চিকিৎসার নামে প্রতারণা, কোটিপতি কবীর by নূর ইসলাম
স্থানীয়রা জানান, ‘গত ১০ বছরে আওয়ামী লীগ দুঃশাসনের সময় গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বাড়ি হওয়ায় মিলিটারি কবীরের বিরুদ্ধে ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাননি। প্রতারিতরা সকলেই মুখবুজে তার প্রতারণা সহ্য করেছেন।’ গোপালগঞ্জের দাপট দেখিয়ে প্রতারক মিলিটারি কবীর এখন জিরো থেকে হিরো। বিগত দিনে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দেয়া হলেও তিনি ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিলিটারি কবির ওরফে খন্দকার কবীর হোসেনের পৈতৃক বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার নারিকেলবাড়িয়ায়। তার পিতার নাম ওসমান আলী খন্দকার ও মাতার নাম রিজিয়া খাতুন। তিনি সেনাবাহিনীর নন কমিশনে চাকরি করতেন। চাকরি জীবনের শেষ দিকে তিনি পোস্টিং নিয়ে যশোর সেনানীবাসে কর্মরত ছিলেন। এখান থেকেই তিনি অবসরে যান। সে সময় সেনানীবাসের বাসা ছেড়ে তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে পাশেই ছাতিয়ানতলা গ্রামে অধ্যাপক মশিউল আজমের বাড়িতে ভাড়ায় বসবাস শুরু করেন। কবীর ভাড়া বাড়ির ছাদে গড়ে তোলেন একটি সুন্দর ছাদবাগান। ১ বছর পর তিনি ছাতিয়ানতলা মল্লিকপাড়ায় মাসুদ পারভেজের ভাড়াবাড়িতে চলে যান। সেখানে তিনি ননী ফল নার্সারি করেন। এরপর থেকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ননী ফল নার্সারিকে পুঁজি করে শুরু হয় খন্দকার কবীরের মানুষ ঠকানোর ব্যবসা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ননী ফল নার্সারির আড়ালে চিকিৎসার নামে প্রতারণার ফাঁদ পাতেন খন্দকার কবীর হোসেন। দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষের দুর্বলতাকে পুঁজি করে যৌন ও ক্যান্সার চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা শুরু করেন। যা নিয়ে সে সময় স্থানীয় একাধিক পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হলে ২০২২ সালের ১৭ই মে জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ প্রতারক কবীরের ডেরায় অভিযান চালায়। এ সময় আপাদমস্তক প্রতারক কবীরের মুখোশ উন্মোচিত হয়। তৎকালীন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সৌম্য চৌধুরী ও সিভিল সার্জন ডা. বিপ্লব কান্তি বিশ্বাসের নেতৃত্বে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত ক্যান্সার ও যৌন চিকিৎসায় প্রতারণা ও অবৈধভাবে ভুয়া ওষুধ তৈরির দায়ে খন্দকার কবীর হোসেনকে ৩ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা করেন। নামের পরে মিলিটারি শব্দ যোগ করায় কবীরকে বিশেষভাবে সতর্কও করা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, প্রতারক কবীর জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে এসেই সোশ্যাল মিডিয়ায় অ্যাকাউন্ট খুলে ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে চিকিৎসার নামে প্রতারণা ব্যবসা জোরদার করেন। একাধিক ফেসবুক পেজ খুলে দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক তৈরি করে সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে (চিকিৎসা ও ওষুধ পাঠানোর নামে) মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয় কবীর চক্র। ৯০ বছরের বৃদ্ধকে যৌন রোগের ওষুধ খাওয়ায়ে ১৭ বছরের যুবক বানানোর ঘোষণা দিয়েও তিনি প্রতারণা করেন। এসব অভিযোগে ২০২২ সালের ১৭ই অক্টোবর কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশ খন্দকার কবীর হোসেনের ডেরায় অভিযান চালায়। এ সময় কবীর হোসেন পালিয়ে রক্ষা পেলেও তার চার সহযোগীকে আটক করে পুলিশ। পরে এসআই মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বাদী হয়ে কবীর ও তার ৪ সহযোগীর নামে মামলা করেন। কিছু দিন গা ঢাকা দিয়ে থাকার পর তিনি ফের প্রতারণার ব্যবসা শুরু করেন। এদিকে ২০২৩ সালের ১৪ই জানুয়ারি রাতে খন্দকার কবীর ফের আটক হন। কুষ্টিয়া সদর থানা পুলিশ একটি প্রতারণা মামলায় নিজ বাড়ি থেকে তাকে আটক করে। পুলিশ জানায়, কুষ্টিয়ার সরকারি একটি দপ্তরে অফিস সহকারী পদে কর্মরত তানজিল নামে এক ব্যক্তি খন্দকার কবীর হোসেনের ফাঁদে পড়ে ১ লাখ টাকা ব্যয়ে চিকিৎসা নিয়ে প্রতারিত হন। ২০২৩ সালের ১লা জানুয়ারি তানজিল হোসেন কুষ্টিয়া সদর থানায় খন্দকার কবীর হোসেনের নামে মামলা করে। যার নম্বর -২৩/২৩।
