একাত্তর: আগে-পরে, ৫- সেফ হাউজে রক্ত, মগজের চিহ্ন দেখে অসাড় হয়ে গিয়েছিলাম by কাজল ঘোষ
বাকশালে
যোগ না দেয়ায় খুনি মোশ্তাক বসকে (বঙ্গবন্ধুকে) বলেছিল, তোমার আসকারাতেই
নূরে আলম সিদ্দিকীর এতটা স্পর্ধা হয়েছে। তিনি এই উস্কানিতে প্রচণ্ডভাবে
ক্রোধান্বিত হয়ে বলেছিলেন, ‘ওকে আমি কিমা বানিয়ে কেও (কাক) দিয়ে খাইয়ে
দেবো। ও ভেবেছেটা কী?’ যদিও ওটা ছিল কথার কথা। তবে পরিবর্তিত রাজনৈতিক
পরিস্থিতিতে বন্ধু, শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শে অনেকদিন আত্মগোপনে ছিলাম।
পঁচাত্তরের নভেম্বরে গ্রেপ্তার হলে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর পূর্বে
আমাকে অনেকদিন সেফ হাউজে রাখা হয়। বাকশালে যোগ না দেয়া, বাকশাল গঠন ও এর
ব্যর্থতার নানা আদ্যোপান্ত মানবজমিনকে দেয়া ধারাবাহিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন নূরে আলম সিদ্দিকী।
আজ পড়ুন পঞ্চম কিস্তি-
প্রশ্ন: কোন প্রেক্ষাপটে বাকশাল গঠিত হয়েছিল?
বাকশালের মূল প্রতিপাদ্য ছিল রাশিয়ার প্রচলিত সমাজতান্ত্রিক ধারা। আসলে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিপ্লব একটি অনিবার্য শর্ত। সেই বিপ্লব ঘটানোর জন্য সমাজতান্ত্রিক আদর্শে ক্যাডার তৈরি করা হয়। অন্তত তাত্ত্বিকভাবে বলা হয়েছে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারা রাষ্ট্র কায়েম করা। যে রাষ্ট্রের কোনো ক্ষেত্রেই ব্যক্তি মালিকানা থাকবে না। কিন্তু ব্যক্তি মালিকানা ছাড়া সম্পদের বিকাশ সম্ভব নয় বলে পাশ্চাত্য ধারণার যে প্রচারটি করা হয়, অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরও সেটি বাস্তবসম্মত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তখন থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে মুখে যে যা-ই বুলি আওড়ান না কেন প্রকৃত অর্থে সর্বহারা মানসিকতার কোনো ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আজ পর্যন্ত আমার পরিচয় হয়নি। আমি দীর্ঘ সময় কারাগারে অবস্থানকালে এ দেশের প্রতিথযশা সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিত্বদের দেখা পেয়েছি। বিস্তর আলোচনারও সুযোগ হয়েছে। তারা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্রতী বলে আত্মতুষ্টি লাভ করলেও ব্যক্তিজীবন বাস্তবে সেটার ধারে-কাছে ছিল না। তাদের তরুণ নেতৃত্বের মধ্যে পালটি খাওয়ার দৃষ্টান্ত সবচাইতে বেশি। জাতীয়করণের মধ্যে সমাজতন্ত্রের উদ্যোগ নেয়ার প্রচেষ্টা শুধু অর্থনীতিকেই লণ্ডভণ্ড করলো না রাজনীতির মধ্যে একটা চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি করলো। শিল্প-কারখানা জাতীয়করণ করে ওই কারখানার ম্যানেজার বা ব্যবস্থাপক অথবা মহাব্যবস্থাপক রাতারাতি কারখানার মালিক বনে গেলেন এবং লাগামহীনভাবে দুর্নীতি শুরু করলেন। আমাদেরই এক বড় ভাই আবদুল আউয়াল। তিনি আদমজীর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি গুদামে তালা দেয়ার জন্য তখনকার সময় পঁচাত্তর লাখ টাকা (তখন গুলশানে জমির দাম এক লাখ) তালা ক্রয়ের ভাউচার তৈরি করেন। আমি উনাকে কোনো একটি নৈশভোজে জিজ্ঞাসা করেছিলাম পঁচাত্তর লাখ টাকার তালা কিনলেন কোথা থেকে আউয়াল ভাই? এতো তালা পেলেন কোথায়? ওনি নিরুত্তর ছিলেন। ফলে যা হওয়ার তাই হলো। লুটপাটের লীলাক্ষেত্র কল-কারখানাগুলো মুখ থুবড়ে পড়লো। অতি বিপ্লবীদের অপতৎপরতা, নির্বিচারে হত্যা, লুণ্ঠন বাকশাল সৃষ্টির পেছনে এটিও ছিল অন্যতম কারণ।
প্রশ্ন: বাকশাল ব্যর্থ হয়েছিল কেন? আর আপনিইবা পদত্যাগ করেছিলেন কেন?
