দুর্নীতির বরপুত্র আনোয়ারুজ্জামানের এপিএস শহীদ by ওয়েছ খছরু

কাগুজে-কলমে সিলেটের আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ১০ মাস নগর পিতার দায়িত্ব পালন করেছেন। এই সময়ে নগর ভবনে যিনি সবচেয়ে বেশি দাপট দেখিয়েছিলেন তিনি মেয়রের এপিএস শহীদ চৌধুরী। ৫ই আগস্টের দৃশ্যপট পরিবর্তনের আগেই সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী শহীদকে নগর ভবন থেকে বের করে দিয়েছিলেন। সাবেক মেয়রের ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন, শহীদের অবাধ দুর্নীতির একের পর এক বিষয় কানে পৌঁছার পর তিনি বিরক্ত হয়ে তাকে নগর ভবন থেকে বের করে দেন। নগর ভবনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মেয়রের পদ বাতিল হওয়ার পর তার নিয়োজিত কিছু কর্মচারীর চাকরির কার্যকালও শেষ হয়ে গেছে। এর মধ্যে শহীদ চৌধুরীও একজন। আনোয়ারুজ্জামান নগর ভবনে যাদের নিয়ে চেয়ারে বসেছিলেন তাদের মধ্যে শহীদ চৌধুরী অন্যতম। লন্ডন থাকাকালেই সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে সম্পর্ক শহীদের। সেই সুবাদে আনোয়ার মেয়র হওয়ার পর দলীয় নেতাদের তীব্র আপত্তির মুখে শহীদ হয়ে যান তার এপিএস। কিন্তু নগর ভবন নিয়ে শহীদের স্বপ্ন অনেক আগের। নগরে থাকা ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন, প্রায় ৪ বছর আগে লন্ডন থেকে সিলেটে ফেরেন শহীদ চৌধুরী। তখন মেয়রের চেয়ারে বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী। তার সময়ই একান্ত বন্ধু নগরের বাগবাড়ি এলাকার জসিমকে নিয়ে ঠিকাদারি শুরু করেন। নানাভাবে আরিফুল হক চৌধুরীকে প্রেসার দিয়ে কাজ ভাগিয়ে নেন শহীদ। এরপর বন্ধু জসিমকে দিয়ে করান কাজ। তার এই কাজ নিয়ে কয়েকটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা ক্ষুব্ধ ছিলেন। সদ্য সাবেক হওয়া এক কাউন্সিলর জানিয়েছেন, নগরের ৬, ৭ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে অনেক কাজ শহীদ তার বন্ধু ও পরিচিত ঠিকাদারদের দিয়ে করিয়েছেন। সে কাজগুলো নিয়ে কাউন্সিলররা আপত্তি তুললেও কোনো কাজ হয়নি। এখন অনেক কাজ গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিলেটে আসার আগে সিটি করপোরেশন থেকে সড়ক মেরামত ও নগর সাজানো বাবদ কয়েক কোটি টাকার কাজ থোক বরাদ্দ থেকে করা হয়েছিল। কিন্তু কাজের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি টাকা তুলে শহীদ তার নিজস্ব ঠিকাদারদের দিয়ে করিয়ে নেন।

