গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা কতোটা দায়িত্বশীল আচরণ করছি by জি এম রাজিব হোসেন

দিনবদলের অঙ্গীকার করে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে। কিন্তু তারা কথা রাখেনি। তারা সেই পুরনো রাজনৈতিক ধারায় ফিরে যায়। ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল, বিরোধী দল ও মতকে কঠোরভাবে দমনে হামলা-মামলার আশ্রয়, গুম-খুন, লুটপাট চালিয়ে দেশে ফ্যাসিজম কায়েম করে। এভাবে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ কখন যে দেশের বিরাট একটি অংশকে নিজেদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলে তা হয়তো শেখ হাসিনা বুঝতে পারেননি। তাইতো গত জুলাই-আগস্ট মাসে গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে তার পতন ঘটে। আন্দোলনের মুখে তাকে দেশ থেকে পালাতে হয়। কিন্তু পালানোর আগে অন্তিম সময়েও তিনি নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে খুন করে সহস্রাধিক মানুষকে। আহত হয় কমপক্ষে ১৮ হাজার মানুষ।

আমার প্রশ্ন এই যে, এত মানুষ আত্মত্যাগ করলো, প্রাণ বিসর্জন দিলো তার কারণ কি? তারা কি নিছকই প্রাণ দিলো নাকি তাদের কোনো স্বপ্ন ছিল? প্রত্যেকটা বিপ্লবের পিছনে একটি স্বপ্ন থাকে। এবারো বিপ্লবীদের একটা স্বপ্ন ছিল। তা হলো একটি গণতান্ত্রিক মানবিক বাংলাদেশ গড়া। যেখানে কেউ বৈষম্যের শিকার হবে না।  সবার জন্য ন্যায়বিচার থাকবে। ভোটাধিকার থাকবে। বাক স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকবে।

আগস্টের পটপরিবর্তনের পর আমরা সড়কে বিভিন্ন গ্রুপের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করলাম। যাদেরকে আগে দেখা যায়নি। প্রতিদিন তারা বিভিন্ন দাবি নিয়ে রাস্তায় বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। প্রেস ক্লাবের সামনের সড়ক ও শাহবাগ অবরোধ করতে থাকে। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে অনেকগুলো সংগঠন একসঙ্গে যখন স্লোগান ও বক্তৃতা দিতে থাকে তখন কী ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তা সহজে অনুমেয়। কারও বক্তব্যই ঠিকমতো কেউ বুঝতে পারে না। অথচ স্লোগান চলছে। তাদের অনেক দাবিই যোক্তিক। কিন্তু বিষয়টি এমন দাঁড়ায় যেন মুহূর্তেই তাদের সব দাবি-দাওয়া পুরণ হওয়া চায়। বৈষম্য নিরসনে তাদের দাবি দাওয়ার ন্যায্যতা অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু তাদের মনে রাখতে হবে বর্তমানে যে সরকার রয়েছে তারা এ বৈষম্যের জন্য দায়ী নয়। একটা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে তারা দায়িত্ব নিয়েছে মাত্র। তাই অন্তর্বর্তীকালীন এ সরকারকে তিনদিন-সাতদিনের আল্টিমেটাম না দিয়ে সময় দেয়াটা শ্রেয়। তাতে সরকারও স্থিতিশীল হবে এবং বৈষম্য নিরসনের উদ্যোগও নিতে পারবে। একইসঙ্গে বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা এ সরকার দেশি-বিদেশি চক্রান্তও মোকাবিলা করতে পারবে।