বাকশালের ব্যর্থতার মূল কারণ হিসেবে মনে করি সমাজতন্ত্রকে সমাজে চাপিয়ে দেয়া অদূরদর্শিতা। এর সঙ্গে দুর্নীতি, দুর্বিচার, স্বজনপ্রীতি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যর্থতায় বাকশাল সামনের দিকে এগুতে তো পারেনি বরং মুখ থুবড়ে পড়েছিল ভেতরে ভেতরে। আমি বাকশালের বিরোধিতা করেছিলাম, সংসদ থেকেও পদত্যাগ করেছিলাম। কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করিনি। সিদ্ধান্তটি আমার সাহসী ছিল। কিন্তু কতখানি নির্ভুল ছিল সেটা ইতিহাসের ওপর ছেড়ে দিলাম। সেখান থেকেই আমার জীবনে রাজনৈতিক আলো নিষ্প্রভ হতে শুরু করে। আজকে আমি স্বক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে সরে আসা ঐতিহ্যনির্ভর এক ব্যক্তি।
আমি বাকশাল সৃষ্টির আগেই সংসদ থেকে পদত্যাগ করি এবং কোনো অবস্থাতেই বাকশালের ফরম পূরণ করিনি। অথচ আইন করা হয়েছিল বাকশালের ওই ফরমটি নির্ধারিত সময়ে পূরণ করা না হলে কারো কোনো রাজনৈতিক পদপদবি থাকবে না- এমনকি সরকারি কর্মচারী-শিক্ষক সর্বস্তরের মানুষ যেকোনো রকমের সরকারি কাজে সংশ্লিষ্টতা থাকলে তার পদচ্যুতি ঘটবে। আমার খারাপ লাগে এটা ভেবে শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক কোনো ক্ষেত্রেই প্রতিরোধ তো দূর থাক উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদটুকু হয়নি। ১৯৭৫ সালের ৭ই জুন বাকশালে যোগদানে একটি আনুষ্ঠানিক দিবস হিসেবে কর্মসূচি ঘোষণা করা হলে প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে সমগ্র বুদ্ধিজীবী মানুষ মাথায় মাথাল দিয়ে; কাঁধে লাঙল নিয়ে; কেউ কাস্তে কোদাল হাতে মিছিল করে বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে অভিবাদন জানিয়ে যাচ্ছিলেন তার কৃত্রিম স্বতঃস্ফূর্ততা আমাকে বিস্মিত করেছে, বেদনাহত করেছে। কাজল, আমি তখন অনেকটাই আত্মগোপনে। আমার সুহৃদরা বাকশালে পদত্যাগের মুহূর্ত থেকেই আমাকে পরামর্শ দিতেন, আপনাকে হত্যা করে ওরাই আমার জন্য শোক মিছিল বের করবে। আমার স্মৃতিতে এখনও উজ্জ্বল খুনি মোশতাক বসকে (বঙ্গবন্ধুকে) বলেছিল, তোমার আসকারাতেই নূরে আলম সিদ্দিকীর এতটা স্পর্ধা হয়েছে। তিনি এই উসকানিতে প্রচণ্ডভাবে ক্রোধান্বিত হয়ে বলেছিলেন, ‘ওকে আমি কিমা বানিয়ে কেও (কাক) দিয়ে খাইয়ে দেবো। ও ভেবেছেটা কি?’ ওটা ছিল নিত্যান্ত কথার কথা। আমার প্রতি তার স্নেহকাতরতার কারণে নিহত হওয়া তো দূরে থাক তার জীবিত অবস্থায় আমাকে গ্রেপ্তারও হতে হয়নি। যদিও আমি আত্মগোপনে ছিলাম। কিন্তু সরকার বেপরোয়া হলে আমাকে গ্রেপ্তার করা দুঃসাধ্য ছিল না। ৯ই নভেম্বর, ১৯৭৫ সালে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় আমি গ্রেপ্তার হই। জেনারেল ওসমানীর সদয় হস্তক্ষেপে এবং মরহুম জিয়াউর রহমানের আমার প্রতি সম্মান ও সহানভূতির কারণে আমি