কাশ্মীর সংকট: 'ভূস্বর্গ' থেকে 'মৃত্যু উপত্যকা' এবং নারীরা আবার হুমকির মুখে? by মালবী গুপ্ত
একথা সত্য যে স্বর্গের কোন ভাগাভাগি
হয় না। যদিও তার দখলদারি নিয়ে দেবতা ও দানবদের মধ্যে লড়াই বেঁধেছে
বারবার। এবং দেবতাদের কাছে বারম্বার পরাজিত হওয়ায় দানবদের স্বর্গবাসের
আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণই থেকে গেছে।
তবে নাগালের বাইরে বলেই বোধহয়
স্বর্গলোক নিয়ে মানুষ তত মাথা ঘামায়নি। কিন্তু এই ধরাধামেই যদি কোন
জায়গা স্বর্গের মত মনে হওয়ায় সে 'ভূস্বর্গ'র আখ্যা পেয়ে যায়?
ঠিক
যেমনটা সপ্তদশ শতাব্দীতে কাশ্মীর পেয়েছিল তার অসামান্য প্রাকৃতিক শোভায়
অভিভূত মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে। তাহলে যে সেই 'ভূস্বর্গ'র
দাবিদার হতে অনেকেই হাতের আস্তিন গোটাবে, তাতে আর আশ্চর্য কি?
কিন্তু
কে জানত যে সেই 'ভূস্বর্গ কাশ্মীর'ই একদিন 'মৃত্যু উপত্যকা' হয়ে উঠবে।
কে জানত গত কয়েক দশক ধরে সংঘাত দীর্ণ সেই ভূস্বর্গেই নারী ও কিশোরীরা
সেনা, আধা সেনাবাহিনী এবং জঙ্গিদের দ্বারা ধর্ষণসহ নানা অত্যাচারের শিকার
হয়ে উঠবেন।
এবং কে জানত যে, একেবারে সরকারি সিলমোহর লাগিয়েই সেখানকার মেয়েদের মৌলিক অধিকারগুলিও অচিরেই কেড়ে নেওয়া হবে?
নারীদের প্রতিবাদ: বিশেষ ধারা বাতিলের বিরুদ্ধে কাশ্মীরিদের বিক্ষোভ |
ইতিহাস হাতড়াতে গিয়ে দেখছি - মধ্য, পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়া ছুঁয়ে থাকা
ভারতীয় উপমহাদেশে জম্মু -কাশ্মীরের যে ভৌগোলিক অবস্থান, তাতে প্রাচীন
থেকে মধ্য যুগ - ক্রমান্বয়ে হিন্দু, মুঘল, আফগান, শিখ, ডোগরা রাজা
বাদশাহদের শাসনে ছিল সে। ফলে সেই উপত্যকায় হিন্দু-বৌদ্ধ-শৈব হয়ে ত্রয়োদশ
শতাব্দীতে ইসলাম ধর্মও এসে মিশেছে। এবং মনে হয় যুগ যুগ ধরেই সেই নানা
ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরম্পরা অন্তর্লীন ছিল উপত্যকাবাসীর জীবন
চর্যাতেও ।
কিন্তু ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় যে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা সংঘাতের
মধ্যে দিয়ে দেশভাগ, ভারতের স্বাধীনতা অর্জন এবং পাকিস্তানের জন্ম হয়,
তার মধ্যেই যেন এই উপত্যকায় এক অনিঃশেষ দ্বন্দ্ব - সংঘাতের বীজ লুকিয়ে
ছিল। কারণ জম্মু-কাশ্মীরের শেষ হিন্দু রাজা হরি সিং স্বাধীনতা বজায় রাখতে
চাইলেও শেষ পর্যন্ত কেন তিনি ভারতের সঙ্গে জম্মু-কাশ্মীরের সংযুক্তি মেনে
নিয়েছিলেন?
