রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীনের ত্বরিত প্রচেষ্টা ব্যর্থ যে কারণে by ল্যারি জাগান
কয়েক
লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর পরিকল্পিত প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের
মধ্যে অচলাবস্থা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু চীনের হস্তক্ষেপ বিষয়টিকে আরো একটু
বেশি জটিল করে তুলেছে। সবদিক দিয়ে সৎ উদ্দেশ্যে বেইজিং এখন অস্থির
অবস্থাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। তারা এর আগে ভুল ধারণা নিয়ে এ প্রচেষ্টায়
জড়িত হয়েছিল। ফলে এখন তারা আগামী কয়েক সপ্তাহে নিউ ইয়র্কে
পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক প্রস্তাব করেছে জাতিসংঘ মহাসচিব
অ্যান্তনিও গুতেরাঁর সৌজন্যে। উদ্দেশ্য ক্রমবর্ধমান অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে
আসতে একটি উপায় খুঁজে বের করা।
কিন্তু এটা শুধু তখনই সফল হবে, যদি চীন সমস্যা সমাধানে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেয়, যদি দুই দেশ সমঝোতার জন্য বাস্তবেই সরাসরি জড়িত হতে প্রস্তুত থাকে এবং এটা শুধু সহযোগিতার জন্য মুখের ভাষা না হয়। অবশ্যই, এ প্রক্রিয়াকে শুধু সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, যদি শরণার্থীদের উদ্বেগ ও তাদের স্বার্থের বিষয়টি ভবিষ্যৎ প্রত্যাবর্তন বিষয়ক পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু হয়। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সর্বশেষ প্রক্রিয়াটি ছিল গত মাসে, চীনের গোঁ ধরার ফলে তাড়াহুড়ো করে এই প্রক্রিয়া শুরু করার চেষ্টা। বাংলাদেশের শরণার্থী শিবির থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাসগুলো শিবিরে গিয়ে অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু তাতে যখন একজনও শরণার্থী গিয়ে ওঠেননি, তখন এই প্রক্রিয়াটি দ্রুত এক চরম ব্যর্থতায় পরিণত হলো।
খুব দ্রুততার সঙ্গে সর্বশেষ এই অবস্থায় পাল্টাপাল্টি অভিযোগ শুরু হলো। ব্যর্থতার জন্য উভয় দেশ একে অন্যকে দায়ী করলো। ঢাকার পক্ষ অবলম্বন করলো যুক্তরাষ্ট্র। তারা ব্যর্থতার জন্য মিয়ানমারকে দায়ী করলো। যখন শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর জন্য অবশ্যই অধিক প্রস্তুতি নেয়া উচিত ছিল বাংলাদেশের, তখন মিয়ানমারকে অবশ্যই তাদের প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করার জন্য অধিক প্রস্তুত হওয়া উচিত ছিল। মূল সমস্যা হলো, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ- উভয়ের প্রতি শরণার্থীদের রয়েছে তীব্র এক অবিশ্বাস।
তবে বর্তমান ব্যর্থতার মূল কারণ হলো প্রত্যাবাসন কর্মসূচি শুরু করতে চীনের শক্ত হাতের অপরিপক্ব শক্তির প্রয়োগ। ২০১৭ সালের আগস্টে নতুন করে সংকট সৃষ্টি হওয়ার সময় থেকেই এ ঘটনার নেপথ্যে গঠনমূলক ভূমিকা রেখে আসছে বেইজিং। যদিও এক্ষেত্রে তাদের যথেষ্ট কৃতিত্ব দেয়া হয় না। তবে এবার তারা অধৈর্য হয়ে রাখাইন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছে। আর তা পাল্টা ফল দিয়েছে। এটা শুধু প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে আরেকটি মিথ্যা সূচনায়ই ডুবিয়ে দিয়েছে এমন না। একই সঙ্গে এতে শরণার্থীদের নিজেদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। এতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যবর্তী দূরত্বকে বাস্তবেই আরো বিস্তৃত করতে পারে। একই সঙ্গে আন্তরিকভাবে ভবিষ্যতে প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া শুরু করার ক্ষেত্রে আরো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
বেইজিংকে এটা বুঝতে হবে যে, সমস্যা সমাধানে মধ্যস্থতা করা এবং তাদের ‘গুড অফিসগুলোর’ ব্যবহার করার মধ্যে পার্থক্য আছে- একটি হতে পারে শরণার্থীদের সব পক্ষের সম্মতি ও গ্রহণযোগ্য বিষয়। দুর্ভাগ্যজনক হলো, এই সূক্ষ্মতার বিষয়টি কোথায় যেন পথ হারিয়ে গেছে।
গত কয়েক মাসে রাখাইনে সমস্যা সমাধানে অধৈর্য ও গভীরভাবে মনোনিবেশ করেছে বেইজিং। হতে পারে সেটা মিয়ানমারের স্বার্থে। কিন্তু তারা এটা করছে সুনির্দিষ্টভাবে তাদের (চীন) নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে। তারা চাইছে মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলে, বিশেষ করে যেখানে তাদের অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ও কাউক ফাইউ বন্দর রয়েছে, সেখানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনা। একই সঙ্গে তারা মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। এসব করা হচ্ছে তাদের নিজেদের স্বার্থকে সুরক্ষিত রাখার জন্য।
এই লক্ষ্য কীভাবে অর্জন করা যায় তা নিয়ে এ বছরের শুরুর দিকে অভ্যন্তরীণভাবে উচ্চ পর্যায়ের আলোচনা হয়েছে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। চীনা সরকারের বিভিন্ন সূত্রমতে, চীনের মিয়ানমার বিষয়ক নীতি ও কৌশলের কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে উঠেছে রাখাইন সমস্যার সমাধান। জুলাইয়ের শুরুতে বেইজিং সফর করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মিয়ানমার যাতে পদক্ষেপ নেয় এবং ২০১৭ সালের নভেম্বরে সম্পাদিত চুক্তির অধীনে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করে, সে জন্য সহায়তা করতে তিনি চীনা নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। ২০১৭ সালের ওই চুক্তি হয়েছিল বেইজিং নেপথ্যে ব্রোকারের ভূমিকা পালন করায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওই চুক্তি বাস্তব প্রয়োগ ব্যর্থ হয়েছে। চীন রাখাইন ইস্যু সমাধানে সহায়তায় দৃষ্টি দেয়, এ ঘটনায় তাদের সেই প্রচেষ্টায় গতি এসেছিল।
গত কয়েক মাসে ধারাবাহিকভাবে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়েছে। অচলাবস্থা ভাঙতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন চীনের কূটনীতিকরা ও বিশেষ দূত সান গাওসিংয়াং। রোহিঙ্গাদের মিয়ামনমারে ফেরত যাওয়া উৎসাহিত করতে কমপক্ষে দু’বার কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে তারা সাক্ষাৎ করেছেন।
চীনের মধ্যস্থতায় জুলাইয়ের শেষের দিকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে সিদ্ধান্তে পৌঁছান তারা। দৃশ্যত এতে দ্বিপক্ষীয় উত্তেজনা প্রশমিত হয় এবং প্রত্যাবাসন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার একটি পথ পরিষ্কার করে দেয়। চীনা প্রতিনিধিরা সহ অন্য কূটনীতিক ও কর্মকর্তারাও এসব বৈঠকে যোগ দেন। ঢাকায় অনুষ্ঠিত সর্বশেষ বৈঠকে মিয়ানমার ৩৪৫০ জন শরণার্থীর একটি তালিকা হস্তান্তর করে। এক বছরেরও বেশি সময় আগে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে বাংলাদেশ হস্তান্তর করেছিল ২২০০০ নামের একটি তালিকা। তাদের মাঝ থেকে মিয়ানমার ফেরত নেয়ার জন্য ওই সংখ্যক শরণার্থীকে ক্লিয়ারেন্স দেয়। ওদিকে বাংলাদেশ পক্ষ পরবর্তীতে ২৫০০০ শরণার্থীর একটি তালিকা জমা দেয়।
ওইসব বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন কূটনীতিকরা বলছেন, যদিও প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া শুরুর বিষয়ে দৃশ্যত কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি নেই বলে মনে হচ্ছে, তথাপি সামনে অগ্রসর হওয়ার কাজ এগিয়ে নেয়া হয়। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে খুব বেশি উদগ্রীব ছিল চীন। তাই তারা আগস্টে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে ঢাকার ওপর চাপ সৃষ্টি করে, চতুর্দিকে বিভ্রান্তি থাকা সত্ত্বেও এক্ষেত্রে খুব তাড়াহুড়ো করা হয়। প্রকৃতপক্ষে মধ্য আগস্টে এই প্রক্রিয়া শুরু করতে ঢাকার প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল বেইজিং। বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের মতে, এ সময়টা মুসলিমদের বড় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহার সময়ে পড়া সত্ত্বেও এ বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছিল চীন। ফলস্বরূপ, এ প্রক্রিয়া এক সপ্তাহ পিছিয়ে ২২শে আগস্ট নেয়া হয়।
কিন্তু বাংলাদেশের কর্মকর্তারা মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের নোটিফাইং করার পরিবর্তে, চীনের দূত তার নিজস্ব শাটল কূটনীতি শুরু করেন। তিনি ৬ই আগস্ট ন্যাপিডতে সাক্ষাৎ করেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সুচির সঙ্গে। তিনি সুচিকে বলেন, ২২শে আগস্ট শরণার্থী প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া শুরু করবে বাংলাদেশ। এর পরের দিন চীনা ওই দূত সাক্ষাৎ করেন মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে। সেখানে তারা রাখাইন নিয়ে আলোচনার পর আলোচনা করতেই থাকেন। এর মধ্য দিয়ে তারা মিয়ানমারকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে উৎসাহিত করেন। এর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো মিয়ানমার সরকার জানতে পারে যে, অনতিবিলম্বে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করবে বাংলাদেশ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের সিনিয়র কর্মকর্তারা এ তথ্য দিয়েছেন।
প্রকৃতপক্ষে, ওই সময়ে শরণার্থী প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া শুরু করার মতো বাস্তবসম্মত অবস্থানে ছিল না বাংলাদেশ অথবা মিয়ানমারের সরকার। আসলে এসব আয়োজন করা হয়েছিল অতি দ্রুততার সঙ্গে এবং অপ্রস্তুত (ইল-প্রিপেয়ার্ড) অবস্থায়। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার দু’সপ্তাহ আগে রোহিঙ্গাদের তালিকা দেয়া হয় শরণার্থী বিষয়ক জাতিসংঘের এজেন্সি ইউএনএইচসিআর’কে। নির্বাচিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পরিবারগুলো স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে চায় কিনা তা নির্ধারণ করার দায়িত্ব এ সংস্থার। ফলে দু’সপ্তাহ আগে তাদের কাছে ওই তালিকা দেয়ার ফলে প্রকৃতপক্ষে মিশন অসম্ভব হয়ে যায়। ফলে সর্বশেষ উদ্যোগ যে ব্যর্থ হয়েছে, এতে কেউই বিস্মিত নন। শুরু থেকেই এমনটা দৃশ্যমান ছিল।
মিয়ানমারের প্রতি সমর্থন ছিল এমন আসিয়ানভুক্ত কর্মকর্তাদেরকেও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার নির্ধারিত তারিখের মাত্র দু’সপ্তাহ আগে বিষয়টি সম্পর্কে জানানো হয়েছিল। ফলে দ্রুততার প্রচণ্ড তাড়াহুড়ো করে আসিয়ান কো-অর্ডিনেটিং কমিটি ফর হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাসিসটেন্স অন ডিজঅ্যাস্টার ম্যানেজমেনটকে (এএইচএ) প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া মনিটরিং করতে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। ফলে তাদেরকে প্রচণ্ড তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে তারা এ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করবে কিনা। শেষ পর্যন্ত তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা মিয়ানমারের পক্ষে অংশ নেবে। সেখানে তারা এরই মধ্যে একটি টিম পাঠিয়েছিল। তবে বাংলাদেশ অংশে মনিটরিং করতে একটি টিম পাঠাতে অসমর্থ হয়।
চরম এই ব্যর্থতার পর থেকে, মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা মাথায় রেখে আরো সমর্থন ও সহযোগিতার জন্য আসিয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দৃঢ়তার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ। শরণার্থীদের পুনর্বাসন করতে জাপানের কাছে সহায়তা চায় বাংলাদেশ। শরণার্থীদের যাতে ফেরত নেয় মিয়ানমার সেজন্য তাদের ওপর আরো চাপ সৃষ্টি করুক জাতিসংঘ- এমন দাবি করে বাংলাদেশ। যদিও ঢাকা ও ন্যাপিড জাতিসংঘের উদ্দেশ্য নিয়ে সংশয়ে, তবু দুর্ভাগ্যজনক হলো- দৃশ্যত বাংলাদেশ চাইছে এই ইস্যুকে আন্তর্জাতিকীকরণ করতে। কিন্তু মিয়ানমার এমন প্রস্তাবের ঘোর বিরোধিতা করে আসছে এখন পর্যন্ত।
কিন্তু উভয় দেশই বেইজিংয়ের মধ্যস্থতা স্বেচ্ছায় মেনে নিতে আগ্রহী। দুই দেশই চীনের ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল। সেটা ত্রাণ, বিনিয়োগ, ব্যবসা সব ক্ষেত্রে। দুই দেশই কৌশলগত দিক দিয়ে বেইজিংয়ের সঙ্গে যুক্ত। সামরিক দিক দিয়ে দুই দেশের মধ্যে রয়েছে শক্তিশালী সম্পর্ক। মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের এমন সম্পর্ক গত ৩০ বছরের। আর বাংলাদেশের সঙ্গে ইদানীং। প্রমাণ হলো, অতি সম্প্রতি চীনের কাছ থেকে দুটি সাবমেরিন কিনছে ঢাকা। তবে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো উভয় দেশই বেইজিংকে দেখছে একটি সৎ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে।
এখন আশা করা যায়, সব পক্ষই গত মাসের হতাশা থেকে শিক্ষা নিয়ে থাকবে। পরবর্তী উদ্যোগ হতে হবে উন্নতর পরিকল্পিত, সীমান্তের দু’পাড়ে প্রস্তুতিটা হতে হবে আরো বিস্তৃত এবং নতুন করে প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ায় শরণার্থীদের থাকতে হবে আগ্রহ। তা হতে হলে অবশ্যই সবকিছুতে জড়িত থাকতে হবে জাতিসংঘকে। সর্বোপরি মিয়ানমার জাতিসংঘের সঙ্গে তার সমঝোতা স্মারক নবায়ন করেছে।
(ল্যারি জাগান মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ। তিনি বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের আঞ্চলিক সাবেক বার্তা সম্পাদক। তার এ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক পোস্টে)
কিন্তু এটা শুধু তখনই সফল হবে, যদি চীন সমস্যা সমাধানে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেয়, যদি দুই দেশ সমঝোতার জন্য বাস্তবেই সরাসরি জড়িত হতে প্রস্তুত থাকে এবং এটা শুধু সহযোগিতার জন্য মুখের ভাষা না হয়। অবশ্যই, এ প্রক্রিয়াকে শুধু সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, যদি শরণার্থীদের উদ্বেগ ও তাদের স্বার্থের বিষয়টি ভবিষ্যৎ প্রত্যাবর্তন বিষয়ক পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু হয়। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সর্বশেষ প্রক্রিয়াটি ছিল গত মাসে, চীনের গোঁ ধরার ফলে তাড়াহুড়ো করে এই প্রক্রিয়া শুরু করার চেষ্টা। বাংলাদেশের শরণার্থী শিবির থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাসগুলো শিবিরে গিয়ে অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু তাতে যখন একজনও শরণার্থী গিয়ে ওঠেননি, তখন এই প্রক্রিয়াটি দ্রুত এক চরম ব্যর্থতায় পরিণত হলো।
