ফোনের মধ্যে ডুবে থেকো না
কাল
বড়দিন। খ্রিষ্টীয় ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব। কিছুদিন আগে বাংলাদেশে
এসেছিলেন ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস। ২ ডিসেম্বর
নটর ডেম কলেজে তরুণদের উদ্দেশে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন তিনি। আজ সেটিরই
অংশবিশেষ ছাপা হলো। প্রিয় তরুণ বন্ধুরা, শুভসন্ধ্যা। অবশেষে আজ এখানে আমরা
এক হয়েছি। তোমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনার জন্য কৃতজ্ঞতা। বিশপ জের্ভাস রোজারিও,
উপাসনা ও অ্যান্থনিকে ধন্যবাদ তাঁদের হৃদয়গ্রাহী বক্তব্যের জন্য। তরুণদের
একটা বিশেষত্ব হলো, তোমরা উদ্যমে পরিপূর্ণ। তরুণদের সান্নিধ্যে এলে আমিও
যেন তরুণ হয়ে যাই। উপাসনা তাঁর বক্তব্যে বলছিল, তোমরা সবাই ভীষণ উদ্যমী।
তোমাদের দেখে আমি সেটা অনুভব করতে পারছি। তারুণ্যে ভরপুর এই উদ্যম আছে বলেই
তোমরা দুঃসাহসী। তোমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাই তরুণদের
‘নির্ভীক’ বলেছেন, বলেছেন তরুণেরাই অন্ধকারের গর্ভ থেকে আলো ছিনিয়ে আনে।
ঝুঁকির পরোয়া না করে তরুণেরা সব সময় সামনে এগোতে প্রস্তুত। সময়টা অনুকূলে
থাক বা না থাক, তোমাদের এগিয়ে চলার এই যে উদ্যম; এটাকে আমি ভীষণ উৎসাহিত
করি। এগিয়ে যাও। বিশেষ করে তখন, যখন সমস্যা আর বিষাদ তোমাকে আঁকড়ে ধরে, যখন
হতাশ হয়ে তুমি ভাবো যে ঈশ্বর তোমার সঙ্গে নেই। তবে এগোনোর সময় ঠিক পথে
যাচ্ছ কি না, সেদিকে লক্ষ রেখো। অর্থাৎ, জীবনের পথে তোমার এই ভ্রমণ যেন
স্রেফ ‘লক্ষ্যহীন ঘোরাফেরা’ হয়ে না যায়। আমাদের জীবন উদ্দেশ্যহীন নয়, ঈশ্বর
প্রত্যেকের জীবনের একটা উদ্দেশ্য ঠিক করে দিয়েছেন। তিনিই অনুগ্রহ করে
আমাদের পথ দেখান। ঈশ্বর যেন আমাদের সবার মধ্যে একটা কম্পিউটার সফটওয়্যার
বসিয়ে দিয়েছেন। এই সফটওয়্যারের কাজ হলো স্বাধীনভাবে ঈশ্বরের দেখানো পথ
অনুসরণ করা। কিন্তু আর দশটা সফটওয়্যারের মতো এই সফটওয়্যারও সব সময় ‘আপডেট’
করতে হয়। ঈশ্বরের দেওয়া দিকনির্দেশনা অনুযায়ী নিজেদের প্রোগ্রামটা আপডেট
রাখাই হলো চ্যালেঞ্জ। অ্যান্থনি, তোমার বক্তব্যে এই চ্যালেঞ্জের কথা তুমি
বলেছ। বলেছ, এই ভঙ্গুর পৃথিবীতে আমরা কেবল জ্ঞানের জন্য কাতর। ‘জ্ঞান’
শব্দটা ব্যবহার করেই তুমি আসলে আমাদের পথ বাতলে দিয়েছ। যা আমাদের সঠিক পথে
পরিচালিত করে, তা হলো জ্ঞান। জ্ঞানের জন্ম বিশ্বাস থেকে। এটা পৃথিবীর তৈরি
করা মিথ্যা জ্ঞান নয়। এটা সেই জ্ঞান, যা আমরা আমাদের পিতা-মাতা, পিতামহের
চোখে দেখে এসেছি; যাঁরা ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস রেখেছিলেন। আমরা যদি ঈশ্বরের
চোখে দেখি, তাঁর কানে শুনি, তাঁর মতো হৃদয় দিয়ে ভালোবাসি, তাঁর মতো করে
বিবেচনা করি, তবেই আমরা সেই জ্ঞানের অধিকারী হব। সুখের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি
যেন আমাদের পথ ভুলিয়ে না দেয়, সে জন্যই জ্ঞানের প্রয়োজন।
মিথ্যা সুখের
সংস্কৃতি মানুষকে স্বার্থপর করে, হৃদয় ভরিয়ে দেয় অন্ধকার আর তিক্ততায়।
ঈশ্বরের দেখানো পথ আমাদের বলে দেয়, কী করে ভিন্ন চিন্তাধারার মানুষকে
স্বাগত জানাতে হয়। আমরা শুধু নিজের ছোট্ট পৃথিবীর মধ্যেই বন্দী থাকতে চাই,
অন্তর্মুখী হয়ে যাই, এটা খুব দুঃখজনক। আমাদের নীতি হলো, হয় আমার পথে আসো,
নয়তো দূর হও। এই নীতি অনুসরণ করতে গিয়েই আমরা ফাঁদে পা দিই, নিজের মধ্যে
আটকা পড়ে যাই। যখন একটা সমাজের মানুষ নিজেদের গণ্ডির মধ্যে বাঁধা পড়ে যায়,
