জনপ্রশাসনে প্রতি মাসেই ওএসডি বাড়ছে by শরীফুল ইসলাম

নপ্রশাসনে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) প্রতি মাসে বেড়েই চলেছে। পদের তুলনায় কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি এবং পদায়নের ক্ষেত্রে দলীয়করণের প্রভাবে এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। ওএসডি ঠেকাতে সরকারের কোনো নীতিই কাজে আসছে না। ফলে প্রশাসনে সৃষ্টি হচ্ছে বিশৃঙ্খলা। কয়েকশ' কর্মকর্তাকে বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে হচ্ছে। যারা বছরের পর বছর ওএসডি রয়েছেন তারা মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। অনেকেই চাকরি ছেড়ে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন। অনেকে অপেক্ষা করছেন পরবর্তী সরকারের জন্য।


বিগত সাড়ে চার বছর ধরে ওএসডি রয়েছেন যুগ্ম সচিব রফিকুল ই মোহামেদ। সমকালকে তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বগুড়ার ডিসি থাকার কারণেই তাকে ওএসডির যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ওএসডি বিষয়ে কোনো কথা শুনতে চান না। পদায়নের জন্য গেলে বেতন ঠিকমতো পাচ্ছি কি-না, গাড়ি আছে কি-না_ এসব জিজ্ঞাসা করে বিদায় জানানো হয়। সামাজিক বা পারিবারিকভাবেও হেয় হতে হয়।
প্রশাসনে আরও ৩৯৬ কর্মকর্তা মানসিক যন্ত্রণায় দিন কাটাচ্ছেন। তাদের মনেও একই প্রশ্ন_ কেন তাদের ওএসডি হতে হয়েছে? এর উত্তর তারা পাচ্ছেন না।
ওএসডি ব্যবস্থা শুধু চাকরিজীবীদেরই যন্ত্রণা দেয় না; রাষ্ট্রেরও গচ্চা যায় কোটি কোটি
টাকা। শুধু প্রশাসন ক্যাডারের ওএসডি কর্মকর্তাদের জন্য প্রতি বছর সরকারের প্রায় ৪০ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হয়। এ ছাড়া পুলিশ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, ট্যাক্স, কাস্টমস, তথ্য, পররাষ্ট্র, প্রকৌশল, মৎস্য, ট্রেড ও ইকোনমিকসহ অন্যান্য ক্যাডারের আরও পাঁচ শতাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বসিয়ে রেখে রাষ্ট্রের বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রশাসনে বর্তমানে ৩৯৬ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ওএসডি রয়েছেন। তাদের মধ্যে সচিব রয়েছেন তিন জন, অতিরিক্ত সচিব ৩৯, যুগ্ম সচিব ১৫৪, উপ-সচিব ১৪১, সিনিয়র সহকারী সচিব ৫২ ও সহকারী সচিব আট জন। অধিকাংশ কর্মকর্তা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ওএসডি। ওএসডি থাকা এক সচিবের জন্য গাড়ি, টেলিফোন বিল, বেতন-ভাতাসহ প্রতি মাসে প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ হচ্ছে। অতিরিক্ত সচিবদের জন্য মাসে সোয়া লাখ, যুগ্ম সচিবদের জন্য এক লাখ, উপ-সচিবদের জন্য ৫৫ হাজার এবং সিনিয়র সহকারী ও সহকারী সচিবদের জন্য ব্যয় হচ্ছে প্রায় ২৫ হাজার টাকা।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে বলা হচ্ছে, পদের তুলনায় কর্মকর্তা বেশি হওয়ায় প্রশাসনে ওএসডি কমানো যাচ্ছে না। সরকারের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রতি বছর কয়েকশ' কর্মকর্তাকে পদায়ন করা যায় না। গত বছরের এই সময়ে ওএসডির সংখ্যা ছিল ২৩৬। এক বছরে বেড়ে তা হয়েছে প্রায় ৪০০। মূলত পদের চেয়ে কর্মকর্তা বেশি হওয়ায় ওএসডির সংখ্যা বাড়ছে। গত এক বছরে পদ না থাকার পরও কয়েক দফা পদোন্নতি দেওয়ার কারণেই ওএসডি বেড়েছে। পদায়নের ক্ষেত্রে দলীয়করণকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণেও কিছু কর্মকর্তাকে ওএসডি রাখা হচ্ছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পরও ভিন্নমতাদর্শী চিহ্নিত করে অনেককে ওএসডি করা হয়েছে। সরকারের ক্ষমতায় আসার ছয় মাসের মধ্যে প্রায় ২০০ কর্মকর্তা ওএসডি হন। এসব কর্মকর্তার বেশিরভাগই চারদলীয় জোট সরকারের সময় মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর পিএস, এপিএস, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্মরত, বিভিন্ন দূতাবাসে কর্মরত, জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব এবং বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন।
ওএসডি উপ-সচিব তালাত মাহমুদ সমকালকে বলেন, বিএনপি-জামায়াত আমলে মালয়েশিয়ার কাউন্সিলর অব লেবার হিসেবে কর্মরত ছিলাম। এটিই এখন আমার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ জন্য আমাকে কোথাও পদায়ন করা হচ্ছে না। আড়াই বছর ধরে ওএসডি। প্রথমে আমাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি অনুবিভাগে ন্যস্ত করা হয়। ওই সময় কোনো বেতন-ভাতা পেতাম না। সংসার চালানোই দুরূহ হয়ে পড়ে। পরে বেতন-ভাতার জন্য আবেদন করলে আমাকে ওএসডি করা হয়। কী কারণে ওএসডি করা হলো_ এর উত্তর খুঁজে পাইনি।
সূত্র জানায়, ওএসডি প্রথা বাতিল করে প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। অবশ্য এটি আদৌ আলোর মুখ দেখবে কি-না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এ অ্যাক্টের খসড়াই তৈরি হয়নি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান সমকালকে বলেন, ওএসডি বর্তমান প্রশাসনে ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নব্বইয়ের দশকের পর থেকে সরকার এটিকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে প্রশাসনকে দ্বিধাবিভক্ত করে ফেলেছে। যে কর্মকর্তাকে সরকারের পক্ষের মনে হচ্ছে না, তাকে শায়েস্তা করতেই এ প্রথাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তিনি বলেন, নব্বইয়ের দশকের আগে ওএসডি কর্মকর্তাদের এক ধরনের সম্মান ছিল। মূলত যারা সরকারি প্রশিক্ষণে দেশের বাইরে যেতেন তাদের ওএসডি করা হতো। প্রশিক্ষণ শেষে ফিরলে তারা একই পদে কাজ শুরু করতেন। এখন ওএসডি নাম ঠিক থাকলেও এর ব্যবহার পাল্টে গেছে। এখন কর্মকর্তাদের শাস্তি হিসেবেই ওএসডি করা হয়। এ অবস্থায় কর্মকর্তাদের মনোবল ভেঙে যাচ্ছে। তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে সংবিধান এক ধরনের অমান্য করা হচ্ছে। কারণ সংবিধানে স্পষ্ট বলা হয়েছে_ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অধিকার বজায় রাখা সরকারের দায়িত্ব।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুুস সোবহান শিকদার সমকালকে বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর ওএসডির সংখ্যা অনেক কমেছে। সরকার সব সময় কর্মকর্তাদের পদায়নে আন্তরিক। পদ কম থাকায় এ সমস্যা থেকে যাচ্ছে। তিনি জানান, শিগগির নতুন পদ সৃষ্টি করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.