প্রাণে বেঁচে যাই। কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর আগে আমাকে অনেক দিন সেনা ছাউনিতে অবরুদ্ধ রাখা হয়। প্রথমে যখন সেফ হাউজে আমাকে রাখা হয় তখন আমার নামটি নাকি হত্যা তালিকায় ছিল। তখন গোটা ক্যান্টনমেন্টজুড়ে বিশেষ করে সেফ হাউজে আমাকে যেখানে আটকে রাখা হয়েছিল সেখানে হত্যা করা শবদেহের রক্ত, মগজের চিহ্ন স্বচক্ষে দেখেছি। সেই দৃশ্য দেখে আমি অসাড় হয়ে গিয়েছিলাম। আজও ভাবি আমি আজরাইয়েল কোন চেহারা থাকলে তা বর্ণনা করতে পারতাম। প্রায় দুই মাসের মতো আমার সেনাছাউনিতে বন্দিজীবনের মধ্যে দু-তিন রাত সেফ হাউজে জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি এক বিভীষিকাময় সময় আমাকে পার করতে হয়েছে।
প্রশ্ন: বাকশাল থেকে সরে আসা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কি কথা হয়েছিল আপনার?
শেখ ফজলুল হক মনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। আমি তার ভীষণ বিশ্বস্ত ছিলাম। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় মনি ভাই গোপনে যোগাযোগ করে তার গাড়িতে করে আমাকে বঙ্গবন্ধুর বাসায় নিয়ে যান। আমি কিছুটা ভয়, কিছুটা সংশয় চিত্ত নিয়ে তার সামনে গেলে আবার নতুন করে উপলব্ধি করলাম এই মহান হৃদয়ের ব্যক্তিটিকে। তিনি তিন তলার ছাদে যেখানে বাকশাল গঠনের বিরোধিতার আগে আমার নিত্য আসা-যাওয়া ছিল সেখানেই একটি সোফায় বসা ছিলেন। আমাকে দেখে তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ‘কী ব্যাপার, কার বুদ্ধিতে চলো, আমি ছাড়া অন্য কাউকে নেতা মানতে শুরু করছো নাকি?’ আমি বললাম, ‘কেন বস’? মুজিব ভাই বললেন, আমার সঙ্গে আলাপ না করে এত বাহাদুরি দেখাতে গেলে কেন? প্রত্যুত্তরে আমি সবিনয়ে বলেছিলাম, সংসদীয় দলের সভায় তো আমি এর বিরোধিতা করেছি। গণতন্ত্রে নিখাদ বিশ্বাস করি বলেই আমি বাকশালের বিরোধিতায় সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছি। উনি বললেন, ‘এখন কী করবে?’ আমি উত্তরে বলেছিলাম, এখন হৃদয়টা ভারাক্রান্ত। উনি বললেন, ‘যাও, গোপালগঞ্জে আমার বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত কলেজটিতে তোমাকে প্রিন্সিপাল বানিয়ে দিবো।’ আমি প্রতি উত্তরে বলেছিলাম, ‘হৃদয়টা; মনটা খুব ভারাক্রান্ত। মনটা একটু শান্ত হলে আপনার এ আদেশ মেনে নেবো।’ এরপর বেশ ক’বার নেতার সঙ্গে দেখা হয়েছে। আমার আত্মগোপনের বিষয়টি তার কাছে গোপন রেখেছিলাম। আমার প্রতি তার আপত্য স্নেহের ঘাটতি কখনও দেখিনি। অদ্ভুত উদারচিত্তের মানুষ ছিলেন বস। আজকের দিনের গুম-খুনের রাজনীতির দিকে তাকালে মনে হয় শুধু আমি কেন শত অপরাধ করেও মুজিব ভাইয়ের সামনে কেউ গেলে তার প্রচণ্ড ক্রোধ কর্পূরের মতো কোথায় যেন উবে যেতো।
আজ পড়ুন পঞ্চম কিস্তি-
প্রশ্ন: কোন প্রেক্ষাপটে বাকশাল গঠিত হয়েছিল?
