেয়ে লজ্জায় অভিমানে আত্মহত্যা করেন।
সেঁজুতির মা হাফেজা বেগম ও সেঁজুতি নিজেও গ্রাম্য মাতব্বরদের কাছে বিচারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। তাদের কাছে বিচার না পেয়ে শেষ পর্যন্ত বাখেরগঞ্জ থানার ওসির কাছে বিচার চাইতে যান। অথচ সব ক্ষেত্রেই বিচারের পরিবর্তে মা মেয়ের কপালে জুটেছে ভর্ৎসনা।
এ ব্যাপারে স্থানীয় ইউপি সদস্য হামেদ ভান্ডারী ও লিলি আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি বিষয়টি সুরাহা করার। কিন্তু অপরাধীর পিতা মাতা রাজি হয়নি। তবে আমরা তারপরও চেষ্টা করছি। কিন্তু এত অল্প সময়ের মধ্যে মেয়েটি আত্মহত্যা করবে, কেউই বুঝতে পারি নাই।’
পুলিশের ভূমিকা
শুরু থেকেই পুলিশের ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। থানার ওসি রবিউল অপরাধীর কাছ থেকে এক লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে আসামিদের পক্ষে ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ কারণে সেঁজুতির মা ওসির কাছে বিচার চেয়ে মামলা করতে গেলে ওসি রবিউল তাকে নষ্টা মেয়ের নষ্ট মা বলে গালি দেন।
বর্তমানে থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আচরণও রহস্যজনক বলে মনে করছেন অনেকে।
কারণ বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গেলেও পুলিশ ৯ আসামির একজনকেও এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
প্রধানমন্ত্রীর ফোন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেঁজুতির আত্মহত্যার ঘটনাটি জানার পর সঙ্গে সঙ্গে বরিশালের মেয়র শওকত হোসেন হিরনকে ফোন দেন।
তিনি মেয়রকে সেঁজুতির পরিবার যাতে সঠিক বিচার পায়, তার ব্যবস্থা করতে প্রায়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেন।
এরপর মেয়র হিরন গত ২৪ সেপ্টেম্বর সেঁজুতির বাড়িতে আসেন ও তার পরিবারকে সান্ত্বনা দেন। একই সঙ্গে সুষ্ঠু বিচারেরও আশ্বাস দেন।
এ সময় বরিশালের উচ্চপদস্থ পুলিশ ও র্যাবের কর্মকর্তারা মেয়রের সঙ্গে সেঁজুতির বাড়িতে যান।
ওসি রবিউলের অপকর্ম
এলাকাবাসীর অভিযোগ, বিপদে পড়ে কেউ থানায় গেলে ওসি রবিউল তাদের অশ্লীল ভাষায় গালমন্দ করেন। এছাড়া তিনি ঘুষ ছাড়া কোনও কাজ করেন না।
এলাকাবাসী জানায়, ওসি রবিউলের তিনজন ঘনিষ্ঠ দালাল আছে। এর মধ্যে বিসমিল্লাহ কামাল অন্যতম।
মহেশপুরের রাজ্জাক বাংলানিউজকে জানান, ওসি রবিউল লোভী মানুষ। মাসখানেক আগে মহেশপুর থেকে একটি ছাগল নিয়ে যান তিনি। কিন্তু কোনও টাকা দেননি।
পরে ঘটনাটি গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা জেলা পুলিশ সুপারকে জানালে ওসি রবিউল নিজেই ছাগলটি ফেরত দিয়ে যান। সেইসঙ্গে গ্রামবাসীর কাছে ক্ষমাও চান।
কে এই বিসমিল্লা কামাল
থানার দালাল বিসমিল্লাহ কামাল যে সরকার আসে তাদেরই লোক হয়ে যায়Ñ এমনটাই বলছেন গ্রামবাসী।
গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য হোসেন মৃধা বাংলানিউজকে বলেন, বিসমিল্লাহ কামাল একজন সন্ত্রাসী ও থানার দালাল। তিনিই আসামিদের পক্ষে এক লাখ টাকা দিয়েছে ওসি রবিউলকে। আর এ কারণেই ওসি রবিউল থানায় মামলা না নিয়ে সেঁজুতির মাকে গালমন্দ করে।
