সাংবিধানিক সংস্কার ও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা by ড. মো. সফিকুল ইসলাম
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সমপ্রতি রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠন করেছে। আমার মতে, এ কমিশনগুলোর মধ্যে সাংবিধানিক সংস্কার কমিশন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এটি অন্যান্য সংস্কার কমিশনের কার্যক্রমের সঙ্গেও যুক্ত। বিশেষ করে, শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, নির্বাচনকালীন সরকার এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সাংবিধানিক সংস্কারের প্রধান বিষয় বলা যেতে পারে। এদের মধ্যে শাসন ও আইন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার দাবিটি অনেক আগে থেকেই আলোচিত হচ্ছে। বিদ্যমান সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আইনসভার ক্ষমতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। কেননা, প্রধানমন্ত্রী একাধারে শাসন বিভাগের প্রধান ও জাতীয় সংসদের নেতা। দলীয় শৃঙ্খলা ও আনুগত্যের নীতি, বিশেষ করে, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনকৃত সকল নীতিই আইনসভায় অনুমোদিত হয়। জাতীয় সংসদ একটি রাবার স্ট্যাম্পে পরিণত হয়েছে। এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা দ্বারা বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হলেও এদেশে রাজনৈতিক এলিটদের মধ্যে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইন সভার ধারণা নতুন নয়। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে অখণ্ড ভারতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার অস্তিত্ব ছিল। স্বাধীনতার শুরুতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, অরাজকতা ও অনৈক্য দূর করতে এবং পেশাজীবীদের স্বার্থ সংরক্ষণে বামধারার বিশিষ্ট তাত্ত্বিক সিরাজুল আলম খান এবং বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জিল্লুর রহমান খান একটি নতুন ধারার একক আইনসভা গঠনের প্রস্তাব করেন। সে সময় তারা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার কথা না বললেও পরবর্তীকালে তারা সরাসরি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার কথা বলেন। একইভাবে, ২০১৬ সালের ১৯শে মার্চ দলের জাতীয় কাউন্সিলে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া স্পষ্টভাবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। সে অনুযায়ী তিনি বিএনপি ঘোষিত ভিশন-২০৩০-এ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা ধারণা অন্তর্ভুক্ত করেন। ভিশন-২০৩০ এ বলা হয় “সংবিধানের এককেন্দ্রিক চরিত্র অক্ষুণ্ন রেখে বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থা সংস্কারের অংশ হিসেবে জাতীয় সংসদের উচ্চ কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হবে।” বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন। ২০২২ সালের ১৯শে জানুয়ারি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৮৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এক ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভায় তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে, বিএনপি সরকার গঠন করলে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তন করবেন। যুক্তরাজ্যের হাউজ অব লর্ডসের আদলে দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা ও বুদ্ধিজীবীদের প্রতিনিধিত্বশীল উচ্চকক্ষ গঠন করা হবে। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি ইঙ্গিত করে তারেক রহমান বলেন, অনেকে সরকারে যোগ দেবেন না কিন্তু তাদের পরামর্শ আমাদের দরকার। এ জন্য সংসদের উচ্চকক্ষ সৃষ্টি করা হবে। উচ্চকক্ষে এসে তারা তাদের মতামত দিবেন। পরবর্তীতে ২০২২ সালে ১৯শে ডিসেম্বর বিএনপি ঘোষিত ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা’ এর ৬ নং দফায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা তথা জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। এখানে বলা হয়, “দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে জাতীয় সংসদের উচ্চ কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তন করা হবে।” এ ছাড়া বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নির্বাচন পরবর্তী জাতীয় সরকার গঠনের কথাও বলেছেন। এর মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষ করে জাতীয় ঐক্যের পথ সুগম করেছেন।