বাকশালের মূল প্রতিপাদ্য ছিল রাশিয়ার প্রচলিত সমাজতান্ত্রিক ধারা। আসলে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিপ্লব একটি অনিবার্য শর্ত। সেই বিপ্লব ঘটানোর জন্য সমাজতান্ত্রিক আদর্শে ক্যাডার তৈরি করা হয়। অন্তত তাত্ত্বিকভাবে বলা হয়েছে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারা রাষ্ট্র কায়েম করা। যে রাষ্ট্রের কোনো ক্ষেত্রেই ব্যক্তি মালিকানা থাকবে না। কিন্তু ব্যক্তি মালিকানা ছাড়া সম্পদের বিকাশ সম্ভব নয় বলে পাশ্চাত্য ধারণার যে প্রচারটি করা হয়, অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরও সেটি বাস্তবসম্মত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তখন থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে মুখে যে যা-ই বুলি আওড়ান না কেন প্রকৃত অর্থে সর্বহারা মানসিকতার কোনো ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আজ পর্যন্ত আমার পরিচয় হয়নি। আমি দীর্ঘ সময় কারাগারে অবস্থানকালে এ দেশের প্রতিথযশা সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিত্বদের দেখা পেয়েছি। বিস্তর আলোচনারও সুযোগ হয়েছে। তারা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্রতী বলে আত্মতুষ্টি লাভ করলেও ব্যক্তিজীবন বাস্তবে সেটার ধারে-কাছে ছিল না। তাদের তরুণ নেতৃত্বের মধ্যে পালটি খাওয়ার দৃষ্টান্ত সবচাইতে বেশি। জাতীয়করণের মধ্যে সমাজতন্ত্রের উদ্যোগ নেয়ার প্রচেষ্টা শুধু অর্থনীতিকেই লণ্ডভণ্ড করলো না রাজনীতির মধ্যে একটা চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি করলো। শিল্প-কারখানা জাতীয়করণ করে ওই কারখানার ম্যানেজার বা ব্যবস্থাপক অথবা মহাব্যবস্থাপক রাতারাতি কারখানার মালিক বনে গেলেন এবং লাগামহীনভাবে দুর্নীতি শুরু করলেন। আমাদেরই এক বড় ভাই আবদুল আউয়াল। তিনি আদমজীর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি গুদামে তালা দেয়ার জন্য তখনকার সময় পঁচাত্তর লাখ টাকা (তখন গুলশানে জমির দাম এক লাখ) তালা ক্রয়ের ভাউচার তৈরি করেন। আমি উনাকে কোনো একটি নৈশভোজে জিজ্ঞাসা করেছিলাম পঁচাত্তর লাখ টাকার তালা কিনলেন কোথা থেকে আউয়াল ভাই? এতো তালা পেলেন কোথায়? ওনি নিরুত্তর ছিলেন। ফলে যা হওয়ার তাই হলো। লুটপাটের লীলাক্ষেত্র কল-কারখানাগুলো মুখ থুবড়ে পড়লো। অতি বিপ্লবীদের অপতৎপরতা, নির্বিচারে হত্যা, লুণ্ঠন বাকশাল সৃষ্টির পেছনে এটিও ছিল অন্যতম কারণ।
প্রশ্ন: বাকশাল ব্যর্থ হয়েছিল কেন? আর আপনিইবা পদত্যাগ করেছিলেন কেন?
