নীড় ছোট, আকাশও কি ছোট্ট হচ্ছে?
বাউল
সুফি মরমিবাদের পুণ্যভূমি কুষ্টিয়ার কোনো এক গ্রামে নারীদের কৃষিক্ষেত্রে
যাওয়া নিষিদ্ধ করে পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। এই নিষেধাজ্ঞা প্রচার করা
হয়েছিল মসজিদের মাইকে। সঙ্গে সঙ্গে খবরটি সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে না পড়লে এবং
এটা নিয়ে শোরগোল না হলে নারীদের মাঠে যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞাটি হয়তো পাকাপোক্ত
হয়ে যেত। এখন যে সেটা পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে গেছে, এ নিয়ে নারীদের মনে যে
এখন আর কোনো শঙ্কা বা অস্বস্তি নেই, তা হলফ করে বলা যাচ্ছে কি? পুলিশ
পাঠিয়ে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়ে পরিস্থিতি ‘আয়ত্তে’ আনা হয়েছে। কিন্তু
নারীরা কি সেখানে স্বস্তিতে আছেন? যাচ্ছেন কি তারা মাঠঘাটে যখন তাঁদের
দরকার পড়ে? কী হবে রিমান্ডের ডিমান্ড ফুরিয়ে গেলে? জামিন পেয়ে তাঁরা বের
হয়ে এলে? অথবা আবার মাইকের দখল ফিরে পেলে? আমাদের কোনো ধারণা নেই। পুলিশ,
জেল, রিমান্ড দিয়ে কোনো কিছু প্রতিষ্ঠা করা যায় কি? সতীদাহ বন্ধে পুলিশের
মরিয়া তৎপরতা কিছুই করতে পারেনি। পেরেছিল শিক্ষা আর মনোভাবের পরিবর্তন।
মনের জমিতে পরিবর্তনের গাছ লাগাতে না পারলে সেই গাছে সার, পানি ও
আলো-বাতাসের নিয়মিত জোগান দিতে পারলে আগাছা গজাবে আর আগাছাই খেয়ে ফেলবে আসল
গাছটা। সেটাই ঘটে চলেছে একের পর এক—সভ্যতা, প্রগতি এসবই চর্চার বিষয়।
এগুলো রাতারাতি হাসিল করা যায় না। অনেকটা বাগান করার মতো। নিয়মিত হতে হয়।
আগাছা সাফ করতে হয়। না হলে বাগান বিরান হয়। পঞ্চদশ শতকে দক্ষিণ মুম্বাইয়ের
ওরলি উপকূলে সাগরের একটু ভেতরে তৈরি করা হয়েছিল হাজি আলীর দরগাহ। সুফি
মতবাদে বিশ্বাসী হাজি আলীর দরগাহে নারী-পুরুষ, হিন্দু-অহিন্দু সবাই আসতেন।
তাসখন্দের বুখারা থেকে ভারতে আসা এই উদারমনা আলেম নারী-পুরুষের ভেদাভেদ
নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। সব মানুষকেই তিনি আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা
হিসেবে বিবেচনা করতেন। তাঁদের দর্শন দিতেন, কথা শুনতেন। তাঁর মৃত্যুর পরও
তাঁর মাজার জিয়ারতে হাজার হাজার নারী-পুরুষের ভিড় লেগেই থাকত। শত শত বছর
ধরে সেটা চলছিল।
হঠাৎ ২০১২ সালে আগাছা মহিরুহে পরিণত হয়ে নারীদের
প্রবেশাধিকার কেড়ে নেয়। দরগাহের ট্রাস্টিরা একমত হয়ে এলান জারি করেন—নারীরা
আর দরগাহে প্রবেশ করতে পারবেন না। নারীরা প্রতিবাদ করেন এই
ফতোয়ার—চিত্কার-চেঁচামেচি, মানববন্ধন, হরতাল, পিকেটিং না করে তাঁরা আদালতের
আশ্রয় চান। ছোট কোর্ট, মাঝারি কোর্ট হয়ে উঁচু কোর্টে যেতে যেতে প্রায় চার
বছর পার হয়ে যায়। নারীদের জয় হয়—জয় হয় সত্যের আর অধিকারের। যে সম-অধিকারের
চর্চা ছিল মোগল আমলে ব্রিটিশদের সময় ব্রিটিশমুক্ত ভারতে ষাট-পঁয়ষট্টি বছর
পর্যন্ত, সেখানে হঠাৎ কী ঘটল যে নারীদের জন্য দরজা বন্ধের মতো একটা
অধার্মিক ও অগণতান্ত্রিক কাজ করতে হলো? উত্তর একটাই, আগাছা বাড়তে দেওয়া
হয়েছে। ধরেই নেওয়া হয়েছিল, যেমন চলছে তেমন চলবে, কিন্তু ‘তোমাকে বধিবে যে
