অর্থনীতিতে ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করছে খেলাপি ঋণ
দেশের
ব্যাংকিং খাতে বড় চ্যালেঞ্জ খেলাপি ঋণ। মোট ঋণের বিপরীতে খেলাপির হার
ক্রমেই বাড়ছে। প্রতিযোগী সব দেশের চেয়ে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ বেশি। এছাড়া
প্রতিনিয়তই ব্যাংকে প্রতারণা ও জালিয়াতি বাড়ছে, যা ক্রমেই পুরো অর্থ
ব্যবস্থায় দীর্ঘ মেয়াদে মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে। শনিবার রাজধানীর
ইন্সটিটিউশন অব ডিপে্লামা ইঞ্জিনিয়ার্সে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির
দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের সমাপনী দিনের আলোচনায় এসব বিষয় উঠে আসে। সম্মেলনে
আরও বেশকিছু সমস্যা উঠে এসেছে। এগুলো হল- সুদের হার এখনও বেশি, মোবাইল
ব্যাংকিংয়ের ঝুঁকি, ব্যাংকগুলোর শেয়ারবাজারে অতিরিক্ত বিনিয়োগ, কৃষি,
স্থাস্থ্য ও শিক্ষার মতো সামাজিক খাতে ব্যাংকের বিনিয়োগ কম এবং টেকসই
বিনিয়োগের অভাব। সম্মেলনে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারের উপস্থাপিত
প্রবন্ধে যেসব বিষয় উঠে এসেছে, তার মূল কথা ব্যাংকিং খাতের ব্যাপারে সতর্ক
পদক্ষেপ নিতে হবে। এ সময় বহুল সমালোচিত ফারমার্স ব্যাংক বন্ধ করে দেয়া
উচিত বলে মত দিয়েছেন বক্তারা। বিআইবিএমের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. তেৌফিক
আহমদ চেৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিভিন্ন প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মো.
কবির হোসেন, গুলজারে নবী, নির্মল চন্দ্র ভক্ত, খান এ মতিন, রুবানা হাসান,
মো. গোলাম মাওলা, পার্থ সারতী ঘোষ ও মো. তেৌফিক হোসেন। এ সময় ব্যাংকিং
খাতের উন্নয়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও শক্তিশালী করার সুপারিশও করেন
বক্তারা। তৌফিক আহমদ বলেন, ফারমার্স ব্যাংকের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। কোনো
ব্যাংক অক্সিজেন দিয়ে বঁাচিয়ে রাখা ঠিক হবে না। বরং ব্যাংক ও আর্থিক খাতের
অনিয়ম কমিয়ে আনতে একটি ব্যাংক বন্ধ করে দেয়া হলে তা একটি উদাহরণ হয়ে
থাকবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে একবার কেউ ব্যাংকের লাইসেন্স পেলে তা বঁাচিয়ে
রাখার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু ফারমার্স ব্যাংকে যা হয়েছে, তাতে এ ব্যাংকের
অবশ্যই মরে যাওয়া উচিত। তিনি বলেন, যত কিছুই করা হোক না কেন, শক্তিশালী
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছাড়া আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। গুলজারে নবী
বলেন, ব্যাংকের অন্যতম চ্যাঞ্জেল হল খেলাপি ঋণ। প্রতিনিয়ত খেলাপি ঋণের হার
বাড়ছে, যা পুরো অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অনুষ্ঠানে যা
জানানো হয়- বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে বর্তমানে মোট ঋণের
প্রায় ১১ শতাংশ খেলাপি; কিন্তু ভারতে তা ৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ, হংকংয়ে শূন্য
দশমিক ৯ শতাংশ, চীনে ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ,
থাইল্যান্ডে ২ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং ফিলিপাইনে ১ দশমিক ৯৫ শতাংশ। অর্থাত্
প্রতিযোগী সব দেশের চেয়ে বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের অনুপাত কয়েকগুণ বেশি।
তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ সুনির্দষ্টিভাবে কয়েকটি সমস্যা সৃষ্টি করে। এর মধ্যে
ব্যাংকের আয় কমিয়ে দেয়। এছাড়াও এ ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের নিরাপত্তা সঞ্চিতি
(প্রভিশন) বেশি রাখতে হয়, যা ব্যাংকের ঋণ বিতরণ ও মুনাফার সক্ষমতা কমে।
এছাড়াও এ কারণে ঋণের সুদের হার কমানো যায় না। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ শুধু
ব্যাংকে নয়, পুরো অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে
দেশের ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৮১ শতাংশ দেয়া হয়েছে বাণিজ্যিক
খাতে। কিন্তু উত্পাদনশীল খাতে ঋণ পর্যাপ্ত নয়। অর্থনীতির স্বার্থে বিষয়টি
পুনর্বিবেচনা করা উচিত। এছাড়াও শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক খাতে
ব্যাংকগুলোর আরও বিনিয়োগ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি। বক্তারা বলেন,
সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং খাতে প্রতারণা এবং জাল-জালিয়াতি বেড়েছে। জাল নোট
বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে একটি প্রবন্ধের উপস্থাপক নির্মল চন্দ্র ভক্ত বলেন, জাল
নোটের কারণে পুরো আর্থিক খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তিনি বলেন, যদিও
জাল নোট তৈরি একেবারে নিমর্ূল করা যাবে না। কিন্তু নজরদারি এবং উন্নত
প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। বক্তারা বলেন, দেশে
শিল্প ঋণে সুদের হার বেশি। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে ঋণের সুদের হার কমেছে।
কিন্তু প্রতিযোগী দেশগুলোয় বাংলাদেশের চেয়ে সুদের হার আরও কম। ফলে
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সুদের হারের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা উচিত। অন্য
একটি প্রবন্ধের উপস্থাপক মো. তেৌফিক হোসেন বলেন, দেশের ব্যাংকগুলো
শেয়ারবাজারে বেশি বিনিয়োগ করেছে। ২০০৯ সাল থেকে এ প্রবণতা শুরু হয়। এতে
ব্যাংকগুলোর আয় বাড়ছে। এ আয়ের কারণে ব্যাংকগুলোর মূল কাজ ঋণ বিতরণের দিকে
তাদের মনোযোগ কমেছে। ব্যাংকগুলোর এ ধরনের কাজ পুরো খাতের জন্য ইতিবাচক
নয়। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, দেশে ৫৬টি ব্যাংক কাজ করছে। এসব ব্যাংকের মোট
শাখা ৯ হাজার ৪৫৩টি। আর মোট আমানত ৮ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা এবং সম্পদের
পরিমাণ ১২ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসরকারি ৩৯ ব্যাংকের আমানত ৫
লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা এবং সরকারি ৬ বাণিজ্যিক ব্যাংকের আমানত ২ লাখ ৪৪
হাজার কোটি টাকা।
No comments