এরশাদ যেদিকে ক্ষমতা সেদিকে
রংপুর
সিটি কর্পোরেশন (রসিক) নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভের মধ্য দিয়ে
জাতীয় পার্টির সক্ষমতা নিয়ে নতুন করে হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক
বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, এমনিতে দলটির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকার গঠনের রাজনীতিতে বড় ফ্যাক্টর। উপরন্তু এ জয়ের
মধ্য দিয়ে এরশাদের রাজনৈতিক দরকষাকষির শক্তি আরও বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভোটের রাজনীতির নানা সমীকরণ ও বাস্তব কিছু প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে এককথায়
বলা যায়, এরশাদ যেদিকে, ক্ষমতাও সেদিকে ঝুঁকবে। অর্থাৎ অতীতের মতো আসন্ন
জাতীয় নির্বাচনে এরশাদ বড় দুই দলের যে দলকে সমর্থন দেবেন, সেই দলই ক্ষমতায়
আসবে। এটিই রূঢ় বাস্তবতা। শুধু তা-ই নয়, আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের
পর যে দল সরকার গঠন করবে, সেখানে জাপা চেয়ারম্যান এরশাদের গুরুত্বপূর্ণ পদ
পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তাদের মতে, এরকম বাস্তবতায় জাতীয় পার্টির
সমর্থন পেতে এরই মধ্যে পর্দার আড়ালে অনেক কিছুই হচ্ছে। এ প্রচেষ্টায় যারা
এগিয়ে থাকবেন, তারাই বিজয়ী হবেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মূলত তিনটি
কারণে এরশাদের সমর্থন ছাড়া কোনো দলের পক্ষে সরকার গঠন করা সম্ভব হবে না।
প্রথমত, প্রতিটি নির্বাচনী আসনে ৫ থেকে ১০ শতাংশ রিজার্ভ ভোট আছে জাতীয়
পার্টির। এ ভোটের ব্যবধানে যেখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীর জয়-পরাজয়
নির্ধারণ হবে, সেখানে জাতীয় পার্টির ভোট বড় ফ্যাক্টর। সঙ্গত কারণে জাপার
সঙ্গে নির্বাচনী জোট যে দল করতে পারবে, সংশ্লিষ্ট আসনগুলোয় তাদের জয়
নিশ্চিত। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের আগে এরশাদ কোনো দলকে সমর্থন দেয়ার পর ভোটের
মাঠে এক ধরনের আগাম ফলাফল চিত্র ফুটে উঠবে। ভাসমান ভোটাররা বার্তা পেয়ে
যাবেন কোন দল সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। ফলে ভাসমান বা ফ্লোটিং ভোটারদের একটি
বড় অংশ ভোট নষ্ট না করার চেয়ে এরশাদ সমর্থিত জোটের প্রার্থীকে ভোট দেবেন।
এই সমীকরণের যুক্তিতে যদি রাজনৈতিক সমঝোতায় জাতীয় পার্টিকে ৪০ থেকে ৫০টি
আসন বড় কোনো দল ছেড়ে দেয়, তাতেও কোনো ক্ষতি নেই। বরং এ সুবাদে ওই দলের
কমপক্ষে অতিরিক্ত ১০০ আসনে বিজয় সুনিশ্চিত হবে। এতে করে দুই-তৃতীয়াংশ আসন
নিয়ে সরকার গঠন করার সুযোগ তৈরি হবে।
তৃতীয়ত, এরশাদ যে দলকে সমর্থন দেবেন,
সেই দলের বিরুদ্ধে প্রশাসনের লোকজন হার্ডলাইনে যাওয়ার সাহস দেখাবে না। কারণ
তারাও পরিস্থিতি ও ফল কী হতে যাচ্ছে, তা আঁচ করতে পারবেন। এজন্য অবাধ ও
সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করতে তারা আরও সক্রিয় হবেন। আগামীতে সরকার গঠন
নিয়ে দলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ শনিবার যুগান্তরকে বলেন,
‘আমার লক্ষ্য জাতীয় পার্টিকে ক্ষমতায় নেয়া। আমি এ লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি।
আমি সব সময় বলেছি, দুর্বলের সঙ্গে কেউ হাত মেলায় না। জাতীয় পার্টি দুর্বল
নয়। অনেক শক্তিশালী দল। রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জয়ী হওয়ার মধ্য
দিয়ে প্রমাণ হয়েছে জাতীয় পার্টিকে উপেক্ষা করার শক্তি কারও নেই। জাতীয়
পার্টি যে আগামী দিনের রাজনীতিতে বড় ফ্যাক্টর তা আরও এক দফা প্রমাণ হয়েছে।
রংপুর থেকে জয়ের যে ধারা সূচিত হয়েছে আমরা তা ধরে রাখতে চাই। আমরা মনে করি,
দুই বড় দলের ব্যর্থতার কারণে দেশের মানুষ এখন জাতীয় পার্টির মধ্যেই আশার