তিনি বলেন, বিসমিল্লাহ কামাল কখনও বিএনপি, কখনও জাতীয় পার্টি, বর্তমানে আওয়ামী লীগ করছে। তিনি একজন সুবিধাবাদী লোক।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে বিসমিল্লাহ কামাল বাংলানিউজকে বলেন, ‘এ ঘটনার সঙ্গে হোসেন মৃধাই জড়িত।’
উল্লেখ্য, বিসমিল্লাহ কামাল পলাতক রয়েছেন।
উদ্ভট কাণ্ড পুলিশের
সেঁজুতির ধর্ষণ ও হত্যাপ্ররোচনাকারীদের গ্রেপ্তার করতে না পারলেও এলাকায় পাহারারত পুলশের উদ্ভট কাণ্ড নিয়ে এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ।
পাশ্ববর্তী গ্রামের আছিয়া বেগম বাংলানিউজকে জানান, তিনি সেঁজুতিদের বাড়িতে গত সপ্তাহে গিয়ে বিপদেই পড়েছিলেন। পুলিশ তাকে সূর্যের দিকে মুখ করে বসিয়ে রাখে ঘণ্টাখানেক।
এর আগের দিন এক ভিক্ষুক সেঁজুতির বাড়িতে ঢুকলেই পুলিশ তাকে কান ধরে ওঠবস করায়।
এসব ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
পরীক্ষা দেওয়া হলো না সেঁজুতির
তিন বোনের মধ্যে সেঁজুতি মেজ। এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল তার। টেস্ট পরীক্ষায় এ গ্রেড পেয়েছিল সে। আর কিছুদিন পরেই পরীক্ষা।
তদন্তকারী কর্মকর্তার বক্তব্য
সেঁজুতির ঘটনায় তদন্তকারী কর্মকর্তা আফজাল হোসেন ও হুমায়ুন কবির বুধবার দুপুরে বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি আসামিদের গ্রেপ্তারে।’
আফজাল বলেন, ‘আমরা এখন বাখেরগঞ্জের পথে। চিটাগাং গিয়েছিলাম সোমবার। এখান থেকে সেঁজুতি আত্মহত্যার মূল প্ররোচনাকারী ফারুক মৃধাকে গ্রেপ্তার করছি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেই অন্য আসামিদের ধরার চেষ্টা করছি।’
ওসি রবিউলের বাঁচার চেষ্টা
ওসি রবিউল মামলা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছাকাছি যেতে চেষ্টা করছেন।
তিনি গত সোমবার রাতে পুলিশের এক উর্ধ্বতন আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন।
পুলিশ কর্মকর্তার ওই আত্মীয়ের বাড়ি বাখেরগঞ্জের রঘুনাথপুরে।
জানা গেছে, ওই ব্যক্তিকে নানা উপঢৌকন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও কোনও সুবিধা আদায় করতে পারেননি ওসি রবিউল। তিনি গভীর রাত পর্যন্ত ওই বাসায় ছিলেন।
পুলিশের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। কাঁদছে সেঁজুতির স্কুলের সহপাঠিরা। ক্ষোভে দুঃখে জ্বলছেন সেঁজুতির স্কুলশিক্ষকরা। বড় বড় নেতারা ও পুলিশের বড় কর্তারা আশ্বাস দিলেও বিচার পাবে কি-না, এ নিয়ে সেঁজুতির পরিবার ও গ্রামবাসীর সন্দেহ আস্তে আস্তে ঘনীভূত হচ্ছে।
কারণ এখনও গ্রেপ্তার হয়নি আসামিরা। ফলে আতঙ্কিত সেঁজুতির মা ও তার আত্মীয় স্বজন।
আসামি গ্রেপ্তার না হওয়ায় গ্রামবাসীর সন্দেহ
সেঁজুতির ধর্ষিত হওয়ার ২১ দিন ও আত্মহত্যার ১৪দিন পরও দু‘টি মামলার একজন আসামিও গ্রেপ্তার না হওয়ায় গ্রামবাসী ও সেঁজুতির মা-বাবার মনে সংশয় দানা বেঁধেছে।