কিন্তু
একটি মুসলমান প্রধান প্রদেশ, একটি হিন্দু প্রধান রাষ্ট্রের সঙ্গে আদৌ
অন্তর্ভুক্তি চায় কি না, এবং তাতে তাদের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক-আর্থ-সামাজিক
জীবনে সমস্যা হতে পারে কি না, রাজ্যবাসীর কাছে তা জানতে চাননি হরি সিং।
যে ঐতিহাসিক, ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারতের সঙ্গে দেশের একমাত্র
মুসলমান প্রধান রাজ্য জম্মু-কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তি, তাতে হয়তো একটা
'সেফগার্ড'এর প্রয়োজন ছিল। যা সংবিধানের অস্থায়ী ৩৭০ ধারা তাকে দেয়। এবং
সেই ধারায় প্রায় ৭০ বছর ধরে রাজ্যটি 'স্পেশাল স্টেটাস'র বিশেষ সুবিধাও
পেয়ে এসেছে।
কিন্তু আশ্চর্য, রাজ্যের সেই নিজস্ব সংবিধানই কাশ্মীরি মহিলাদের নানা মৌলিক অধিকার হরণ করে নেয়।
সেই
সংবিধানের ৩৫এ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী উপত্যকায় সকলেরই যে 'পার্মানেন্ট
রেসিডেন্ট সার্টিফিকেট' বা পিআরসি থাকা উচিত, তা বাতিল হয়ে যায় যদি কোন
কাশ্মীরি মেয়ে পিআরসি নেই এমন পুরুষকে বিয়ে করে।
তখন পিআরসি
হোল্ডার'র সমস্ত সুযোগ থেকেই সে বঞ্চিত হয়। সরকারি স্কুল-কলেজে পড়া, কোন
কেন্দ্রীয় ও রাজ্য স্কলারশিপ, সরকারি অনুদান কিম্বা সরকারি চাকরি পাওয়ার
অধিকার সে হারায়।
সেখানে সম্পত্তি কেনা বেচা, এমনকি পারিবারিক
বিষয় সম্পত্তির অধিকার থেকেও মেয়েটি বঞ্চিত হয়। তার অধিকার থাকে না
নির্বাচনে অংশ নেওয়ারও।
অথচ কোন কাশ্মীরি পুরুষ অন্য রাজ্যের বা দেশের কোন মহিলাকে বিয়ে করলেও
তার স্টেটাসের কোনই পরিবর্তন হয় না। উপরন্তু তার স্ত্রী কাশ্মীরের
'পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট'র মর্যাদা পেয়ে যায়।
তাই
হঠাৎ জম্মু-কাশ্মীর থেকে সেই ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা তুলে নেওয়ায়, ভারতীয়
সংবিধান অনুযায়ী কাগজে কলমে অন্তত সমস্ত নারী-পুরুষের সমানাধিকার সেখানেও
এবার প্রযোজ্য হবে। সরকারের এই পদক্ষেপে জম্মু-কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ আদৌ
উজ্জ্বল হবে, নাকি কাশ্মীরিদের জীবন আরও দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা ও অনিশ্চয়তার
ঘোর অন্ধকারে তলিয়ে যাবে, তা এখনই বলা কঠিন।
কিন্তু যেসব কাশ্মীরি
মহিলারা তাঁদের জীবনে এই ঘোর বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, ওই
অনুচ্ছেদ বাতিলের দাবি জানিয়েছেন বারবার, তাঁরা অন্তত এই পদক্ষেপকে স্বাগত
জানাচ্ছেন।
তবে কাশ্মীরি মেয়েদের জীবনের সুরক্ষা নিয়ে একটা আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
কারণ, ৩৭০ বাতিল হতে না হতেই বিজেপির নেতা, মন্ত্রীরা যেভাবে উঠে পড়ে
'ফর্সা কাশ্মীরি মেয়ে'দের বউ করে আনার ব্যাপারে অকাশ্মীরিদের প্রতি আহ্বান
জানাচ্ছেন, তা শুধু অশালীন ও অরুচিকরই নয়, অত্যন্ত লজ্জাজনকও বটে।
বিজেপি
ল'মেকার বিক্রম সাইনি তো তাঁর দলের মুসলমান কর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন যে,
এখন তাঁরা কাশ্মীরে গিয়ে 'ফেয়ার স্কিনড কাশ্মীরি গার্লস' বিয়ে করে আনতে
পারেন।
আসলে
যে ঘোর পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মেয়েদের চিরকালই পণ্য হিসেবে দেখে এসেছে,
তারই জেরে হঠাৎ ভূস্বর্গের নারীদের পাওয়া আয়াসসাধ্য মনে হচ্ছে দেশের বহু
পুরুষেরই। তারা যেন খেই হারিয়ে ফেলছেন।
তাই তাঁদের ওই 'ফেয়ার
স্কিন্ড গার্লস' পাওয়ার লোভের কাছে বিশেষ করে দরিদ্র কাশ্মীরি মেয়েদের
নিরাপত্তা কতটা অটুট থাকবে, তা নিয়ে একটা আশঙ্কা জাগছেই। কারণ বিশ্বে
কন্যাশিশু ও নারী পাচারে ভারতের স্থান কিন্তু বেশ ওপরের দিকেই।
তাছাড়া
ভারতের সংবিধান নারী পুরুষের সমান অধিকার দিলেও অন্যান্য রাজ্যের বেশিরভাগ
মেয়েদের মতো কাশ্মীরি মেয়েরাও যে তার নাগাল পাবে না, তাতে সন্দেহ নেই।
তাই
সেখানকার হাজার হাজার 'হাফ উইডো', যাঁদের স্বামী নিখোঁজ, সন্তান নিখোঁজ,
তাঁদের হদিশ না পেলে, গণকবরে পরিচয়হীন যারা শুয়ে আছেন, তাঁদের পরিচয় না
জানালে, সেনাবাহিনীর হাতে অত্যাচারিত ও নিহতদের সেই হাজার হাজার মা, বোন,
স্ত্রী ও কন্যাদের মনের ক্ষত শুকবে কি করে?
গত কয়েক দশক ধরে ধর্ষণ ও
গণধর্ষণে অপরাধীদের শাস্তি না দিলে কাশ্মীর ভূখণ্ডের ওপর হয়তো জাতীয়
পতাকা ওড়ানো যাবে। কিন্তু কাশ্মীরি নারী-হৃদয়ের এক ইঞ্চি জায়গাও দেশের
শাসকরা পাবেন না। এবং জঙ্গিদের সমর্থনে নয়, ভারত সরকারের বিরুদ্ধেই তাঁদের
হাতেও হয়তো তখন পাথর উঠে আসবে।
কাশ্মীরি নারীর প্রতিক্রিয়া: ভারত সরকারের বিরুদ্ধেই তাঁদের হাতেও পাথর উঠে আসছে। |
No comments