খুব দ্রুততার সঙ্গে সর্বশেষ এই অবস্থায় পাল্টাপাল্টি অভিযোগ শুরু হলো। ব্যর্থতার জন্য উভয় দেশ একে অন্যকে দায়ী করলো। ঢাকার পক্ষ অবলম্বন করলো যুক্তরাষ্ট্র। তারা ব্যর্থতার জন্য মিয়ানমারকে দায়ী করলো। যখন শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর জন্য অবশ্যই অধিক প্রস্তুতি নেয়া উচিত ছিল বাংলাদেশের, তখন মিয়ানমারকে অবশ্যই তাদের প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করার জন্য অধিক প্রস্তুত হওয়া উচিত ছিল। মূল সমস্যা হলো, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ- উভয়ের প্রতি শরণার্থীদের রয়েছে তীব্র এক অবিশ্বাস।
তবে বর্তমান ব্যর্থতার মূল কারণ হলো প্রত্যাবাসন কর্মসূচি শুরু করতে চীনের শক্ত হাতের অপরিপক্ব শক্তির প্রয়োগ। ২০১৭ সালের আগস্টে নতুন করে সংকট সৃষ্টি হওয়ার সময় থেকেই এ ঘটনার নেপথ্যে গঠনমূলক ভূমিকা রেখে আসছে বেইজিং। যদিও এক্ষেত্রে তাদের যথেষ্ট কৃতিত্ব দেয়া হয় না। তবে এবার তারা অধৈর্য হয়ে রাখাইন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছে। আর তা পাল্টা ফল দিয়েছে। এটা শুধু প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে আরেকটি মিথ্যা সূচনায়ই ডুবিয়ে দিয়েছে এমন না। একই সঙ্গে এতে শরণার্থীদের নিজেদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। এতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যবর্তী দূরত্বকে বাস্তবেই আরো বিস্তৃত করতে পারে। একই সঙ্গে আন্তরিকভাবে ভবিষ্যতে প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া শুরু করার ক্ষেত্রে আরো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
বেইজিংকে এটা বুঝতে হবে যে, সমস্যা সমাধানে মধ্যস্থতা করা এবং তাদের ‘গুড অফিসগুলোর’ ব্যবহার করার মধ্যে পার্থক্য আছে- একটি হতে পারে শরণার্থীদের সব পক্ষের সম্মতি ও গ্রহণযোগ্য বিষয়। দুর্ভাগ্যজনক হলো, এই সূক্ষ্মতার বিষয়টি কোথায় যেন পথ হারিয়ে গেছে।
গত কয়েক মাসে রাখাইনে সমস্যা সমাধানে অধৈর্য ও গভীরভাবে মনোনিবেশ করেছে বেইজিং। হতে পারে সেটা মিয়ানমারের স্বার্থে। কিন্তু তারা এটা করছে সুনির্দিষ্টভাবে তাদের (চীন) নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে। তারা চাইছে মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলে, বিশেষ করে যেখানে তাদের অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ও কাউক ফাইউ বন্দর রয়েছে, সেখানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনা। একই সঙ্গে তারা মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। এসব করা হচ্ছে তাদের নিজেদের স্বার্থকে সুরক্ষিত রাখার জন্য।
এই লক্ষ্য কীভাবে অর্জন করা যায় তা নিয়ে এ বছরের শুরুর দিকে অভ্যন্তরীণভাবে উচ্চ পর্যায়ের আলোচনা হয়েছে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। চীনা সরকারের বিভিন্ন সূত্রমতে, চীনের মিয়ানমার বিষয়ক নীতি ও কৌশলের কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে উঠেছে রাখাইন সমস্যার সমাধান। জুলাইয়ের শুরুতে বেইজিং সফর করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মিয়ানমার যাতে পদক্ষেপ নেয় এবং ২০১৭ সালের নভেম্বরে সম্পাদিত চুক্তির অধীনে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করে, সে জন্য সহায়তা করতে তিনি চীনা নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। ২০১৭ সালের ওই চুক্তি হয়েছিল বেইজিং নেপথ্যে ব্রোকারের ভূমিকা পালন করায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওই চুক্তি বাস্তব প্রয়োগ ব্যর্থ হয়েছে। চীন রাখাইন ইস্যু সমাধানে সহায়তায় দৃষ্টি দেয়, এ ঘটনায় তাদের সেই প্রচেষ্টায় গতি এসেছিল।
গত কয়েক মাসে ধারাবাহিকভাবে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়েছে। অচলাবস্থা ভাঙতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন চীনের কূটনীতিকরা ও বিশেষ দূত সান গাওসিংয়াং। রোহিঙ্গাদের মিয়ামনমারে ফেরত যাওয়া উৎসাহিত করতে কমপক্ষে দু’বার কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে তারা সাক্ষাৎ করেছেন।