গ্রামের জমির উদ্দিন মনে করেন পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তার করছে না। তার সন্দেহ, বাখেরগঞ্জ থানার বরখাস্তকৃত ওসি রবিউলের মতো বর্তমান দায়িত্বরত তদন্তকারী কর্মকর্তাও অর্থের বিনিময়ে বিক্রি হয়ে গেছেন।
তিনি মনে করেন, পুলিশ ইচ্ছা করলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পারে।
বাংলানিউজকে একই কথা বললেন, সেঁজুতির বাড়ির পার্শ্ববর্তী মহল্লার আলম।
তার মতে, পুলিশের টালবাহানার কারণেই সেঁজুতিকে ধর্ষণকারী ও হত্যায় প্ররোচনাকারীরা গ্রেপ্তার হচ্ছে না।
বরখাস্তকারী ওসি রবিউল ও বারেক মৃধা, ফারুক মৃধাসহ যারা সেঁজুতিকে অশ্লীল গালাগাল করেছেন তাদের গ্রেপ্তার না করায় একই সন্দেহ কাজ করছে।
বাঁচতে চেয়েছিল সেঁজুতি
সেঁজুতি বাচঁতে চেয়েছিল। সে আশা করেছিল গ্রামের মাতব্বররা যখন বিচার করেনি, তখন থানায় গেলে হয়তো বিচার পাওয়া যাবে। কিন্তু থানায় মামলা করতে গেলে ওসি রবিউলের অকথ্য গালাগাল ও বাড়িতে ঢুকে আসামিদের আত্মীয়দের অকথ্য গালাগালে ক্ষুব্ধ অপমানিত সেঁজুতি আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
এ ব্যাপারে সেঁজুতির মা বাংলানিউজকে বলেন, ‘ওসি রবিউলের কাছে আমি মামলা করতে গেলে ওসি আমাকে নষ্টা মেয়ের নষ্টা মা বলে গালি দেয়। ওসি বলে তুই নষ্ট, তোর মেয়েও নষ্ট।’
একইভাবে সেঁজুতির বাড়িতে গিয়ে ধর্ষকদের মা-বাবারাও অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে যায় বলে জানান সেঁজুতির মা।
লজ্জা, ঘৃণায় আর তীব্র অপমানে গত ২১ অক্টোবর নিজ ঘরের আড়ার সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে সেঁজুতি আত্মহত্যা করেন বলে জানান তার মা।
তিনি আরও বলেন, ‘বাঁচতে চেয়েও বাঁচতে পারলো না সেঁজুতি। ওর অনেক স্বপ্ন ছিল। লেখা পড়া করে অনেক বড় হবে। মৃত্যুর আগের দিনও রিকশাচালক মোতালেবকে সেঁজুতি বলেছিল, চাচা বিচার পাইলেই আমি খুশি। আমি পড়াশুনা করে বড় হয়ে এর প্রতিশোধ নেব। যে যাই বলুক আমি বাঁচতে চাই।‘
যেভাবে ধর্ষিত হল সেঁজুতি
গত অক্টোবর মাসের ১৩ তারিখ। রাত ৮টা। সেঁজুতিকে ঘর থেকে উঠানে ডেকে নেয় নয়ন। সেঁজুতি উঠানে নামতেই তাকে সাইফুল, সবুজ, নেছার, নয়ন, রজিব, নাছির ও শামীম টেনে হেঁচড়ে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়।
মেয়েকে না দেখে সেঁজুতির মা তাকে খুঁজতে থাকেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর সেঁজুতিকে রাস্তায় ফেলে চলে যায় ধর্ষণকারীরা।
পরে অজ্ঞান অবস্থায় সেঁজুতিকে উদ্ধার করেন তার মা। প্রায় এক ঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরলে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে সেঁজুতি। কী হয়েছে, বার বার জিজ্ঞাসা করেও কোনও উত্তর মেলেনি।
বাবা মায়ের আর্তনাদ
সেঁজুতির মা গত তিন সপ্তাহ ধরেই কাঁদছেন। গত ৭ নভেম্বর ঈদের দিন সেঁজুতির ছবি নিয়ে কেঁদেছেন। খাওয়া দাওয়া ছিল বন্ধ। পাড়া প্রতিবেশী খাবার নিয়ে গেলেও কোনও খাবারই মুখে তোলেননি।
সেঁজুতির মা বাংলানিউজকে বলেন, ‘ওসি রবিউলের অশ্লীল ব্যাবহার ও সন্ত্রাসীদের স্বজনদের গালাগালির কারণে ঘৃণায় আমার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে।’