বিভিন্ন সংগঠনের বৈষম্য নিরসনের দাবির সুযোগে দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত যে একেবারে হয়নি তা কিন্তু উড়িয়ে দেয়া যায় না। চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে অঙ্গীভূত আনসারদের আন্দোলনের সময় এ ধরনের একটি চক্রান্ত হয়েছিল। আনসারদের আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ছাত্র-জনতার সঙ্গে সংঘর্ষে রূপ নেয়। এতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহসহ ৪০ জন ছাত্র আহত হয়। সরকারি অনেক নীতি নির্ধারক মনে করেন, তাৎক্ষণিক বৈঠকে আনসারদের রেস্ট প্রথা বাতিল এবং চাকরি জাতীয়করণের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে একটি কমিটি গঠনের পরও তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া এবং সচিবালয়ের চারপাশে প্রায় ১০ হাজার আনসার সদস্যের জমায়েত গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। তাদের সন্দেহ কিন্তু অমূলক নয়। একদিনের মধ্যে ৫৫ হাজার অঙ্গীভূত আনসার সদস্যের চাকরি স্থায়ী করে গেজেট প্রকাশের দাবি এ সন্দেহকে আরও ঘনিভূত করে।

সমসাময়িককালে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও স্থাপনায় হামলার মতো কিছু দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। তবে সংখ্যালঘু হওয়ার কারণেই যে হামলা হয়েছে তা কিন্তু নয়। হামলা হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। যেমন ধর্মীয় কারণে সংখ্যালঘু কিন্তু হয়তো তিনি আওয়ামী লীগের নেতা বা সক্রিয় কর্মী থেকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনেরর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন কিংবা গত ১৭ বছর ধরে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালিয়েছেন এমন ব্যক্তিবর্গের বাড়িঘর কিংবা স্থাপনা হামলার শিকার হয়েছে।

প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয় গত ৫ থেকে ২০শে আগস্ট সারা দেশে সংখ্যালঘুদের এক হাজার ৬৮টি স্থাপনায় হামলা হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৫০৬টির মালিক আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক ঘটনা ঘটেছে তাদের আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টতার কারণে। হতে পারে তারা বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের হয়ে নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছিলেন।

কিন্তু আমরা দেখেছি ৫ই আগস্টের পর সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সংগঠন রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করেছে। রাজপথে বড় আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা হয়েছে এবং এসব আন্দোলনে এমন অনেককে দেখা গেছে যারা ধর্মীয় কারণে সংখ্যালঘু হলেও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন কয়েক জনের পরিচয়ও প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ তারা এসেছে কিন্তু হামলার সহমর্মী হিসেবে নয় বরং ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য একটি স্পেস তৈরির সুযোগ সৃষ্টির জন্য। বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের একটি বক্তব্য এ ধারণাকে আরও সত্য প্রমাণ করেছে। গত ২৩শে আগস্ট ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটি জানায়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা “সাম্প্রদায়িক হামলা” হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। তারা আরও বলেন, সরকার পতনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর রাজনৈতিক স্বার্থে হামলা হয়েছিল। কিছু সুযোগসন্ধানীও এই হামলায় যোগ দিয়েছিল। তাই যদি হয়, তাহলে একটি নবীন সরকার যখন দেশ সংস্কারের দায়িত্ব নিয়েছে ঠিক তখনই সংখ্যালঘু বিষয়টিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার কেন? এটা কোন ধরনের রাজনীতি।       

একই সময়ে আমরা বেতন বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন দাবিতে শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা দেখতে পাই। এবার পোশাক শ্রমিকদের পাশাপাশি ওষুধ শিল্প শ্রমিক ও জুতার কারখানার শ্রমিকরাও আন্দোলনে নামে। তবে অন্যান্য সময়ে মূলত বেতন বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিক আন্দোলন হলেও এবার এমন কিছু দাবি তুলে শ্রমিক অসেন্তাষ দেখা দেয় যেটা অযোক্তিক। যেমন- কারখানায় নারী-পুরুষ সমানুপাতিক হারে নিয়োগ, টিফিন, নাইট ও ওভারটাইম বিল বৃদ্ধি, মৃত শ্রমিকের মরদেহ কোম্পানির খরচে গ্রামের বাড়িতে প্রেরণ, অসুস্থ শ্রমিকের চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ, খাবারে সপ্তাহে দুইদিন গরুর মাংস, দুইদিন মুরগির মাংস ও দুইদিন সবজির সঙ্গে ডিম প্রদান, ঈদে ১২ দিন ছুটি, বছরে একবার পিকনিকে নিয়ে যাওয়া। দেখা গেছে একেক জায়গায় একেক দাবিতে শ্রমিকরা কাজ বন্ধ রেখেছেন। তাদের দাবিগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় ছিল না। এমনকি কারা এসব দাবি দিচ্ছে সে ব্যাপারেও শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের সুনির্দিষ্ট কোনো ধারণা নেই বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। অনেক জায়গায় কারখানায় হামলা হয়েছে। বহিরাগতরা এসব হামলায় জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এই বহিরাগত কারা? শ্রমিকরা ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন করবে এটা স্বাভাবিক। তবে মাত্র ১০ মাসের মাথায় নতুন করে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন অন্য বার্তা দেয়।

এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনি দিয়ে ৩টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোবাইল চোর সন্দেহে একজনকে পিটিয়ে মারা হলো। যাকে মারা হলো তিনি এক সময় ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি প্রেম সংক্রান্ত ও পারিবারিক কারণে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। অবশ্য গণপিটুনিতে যিনি নেতৃত্ব দিলেন তিনি ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সাবেক দুইজন নেতাকে পিটিয়ে মারা হলো। তাদের মধ্যে একজনের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ ছিল। এখন প্রশ্ন হলো কয়েকদিন আগে যেখানে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দাবিতে এতবড় আন্দোলন হলো সেখানে আবারো বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কেন? ইতিপূর্বে তারা সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর হামলা করেছিল এ যুক্তি কখনোই এখানে বৈধতা পেতে পারে না। তাহলে কেন আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া হলো এবং তা এমন একটা সময় করা হলো যখন চারিদিক থেকে নতুন করে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা হচ্ছে।

ইদানিং আরেকটি বিষয় নিয়ে সমাজে বিভেদ তৈরির পাঁয়তারা হচ্ছে। “গণঅভ্যুত্থানের মালিকানা” নিয়ে রীতিমত বাকযুদ্ধ চলছে। কে সমন্বয়ক, কে মাস্টারমাইন্ড, কে নয় দফার প্রবর্তক, কে এক দফার প্রবর্তক এসব নিয়ে তর্কাতর্কি থামছেই না। যেন “আমিই” সব করেছি। কিন্তু আসলে বিষয়টা “আমি” না “আমরা করেছি”। দেশের মানুষ সম্মিলিতভাবেই করেছে। একাই যদি সব করা যেতো তাহলে ১৫ বছর ফ্যাসিজমের রাজত্ব চলতো না। তাই গণতন্ত্রকামী সব মানুষ এই গণঅভ্যুত্থানের দাবিদার। যারা জুলাই-আগস্ট মাসে আন্দোলনে শরিক হয়েছে এবং যারা ১৫ বছর ধরে আন্দোলন সংগ্রাম করে গণঅভ্যুত্থানের পথ প্রশস্ত করেছে তারা সবাই এর দাবিদার। সবার ত্যাগের বিনিময়ে “দ্বিতীয় এ স্বাধীনতা” এসেছে।

এখনো বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে মানুষ রাস্তায় নামছেন। কমবেশি শ্রমিক অসন্তোষ চলছে। রাষ্ট্রীয় আইন না মানার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সবকিছুতেই যেন একটা হামবড়া ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। যেন যা কিছু করছি সব ঠিক আছে। এটা করা অধিকার। সরকারকে আজই সবকিছু মেনে নিতে হবে। কেন তারা মানবে না। তাদেরকে মানতেই হবে এবং সেটা আজই। এভাবে একদিকে কিছু মানুষ গায়ের জোরে হয়তো তাদের “ন্যায্য অধিকার” আদায়ের চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে পতিত স্বৈরাচার ও স্বার্থান্বেষী মহল এটাকে পুঁজি করে ষড়যন্ত্র করছে এবং পুরোনো ফ্যাসিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন হচ্ছে “উগ্র আচরণের” মাধ্যমে দাবি-দাওয়া পূরণের চেষ্টা করে আমরা কী সত্যিকার অর্থে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছি? আর এভাবে আমরা কী কারও রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হচ্ছি?

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

mzamin

No comments

Powered by Blogger.