চীনের মধ্যস্থতায় জুলাইয়ের শেষের দিকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে সিদ্ধান্তে পৌঁছান তারা। দৃশ্যত এতে দ্বিপক্ষীয় উত্তেজনা প্রশমিত হয় এবং প্রত্যাবাসন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার একটি পথ পরিষ্কার করে দেয়। চীনা প্রতিনিধিরা সহ অন্য কূটনীতিক ও কর্মকর্তারাও এসব বৈঠকে যোগ দেন। ঢাকায় অনুষ্ঠিত সর্বশেষ বৈঠকে মিয়ানমার ৩৪৫০ জন শরণার্থীর একটি তালিকা হস্তান্তর করে। এক বছরেরও বেশি সময় আগে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে বাংলাদেশ হস্তান্তর করেছিল ২২০০০ নামের একটি তালিকা। তাদের মাঝ থেকে মিয়ানমার ফেরত নেয়ার জন্য ওই সংখ্যক শরণার্থীকে ক্লিয়ারেন্স দেয়। ওদিকে বাংলাদেশ পক্ষ পরবর্তীতে ২৫০০০ শরণার্থীর একটি তালিকা জমা দেয়।
ওইসব বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন কূটনীতিকরা বলছেন, যদিও প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া শুরুর বিষয়ে দৃশ্যত কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি নেই বলে মনে হচ্ছে, তথাপি সামনে অগ্রসর হওয়ার কাজ এগিয়ে নেয়া হয়। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে খুব বেশি উদগ্রীব ছিল চীন। তাই তারা আগস্টে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে ঢাকার ওপর চাপ সৃষ্টি করে, চতুর্দিকে বিভ্রান্তি থাকা সত্ত্বেও এক্ষেত্রে খুব তাড়াহুড়ো করা হয়। প্রকৃতপক্ষে মধ্য আগস্টে এই প্রক্রিয়া শুরু করতে ঢাকার প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল বেইজিং। বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের মতে, এ সময়টা মুসলিমদের বড় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহার সময়ে পড়া সত্ত্বেও এ বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছিল চীন। ফলস্বরূপ, এ প্রক্রিয়া এক সপ্তাহ পিছিয়ে ২২শে আগস্ট নেয়া হয়।
কিন্তু বাংলাদেশের কর্মকর্তারা মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের নোটিফাইং করার পরিবর্তে, চীনের দূত তার নিজস্ব শাটল কূটনীতি শুরু করেন। তিনি ৬ই আগস্ট ন্যাপিডতে সাক্ষাৎ করেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সুচির সঙ্গে। তিনি সুচিকে বলেন, ২২শে আগস্ট শরণার্থী প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া শুরু করবে বাংলাদেশ। এর পরের দিন চীনা ওই দূত সাক্ষাৎ করেন মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে। সেখানে তারা রাখাইন নিয়ে আলোচনার পর আলোচনা করতেই থাকেন। এর মধ্য দিয়ে তারা মিয়ানমারকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে উৎসাহিত করেন। এর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো মিয়ানমার সরকার জানতে পারে যে, অনতিবিলম্বে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করবে বাংলাদেশ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের সিনিয়র কর্মকর্তারা এ তথ্য দিয়েছেন।
প্রকৃতপক্ষে, ওই সময়ে শরণার্থী প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া শুরু করার মতো বাস্তবসম্মত অবস্থানে ছিল না বাংলাদেশ অথবা মিয়ানমারের সরকার। আসলে এসব আয়োজন করা হয়েছিল অতি দ্রুততার সঙ্গে এবং অপ্রস্তুত (ইল-প্রিপেয়ার্ড) অবস্থায়। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার দু’সপ্তাহ আগে রোহিঙ্গাদের তালিকা দেয়া হয় শরণার্থী বিষয়ক জাতিসংঘের এজেন্সি ইউএনএইচসিআর’কে। নির্বাচিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পরিবারগুলো স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে চায় কিনা তা নির্ধারণ করার দায়িত্ব এ সংস্থার। ফলে দু’সপ্তাহ আগে তাদের কাছে ওই তালিকা দেয়ার ফলে প্রকৃতপক্ষে মিশন অসম্ভব হয়ে যায়। ফলে সর্বশেষ উদ্যোগ যে ব্যর্থ হয়েছে, এতে কেউই বিস্মিত নন। শুরু থেকেই এমনটা দৃশ্যমান ছিল।
মিয়ানমারের প্রতি সমর্থন ছিল এমন আসিয়ানভুক্ত কর্মকর্তাদেরকেও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার নির্ধারিত তারিখের মাত্র দু’সপ্তাহ আগে বিষয়টি সম্পর্কে জানানো হয়েছিল। ফলে দ্রুততার প্রচণ্ড তাড়াহুড়ো করে আসিয়ান কো-অর্ডিনেটিং কমিটি ফর হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাসিসটেন্স অন ডিজঅ্যাস্টার ম্যানেজমেনটকে (এএইচএ) প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া মনিটরিং করতে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। ফলে তাদেরকে প্রচণ্ড তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে তারা এ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করবে কিনা। শেষ পর্যন্ত তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা মিয়ানমারের পক্ষে অংশ নেবে। সেখানে তারা এরই মধ্যে একটি টিম পাঠিয়েছিল। তবে বাংলাদেশ অংশে মনিটরিং করতে একটি টিম পাঠাতে অসমর্থ হয়।
চরম এই ব্যর্থতার পর থেকে, মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা মাথায় রেখে আরো সমর্থন ও সহযোগিতার জন্য আসিয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দৃঢ়তার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ। শরণার্থীদের পুনর্বাসন করতে জাপানের কাছে সহায়তা চায় বাংলাদেশ। শরণার্থীদের যাতে ফেরত নেয় মিয়ানমার সেজন্য তাদের ওপর আরো চাপ সৃষ্টি করুক জাতিসংঘ- এমন দাবি করে বাংলাদেশ। যদিও ঢাকা ও ন্যাপিড জাতিসংঘের উদ্দেশ্য নিয়ে সংশয়ে, তবু দুর্ভাগ্যজনক হলো- দৃশ্যত বাংলাদেশ চাইছে এই ইস্যুকে আন্তর্জাতিকীকরণ করতে। কিন্তু মিয়ানমার এমন প্রস্তাবের ঘোর বিরোধিতা করে আসছে এখন পর্যন্ত।
কিন্তু উভয় দেশই বেইজিংয়ের মধ্যস্থতা স্বেচ্ছায় মেনে নিতে আগ্রহী। দুই দেশই চীনের ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল। সেটা ত্রাণ, বিনিয়োগ, ব্যবসা সব ক্ষেত্রে। দুই দেশই কৌশলগত দিক দিয়ে বেইজিংয়ের সঙ্গে যুক্ত। সামরিক দিক দিয়ে দুই দেশের মধ্যে রয়েছে শক্তিশালী সম্পর্ক। মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের এমন সম্পর্ক গত ৩০ বছরের। আর বাংলাদেশের সঙ্গে ইদানীং। প্রমাণ হলো, অতি সম্প্রতি চীনের কাছ থেকে দুটি সাবমেরিন কিনছে ঢাকা। তবে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো উভয় দেশই বেইজিংকে দেখছে একটি সৎ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে।
এখন আশা করা যায়, সব পক্ষই গত মাসের হতাশা থেকে শিক্ষা নিয়ে থাকবে। পরবর্তী উদ্যোগ হতে হবে উন্নতর পরিকল্পিত, সীমান্তের দু’পাড়ে প্রস্তুতিটা হতে হবে আরো বিস্তৃত এবং নতুন করে প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ায় শরণার্থীদের থাকতে হবে আগ্রহ। তা হতে হলে অবশ্যই সবকিছুতে জড়িত থাকতে হবে জাতিসংঘকে। সর্বোপরি মিয়ানমার জাতিসংঘের সঙ্গে তার সমঝোতা স্মারক নবায়ন করেছে।
(ল্যারি জাগান মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ। তিনি বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের আঞ্চলিক সাবেক বার্তা সম্পাদক। তার এ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক পোস্টে)
No comments