তিনি তার মেয়ের এ করুণ পরিণতির জন্য যারা দায়ী, তাদের বিচার চেয়েছেন।
এদিকে সৌদি আরব প্রবাসী সেঁজুতির বাবা সাদেক মৃধা ফোনে (০০৯৬৬৫৫৩২৫৭০৮৮) বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমি সন্তানহারা পিতা। আমি বেঁচে থাকতে আমার মেয়েকে সন্ত্রাসীরা ধরে নিয়ে...বলেই তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
কিছুক্ষণ পর তিনি ফের বলেন, ‘আমি এর বিচার চাই।’ আবারও কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সাদেক।
গ্রাম্য মাতব্বরদের ভূমিকা
সেঁজুতি ধর্ষিত হওয়ার পর গ্রামের মাতব্বরদের ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। আর এ কারণেই সেঁজুতি বিচার না পেয়ে লজ্জায় অভিমানে আত্মহত্যা করেন।
সেঁজুতির মা হাফেজা বেগম ও সেঁজুতি নিজেও গ্রাম্য মাতব্বরদের কাছে বিচারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। তাদের কাছে বিচার না পেয়ে শেষ পর্যন্ত বাখেরগঞ্জ থানার ওসির কাছে বিচার চাইতে যান। অথচ সব ক্ষেত্রেই বিচারের পরিবর্তে মা মেয়ের কপালে জুটেছে ভর্ৎসনা।
এ ব্যাপারে স্থানীয় ইউপি সদস্য হামেদ ভান্ডারী ও লিলি আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি বিষয়টি সুরাহা করার। কিন্তু অপরাধীর পিতা মাতা রাজি হয়নি। তবে আমরা তারপরও চেষ্টা করছি। কিন্তু এত অল্প সময়ের মধ্যে মেয়েটি আত্মহত্যা করবে, কেউই বুঝতে পারি নাই।’
পুলিশের ভূমিকা
শুরু থেকেই পুলিশের ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। থানার ওসি রবিউল অপরাধীর কাছ থেকে এক লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে আসামিদের পক্ষে ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ কারণে সেঁজুতির মা ওসির কাছে বিচার চেয়ে মামলা করতে গেলে ওসি রবিউল তাকে নষ্টা মেয়ের নষ্ট মা বলে গালি দেন।
বর্তমানে থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আচরণও রহস্যজনক বলে মনে করছেন অনেকে।
কারণ বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গেলেও পুলিশ ৯ আসামির একজনকেও এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
প্রধানমন্ত্রীর ফোন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেঁজুতির আত্মহত্যার ঘটনাটি জানার পর সঙ্গে সঙ্গে বরিশালের মেয়র শওকত হোসেন হিরনকে ফোন দেন।
তিনি মেয়রকে সেঁজুতির পরিবার যাতে সঠিক বিচার পায়, তার ব্যবস্থা করতে প্রায়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেন।
এরপর মেয়র হিরন গত ২৪ সেপ্টেম্বর সেঁজুতির বাড়িতে আসেন ও তার পরিবারকে সান্ত্বনা দেন। একই সঙ্গে সুষ্ঠু বিচারেরও আশ্বাস দেন।
এ সময় বরিশালের উচ্চপদস্থ পুলিশ ও র্যাবের কর্মকর্তারা মেয়রের সঙ্গে সেঁজুতির বাড়িতে যান।
ওসি রবিউলের অপকর্ম
এলাকাবাসীর অভিযোগ, বিপদে পড়ে কেউ থানায় গেলে ওসি রবিউল তাদের অশ্লীল ভাষায় গালমন্দ করেন। এছাড়া তিনি ঘুষ ছাড়া কোনও কাজ করেন না।
এলাকাবাসী জানায়, ওসি রবিউলের তিনজন ঘনিষ্ঠ দালাল আছে। এর মধ্যে বিসমিল্লাহ কামাল অন্যতম।