বর্তমানে দ্বিকক্ষ আইনসভা প্রতিষ্ঠার দাবি জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদগণ সাংবিধানিক সংস্কারের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তনের বিষয়টি তুলে ধরছেন। এখন জনগণের মনে প্রশ্ন উঠতে পারে এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রযোজ্য কিনা এবং আমাদের দেশে এটি কেন দরকার? সংসদ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরির জন্য বাংলাদেশের মতো এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রতিষেধক হতে পারে। পৃথিবীর অনেক এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থায় এ ধরনের আইনসভা রয়েছে। গ্রেট বৃটেন, থাইল্যান্ড, আলজেরিয়া, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ায় আইনসভা এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যে দল ক্ষমতায় থাকে আইন ও শাসন বিভাগে সে দলের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থাকে। বিশেষ করে, দলীয় সিদ্ধান্ত কেবিনেটের সিদ্ধান্তে পরিণত হয়। আইনসভা নামমাত্র অনুমোদন করে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় উভয় কক্ষে একদলের নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা কম থাকবে। বিশেষ করে, নিম্নকক্ষে ক্ষমতাসীন দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং একচ্ছত্র প্রাধান্য থাকলেও উচ্চ কক্ষে তাদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে থাকার সম্ভাবনা কমে যাবে। উচ্চকক্ষ নিম্নকক্ষের ঈযবপশং ধহফ ইধষধহপব হিসেবে কাজ করবে। ক্ষমতাসীন দলের যা খুশি তা করার প্রবণতা কমে যাবে। কেননা, নিম্নকক্ষে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রাধান্য পেলে উচ্চ কক্ষ তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে পারবে। ফলে আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি হবে।
বাংলাদেশে দুই কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আইনসভার উচ্চকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য নির্বাচিত ও এক তৃতীয়াংশ সদস্য মনোনীত হতে পারে। সমাজসেবা, সাহিত্য, শিক্ষা-গবেষণা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে যাদের বিশেষ অবদান রয়েছে তাদের মধ্যে থেকে উচ্চকক্ষে এক তৃতীয়াংশ সদস্য মনোনীত হতে পারেন। ভারতের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় ১২ জন সদস্য সমাজসেবা, সাহিত্য, শিক্ষা-গবেষণা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে যাদের বিশেষ অবদান রয়েছে তাদের মধ্যে থেকে রাষ্ট্রপতি মনোনয়ন দিয়ে থাকেন। সুতরাং উচ্চকক্ষের কিছু সদস্য অরাজনৈতিক হয়। অর্থ বিল ব্যতীত সকল বিল আইন সভার উচ্চকক্ষে উত্থাপন করার ক্ষমতা দেয়া যেতে পারে। উচ্চকক্ষের অর্থ বিলসহ যেকোনো বিল নিয়ে বিতর্ক, সংশোধন বা প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা থাকবে। শাসন বিভাগের যেকোনো কার্যক্রমের উপর প্রশ্ন উত্থাপন, সমালোচনা এবং তদন্ত করার ক্ষমতা দেয়া যেতে পারে। এতে সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে উচ্চকক্ষে ভূমিকা রাখতে পারবে। তাছাড়া উচ্চকক্ষে নির্বাচিত সদস্যগণ যাতে তুলনামূলকভাবে বয়োজ্যেষ্ঠ ও অভিজ্ঞ হন সেজন্য বিশেষ শর্ত আরোপ করে বিধান করা যেতে পারে। আর মনোনীত সদস্যগণ বিশেষজ্ঞ জ্ঞান সম্পন্ন হবেন। ফলে জনকল্যাণমূলক ও মান সম্পন্ন আইন বা নীতি প্রণীত হতে পারে। এ ছাড়া, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, বিশেষ করে, নির্বাচন কমিশন ও পাবলিক সার্ভিস কমিশন সদস্যদের এবং মহা হিসাবরক্ষক ও নিরীক্ষক নিয়োগে উচ্চ কক্ষের অনুমোদনের ক্ষমতা দেয়া যেতে পারে। ফলে এসব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে দলনিরপেক্ষ, দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিগণ নিয়োগ পাবেন। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকবে। প্রতিষ্ঠানগুলো আইন ও নীতি অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করবে।
আইনসভার উচ্চকক্ষ হতে পারে মার্কিন সিনেটের মতো একটি স্থায়ী কক্ষ। এর সদস্যদের মেয়াদকাল ছয় বছর হতে পারে। দুই বছর পর পর এ কক্ষের এক-তৃতীয়াংশ সদস্যের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। সংবিধানে রাষ্ট্রপতির এটি ভেঙে দেয়ার ক্ষমতা রহিত করার বিধান যুক্ত করা যেতে পারে। এটি একটি স্থায়ী কক্ষ হিসেবে বাংলাদেশের যে কোনো রাজনৈতিক সংকটে দলনিরপেক্ষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক সংকটের উদ্ভব হয়। এসব সংকট সমাধানে আইনসভার উচ্চ কক্ষের মতো একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার। যাহোক, সংবিধান সংশোধন করে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজনৈতিক সমঝোতা দরকার। কেননা, এ সরকার অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করলে ও পরবর্তীতে নির্বাচিত জাতীয় সংসদের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ইতিমধ্যে রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা ঘোষণা করে এ বিষয়ে তাদের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। তারপরও আমি মনে করি এ সরকার বিএনপিসহ অন্যান্য সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসা উচিত। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার কাঠামো কেমন হবে এবং কখন থেকে শুরু করা যায় এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তবে সাংবিধানিক সংস্কারসহ অন্যান্য সংস্কারসমূহ দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা উচিত। জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান বিলম্ব হলে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে। নতুন রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হতে পারে।
লেখক: অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments