গ্যাং কালচারের ভয়াল বিস্তার: সাইবার পেট্রলিং শুরু, পুলিশ সদর দপ্তরের সতর্কতা by শুভ্র দেব
প্রতিপক্ষ
গ্রুপকে প্রকাশ্যে হুমকি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রুপের নানা তৎপরতা।
দলে নতুন সদস্য সংগ্রহ করার প্রতিযোগিতা। এলাকা নিয়ন্ত্রণের জন্য আধিপত্য
বিস্তার। মাদক ব্যবসার সিন্ডিকেট। ছিনতাই-ইভটিজিং তাদের রুটিন কাজ। পান
থেকে চুন খসলেই প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংঘাতে জড়ানো। আর খুন-খারাবির ঘটনাতো
ঘটছে অহরহ। সাম্প্রতিক সময়ে এভাবেই সারা দেশে সক্রিয় হয়ে উঠেছে কিশোর
গ্যাং। একই নীতি-স্টাইলে সারা দেশে অন্তত সহাস্রাধিক গ্যাং তৎপরতা
চালাচ্ছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নজরদারি থাকা সত্তেও তারা
বেপরোয়া। সব ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। পুলিশ
ও র্যাবের নিয়মিত ধরপাকড়েও তাদের দমানো যাচ্ছে না। এতে করে এই দুই
বাহিনীর পক্ষ থেকে সারাদেশে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ধরপাকড়ের পাশাপাশি
শুরু করা হয়েছে সাইবার পেট্রলিং।
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, কিশোর বয়সী ছেলেরা নানা অপরাধে জড়িয়ে বিপদগামী হয়ে যাচ্ছে। অভিযান চালিয়ে অনেক কিশোর অপরাধীকে সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য স্কুল-কলেজের শিক্ষক, অভিভাবকদের কাছে বার্তা পাঠানো হচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, এটা ভবিষ্যতের জন্য একটা হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আজকে যারা গ্যাং কালচার গড়ে তোলে ছোট ছোট অপরাধ করছে। তাদের বড় অপরাধের হাতেখড়ি এখানেই হচ্ছে। ছোট ছোট অপরাধ করে তারা সাহস বৃদ্ধি করছে। তাই এখনই গ্যাং কালচারকে রুখতে হবে।
র্যাব সূত্র জানিয়েছে, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বয়স চৌদ্দ থেকে বিশের কোটায়। এদের অনেকেই স্কুলের গণ্ডি পার হতে পারেনি। ইউরোপীয় কালচারের আদলে তাদের চলাফেরা। গ্রুপের বেশিরভাগ সদস্য নিত্য-নতুন মডেলের স্পোর্টস বাইক ব্যবহার করেন। মোটা সাইলেন্সরারের ভো ভো শব্দ আর বেপরোয়া গতিতে ছুটে বেড়ায়। মুলত ফেসবুক, ভাইভার, হোয়াটসঅ্যাপ এ তাদের গ্রুপ চ্যাটিং হয়। গ্রুপের নেতা বিভিন্ন নির্দেশনা চ্যাটের মাধ্যমেই জানিয়ে দেন। এমনকি অন্যান্য অপরাধের তথ্যও আদান প্রদান করা হয় এসব মাধ্যমে। তারা আড্ডা জমায় বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের যাওয়া আসার রাস্তায়। রাতের বেলা ফাঁকা রাস্তায় লুটে নেয় পথচারি-রিকশা যাত্রীদের সবকিছু। এছাড়া মাদক ব্যবসা করে যে আয় হয় তা দিয়েই তারা গ্রুপের খরচ চালায়। এসব কিশোর গ্যাংদের সাহস জোগান কথিত রাজনৈতিক বড় ভাইরা। যার কারণে অনেক সময় পুলিশ-র্যাব তাদের সম্পর্কে অবগত থাকার পরেও কিছু করার থাকে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রামে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে কিশোর অপরাধীরা। গত আট মাসে চট্টগ্রামে কিশোর অপরাধীদের হাতে খুন হয়েছেন আরো ৬ জন। গত দেড় বছরে কিশোর অপরাধের কারণে নগরের বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে অন্তত ২৫টি।
রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ের কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এতে কিশোররা প্রকাশ্যেই জড়িয়ে পড়ছে প্রাণঘাতি সংঘাত ও হানাহানিতে। ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরীর জামালখানে কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র আদনান ইসপারকে প্রকাশ্যে মাথায় গুলি করে হত্যার ঘটনার পর নগর দাপিয়ে বেড়ানো কিশোর অপরাধীদের নিয়ে নড়েচড়ে বসেছিল চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ। এ সময় পাড়ায়-পাড়ায় সক্রিয় কিশোর গ্যাংয়ের তালিকাও করা হয়েছিল। কিশোরদের আড্ডায় নিয়মিত হানা দিয়েছিল পুলিশ। পুলিশের তথ্যমতে, নগরীতে অন্তত ৩০০ কিশোর গ্যাং চিহ্নিত করা হয়েছে। যারা আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় চট্টগ্রাম নগরীতে কিশোর অপরাধীদের সন্ধানে নেমেছে র্যাব। পাশাপাশি সক্রিয় পুলিশও।
৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুরে চাইল্ড হ্যাভেন ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের দশম শ্রেনির ছাত্র মহসিনকে হত্যা করে আতঙ্ক গ্রুপের সদস্যরা। গ্রুপ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কারণে এবং এক তরুণীকে নিয়ে বিরোধের জেরে তাকে হত্যা করা হয়। ২৯ শে জুন হাজারীবাগ এলাকায় ১৫ বছর বয়সী ইয়াছিন আরফাত ও ৭ জুলাই গেণ্ডারিয়া হাইস্কুলের নবম শ্রেনীর ছাত্র শাওন খুন হয়। পরে র্যাব বংশাল, তাতীবাজার, শাঁখারীবাজার, লালবাগ, হাজারীবাগ ও সূত্রাপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের ৫৮ জনকে আটক করে। ২০১৮ সালের পহেলা মার্চ পুরাণ ঢাকার শাঁখারী বাজারের শনি মন্দিরের সামনে হলি উৎসবে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় রওনক নামের এক কিশোরকে। এ ঘটনায়ও কিশোর গ্যাংয়ের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। ২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি উত্তরার ডিসকো বয়েজ ও নাইন স্টার গ্রুপের দ্বন্ধে খুন হয় ট্রাস্ট স্কুল এন্ড কলেজের নবম শ্রেনীর ছাত্র আদনান কবির।
এদিকে রোববার ঢাকা, চাঁদপুর, নওগাঁ, গাইবান্ধা ও চুয়াডাঙ্গা জেলায় নবনিযুক্ত পুলিশ সুপারদের ব্রিফিংকালে কিশোর গ্যাং কালচার যাতে গড়ে না উঠে সেজন্য তৎপর থাকার নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। তিনি বলেছেন, গ্যাং কালচারের নামে শিশু-কিশোররা সমাজে নানা ধরণের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তাই দেশের কোথাও যেন কিশোর ‘গ্যাং কালচার’ গড়ে উঠতে না পারে সে ক্ষেত্রে জেলার পুলিশ সুপাররা তৎপর থাকতে হবে। পুলিশের সদরদপ্তরের এআইজি সোহেল রানা মানবজমিনকে বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম রোধে কাজ করছে পুলিশ। এ বিষয়ে জোড়ালো পদক্ষেপ নিতে পুলিশের সকল ইউনিটকে নির্দেশ দিয়েছেন আইজিপি। আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি এ বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যেগ নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের নামে যে সকল কিশোররা নানা অপরাধে জড়িত হচ্ছে তাদের অনেককেই ইতিমধ্যে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। যারা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের শিক্ষক শাহারিয়া আফরিন মানবজমিনকে বলেন, একটা মানুষ যত ছোট বয়সে অপরাধ শুরু করবে সে তত বড় অপরাধী হবে। আর কোনো কিশোর যদি অপরাধ করার পর তাকে শাস্তির আওতায় আনা না হয় বা পরিবার যদি জোড়ালো পদক্ষেপ না নেয় তবে ওই কিশোর আরও অপরাধ করার জন্য মোটিভেশন পায়। তিনি বলেন, একটা কিশোর বয়সী ছেলে যদি রাত ১০টা পর্যন্ত ঘরের বাইরে থাকে তবে আমরা ধরে নিতেই পারি সে কত গুরুত্বপূর্ণ কাজে এত রাত পর্যন্ত বাইরে ছিল। তাই পরিবারের সঙ্গে কিশোরদের বন্ধনটা শক্তিশালী করতে হবে। সে কতটুকু সামাজিক, ধর্মীয় কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। টিভিতে, ইউটিউবে সে কি দেখছে সেদিকে নজরদারি থাকতে হবে। এছাড়া শিশু আইন যেটি করা হয়েছে সেটার প্রয়োগ করতে হবে। আমরা ওই আইনের তেমন কোনো প্রয়োগ দেখি না। এর বাইরে কমিউনিটি পুলিশিং ও ভলান্টিয়ার ক্লাবগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। তাহলে পাড়া মহল্লায় গড়ে উঠা কিশোর গ্যাং গুলোকে শনাক্ত করা যাবে। কারণ পুলিশ বড় অপরাধীদের পেছনে দৌঁড়াবে নাকি কিশোরদের পেছনে ছুটে বেড়াবে।
সমাজবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম মানবজমিনকে বলেন, আকাশ সংস্কৃতি ও বয়সের কারণে কিশোররা গ্যাং কালচারের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে। কারণ আমাদের পর্যাপ্ত খেলাধুলা বা সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ কম। তাই কিশোর বয়সী ছেলেরা অনেক সময় অলস সময় কাটায়। তখন তারা অনলাইনে মজে যায়। আর সেখান থেকেই তারা গ্যাং কালচার আয়ত্ত করছে। যে সকল পরিবারের অভিভাবকরা ব্যস্ততার জন্য সন্তানকে ঠিকমত সময় দিচ্ছেন না। সে কি করছে, কোথায় যাচ্ছে, কাদের সঙ্গে মিশছে, তার একাডেমিক রেজাল্ট ভালো হচ্ছে না খারাপ হচ্ছে সেদিকে খেয়াল রাখছেন না ওই পরিবারের সন্তানেরা গ্যাং কালচারে সম্পৃক্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, কিশোরদের এ পথ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য মা বাবাকেই সচেতন হতে হবে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্ণেল তোফায়েল মোস্তফা সরোয়ার বলেন, আমাদের গোয়েন্দা তথ্য মতেই আমরা জানতে পেরেছি কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা। এর পরে এমন ১৮টি গ্রুপের সদস্যদের ধরে সংশোধনাগারে পাঠিয়েছি। এর পর থেকে ওইসব গ্রুপের তৎপরতা কিছুটা কমেছে। নতুন গ্রুপ তৈরি হচ্ছে না। বরং এক একটি গ্রুপের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া আমরা সাইবার নজরদারি শুরু করেছি। অনলাইনে তারা কি করছে, তাদের গতিবিধি নজরদারি করছি। তিনি বলেন, গ্যাং কালচারটা সামাজিকভাবেই মোকাবেলা করতে হবে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদেরকে ধরে সংশোধনাগারে পাঠানোর কাজ করতে পারবে।
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, কিশোর বয়সী ছেলেরা নানা অপরাধে জড়িয়ে বিপদগামী হয়ে যাচ্ছে। অভিযান চালিয়ে অনেক কিশোর অপরাধীকে সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য স্কুল-কলেজের শিক্ষক, অভিভাবকদের কাছে বার্তা পাঠানো হচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, এটা ভবিষ্যতের জন্য একটা হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আজকে যারা গ্যাং কালচার গড়ে তোলে ছোট ছোট অপরাধ করছে। তাদের বড় অপরাধের হাতেখড়ি এখানেই হচ্ছে। ছোট ছোট অপরাধ করে তারা সাহস বৃদ্ধি করছে। তাই এখনই গ্যাং কালচারকে রুখতে হবে।
র্যাব সূত্র জানিয়েছে, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বয়স চৌদ্দ থেকে বিশের কোটায়। এদের অনেকেই স্কুলের গণ্ডি পার হতে পারেনি। ইউরোপীয় কালচারের আদলে তাদের চলাফেরা। গ্রুপের বেশিরভাগ সদস্য নিত্য-নতুন মডেলের স্পোর্টস বাইক ব্যবহার করেন। মোটা সাইলেন্সরারের ভো ভো শব্দ আর বেপরোয়া গতিতে ছুটে বেড়ায়। মুলত ফেসবুক, ভাইভার, হোয়াটসঅ্যাপ এ তাদের গ্রুপ চ্যাটিং হয়। গ্রুপের নেতা বিভিন্ন নির্দেশনা চ্যাটের মাধ্যমেই জানিয়ে দেন। এমনকি অন্যান্য অপরাধের তথ্যও আদান প্রদান করা হয় এসব মাধ্যমে। তারা আড্ডা জমায় বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের যাওয়া আসার রাস্তায়। রাতের বেলা ফাঁকা রাস্তায় লুটে নেয় পথচারি-রিকশা যাত্রীদের সবকিছু। এছাড়া মাদক ব্যবসা করে যে আয় হয় তা দিয়েই তারা গ্রুপের খরচ চালায়। এসব কিশোর গ্যাংদের সাহস জোগান কথিত রাজনৈতিক বড় ভাইরা। যার কারণে অনেক সময় পুলিশ-র্যাব তাদের সম্পর্কে অবগত থাকার পরেও কিছু করার থাকে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রামে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে কিশোর অপরাধীরা। গত আট মাসে চট্টগ্রামে কিশোর অপরাধীদের হাতে খুন হয়েছেন আরো ৬ জন। গত দেড় বছরে কিশোর অপরাধের কারণে নগরের বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে অন্তত ২৫টি।
রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ের কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এতে কিশোররা প্রকাশ্যেই জড়িয়ে পড়ছে প্রাণঘাতি সংঘাত ও হানাহানিতে। ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরীর জামালখানে কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র আদনান ইসপারকে প্রকাশ্যে মাথায় গুলি করে হত্যার ঘটনার পর নগর দাপিয়ে বেড়ানো কিশোর অপরাধীদের নিয়ে নড়েচড়ে বসেছিল চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ। এ সময় পাড়ায়-পাড়ায় সক্রিয় কিশোর গ্যাংয়ের তালিকাও করা হয়েছিল। কিশোরদের আড্ডায় নিয়মিত হানা দিয়েছিল পুলিশ। পুলিশের তথ্যমতে, নগরীতে অন্তত ৩০০ কিশোর গ্যাং চিহ্নিত করা হয়েছে। যারা আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় চট্টগ্রাম নগরীতে কিশোর অপরাধীদের সন্ধানে নেমেছে র্যাব। পাশাপাশি সক্রিয় পুলিশও।
৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুরে চাইল্ড হ্যাভেন ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের দশম শ্রেনির ছাত্র মহসিনকে হত্যা করে আতঙ্ক গ্রুপের সদস্যরা। গ্রুপ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কারণে এবং এক তরুণীকে নিয়ে বিরোধের জেরে তাকে হত্যা করা হয়। ২৯ শে জুন হাজারীবাগ এলাকায় ১৫ বছর বয়সী ইয়াছিন আরফাত ও ৭ জুলাই গেণ্ডারিয়া হাইস্কুলের নবম শ্রেনীর ছাত্র শাওন খুন হয়। পরে র্যাব বংশাল, তাতীবাজার, শাঁখারীবাজার, লালবাগ, হাজারীবাগ ও সূত্রাপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের ৫৮ জনকে আটক করে। ২০১৮ সালের পহেলা মার্চ পুরাণ ঢাকার শাঁখারী বাজারের শনি মন্দিরের সামনে হলি উৎসবে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় রওনক নামের এক কিশোরকে। এ ঘটনায়ও কিশোর গ্যাংয়ের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। ২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি উত্তরার ডিসকো বয়েজ ও নাইন স্টার গ্রুপের দ্বন্ধে খুন হয় ট্রাস্ট স্কুল এন্ড কলেজের নবম শ্রেনীর ছাত্র আদনান কবির।