সবচেয়ে আলোচিত বিষয়টি হচ্ছে কেন শহীদকে গণ-অভ্যুত্থানের আগে নগর ভবন থেকে বের করে দিয়েছিলেন সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে বহু তথ্য। নগরের কর্মকর্তা, কর্মচারীরা জানিয়েছেন, সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর অগাধ বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে নগর ভবনকে লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছিলেন শহীদ চৌধুরী। মেয়র অনুপস্থিত থাকলে শহীদ চৌধুরী সব শাখাতেই দাপট দেখাতেন। টেন্ডার বাণিজ্য, লোকবল নিয়োগসহ নানা খাতে দুর্নীতি করে মাত্র ১০ মাসে ২০ কোটি টাকার মতো লুটে নিয়েছে শহীদ। ঠিকাদারদের সঙ্গে বাণিজ্য করে ১০-১২ কোটি টাকা কামিয়েছেন তিনি। এসব দুর্নীতির খবর নানাভাবে আসতে থাকে সাবেক মেয়রের কানে। শেষবার তিনি যখন লন্ডনে ছিলেন তখনো কয়েকটি বিষয় তার কানে আসে। ওই সময় পরিবার নিয়ে আমেরিকা যাওয়ার প্রস্তুতি নেন এপিএস শহীদ। ভিসাও করিয়ে নেন তিনি। এতে আনোয়ারুজ্জামানের সন্দেহ হলে তিনি গোপনে অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখেন। এতে প্রাথমিক তথ্যও পান। সাবেক এই মেয়রের ঘনিষ্ঠজনেরা জানিয়েছেন, গণ অভ্যুত্থানের প্রায় ১০-১২ দিন আগে হঠাৎ করে তারা মেয়রের কক্ষে উচ্চ স্বরে কথাবার্তা শোনেন। তারা এগিয়ে গিয়ে দেখেন আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী তার বিশ্বস্তজন শহীদকে গালিগালাজ করছেন। একপর্যায়ে মেয়র শহীদকে নগর ভবন থেকে বের করে দেন। একইসঙ্গে নগর ভবনে না আসতে নিষেধও করেন। সেই থেকে নগর ভবন ছাড়া শহীদ। নগর ভবন থেকে বিতারিত শহীদ চৌধুরী এরপরের সময় সাবেক এই মেয়রের কাছাকাছি আসতে অনেক চেষ্টা চালালেও কাজ হয়নি। শহীদ নগর ভবনে কী দুর্নীতি করেছেন?- এ প্রশ্নের উত্তরে জানা গেছে, ১০ মাসে নগর ভবনে মাস্টাররোলে ১৭৩ জন কর্মকর্তা কর্মচারীকে নিয়োগ দেয়া হয়। এর মধ্যে কয়েকজন কর্মকর্তা নিয়োগে মেয়রের নিজের পছন্দ ছিল। এর বাইরে যাদের নিয়োগ হয়েছে অধিকাংশই করেছেন শহীদ চৌধুরী।

মোট নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে ৪৪ জনের নিয়োগের ব্যাপারে কোনো বৈধতা ছিল না। অর্থাৎ মেয়র তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সম্মতি দেননি। অথচ তাদের তালিকা বেতন ভাতার খাতায় ছিল। এ বিষয়টি নিয়ে মেয়র তার উপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। পট পরিবর্তনের পর ওই ৪৪ জনের নিয়োগ বাতিল করে সিলেট সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। নিয়োগ বাণিজ্য করে শহীদ ৮ থেকে ১০ কোটি টাকা কামিয়েছে বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা। গতকাল বিকালে সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইফতেখার আহমদ চৌধুরী মানবজমিনকে জানিয়েছেন, তাদের নিয়োগের বৈধতা না থাকায় বাদ দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে এর কাগজপত্র এপিএসের রুমে পাওয়া যায়। বাদ পড়া কর্মচারীদের অনেকেই জানিয়েছেন, তারা শহীদ চৌধুরীর কাছে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা দিয়ে তারা চাকরিতে ঢুকেছিলেন। পরবর্তীতে চাকরি চলে যাওয়ার পর তারা শহীদ চৌধুরীর কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না। অনেকেই ঘরের গরু বিক্রি করে এনে টাকা দিয়ে নগর ভবনে চাকরি নিয়েছিলেন বলে জানান তারা। এদিকে- নগর ভবনে চাকরি ছাড়াও ঠিকাদার সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিল শহীদ। সব কাজে ঠিকাদারদের তাকে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ করে কমিশন দিতে হতো। আর বন্যার পর জরুরি ভিত্তিতে সড়ক মেরামতে অন্তত দুইশ’ কোটি টাকার কাজের আগেই তিনি কমিশন নিয়ে রেখেছিলেন। এ কাজে ঘাপলার জন্য ফের ভেঙেচুরে গেছে নগরের অনেক রাস্তা। পট পরিবর্তনের পর শহীদ আত্মগোপনে। মোবাইলও বন্ধ। কেউ কেউ বলছেন, পরিবার নিয়ে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছেন। তবে, নগর ভবন ছাড়ার আগে শহীদ চৌধুরী সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে সেগুলো মিথ্যা। তিনি কোনো নিয়োগ বাণিজ্য করেননি। ঠিকাদার সিন্ডিকেটও গড়েননি। তার বন্ধু জসিমও দুর্নীতির বিষয়টি অস্বীকার করেছিলেন।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.