স্থানীয়রা জানান, এতকিছুর পরও থেমে নেই কবীরের প্রতারণা। ডিজিটাল প্ল্যাটফরমের মাধ্যমে তিনি চিকিৎসা প্রতারণা দেশে ও বিদেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন। ব্যবসা জমজমাট করতে খোলা হয়েছে একাধিক ফেসবুক পেজ। যোগাযোগের জন্য পেজে দেয়া হয়েছে একাধিক মোবাইল নম্বর। প্রতারণায় কৌশল অবলম্বন করে প্রতারক কবীর কুরিয়ারে ওষুধ দেয়ার নামে মানুষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। পরে অনেকের ওষুধ পাঠানো হচ্ছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে। সূত্র জানায়, বিগত দিনে এমন প্রতারণার শিকার হয়েছেন লক্ষ্মীপুরের কমলনগর থানার চরকাদিয়া গ্রামের মোহাম্মদ শাহজাহানের ছেলে সোহেল (৩৫)। কুরিয়ার সার্ভিসে ওষুধ পাঠানোর নামে কবীর তার কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন সাড়ে ৯ হাজার টাকা। এ ঘটনায় প্রতারিত সোহেল লক্ষ্মীপুর থানায় একটি জিডি করেছিলেন। সূত্রটি আরও জানায়, খন্দকার কবীর সোশ্যাল মিডিয়া ও বিভিন্ন ইউটিউবারদের ম্যানেজ করে চিকিৎসা প্রচারণা চালিয়ে থাকেন। এসব প্রচারণা বিশ্বাস করে অর্থ খোয়াচ্ছেন বহু মানুষ। তার মূল টার্গেট হচ্ছে যৌন দুর্বল মানুষ ও ক্যান্সারে আক্রান্ত মানুষ। তার খপ্পরে অনেকে সর্বস্বান্ত হলেও আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন কবীর।
এলাকাবাসীর তথ্য মতে, প্রতারণা করে মহাটাউট কবীর এখন কোটিপতি। যশোরে ৩টি আলিশান বাড়ি নির্মাণ করেছেন। এরমধ্যে ছাতিয়ানতলা মল্লিকপাড়ায় চারতলা বাড়ি, খিতিবদিয়া গ্রামে দু’টির একটি ছয়তলা ও অপরটি চারতলা। যার একটি খিতিবদিয়া পুকুর মোড় ও অপরটি কলাবাগান রোডে অবস্থিত। জমি কিনে তিনি এসব আলিশান বাড়ি নির্মাণ করেছেন। এ ছাড়াও ছাতিয়ানতলা মল্লিকপাড়া, খিতিবদিয়া, শানতলাসহ বিভিন্নস্থানে নামে-বেনামে প্রায় শতাধিক বিঘা জমি কিনেছেন। বরিশাল ও গোপালগঞ্জে কবীরের আরও দু’টি আলিশান বাড়ি আছে বলে জানান ছাতিয়ানতলা গ্রামের জাকির হোসেন। ছাতিয়ানতলা গ্রামের মিঠু চাকলাদার জানান, ২০২২ সালে তার শাশুড়ির ক্যান্সার নিরাময়ে ১০০ ভাগ গ্যারান্টি দিয়ে ওষুধ দেন খন্দকার কবীর। চিকিৎসা বাবদ নেয়া হয় ৭০ হাজার টাকা। বলা হয় এই ওষুধ খেলে কেমোথেরাপি ছাড়াই ক্যান্সার ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু ওষুধ খাওয়ানোর কিছু দিন পর তার শাশুড়ি মারা যান। মিঠু চাকলাদার আরও জানান, তার মতো অনেকের সঙ্গে প্রতারণা করে হাতিয়ে নেয়া টাকায় খন্দকার কবীর কোটিপতি বনে গেছেন। কবীরের প্রতারণা থেকে রেহাই পাননি প্রতিবেশী আব্দুর রাজ্জাক। তার মায়ের ক্যান্সার চিকিৎসার নামে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা। যদিও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। অনেকেই জানান, খন্দকার কবীরের বাড়ি গোপালগঞ্জে হওয়ার কারণে তিনি দাপট দেখিয়ে চলাফেরা করতেন। এলাকার একটি প্রভাবশালী চক্রকেও তিনি ম্যানেজ করেছিলেন। ফলে প্রতারিত অনেক মানুষ তার ডেরায় গিয়ে প্রতিবাদ করার সাহস পেতেন না। প্রতিবাদ করলেই নানাভাবে হয়রানি করা হতো। গোপালগঞ্জের প্রভাবে বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে খন্দকার কবীর অনেকটা ফ্রি-স্টাইলে প্রতারণা করেছেন। বছরের পর বছর সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে হয়েছেন অধিক ধন সম্পদের মালিক। তার অবৈধ সম্পদের খোঁজ নেয়ার জন্য দুদকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ভুক্তভোগীরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে খন্দকার কবীর ক্ষিপ্ত হয়ে জানান, চুরি-ডাকাতি করে এই ধন সম্পদের মালিক হয়েছি। কি করবেন আপনি? লিখে আমার বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবেন না। যান যা পারেন লেখেন। আমি সাংবাদিকদের ভয় পাই না। সাংবাদিকদের মতো তো আর আমি চাঁদাবাজি করছি না। যশোরের সিভিল সার্জন ডা. মাহমুদুল হাসান জানান, চিকিৎসার নামে প্রতারণার অভিযোগে খন্দকার কবীরের ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে চিকিৎসা প্রতারণার বিষয়টি জানতাম না। এ ধরনের প্রতারণা অবশ্যই দুঃখজনক। তার প্রতারণা বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। চিকিৎসার নামে মানুষকে ঠকিয়ে প্রতারণা করার সুযোগ দেয়া হবে না। জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম জানান, যৌন ও ক্যান্সার চিকিৎসার নামে খন্দকার কবীরের প্রতারণার ফাঁদের বিষয়টি তিনি জানতেন না। তিনি এই জেলায় নবাগত। এই বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজ নেয়ার পরই তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রতারণা করে কোটিপতি বনে যাওয়ার বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হবে বলে জানান জেলা প্রশাসক।
No comments