গোকুলে বাড়িছে সে’, সেটা বেমালুম ভুলে যাওয়ার ফল যা হওয়ার তা–ই হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যেও হাত পড়েছে। কিশোরগঞ্জের তাড়াইলের ভাস্কর্যে তিন
মুক্তিযোদ্ধার একজন ছিলেন নারী। এখন সেখানে থাকবে তিনজন পুরুষ
মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্য। জানা যায় (বাংলা ট্রিবিউন, ১৭/১২/২০১৭) কতিপয়
ধর্মান্ধ ব্যক্তির চাপে প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের হর্তাকর্তারা এই
সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে যাওয়া নারীর অবয়বকে এখন পুরুষ
বানানো হচ্ছে। এটা নাকি একটা সমঝোতার অংশ—সমঝোতায় না গেলে নাকি পুরো
ভাস্কর্যটাই হাপিশ করে দিত। কমপক্ষে নারীকে বিসর্জন না দিলে নাকি কিছুই
ঠেকানো যেত না। কতখানি ইজ্জতহীন ‘কাপুরুষ’ হলে এ রকমের একটা সমঝোতায় যেতে
পারে কেউ? মহিলা পরিষদসহ দেশের আর কিশোরগঞ্জের নেতৃস্থানীয় নারীরা এখন চুপ
কেন?
কেন নারী-পুরুষনির্বিশেষে আমরা সোচ্চার হচ্ছি না? এর মধ্যেই খবর এসেছে
সিলেট থেকে, নারীদের জন্য তৈরি গণশৌচাগার নাকি মাদ্রাসারছাত্ররা ভেঙে
দিয়েছে। মেয়র হাওয়া বুঝে আগেই মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেনদরবার করে
তাদের সম্মতি নিয়েছিলেন। কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়া এই সম্মতি মেলেনি। মেয়র
মাদ্রাসার ছাত্রদের ব্যবহারের জন্য অজুখানা নির্মাণের দাবি কবুল করেছিলেন,
তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। ছাত্রদের আপত্তি কি শৌচাগার নিয়ে, না নারীদের জন্য
নির্দিষ্ট শৌচাগার নির্মাণ নিয়ে। তারা নাকি বলেছে, এই নির্মাণে সিভিল
সার্জনের (শৌচাগারটি সিভিল সার্জনের অফিসের পাশে) অনুমতি নেই। তাই তারা
ভেঙে দিয়েছে। (প্রথম আলো, ১৮/১২/২০১৭)। শৌচাগার নির্মাণে বাধা দেওয়ার জন্য
সিভিল সার্জন মহোদয়ের পক্ষে কাজ করার জন্য মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের কবে
থেকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে? পুলিশের সামনেই এই ভাঙচুর চলেছে। ওসি বলেছেন,
পুলিশ শিক্ষার্থীদের শান্ত করেছে। নিশ্চয়ই তার কথা ঠিক। শৌচাগার ভেঙেচুরে
তারা শান্ত হয়েছে। এটা নিশ্চিত, এই পরিস্থিতিতে সরকারের বাইরের দলের মেয়রের
পাশে কেউ দাঁড়াবেন না। বরং তাঁকে আরও কোণঠাসা করার এই মোহনীয় সুযোগ নিতে
সবাই লাফিয়ে পড়বেন। মাঝখান থেকে হারিয়ে যাবে পথিক নারীদের জন্য একান্ত
প্রয়োজনীয় একটি মানবিক উদ্যোগ। খেটে খাওয়া নারীদের কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজের
বাধা, ভাস্কর্য থেকে নারীমূর্তি বাদ দেওয়া আর নারীদের শৌচাগার ভেঙে দেওয়া
কিংবা হাজি আলীর দরগাহের কপাট নারীদের জন্য বন্ধ করে দেওয়ার পাঁয়তারা—এগুলো
কি সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা, নাকি কোনো এক সুচিন্তিত আর সুগঠিত চিন্তার ফলাফল?
নারীর জন্য জায়গা আমরা যত সংকুচিত করব, দেশ-সমাজ ততই সংকুচিত হবে। ছোট মন
নিয়ে বড় কাজ করা সম্ভব কি? গওহার নঈম ওয়ারা: ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
কর্মী। শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments