ভয়ঙ্কর প্রতারক আনোয়ারার অজানা কাহিনী by নূর ইসলাম
যশোরের
এক ‘ভয়ঙ্কর নারী প্রতারকের’ খপ্পরে পড়ে শতাধিক পরিবারের কয়েক হাজার মানুষ
পথে বসেছেন। তার প্রতারণার শিকার হয়েছেন ব্যাংকার, পুলিশ, সরকারি
কর্মকর্তা, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, মানবাধিকারকর্মী থেকে শুরু করে গ্রামের
সাধারণ মানুষ। তার প্রতারণার শিকার অনেকেই এখন সর্বস্বান্ত। কেউ কেউ চাকরি
হারিয়ে বসেছেন পথে। এই অভিনব প্রতারক নারীর নাম আনোয়ারা বেগম। যিনি গোটা
যশোরের মানুষের কাছে ‘ভয়ঙ্কর প্রতারক’ হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। ইতিমধ্যে
তিনি প্রতারণার মাধ্যমে প্রায় ৫০ কোটি টাকারও বেশি মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে
নিয়েছেন বলে অভিযোগ। এসব ঘটনায় আনোয়ারা বেগমের নামে ইতিমধ্যে ২৪টি
প্রতারণা ও চেকজালিয়াতির মামলা হয়েছে। যার মধ্যে ৭টিতে তিনি জামিনে আছেন।
বাকি ১৩টি মামলায় আনোয়ারা বেগমকে ‘পলাতক’ দেখিয়ে পুলিশ আদালতে চার্জশিট
দাখিল করেছে। এদিকে ‘পলাতক’ আসামি আনোয়ারা বেগম গতকাল যশোরের একটি আবাসিক
হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করে তার প্রতারণার দায় স্বীকারসহ তার নেপথ্য ঘটনা
তুলে ধরেন। তিনি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। যশোরের কয়েকজন
সিনিয়র আইনজীবী পরিবেষ্টিত ওই সংবাদ সম্মেলনে আনোয়ারা বেগম অকপটে স্বীকার
করেন তিনি কিভাবে মানুষের কাছ থেকে টাকা গ্রহণ করতেন। তার নেপথ্য লোকদের
বিষয়েও তিনি দিয়েছেন চকমপ্রদ তথ্য। তবে প্রতারণার মাধ্যমে অর্জিত কোটি কোটি
টাকা তিনি কিভাবে ব্যয় করেছেন বা প্রতারণার শিকার মানুষদের টাকা তিনি
কিভাবে ফেরত দেবেন সে সম্পর্কে কোন কথা বলতে রাজি হননি। এদিকে পুলিশ
প্রশাসনের নাকের ডগায় কিভাবে একজন ভয়ঙ্কর প্রতারক নারী ২৪ মামলার পলাতক
আসামি দিনক্ষণ জানিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করলেন তা নিয়ে রয়েছে নানা গুঞ্জন।
যশোর সদর উপজেলার কুয়াদা বাজারের কাঠ ব্যবসায়ী ওমর আলীর স্ত্রী আনোয়ারা বেগম। অশিক্ষিত ওই নারী পেশায় গৃহিণী। প্রায় ২৫ বছর আগে ওমর আলী মারা যান। ছেলে-মেয়ে নিয়ে বিপাকে পড়েন সুন্দরী আনোয়ারা বেগম। তিনি স্থানীয়দের কুনজর থেকে বাঁচতে যশোর শহরের নীলগঞ্জে পাড়ি জমান। সেখানে একটি ভাড়া বাসায় থাকার সুবাদে একজন সরকারি ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন আনোয়ারা বেগম। যা নিয়ে রয়েছে রগরগে গল্প। জীবন পাল্টে যায় গ্রামের নিতান্ত সাধারণ একজন গৃহবধূর। রাতারাতি তিনি হয়ে পড়েন অর্থবিত্তের মালিক। ব্যাংকার থেকে শুরু করে যশোর শহরের বড় বড় ব্যবসায়ী, পুলিশ অফিসার, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা সবাই আনোয়ারা বেগমের পানি গ্রহণে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। সুযোগ কাজে লাগান সুচতুর আনোয়ারা বেগম। শুরু করেন ঢাকাকেন্দ্রিক নতুন ব্যবসা। সেই ব্যবসার সূত্র ধরে সোনালী ব্যাংকের সাবেক সিবিএ নেতা নড়াইলের সন্তান বিএম বাকির হোসেনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান আনোয়ারা বেগম। এই সম্পর্কের জের ধরে আনোয়ারা বেগম প্রতারণার নতুন ফাঁদ পাতেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সোনালী ব্যাংকের সাবেক এক ম্যানেজারে স্ত্রী জানান, আনোয়ারা বেগম ১২/১৪ বছর আগে গল্প সাজান, তার স্বামী মৃত ওমর আলী বাংলাদেশের এক সময়ের শীর্ষ ধনী জহুরুল হকের ম্যানেজার এবং ব্যবসায়িক পার্টনার ছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি সোনালী ব্যাংক এবং অগ্রণী ব্যাংক মতিঝিল শাখায় প্রচুর টাকা রেখে যান। সেই টাকা সুদ এবং আসলে ১০০ কোটি ছাড়িয়েছে। সোনালী ব্যাংক এবং অগ্রণী ব্যাংক সময়মতো সঠিক ওয়ারিশ না পাওয়ায় টাকাগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে চলে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাপক খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারে, আনোয়ারা বেগম এবং তার ছেলেমেয়েরা ওই টাকার প্রকৃত ওয়ারিশ। ব্যাংক থেকে ওই ১১২ কোটি টাকা তুলতে আড়াই শতাংশ জমি বা সমপরিমাণ অর্থ প্রায় ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা জমা দিতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংকে। এই টাকা জমা দিলে তিনি ১১২ কোটি টাকার মতো পাবেন। যারা তাকে এখন ওই টাকা তুলতে সহযোগিতা করবেন, তাদের তিনি লভ্যাংশ বাবদ প্রদেয় টাকার দ্বিগুণ, তিনগুণ বা তারও বেশি করে টাকা দেবেন। আর এভাবেই টাকা সংগ্রহে নামেন প্রতারক সুন্দরী আনোয়ারা বেগম।
যাদেরকে তিনি এই ধরনের দ্বিগুণ, তিনগুণ বা কোটি টাকার স্বপ্ন দেখিয়েছেন, তারাও রাতারাতি কোটিপতি হয়ে যাওয়ার মানসে তাকে টাকা দিয়েছেন। আর এভাবে শত শত মানুষের কাছ থেকে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।
যশোর বড় বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী এবং সাবেক এক ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, যশোর কোতোয়ালি থানার একজন সাবেক ওসি, পাশের জেলার গোয়েন্দা পুলিশের একজন ওসি সমপ্রতি আনোয়ারা বেগমকে ফ্ল্যট বাড়ি এবং মার্কেটের একটি দোকান বিক্রি করে প্রায় ৭০ লাখ টাকা দিয়েছেন। এ ছাড়া আনোয়ারা বেগমের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব খুইয়েছেন যশোর উপশহরের বাসিন্দা সোনালী ব্যাংক যশোর বাজার শাখার সাবেক ম্যানেজার আবুল কাসেম, ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ম্যানেজার শহিদুল ইসলাম, যশোর শহরের বকচরের বাহাউদ্দিন, রেল রোডের কাপড় ব্যবসায় ও রুনারুপার মালিক ইকরাম হোসেন, মণিরামপুর রাজগঞ্জের বাসিন্দা আবদুল মান্নান, একই এলাকার ব্যবসায়ী ফারুক হোসেন, খাজুরা বাজারের ফুয়েল স্টেশন মালিক মো. হাসান, ব্যাংক কর্মকর্তার স্ত্রী আলেয়া বেগম, চৌগাছা বাজারের ব্যবসায়ী হাসান আলী, শহরের পালবাড়ি ও নুরপুর এলাকার বাসিন্দা বেশ কয়জন অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মকর্তা ও সদস্য, বেনাপোলের সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম, ঝিকরগাছার ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন, যশোর সিটি প্লাজার গার্মেন্ট ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার, স্বর্ণপট্টির সঞ্জয় কুমার সাহাসহ বহু মানুষ। অভিযোগ রয়েছে মোটা অঙ্কের সুদ প্রদানের কথা বলে ১৪-১৫ বছরে আনোয়ারা বেগম প্রায় ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। সময়মতো টাকা পরিশোধ করতে না পারায় ইতিমধ্যে তার নামে যশোর কোতোয়ালি থানাসহ বিভিন্ন থানায় ও আদালতে ২৪টি প্রতারণা ও চেক জালিয়াতির মামলা হয়েছে।
