পুরনো বন্ধুকে স্বাগত জানিয়ে উচ্ছ্বসিত ইউনূস: ১৮ হাজার কর্মীর মালয়েশিয়ার দরজা খুললো

বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। গতকাল ঢাকায় দুই নেতার একান্ত বৈঠক ও দুই দেশের কর্মকর্তাদের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে যৌথ এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এমনটাই জানান তারা। ব্রিফিংয়ে মালয়েশিয়ান প্রধানমন্ত্রী টিকিট জটিলতায় দেশটিতে যেতে না পারা ১৮ হাজার শ্রমিককে দেশটিতে নিতে তার সরকার সহায়তা দেবে বলে জানান। বলেন, প্রথম ধাপে ৭ হাজারের বেশি শ্রমিক নেয়া হবে। পর্যায়ক্রমে সকল শর্তপূরণ সাপেক্ষে বাকিদেরও নেয়া হবে। এর আগে দুপুর ২টার দিকে সাড়ে ৪ ঘণ্টার সংক্ষিপ্ত সফরে বাংলাদেশে আসেন আনোয়ার ইব্রাহিম। তার সঙ্গে তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, সংসদ সদস্য এবং ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ৫৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ছিলেন। ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আনোয়ার ইব্রাহিমকে স্বাগত জানান বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় বিমানবন্দরে মালয়েশিয়ান প্রধানমন্ত্রীকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা। পরে দুই নেতা সেখানে একান্ত বৈঠক করেন। এ সময় প্রফেসর ইউনূস পুরনো বন্ধুকে বাংলাদেশে স্বাগত জানাতে পেরে খুবই খুশি বলে জানান। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন বিপ্লব, ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ এবং তাদের ওপর বিগত সরকারের চালানো নৃশংসতার বিস্তারিত তুলে ধরেন। এ সময় ড. ইউনূস মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ও সেখানকার নেতাদের সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা স্মরণ করেন।

একান্ত বৈঠক শেষে দুই বন্ধু একই গাড়িতে করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে যান। সেখানে ক্রিস্টাল বলরুমে দুই দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন তারা। বৈঠক শেষে দুই নেতা যৌথ প্রেস বিফ্রিং করেন। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যকার সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই। দুই দেশই সম্পর্ক এগিয়ে নিতে সম্মত হয়েছি। অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে। তাছাড়া বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, শিক্ষা, প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন, জনশক্তি রপ্তানি, যোগাযোগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রতিরক্ষা সহযোগিতাসহ পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কর্মসংস্থান তৈরি, ভিসা সহজীকরণের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রতিদিন চারশ’ থেকে পাঁচশ’ রোহিঙ্গা প্রবেশ করছে, এটা উদ্বেগের বিষয়। তবে এটির সমাধান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হাতে। এ সংকটে কেবল বাংলাদেশই নয়, মালয়েশিয়াও ভুক্তভোগী। এটি নিরসনে একসঙ্গে কাজ করছি। ড. ইউনূস বলেন, আমরা ২০২৫ সালে আসিয়ানের আসন্ন সভাপতি পদে মালয়েশিয়াকে অভিনন্দন জানাই। আমরা আসিয়ানের সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার হিসেবে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা আঞ্চলিক ফোরামে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির জন্য মালয়েশিয়ার সক্রিয় ভূমিকার অপেক্ষায় রয়েছি। দুই দেশের বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা স্মরণ করে মালয়েশিয়াকে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের বন্ধু উল্লেখ করে তিনি বলেন, আনোয়ার ইব্রাহিমের সফর বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

দুই মাস আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রীর এটি হচ্ছে প্রথম বাংলাদেশ সফর। এই সফর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি মালয়েশিয়ার সমর্থনের স্বীকৃতি। এ সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি মালয়েশিয়ার সমর্থনের কথা উল্লেখ করে দেশটির প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, মানুষের মর্যাদা রক্ষায় ড. ইউনূসের ভূমিকা আমরা জানি। তাকে ব্যক্তিগতভাবে আমি চিনি। তাই তার ওপর ভরসা রাখছি। বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি সমর্থন থাকবে। ড. ইউনূস বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবেন বলে আমি আশা করি। এ সময় টিকিট জটিলতায় মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা শ্রমিকদের সুখবর দেন প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। বলেন, দুই দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। যখন আপনারা আমাদের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন, সাত হাজার বা তার বেশিদের বিষয় বিবেচনার জন্য, যারা নিবন্ধন করেও রাজনৈতিক অবস্থা, এখানকার অভ্যুত্থানের কারণে যাওয়ার সুযোগ হারিয়েছে, আমি তাৎক্ষণিকভাবে সেটা বিবেচনা করেছি। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা সংখ্যাটি ১৮ হাজার হবে স্মরণ করিয়ে দিলে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, হ্যাঁ, ১৮ হাজার। কিন্তু প্রথম ধাপে সব সন্তোষজনক হলে বাকিদেরও ক্রমান্বয়ে নেয়া হবে।

তিনি বলেন, ওই ১৮ হাজার শ্রমিক সব ধরনের প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছে এবং এটা তাদের দোষ নয়। সুতরাং প্রয়োজনীয় সমন্বয় ও পরিবর্তন করা আমাদের দায়িত্ব। বাংলাদেশের শ্রমিকদের সুরক্ষার বিষয়ে আমরা কাজ করছি। আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, আমাদের দেশে আরও জনশক্তি প্রয়োজন, তবে উভয় দেশের মধ্যে শ্রম অভিবাসন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা থাকতে হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে সেমি কন্ডাক্টর, ডেটা সেন্টার, এআই, নিউ টেকনোলজির বিষয়ে যৌথভাবে কাজ করার বিষয়ে সম্মত হয়েছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা পুরো ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেছি এবং আমরা খুবই স্বচ্ছ একটি প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে গিয়েছি। তিনি আরও বলেন, কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা আমাদের উদ্বেগের বিষয় নয়। আমাদের মাথাব্যথা হলো এটা নিশ্চিত করা যে আমরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেটা যেন ঠিকমতো মানা হয়। আমাদের শ্রমিক দরকার কিন্তু বাংলাদেশ বা অন্য যে দেশেরই হোক না কেন তাদের প্রতি যেন আধুনিক দাসের মতো আচরণ করা না হয়। আমি এটি অতীতের মতো প্রকাশ্যে বলেছি। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেন, সব দেশের কর্মীদের ক্ষেত্রে একই নিয়ম। তার মানে হচ্ছে, প্রক্রিয়াটা স্বচ্ছ হতে হবে এবং তথাকথিত ‘সিলেক্টেড’ লোকদেরও কঠোরভাবে নীতি মানতে হবে। বিফ্রিংয়ে মালেশিয়ার সরকারপ্রধান বলেন, শ্রমিকদের আবাসনের ব্যবস্থা এবং কাজের ক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় কেউ ঘটালে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমরা তাদের বাদ দিয়ে দেয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছি এবং বাদও দিয়েছি। উল্লেখ করেন, অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে যে সমালোচনা হয় সেটা উচিত নয়। তিনি বলেন, অনুগ্রহ করে নিশ্চিত থাকুন যে, আমি নিজেও এই বাজে সিস্টেম এবং নির্যাতনের সিস্টেমের ভুক্তভোগী। সুতরাং এটাকে চলতে দেয়ার কিংবা কোনোভাবে উপেক্ষা করার সরকার আমরা নই। এ সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস শ্রমিক ইস্যুতে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার জন্য বাংলাদেশিদের পক্ষ থেকে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশে সেসব মালয়েশিয়ান প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, তাদের সুবিধা দেয়ার আহ্বান জানান আনোয়ার ইব্রাহিম।

আরও জনশক্তি রপ্তানিতে মালয়েশিয়ার সহায়তা চাইলেন প্রেসিডেন্ট: এদিকে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে আনোয়ার ইব্রাহিম বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এ সময় প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়াতে যাতে আরও জনশক্তি যেতে পারে সে ব্যাপারে মালয়েশিয়ার সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন। এ ছাড়াও তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ‘অর্থনীতি সংস্কার’ কর্মসূচিতেও মালয়েশিয়া সরকারের সহযোগিতারও অনুরোধ জানান। প্রেসিডেন্টের প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন সাংবাদিকদের জানান, সাক্ষাৎকালে তারা দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়, বিশেষ করে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক, কারিগরি সহযোগিতা, রোহিঙ্গা ইস্যু ও শ্রমবাজারসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে মতবিনিময় করেন। প্রেসিডেন্ট বলেন, মালয়েশিয়া বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির দ্বিতীয় বৃহত্তম গন্তব্যস্থল। বাংলাদেশের জনশক্তি মালয়েশিয়ার ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তিনি বলেন, বিগত ৫৩ বছরে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, কৃষি, মানবসম্পদ যোগাযোগ, সংস্কৃতি, পর্যটন ও শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে সহযোগিতা ও অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় আনোয়ার ইব্রাহিম ঢাকা ছাড়েন। বিমানবন্দরে বন্ধুকে বিদায় জানান প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.