তখন তারা আর সেরা হতে পারে না। ‘আমি ভালো আর তুমি মন্দ’—এই বিশ্বাস তাঁদের
পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ক্যাথলিকদের পাশাপাশি আজ এখানে মুসলিম ও অন্যান্য
ধর্মের তরুণ বন্ধুদের পেয়ে আমি ভীষণ আনন্দিত। আজ এখানে এক হয়ে তোমরা প্রমাণ
করেছ, ধর্মীয় বিভেদ ভুলে তোমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে চাও। তোমাদের দেখে
আমার একটা অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ছে। বুয়েনস এইরেসের খুব দরিদ্র এলাকায় একটা
নতুন গির্জা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের একটা দল সেখানে গির্জার ঘর নির্মাণের কাজ
করছে। আমি সেখানে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। গির্জার যাজক আমাকে একে একে সবার
সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘এই ছেলেটা স্থপতি, সে একজন
ইহুদি। ও কমিউনিস্ট। এই ছেলেটা ক্যাথলিক...।’ তাদের মধ্যে পার্থক্য আছে,
কিন্তু একটা ভালো কিছুর জন্য সবাই একসঙ্গে কাজ করছে। সামাজিক বন্ধুতাকে
তারা স্বাগত জানিয়েছে। কোনো কিছুই যেন তাদের এই বন্ধুত্বের মধ্যে বিভেদ
গড়তে না পারে, এ ব্যাপারে তারা খুব সচেতন। ঈশ্বরের দেখানো পথই বলে দেয়,
কীভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে গিয়ে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে ভালো কিছু
খুঁজে পাওয়া যায়। তোমার সংস্কৃতি তোমাকে বড়দের শ্রদ্ধা করতে শেখায়। প্রজন্ম
থেকে প্রজন্মে আমরা যে বিশ্বাস বহন করছি, সমাজের প্রবীণেরাই সেটা রক্ষা
করেন। তাঁদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান কাজে লাগিয়ে আমরা সচেতন থাকি, যেন অতীতের
ভুলের পুনরাবৃত্তি না হয়। প্রবীণেরা অতীত আর বর্তমানের মধ্যে একটা চমৎকার
সেতু গড়ে দেন, যেন সমাজের মূল্যবোধগুলো তাঁদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের মধ্য
দিয়ে বেঁচে থাকে। তাঁদের কথায়, ভালোবাসায়, স্নেহে, উপস্থিতিতে আমরা বুঝতি
পারি, ইতিহাস আমাকে দিয়ে শুরু হয়নি। যে যাত্রা বহুকাল আগে শুরু হয়েছে,
সেখানে আমি এক নতুন পথিক মাত্র। বাস্তবতা আমার দেখা পৃথিবীটার চেয়েও অনেক
বড়। মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানির সঙ্গে কথা বলো। চারদিকের পৃথিবীটাকে
উপেক্ষা করে সারা দিন ফোনের মধ্যে ডুবে থেকো না! উপাসনা ও অ্যান্থনি, আশার
কথা বলে তোমরা তোমাদের বক্তব্য শেষ করেছ। ঈশ্বরের জ্ঞান আমাদের মনে আশা
জাগায়, ভবিষ্যতের মুখোমুখি হওয়ার শক্তি জোগায়। প্রার্থনায় বসে আমাদের যখন
যিশুর সঙ্গে দেখা হয়, আমরা খ্রিষ্টানরা তখনই এই জ্ঞান খুঁজে পাই। দরিদ্রের
মধ্যে, অসুস্থের মধ্যে, ব্যথিতের মধ্যে, বঞ্চিতদের মধ্যে আমরা যিশুর খোঁজ
পাই। আর যিশুর মাধ্যমেই আমরা জানতে পারি, ঈশ্বর আমাদের সঙ্গে আছেন। প্রিয়
তরুণ বন্ধুরা, তোমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনটা আশা আর আনন্দে ভরে ওঠে।
এই আশা-আনন্দ তোমাদের জন্য, তোমাদের দেশের জন্য, গির্জা আর এই সম্প্রদায়ের
জন্য। প্রার্থনা করি, ঈশ্বরের দেখানো পথ তোমাদের আরও ভালোবাসতে,
ভ্রাতৃত্ববোধে একাত্ম হতে আর ভালো কিছু করতে অনুপ্রাণিত করুক। যেহেতু আজ
আমি তোমাদের দেশ ছেড়ে যাচ্ছি, যাওয়ার আগে নিশ্চিত করে যাই, আমার প্রার্থনা
তোমাদের সঙ্গে থাকবে। যেন তোমরা ঈশ্বর আর প্রতিবেশীদের ভালোবাসায় বেড়ে ওঠো।
আমার জন্য প্রার্থনা করতে ভুলো না। ঈশ্বর বাংলাদেশকে আশীর্বাদ করুন!
No comments