এদিকে রোববার ঢাকা, চাঁদপুর, নওগাঁ, গাইবান্ধা ও চুয়াডাঙ্গা জেলায় নবনিযুক্ত পুলিশ সুপারদের ব্রিফিংকালে কিশোর গ্যাং কালচার যাতে গড়ে না উঠে সেজন্য তৎপর থাকার নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। তিনি বলেছেন, গ্যাং কালচারের নামে শিশু-কিশোররা সমাজে নানা ধরণের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তাই দেশের কোথাও যেন কিশোর ‘গ্যাং কালচার’ গড়ে উঠতে না পারে সে ক্ষেত্রে জেলার পুলিশ সুপাররা তৎপর থাকতে হবে। পুলিশের সদরদপ্তরের এআইজি সোহেল রানা মানবজমিনকে বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম রোধে কাজ করছে পুলিশ। এ বিষয়ে জোড়ালো পদক্ষেপ নিতে পুলিশের সকল ইউনিটকে নির্দেশ দিয়েছেন আইজিপি। আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি এ বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যেগ নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের নামে যে সকল কিশোররা নানা অপরাধে জড়িত হচ্ছে তাদের অনেককেই ইতিমধ্যে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। যারা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের শিক্ষক শাহারিয়া আফরিন মানবজমিনকে বলেন, একটা মানুষ যত ছোট বয়সে অপরাধ শুরু করবে সে তত বড় অপরাধী হবে। আর কোনো কিশোর যদি অপরাধ করার পর তাকে শাস্তির আওতায় আনা না হয় বা পরিবার যদি জোড়ালো পদক্ষেপ না নেয় তবে ওই কিশোর আরও অপরাধ করার জন্য মোটিভেশন পায়। তিনি বলেন, একটা কিশোর বয়সী ছেলে যদি রাত ১০টা পর্যন্ত ঘরের বাইরে থাকে তবে আমরা ধরে নিতেই পারি সে কত গুরুত্বপূর্ণ কাজে এত রাত পর্যন্ত বাইরে ছিল। তাই পরিবারের সঙ্গে কিশোরদের বন্ধনটা শক্তিশালী করতে হবে। সে কতটুকু সামাজিক, ধর্মীয় কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। টিভিতে, ইউটিউবে সে কি দেখছে সেদিকে নজরদারি থাকতে হবে। এছাড়া শিশু আইন যেটি করা হয়েছে সেটার প্রয়োগ করতে হবে। আমরা ওই আইনের তেমন কোনো প্রয়োগ দেখি না। এর বাইরে কমিউনিটি পুলিশিং ও ভলান্টিয়ার ক্লাবগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। তাহলে পাড়া মহল্লায় গড়ে উঠা কিশোর গ্যাং গুলোকে শনাক্ত করা যাবে। কারণ পুলিশ বড় অপরাধীদের পেছনে দৌঁড়াবে নাকি কিশোরদের পেছনে ছুটে বেড়াবে।
সমাজবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম মানবজমিনকে বলেন, আকাশ সংস্কৃতি ও বয়সের কারণে কিশোররা গ্যাং কালচারের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে। কারণ আমাদের পর্যাপ্ত খেলাধুলা বা সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ কম। তাই কিশোর বয়সী ছেলেরা অনেক সময় অলস সময় কাটায়। তখন তারা অনলাইনে মজে যায়। আর সেখান থেকেই তারা গ্যাং কালচার আয়ত্ত করছে। যে সকল পরিবারের অভিভাবকরা ব্যস্ততার জন্য সন্তানকে ঠিকমত সময় দিচ্ছেন না। সে কি করছে, কোথায় যাচ্ছে, কাদের সঙ্গে মিশছে, তার একাডেমিক রেজাল্ট ভালো হচ্ছে না খারাপ হচ্ছে সেদিকে খেয়াল রাখছেন না ওই পরিবারের সন্তানেরা গ্যাং কালচারে সম্পৃক্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, কিশোরদের এ পথ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য মা বাবাকেই সচেতন হতে হবে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্ণেল তোফায়েল মোস্তফা সরোয়ার বলেন, আমাদের গোয়েন্দা তথ্য মতেই আমরা জানতে পেরেছি কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা। এর পরে এমন ১৮টি গ্রুপের সদস্যদের ধরে সংশোধনাগারে পাঠিয়েছি। এর পর থেকে ওইসব গ্রুপের তৎপরতা কিছুটা কমেছে। নতুন গ্রুপ তৈরি হচ্ছে না। বরং এক একটি গ্রুপের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া আমরা সাইবার নজরদারি শুরু করেছি। অনলাইনে তারা কি করছে, তাদের গতিবিধি নজরদারি করছি। তিনি বলেন, গ্যাং কালচারটা সামাজিকভাবেই মোকাবেলা করতে হবে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদেরকে ধরে সংশোধনাগারে পাঠানোর কাজ করতে পারবে।
No comments