বাকশালের ব্যর্থতার মূল কারণ হিসেবে মনে করি সমাজতন্ত্রকে সমাজে চাপিয়ে দেয়া অদূরদর্শিতা। এর সঙ্গে দুর্নীতি, দুর্বিচার, স্বজনপ্রীতি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যর্থতায় বাকশাল সামনের দিকে এগুতে তো পারেনি বরং মুখ থুবড়ে পড়েছিল ভেতরে ভেতরে। আমি বাকশালের বিরোধিতা করেছিলাম, সংসদ থেকেও পদত্যাগ করেছিলাম। কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করিনি। সিদ্ধান্তটি আমার সাহসী ছিল। কিন্তু কতখানি নির্ভুল ছিল সেটা ইতিহাসের ওপর ছেড়ে দিলাম। সেখান থেকেই আমার জীবনে রাজনৈতিক আলো নিষ্প্রভ হতে শুরু করে। আজকে আমি স্বক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে সরে আসা ঐতিহ্যনির্ভর এক ব্যক্তি।
আমি বাকশাল সৃষ্টির আগেই সংসদ থেকে পদত্যাগ করি এবং কোনো অবস্থাতেই বাকশালের ফরম পূরণ করিনি। অথচ আইন করা হয়েছিল বাকশালের ওই ফরমটি নির্ধারিত সময়ে পূরণ করা না হলে কারো কোনো রাজনৈতিক পদপদবি থাকবে না- এমনকি সরকারি কর্মচারী-শিক্ষক সর্বস্তরের মানুষ যেকোনো রকমের সরকারি কাজে সংশ্লিষ্টতা থাকলে তার পদচ্যুতি ঘটবে। আমার খারাপ লাগে এটা ভেবে শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক কোনো ক্ষেত্রেই প্রতিরোধ তো দূর থাক উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদটুকু হয়নি। ১৯৭৫ সালের ৭ই জুন বাকশালে যোগদানে একটি আনুষ্ঠানিক দিবস হিসেবে কর্মসূচি ঘোষণা করা হলে প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে সমগ্র বুদ্ধিজীবী মানুষ মাথায় মাথাল দিয়ে; কাঁধে লাঙল নিয়ে; কেউ কাস্তে কোদাল হাতে মিছিল করে বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে অভিবাদন জানিয়ে যাচ্ছিলেন তার কৃত্রিম স্বতঃস্ফূর্ততা আমাকে বিস্মিত করেছে, বেদনাহত করেছে। কাজল, আমি তখন অনেকটাই আত্মগোপনে। আমার সুহৃদরা বাকশালে পদত্যাগের মুহূর্ত থেকেই আমাকে পরামর্শ দিতেন, আপনাকে হত্যা করে ওরাই আমার জন্য শোক মিছিল বের করবে। আমার স্মৃতিতে এখনও উজ্জ্বল খুনি মোশতাক বসকে (বঙ্গবন্ধুকে) বলেছিল, তোমার আসকারাতেই নূরে আলম সিদ্দিকীর এতটা স্পর্ধা হয়েছে। তিনি এই উসকানিতে প্রচণ্ডভাবে ক্রোধান্বিত হয়ে বলেছিলেন, ‘ওকে আমি কিমা বানিয়ে কেও (কাক) দিয়ে খাইয়ে দেবো। ও ভেবেছেটা কি?’ ওটা ছিল নিত্যান্ত কথার কথা। আমার প্রতি তার স্নেহকাতরতার কারণে নিহত হওয়া তো দূরে থাক তার জীবিত অবস্থায় আমাকে গ্রেপ্তারও হতে হয়নি। যদিও আমি আত্মগোপনে ছিলাম। কিন্তু সরকার বেপরোয়া হলে আমাকে গ্রেপ্তার করা দুঃসাধ্য ছিল না। ৯ই নভেম্বর, ১৯৭৫ সালে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় আমি গ্রেপ্তার হই। জেনারেল ওসমানীর সদয় হস্তক্ষেপে এবং মরহুম জিয়াউর রহমানের আমার প্রতি সম্মান ও সহানভূতির কারণে আমি প্রাণে বেঁচে যাই। কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর আগে আমাকে অনেক দিন সেনা ছাউনিতে অবরুদ্ধ রাখা হয়। প্রথমে যখন সেফ হাউজে আমাকে রাখা হয় তখন আমার নামটি নাকি হত্যা তালিকায় ছিল। তখন গোটা ক্যান্টনমেন্টজুড়ে বিশেষ করে সেফ হাউজে আমাকে যেখানে আটকে রাখা হয়েছিল সেখানে হত্যা করা শবদেহের রক্ত, মগজের চিহ্ন স্বচক্ষে দেখেছি। সেই দৃশ্য দেখে আমি অসাড় হয়ে গিয়েছিলাম। আজও ভাবি আমি আজরাইয়েল কোন চেহারা থাকলে তা বর্ণনা করতে পারতাম। প্রায় দুই মাসের মতো আমার সেনাছাউনিতে বন্দিজীবনের মধ্যে দু-তিন রাত সেফ হাউজে জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি এক বিভীষিকাময় সময় আমাকে পার করতে হয়েছে।
প্রশ্ন: বাকশাল থেকে সরে আসা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কি কথা হয়েছিল আপনার?
শেখ ফজলুল হক মনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। আমি তার ভীষণ বিশ্বস্ত ছিলাম। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় মনি ভাই গোপনে যোগাযোগ করে তার গাড়িতে করে আমাকে বঙ্গবন্ধুর বাসায় নিয়ে যান। আমি কিছুটা ভয়, কিছুটা সংশয় চিত্ত নিয়ে তার সামনে গেলে আবার নতুন করে উপলব্ধি করলাম এই মহান হৃদয়ের ব্যক্তিটিকে। তিনি তিন তলার ছাদে যেখানে বাকশাল গঠনের বিরোধিতার আগে আমার নিত্য আসা-যাওয়া ছিল সেখানেই একটি সোফায় বসা ছিলেন। আমাকে দেখে তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ‘কী ব্যাপার, কার বুদ্ধিতে চলো, আমি ছাড়া অন্য কাউকে নেতা মানতে শুরু করছো নাকি?’ আমি বললাম, ‘কেন বস’? মুজিব ভাই বললেন, আমার সঙ্গে আলাপ না করে এত বাহাদুরি দেখাতে গেলে কেন? প্রত্যুত্তরে আমি সবিনয়ে বলেছিলাম, সংসদীয় দলের সভায় তো আমি এর বিরোধিতা করেছি। গণতন্ত্রে নিখাদ বিশ্বাস করি বলেই আমি বাকশালের বিরোধিতায় সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছি। উনি বললেন, ‘এখন কী করবে?’ আমি উত্তরে বলেছিলাম, এখন হৃদয়টা ভারাক্রান্ত। উনি বললেন, ‘যাও, গোপালগঞ্জে আমার বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত কলেজটিতে তোমাকে প্রিন্সিপাল বানিয়ে দিবো।’ আমি প্রতি উত্তরে বলেছিলাম, ‘হৃদয়টা; মনটা খুব ভারাক্রান্ত। মনটা একটু শান্ত হলে আপনার এ আদেশ মেনে নেবো।’ এরপর বেশ ক’বার নেতার সঙ্গে দেখা হয়েছে। আমার আত্মগোপনের বিষয়টি তার কাছে গোপন রেখেছিলাম। আমার প্রতি তার আপত্য স্নেহের ঘাটতি কখনও দেখিনি। অদ্ভুত উদারচিত্তের মানুষ ছিলেন বস। আজকের দিনের গুম-খুনের রাজনীতির দিকে তাকালে মনে হয় শুধু আমি কেন শত অপরাধ করেও মুজিব ভাইয়ের সামনে কেউ গেলে তার প্রচণ্ড ক্রোধ কর্পূরের মতো কোথায় যেন উবে যেতো।
No comments