অর্থনীতির জন্য নতুন বিপদ সংকেত by মিজান চৌধুরী
৬
দিনের ব্যবধানে সম্প্রতি দু’জন বিদেশী নাগরিক দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত
হওয়ার ঘটনায় সরকারের ওপর নানামুখী চাপ বাড়ছে। বিশেষ করে প্রভাবশালী কয়েকটি
দেশ ও দাতা সংস্থাগুলো বিষয়টি নিয়ে তাদের ক্ষোভের কথা জানিয়েছে। কয়েকটি দেশ
তাদের নাগরিকদের চলাফেরার ওপর সতর্কতা জারি করেছে। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র
ও কমনওয়েলথবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী হু গো সোয়ারে ৩ অক্টোবর তার পূর্বনির্ধারিত
ঢাকা সফর বাতিল করেছেন। গার্মেন্টের বায়ার্স ফোরামের বৈঠকও বাতিল হয়েছে।
বাতিল হয়েছে আলোচিত অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট টিমের বাংলাদেশ সফরও। বিদেশী অনেক
পর্যটক এখানে তাদের সফরসূচি স্থগিত করেছেন। এর মধ্যে একের পর এক গ্রেনেড,
বোমা ও আগ্নেয়াস্ত্রসহ জঙ্গি-সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ধরা পড়ার ঘটনাও
উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মাত্রাকেও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এসব ইস্যুতে মহল বিশেষ
বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র বানাতে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে।
এদিকে যখন এ অবস্থা তখন অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, উদ্বেগজনক এ পরিস্থিতি সরকারকে দ্রুত শক্ত হাতে মোকাবেলা ও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। একই সঙ্গে বিদেশী নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে শতভাগ আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু এমন প্রত্যাশা সহসা পূরণ করতে ব্যর্থ হলে বহির্বিশ্বে সরকারের ইমেজ নিয়ে প্রশ্ন ওঠাসহ দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে নানামুখী প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে বাধার মুখে পড়বে বিদেশী বিনিয়োগ ও রফতানি প্রবাহ। পাশাপাশি ঢাকায় আসন্ন দাতা সংস্থাদের ‘উন্নয়ন ফোরাম’র বৈঠক করা নিয়েও নানা সংশয় ও অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে। আর মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নির্ধারণকারী সংস্থার (এপিজি) কঠিন প্রশ্নের মুখে পড়তে হতে পারে বাংলাদেশকে। এ সংস্থাটির একটি প্রতিনিধি দলের আগামী সপ্তাহে ঢাকা সফরের কথা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বুধবার যুগান্তরকে বলেন, আমাদের রফতানি খাতের অবস্থা মোটেও সন্তোষজনক নয়। বিদেশী ক্রেতারা চায় নিরাপত্তা। তারা এ দেশে না এলে অবশ্যই সমস্যা হবে। তিনি আরও বলেন, বিদেশী বিনিয়োগের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। কিন্তু এর মধ্যে এসব বিষয় চলতে থাকলে নির্ঘাত বিদেশী বিনিয়োগকারীরা নিরৎসাহিত হবেন। আর সে রকম পরিস্থিতিতে দেশী বিনিয়োগকারীদের অনেকে ঝুঁকি নিয়ে বিনিয়োগ করতে চাইবেন না। সব কিছু মিলে এটি অর্থনীতির জন্য শুভ কিছু নয়।
জানা গেছে, সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনায় নিরাপত্তার ইস্যুতে বিদেশী ক্রেতারা বাংলাদেশে সফর বাতিল করেছেন। ইতিমধ্যে পোশাক খাতের ক্রেতাদের সংগঠন বায়ারস ফোরামের বৈঠকও বাতিল হয়েছে। ৫ অক্টোবর পোশাক শিল্পের সংগঠন বিজিএমইএ নেতাদের সঙ্গে এ বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। ২৮ সেপ্টেম্বর নিরাপত্তা ইস্যুতে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট টিম প্রথম বাংলাদেশ সফর স্থগিত করে। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকার মহিলা ক্রিকেট দল বাংলাদেশ সফরও স্থগিত করে। ১৫ অক্টোবর ঢাকা সফরে আসার কথা ছিল এ দলটির।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রফতানিকারক অ্যসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সালাম মুর্শেদী যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা একটি ইমেজ সংকটে পড়েছি। এ মাসে বিদেশী অনেক ক্রেতার বৈঠক ও কারখানা পরিদর্শনের নির্ধারিত সময় ছিল। ক্রয়াদেশ দেয়ার মাসও বলা চলে। কিন্তু দু’জন বিদেশী নাগরিক খুনের ঘটনায় ক্রেতাদের সফরসূচি কিছুটা ওলটপালট হয়ে গেছে।’ তিনি নিজের গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘আমার একজন ক্রেতার ৫ অক্টোবর কারখানা পরিদর্শনে আসার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি তিনি বাতিল না করলেও অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে স্থানান্তর করেছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিগত আড়াই বছরের দুটি বড় ধরনের রাজনৈতিক ধাক্কা শেষ হয়ে মাত্র ৫ মাস অতিক্রম হয়েছে। এরমধ্যে যখন আমরা একটু দাঁড়াতে চেষ্টা করছি, তখন দুই বিদেশী নাগরিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা একটু বিপাকে ফেলে দিয়েছে। তবে আশা করি এটি অতিক্রম করতে পারব।’