আলো দেখছেন। আগামী নির্বাচনে তা প্রমাণিত হবে।’ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক
ড. তারেক শামসুর রেহমান শনিবার যুগান্তরকে বলেন, জাতীয় পার্টি বরাবরই
বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে একটা বড় ফ্যাক্টর। রংপুরের সর্বশেষ সিটি
কর্পোরেশন নির্বাচন প্রমাণ করেছে- এরশাদের প্রতি সেখানকার জনগণের সমর্থন ও
ভালোবাসা এখনও আছে। শুধু রংপুর বা উত্তরবঙ্গই নয়, বাংলাদেশের বেশিরভাগ
স্থানেই এরশাদ এবং জাতীয় পার্টি সমর্থিতদের ভোটব্যাংক রয়েছে। এ ভোট
নির্বাচনী ফলাফল নির্ধারণে একটি বড় ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে যেসব আসনে ৫
থেকে ১০ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে প্রার্থীর জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় সেসব আসনে
জাতীয় পার্টির এ ভোটব্যাংক নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তিনি আরও
বলেন, ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে দীর্র্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ
সরকার গঠন করে।
২০০১ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত
মিলে জোট গঠিত হয়। ভুল বোঝাবুঝির কারণে নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে হুসেইন
মুহম্মদ এরশাদ ওই জোট ত্যাগ করে এককভাবে নির্বাচনে অংশ নেন। জোটের রাজনীতির
সুফল বুঝতে পেরে ২০০৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে আওয়ামী লীগ
মহাজোট গঠন করে এবং সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়। একইভাবে ২০১৪ সালের ৫
জানুয়ারির নির্বাচন বিএনপি-জামায়াত বর্জন করলেও জাতীয় পার্টি অংশ নেয়ার
কারণে এ নির্বাচন বৈধতা পায়। ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, এসব তুলনামূলক
চিত্র এবং বাস্তবতা বিচার করলে দেখা যাবে ভোটের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি
একটি বড় ফ্যাক্টর। তাদের উপেক্ষা করার শক্তি এখন কারও নেই। দুই প্রধান দলের
যে দলই ক্ষমতায় যেতে চায় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের সমর্থন প্রয়োজন হবে।
সরকার গঠনে তার সমর্থন যে কোনো দলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলে
রাজনীতিতে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের গুরুত্ব আগামী দিনে আরও বাড়বে বলেই আমার
ধারণা। এক কথায় পুরো বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে স্পষ্টভাবে বলা যায়, আসন্ন
একাদশতম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরশাদ ও জাতীয় পার্টি একটি গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করবে। তিনি আরও বলেন, রাজনীতি এবং আদর্শগতভাবে বিএনপির সঙ্গে
জাতীয় পার্টির মিল থাকায় বিএনপি যে নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টির দিকে
তাকিয়ে থাকবে না, বা জাতীয় পার্টিকে জোটভুক্ত করতে চাইবে না- তা হলফ করে
বলা যায় না। এরশাদ বর্তমান সরকারের নানা কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করছেন। তাই
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে তিনি যদি বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হন আমি
তাতে অবাক হব না। একই ভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গেও এরশাদের সখ্য পুরনো। আওয়ামী
লীগও ক্ষমতায় টিকে থাকতে এরশাদকে যে কোনো মূল্যে সঙ্গে রাখতে চাইবে- এটাই
বাস্তবতা। এ বাস্তবতাকেও উপেক্ষা করা যায় না। জাতীয় পার্টির মহাসচিব ও
সাবেক মন্ত্রী এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার এমপি এ প্রসঙ্গে শনিবার
যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা ৩০০ আসনে এককভাবে নির্বাচন করার প্রস্তুতি শুরু
করেছি। প্রার্থী বাছাই চলছে। অনেকে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিচ্ছেন। আরও অনেকে
যোগ দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আমরা যোগ্যতা, সামর্থ্য ও জনপ্রিয়তা
বিবেচনায় নিয়ে প্রার্থী মনোনীত করব।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটি কথা পরিষ্কার
করে বলতে চাই, আগামীতে এরশাদ এবং জাতীয় পার্টিকে উপেক্ষা করে কেউ ক্ষমতায়
যেতে পারবে না। কারণ জনগণ আমাদের সঙ্গে রয়েছে।’ এদিকে রংপুর সিটি
কর্পোরেশন (রসিক) নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর ঐতিহাসিক জয়ে উজ্জীবিত এখন
জাতীয় পার্টি। দলটির নেতাকর্মীরা মনে করছেন, এ জয়ের প্রভাব পড়বে আগামী
দিনের জাতীয় রাজনীতিতে। এমনকি রংপুরের জয় রাজনীতির পুরনো হিসাব-নিকাশও বদলে
দেবে। এ জয় আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।
ইতিমধ্যে এর আলামতও শুরু হয়ে গেছে। দলটির নেতাকর্মীদের মতে, জাতীয় পার্টির
সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে এমন ভাবনা থেকেই পিরোজপুর-৩ আসন থেকে
নির্বাচিত স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ডা. রুস্তুম আলী ফরাজী শনিবার
আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছেন। এক সময় জাতীয় পার্টির রাজনীতির
সঙ্গেই সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। সংসদ সদস্যও হন জাতীয় পার্টি থেকে। পরে যোগ
দেন বিএনপিতে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন
বিএনপি বর্জন করায় স্বতন্ত্রভাবে অংশ নিয়ে সংসদ সদস্য হন ডা. রুস্তুম আলী
ফরাজী। আগামী নির্বাচনের আগেই তিনি ফিরে এলেন জাতীয় পার্টিতে। সূত্র জানায়,
সাবেক এবং বর্তমান আরও একাধিক সংসদ সদস্য এবং প্রভাবশালী নেতা জাতীয়
পার্টিতে যোগ দেয়ার অপেক্ষায় আছেন। এছাড়াও বিভিন্ন সময় জাতীয় পার্টি ছেড়ে
গেছেন এরকম অনেকেই দলে ফেরার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তবে আপাতত জাতীয় পার্টির
লক্ষ্য রংপুর সিটি কর্পোরশেন নির্বাচনে যে জয়ের ধারা সূচিত হয়েছে তা ধরে
রাখা। এর অংশ হিসেবে গাইবান্ধা-১ আসনের আসন্ন উপনির্বাচনের ফলাফলও নিজেদের
ঘরে আনার লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামার কথা ভাবছেন দলটির নেতাকর্মীরা। ইতিমধ্যে এ
আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীও চূড়ান্ত করে রেখেছে জাতীয় পার্টি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ (নাসিরনগর) আসনের উপনির্বাচনেও শক্ত প্রার্থী দেয়ার কথা
ভাবছে দলটি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে দীর্ঘ ২৭ বছর
ধারাবাহিকভাবে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দেশ শাসন করে আসছে, যার কারণে ডাক্তার,
আইনজীবী, পেশাজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, সাংবাদিক থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রেই
দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এ অবস্থায় দুই বলয়ের মাঝখানে এরশাদ নেতৃত্বাধীন
জাতীয় পার্টি একাধিকবার নিজেদের অবস্থান জানান দেয়ার চেষ্টা করলেও এরশাদের
বিরুদ্ধে করা মামলা প্রধান প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে নব্বইয়ের পর
থেকে মুক্তভাবে রাজনীতি করতে পারেননি এরশাদ, যা বিভিন্ন বক্তব্যে এরশাদ
নিজেও স্বীকার করেছেন। বর্তমানে জাতীয় পার্টি দেশের প্রধান বিরোধী দল হলেও
সরকারে তাদের মন্ত্রী থাকায় অনেকে সমালোচনা করে আসছেন। এমন একটি সময়ে
রংপুরের বিজয় আগামী নির্বাচনী রাজনীতিতে আবারও নিজেদের শক্ত অবস্থান জানান
দিল এ দলটি।
No comments