এর আগে গত কয়েক বছরে আনোয়ারা বেগম যশোর ও আশপাশের কয়েকটি জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের বহু মানুষের কাছ থেকে আরও দশ ১৫ কোটির টাকা প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার প্রতারণার ফাঁদে পড়ে কোটি কোটি টাকা খুইয়েছেন দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন- পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা, ব্যাংক কর্মকর্তা, আইনজীবী, সাংবাদিক ও ব্যবসায়ী। বাদ পড়েননি গৃহবধূরাও। অনেকে তার প্রতারণায় টাকা খুইয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। টাকার শোকে অপমৃত্যুর শিকারও হয়েছেন কেউ কেউ। এ ছাড়া তার প্রতারণার কাজে সহায়তার দায়ে যশোরের ৩টি ব্যাংকের ম্যানেজাররা চাকরিচ্যুত হয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাবেক ব্যাংক ম্যানেজারে স্ত্রী জানান, আনোয়ারা বেগমের প্রেমে পড়ে তার স্বামী ব্যাংক থেকে হিসাববহির্ভূত ভাবে ৭০ লাখ টাকা তুলে দেন তার হাতে। যা নিয়ে তার সংসার ভেঙেছে। সময়মতো ব্যাংকে টাকা ফেরত দিতে না পারায় তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। জেল খাটতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত টাকার শোকে তার স্বামীর অকাল মৃত্যু হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, আনোয়ারা তার শরীর আর ব্যবহার দিয়ে সবাইকে তুষ্ট রেখে বছরের পর বছর প্রতারণা করে চলেছে। তার প্রতারণার ফাঁদে পড়ে বহু পরিবার সর্বস্বান্ত হয়েছে। ইসলামী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক থেকে শুরু করে বহু সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের ম্যানেজার বা কর্মকর্তারা আনোয়ারা বেগমের প্রতারণার ফাঁদে ফেঁসে গেছেন।
এদিকে বেশ কিছু দিন রাজধানীতে গা-ঢাকা দিয়ে থাকার পর ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছেন ভয়ঙ্কর প্রতারক আনোয়ারা বেগম। তিনি গতকাল যশোরের একটি অভিজাত হোটেলে আইনজীবী দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করেন।
সংবাদ সম্মেলনে নিরক্ষর আনোয়ারা বেগমের পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন অ্যাডভোকেট ডেইজি খাতুন। এ সময় আনোয়ারার সঙ্গে অ্যাডভেকেট আফজাল হোসেন, অ্যাডভোকেট আবুল কায়েস, অ্যাডভোকেট নবকুমার, মিজানুর রহমান মিন্টুসহ বেশ কয়েকজন আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। খবর পেয়ে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হন রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয়কৃষ্ণ মল্লিক।
বিনয় মল্লিক বলেন, ‘ভয়ঙ্কর প্রতারক আনোয়ারা সংবাদ সম্মেলন করছেন শুনে আমি এখানে হাজির হয়েছি। আনোয়ারার প্রতারণার কাহিনী আমি যতটা জানি, তা উপস্থিত আইনজীবীদের বলেছি। আইনজীবীরা এসব কাহিনী শুনে লজ্জা পেয়েছেন।’
তিনি জানান, আনোয়ারা বেগম দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ন কায়দায় মানুষকে প্রতারিত করে আসছেন। তার এক নিকটাত্মীয়র কাছ থেকেও আনোয়ারা মোটা টাকা হাতিয়েছেন বলে বিনয় মল্লিক অভিযোগ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ‘ভয়ঙ্কর প্রতারক’ হিসেবে পরিচিত আনোয়ারা বেগম স্বীকার করেন, ব্যাংকে তার স্বামীর নামে কোন টাকা নেই। পুরো ঘটনাটিই সাজানো। এই প্রতারণার জন্য অবশ্য তিনি সোনালী ব্যাংকের প্রয়াত সিবিএ নেতা বিএম বাকির হোসেন এবং ব্যাংকটির যশোরের একটি শাখায় কর্মরত আবুল কাশেমকে দায়ী করেন।
সংবাদ সম্মেলনে আনোয়ারা বেগম অভিযোগ করেন, “ব্যাংক কর্মকর্তা আবুল কাশেমের শেখানো পথে তিনি হেঁটেছেন মাত্র। আবুল কাশেম আর প্রয়াত বিএম বাকির তাকে নিয়ে খেলেছেন। তার সর্বস্ব লুট করেছেন। তিনি এখন সমাজে ঘৃণিত। কিন্তু এর পেছনে যারা জড়িত তিনি তাদের মুখোশ উন্মোচন করার দাবি জানান। তিনি জানান, মানুষকে প্রতারিত করে তিনি যে ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকা আয় করেছেন তার সিংহ ভাগ আবুল কাশেম আর বিএম বাকির খেয়েছেন। বাকি টাকা তিনি মিডিয়া আর ফুর্তি করে ব্যয় করেছেন। তার কাছে বর্তমানে কোন টাকা নেই। বরং তিনি ২৪টি মামলার আসামি হয়ে এখন ফেরার জীবন যাপন করছেন।”
যশোর সদর উপজেলার কুয়াদা বাজারের কাঠ ব্যবসায়ী ওমর আলীর স্ত্রী আনোয়ারা বেগম। অশিক্ষিত ওই নারী পেশায় গৃহিণী। প্রায় ২৫ বছর আগে ওমর আলী মারা যান। ছেলে-মেয়ে নিয়ে বিপাকে পড়েন সুন্দরী আনোয়ারা বেগম। তিনি স্থানীয়দের কুনজর থেকে বাঁচতে যশোর শহরের নীলগঞ্জে পাড়ি জমান। সেখানে একটি ভাড়া বাসায় থাকার সুবাদে একজন সরকারি ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন আনোয়ারা বেগম। যা নিয়ে রয়েছে রগরগে গল্প। জীবন পাল্টে যায় গ্রামের নিতান্ত সাধারণ একজন গৃহবধূর। রাতারাতি তিনি হয়ে পড়েন অর্থবিত্তের মালিক। ব্যাংকার থেকে শুরু করে যশোর শহরের বড় বড় ব্যবসায়ী, পুলিশ অফিসার, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা সবাই আনোয়ারা বেগমের পানি গ্রহণে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। সুযোগ কাজে লাগান সুচতুর আনোয়ারা বেগম। শুরু করেন ঢাকাকেন্দ্রিক নতুন ব্যবসা। সেই ব্যবসার সূত্র ধরে সোনালী ব্যাংকের সাবেক সিবিএ নেতা নড়াইলের সন্তান বিএম বাকির হোসেনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান আনোয়ারা বেগম। এই সম্পর্কের জের ধরে আনোয়ারা বেগম প্রতারণার নতুন ফাঁদ পাতেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সোনালী ব্যাংকের সাবেক এক ম্যানেজারে স্ত্রী জানান, আনোয়ারা বেগম ১২/১৪ বছর আগে গল্প সাজান, তার স্বামী মৃত ওমর আলী বাংলাদেশের এক সময়ের শীর্ষ ধনী জহুরুল হকের ম্যানেজার এবং ব্যবসায়িক পার্টনার ছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি সোনালী ব্যাংক এবং অগ্রণী ব্যাংক মতিঝিল শাখায় প্রচুর টাকা রেখে যান। সেই টাকা সুদ এবং আসলে ১০০ কোটি ছাড়িয়েছে। সোনালী ব্যাংক এবং অগ্রণী ব্যাংক সময়মতো সঠিক ওয়ারিশ না পাওয়ায় টাকাগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে চলে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাপক খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারে, আনোয়ারা বেগম এবং তার ছেলেমেয়েরা ওই টাকার প্রকৃত ওয়ারিশ। ব্যাংক থেকে ওই ১১২ কোটি টাকা তুলতে আড়াই শতাংশ জমি বা সমপরিমাণ অর্থ প্রায় ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা জমা দিতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংকে। এই টাকা জমা দিলে তিনি ১১২ কোটি টাকার মতো পাবেন। যারা তাকে এখন ওই টাকা তুলতে সহযোগিতা করবেন, তাদের তিনি লভ্যাংশ বাবদ প্রদেয় টাকার দ্বিগুণ, তিনগুণ বা তারও বেশি করে টাকা দেবেন। আর এভাবেই টাকা সংগ্রহে নামেন প্রতারক সুন্দরী আনোয়ারা বেগম।
যাদেরকে তিনি এই ধরনের দ্বিগুণ, তিনগুণ বা কোটি টাকার স্বপ্ন দেখিয়েছেন, তারাও রাতারাতি কোটিপতি হয়ে যাওয়ার মানসে তাকে টাকা দিয়েছেন। আর এভাবে শত শত মানুষের কাছ থেকে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।
যশোর বড় বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী এবং সাবেক এক ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, যশোর কোতোয়ালি থানার একজন সাবেক ওসি, পাশের জেলার গোয়েন্দা পুলিশের একজন ওসি সমপ্রতি আনোয়ারা বেগমকে ফ্ল্যট বাড়ি এবং মার্কেটের একটি দোকান বিক্রি করে প্রায় ৭০ লাখ টাকা দিয়েছেন। এ ছাড়া আনোয়ারা বেগমের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব খুইয়েছেন যশোর উপশহরের বাসিন্দা সোনালী ব্যাংক যশোর বাজার শাখার সাবেক ম্যানেজার আবুল কাসেম, ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ম্যানেজার শহিদুল ইসলাম, যশোর শহরের বকচরের বাহাউদ্দিন, রেল রোডের কাপড় ব্যবসায় ও রুনারুপার মালিক ইকরাম হোসেন, মণিরামপুর রাজগঞ্জের বাসিন্দা আবদুল মান্নান, একই এলাকার ব্যবসায়ী ফারুক হোসেন, খাজুরা বাজারের ফুয়েল স্টেশন মালিক মো. হাসান, ব্যাংক কর্মকর্তার স্ত্রী আলেয়া বেগম, চৌগাছা বাজারের ব্যবসায়ী হাসান আলী, শহরের পালবাড়ি ও নুরপুর এলাকার বাসিন্দা বেশ কয়জন অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মকর্তা ও সদস্য, বেনাপোলের সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম, ঝিকরগাছার ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন, যশোর সিটি প্লাজার গার্মেন্ট ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার, স্বর্ণপট্টির সঞ্জয় কুমার সাহাসহ বহু মানুষ। অভিযোগ রয়েছে মোটা অঙ্কের সুদ প্রদানের কথা বলে ১৪-১৫ বছরে আনোয়ারা বেগম প্রায় ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। সময়মতো টাকা পরিশোধ করতে না পারায় ইতিমধ্যে তার নামে যশোর কোতোয়ালি থানাসহ বিভিন্ন থানায় ও আদালতে ২৪টি প্রতারণা ও চেক জালিয়াতির মামলা হয়েছে।
এর আগে গত কয়েক বছরে আনোয়ারা বেগম যশোর ও আশপাশের কয়েকটি জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের বহু মানুষের কাছ থেকে আরও দশ ১৫ কোটির টাকা প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার প্রতারণার ফাঁদে পড়ে কোটি কোটি টাকা খুইয়েছেন দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন- পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা, ব্যাংক কর্মকর্তা, আইনজীবী, সাংবাদিক ও ব্যবসায়ী। বাদ পড়েননি গৃহবধূরাও। অনেকে তার প্রতারণায় টাকা খুইয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। টাকার শোকে অপমৃত্যুর শিকারও হয়েছেন কেউ কেউ। এ ছাড়া তার প্রতারণার কাজে সহায়তার দায়ে যশোরের ৩টি ব্যাংকের ম্যানেজাররা চাকরিচ্যুত হয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাবেক ব্যাংক ম্যানেজারে স্ত্রী জানান, আনোয়ারা বেগমের প্রেমে পড়ে তার স্বামী ব্যাংক থেকে হিসাববহির্ভূত ভাবে ৭০ লাখ টাকা তুলে দেন তার হাতে। যা নিয়ে তার সংসার ভেঙেছে। সময়মতো ব্যাংকে টাকা ফেরত দিতে না পারায় তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। জেল খাটতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত টাকার শোকে তার স্বামীর অকাল মৃত্যু হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, আনোয়ারা তার শরীর আর ব্যবহার দিয়ে সবাইকে তুষ্ট রেখে বছরের পর বছর প্রতারণা করে চলেছে। তার প্রতারণার ফাঁদে পড়ে বহু পরিবার সর্বস্বান্ত হয়েছে। ইসলামী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক থেকে শুরু করে বহু সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের ম্যানেজার বা কর্মকর্তারা আনোয়ারা বেগমের প্রতারণার ফাঁদে ফেঁসে গেছেন।
এদিকে বেশ কিছু দিন রাজধানীতে গা-ঢাকা দিয়ে থাকার পর ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছেন ভয়ঙ্কর প্রতারক আনোয়ারা বেগম। তিনি গতকাল যশোরের একটি অভিজাত হোটেলে আইনজীবী দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করেন।
সংবাদ সম্মেলনে নিরক্ষর আনোয়ারা বেগমের পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন অ্যাডভোকেট ডেইজি খাতুন। এ সময় আনোয়ারার সঙ্গে অ্যাডভেকেট আফজাল হোসেন, অ্যাডভোকেট আবুল কায়েস, অ্যাডভোকেট নবকুমার, মিজানুর রহমান মিন্টুসহ বেশ কয়েকজন আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। খবর পেয়ে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হন রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয়কৃষ্ণ মল্লিক।
বিনয় মল্লিক বলেন, ‘ভয়ঙ্কর প্রতারক আনোয়ারা সংবাদ সম্মেলন করছেন শুনে আমি এখানে হাজির হয়েছি। আনোয়ারার প্রতারণার কাহিনী আমি যতটা জানি, তা উপস্থিত আইনজীবীদের বলেছি। আইনজীবীরা এসব কাহিনী শুনে লজ্জা পেয়েছেন।’
তিনি জানান, আনোয়ারা বেগম দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ন কায়দায় মানুষকে প্রতারিত করে আসছেন। তার এক নিকটাত্মীয়র কাছ থেকেও আনোয়ারা মোটা টাকা হাতিয়েছেন বলে বিনয় মল্লিক অভিযোগ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ‘ভয়ঙ্কর প্রতারক’ হিসেবে পরিচিত আনোয়ারা বেগম স্বীকার করেন, ব্যাংকে তার স্বামীর নামে কোন টাকা নেই। পুরো ঘটনাটিই সাজানো। এই প্রতারণার জন্য অবশ্য তিনি সোনালী ব্যাংকের প্রয়াত সিবিএ নেতা বিএম বাকির হোসেন এবং ব্যাংকটির যশোরের একটি শাখায় কর্মরত আবুল কাশেমকে দায়ী করেন।
সংবাদ সম্মেলনে আনোয়ারা বেগম অভিযোগ করেন, “ব্যাংক কর্মকর্তা আবুল কাশেমের শেখানো পথে তিনি হেঁটেছেন মাত্র। আবুল কাশেম আর প্রয়াত বিএম বাকির তাকে নিয়ে খেলেছেন। তার সর্বস্ব লুট করেছেন। তিনি এখন সমাজে ঘৃণিত। কিন্তু এর পেছনে যারা জড়িত তিনি তাদের মুখোশ উন্মোচন করার দাবি জানান। তিনি জানান, মানুষকে প্রতারিত করে তিনি যে ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকা আয় করেছেন তার সিংহ ভাগ আবুল কাশেম আর বিএম বাকির খেয়েছেন। বাকি টাকা তিনি মিডিয়া আর ফুর্তি করে ব্যয় করেছেন। তার কাছে বর্তমানে কোন টাকা নেই। বরং তিনি ২৪টি মামলার আসামি হয়ে এখন ফেরার জীবন যাপন করছেন।”
No comments