মহেশপুরের রাজ্জাক বাংলানিউজকে জানান, ওসি রবিউল লোভী মানুষ। মাসখানেক আগে মহেশপুর থেকে একটি ছাগল নিয়ে যান তিনি। কিন্তু কোনও টাকা দেননি।
পরে ঘটনাটি গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা জেলা পুলিশ সুপারকে জানালে ওসি রবিউল নিজেই ছাগলটি ফেরত দিয়ে যান। সেইসঙ্গে গ্রামবাসীর কাছে ক্ষমাও চান।
কে এই বিসমিল্লা কামাল
থানার দালাল বিসমিল্লাহ কামাল যে সরকার আসে তাদেরই লোক হয়ে যায়Ñ এমনটাই বলছেন গ্রামবাসী।
গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য হোসেন মৃধা বাংলানিউজকে বলেন, বিসমিল্লাহ কামাল একজন সন্ত্রাসী ও থানার দালাল। তিনিই আসামিদের পক্ষে এক লাখ টাকা দিয়েছে ওসি রবিউলকে। আর এ কারণেই ওসি রবিউল থানায় মামলা না নিয়ে সেঁজুতির মাকে গালমন্দ করে।
তিনি বলেন, বিসমিল্লাহ কামাল কখনও বিএনপি, কখনও জাতীয় পার্টি, বর্তমানে আওয়ামী লীগ করছে। তিনি একজন সুবিধাবাদী লোক।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে বিসমিল্লাহ কামাল বাংলানিউজকে বলেন, ‘এ ঘটনার সঙ্গে হোসেন মৃধাই জড়িত।’
উল্লেখ্য, বিসমিল্লাহ কামাল পলাতক রয়েছেন।
উদ্ভট কাণ্ড পুলিশের
সেঁজুতির ধর্ষণ ও হত্যাপ্ররোচনাকারীদের গ্রেপ্তার করতে না পারলেও এলাকায় পাহারারত পুলশের উদ্ভট কাণ্ড নিয়ে এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ।
পাশ্ববর্তী গ্রামের আছিয়া বেগম বাংলানিউজকে জানান, তিনি সেঁজুতিদের বাড়িতে গত সপ্তাহে গিয়ে বিপদেই পড়েছিলেন। পুলিশ তাকে সূর্যের দিকে মুখ করে বসিয়ে রাখে ঘণ্টাখানেক।
এর আগের দিন এক ভিক্ষুক সেঁজুতির বাড়িতে ঢুকলেই পুলিশ তাকে কান ধরে ওঠবস করায়।
এসব ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
পরীক্ষা দেওয়া হলো না সেঁজুতির
তিন বোনের মধ্যে সেঁজুতি মেজ। এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল তার। টেস্ট পরীক্ষায় এ গ্রেড পেয়েছিল সে। আর কিছুদিন পরেই পরীক্ষা।
তদন্তকারী কর্মকর্তার বক্তব্য
সেঁজুতির ঘটনায় তদন্তকারী কর্মকর্তা আফজাল হোসেন ও হুমায়ুন কবির বুধবার দুপুরে বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি আসামিদের গ্রেপ্তারে।’
আফজাল বলেন, ‘আমরা এখন বাখেরগঞ্জের পথে। চিটাগাং গিয়েছিলাম সোমবার। এখান থেকে সেঁজুতি আত্মহত্যার মূল প্ররোচনাকারী ফারুক মৃধাকে গ্রেপ্তার করছি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেই অন্য আসামিদের ধরার চেষ্টা করছি।’
ওসি রবিউলের বাঁচার চেষ্টা
ওসি রবিউল মামলা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছাকাছি যেতে চেষ্টা করছেন।
তিনি গত সোমবার রাতে পুলিশের এক উর্ধ্বতন আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন।
পুলিশ কর্মকর্তার ওই আত্মীয়ের বাড়ি বাখেরগঞ্জের রঘুনাথপুরে।
জানা গেছে, ওই ব্যক্তিকে নানা উপঢৌকন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও কোনও সুবিধা আদায় করতে পারেননি ওসি রবিউল। তিনি গভীর রাত পর্যন্ত ওই বাসায় ছিলেন।
No comments