বিদেশী নাগরিক হত্যার ঘটনায় ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির মহাসচিব এএইচএম রেজাউল কবির উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, এ ঘটনা দেশের অভ্যন্তরে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ ও রফতানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় পোশাক খাতের অর্ডার পার্শ্ববর্তী দেশে চলে যাওয়ার পথকে সুগম করবে। পাশাপাশি সামগ্রিক রফতানির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আর বাস্তবে যদি তাই হয়, তাহলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভার্বমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হতে পারে। কিন্তু এমনটি কারও কাছে কাম্য নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, সম্প্রতি দু’জন বিদেশী নাগরিক খুন হয়েছেন। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। ঘটনাটি দুঃখজনক। কিন্তু এর জন্য অর্থনীতিতে দ্রুত কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে তিনি মনে করেন না। তবে সরকারকে দ্রুত অনুসন্ধান করে প্রকৃত খুনিদের শনাক্ত করতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন কিছুদিন অপেক্ষা করে দেখতে হবে দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতিতে এর কোনো প্রভাব পড়ে কিনা। তবে তার বিশ্বাস, সরকার যদি আইনশৃংখলা পরিস্থিতি দ্রুত উন্নতি করতে পারে তাহলে সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে। যেসব বিদেশী নাগরিক ঢাকা সফর স্থগিত কিংবা বাতিল করেছেন তারা পুনরায় সফরসূচি ঠিক করে চলে আসবেন।
এদিকে বাংলাদেশের সন্ত্রাসে অর্থায়ন ও মানি লন্ডারিং নিয়ন্ত্রণে কতটুকু কাজ করেছে তা পর্যবেক্ষণে ১২ অক্টোবর এপিজির একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসছে। কিন্তু তাদের সফরে আসার আগেই বিদেশী দু’জন নাগরিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সরকারকে কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত যদি এটাই প্রতীয়মান হয় যে, এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে জঙ্গিগোষ্ঠীর হাত রয়েছে তাহলে এ বৈঠকে বাংলাদেশকে যেমন কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে, তেমনি এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিচে নেমে যেতে পারে। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এ প্রতিনিধি দলের কাছে যদি মনে হয়, বাংলাদেশে জঙ্গি অর্থায়ন অব্যাহত আছে বা বেড়ে গেছে এবং এ কাজে মানি লন্ডারিং হচ্ছে, তাহলে আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশকে ‘ধূসর’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে। আর সত্যিই যদি এ তালিকায় চলে যায় তবে এখানে বিদেশী বিনিয়োগ, বিদেশীদের সঙ্গে যৌথ ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ধরনের সমস্যায় পড়বে বাংলাদেশ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এপিজি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে এসে পুরনো হিসাব-নিকাশ মেলানোর পাশাপাশি সাম্প্রতিক বিষয়গুলোর প্রশ্ন তুলবে। কেননা দুই বিদেশী খুন এবং চট্টগ্রামে গ্রেনেডসহ জেএমবির একটি গ্রুপকে আটক করার ঘটনাগুলো তাদের আসার পূর্বমুহূর্তে ঘটেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ড. এম আসলাম আলম মঙ্গলবার নিজ কার্যালয়ে যুগান্তরকে বলেন, সম্প্রতি যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তার কারণ বের না হওয়া পর্যন্ত এখানে সন্ত্রাসে অর্থায়ন হওয়ার বিষয়টি বলা যাবে না। তিনি জানান, এপিজি প্রতিনিধি দল আসবে। আমাদের প্রস্তুতিও ভালো। তারা ইতিপূর্বে যেসব প্রশ্ন জানতে চেয়েছে, আমরা সেগুলোর উত্তর দাখিল করেছি। নতুন করে খুব বেশি শংকার কারণ নেই।
এদিকে আগামী মাসে শুরু হচ্ছে দাতাদের সম্মেলন উন্নয়ন ফোরামের বৈঠক। বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যানেত্তি ডিক্সন এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ওয়ানচাই জাংসহ ৩৬টি দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা ওই বৈঠকে অংশ নেয়ার কথা। তবে নিরাপত্তাজনিত ইস্যুতে এ বৈঠক নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দাতাসংস্থার প্রতিনিধিদের দেশে নিয়ে আসা, বিমানবন্দর পর্যন্ত পৌঁছে দেয়াসহ সব ধরনের নিরাপত্তার প্রস্তুতি সরকার নিয়েছে। কারণ দাতা সংস্থার এ বৈঠক কোনো কারণে বানচাল হলে অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন। এ প্রসঙ্গে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কর্মাস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির মহাসচিব যুগান্তরকে বলেন, ‘বিদেশী নাগরিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে এমসিসিআই চিন্তিত। আমরা আশা করছি, পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হবে।’ তবে তিনি মনে করেন, এ দুটি ঘটনায় অর্থনীতির ওপর দ্রুত প্রভাব পড়বে না। কিন্তু এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে এর বিরূপ প্রভাব অবশ্যই পড়বে।’
২৮ সেপ্টেম্বর গুলশান কূটনীতিকপাড়ায় ইতালির নাগরিক সিজারি তাভেল্লাকে গুলি করে দুর্বৃত্তরা হত্যা করে। ৩ অক্টোবর আরেক ঘটনায় রংপুরে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন জাপানের নাগরিক কুনিও হোশি।
এদিকে যখন এ অবস্থা তখন অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, উদ্বেগজনক এ পরিস্থিতি সরকারকে দ্রুত শক্ত হাতে মোকাবেলা ও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। একই সঙ্গে বিদেশী নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে শতভাগ আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু এমন প্রত্যাশা সহসা পূরণ করতে ব্যর্থ হলে বহির্বিশ্বে সরকারের ইমেজ নিয়ে প্রশ্ন ওঠাসহ দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে নানামুখী প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে বাধার মুখে পড়বে বিদেশী বিনিয়োগ ও রফতানি প্রবাহ। পাশাপাশি ঢাকায় আসন্ন দাতা সংস্থাদের ‘উন্নয়ন ফোরাম’র বৈঠক করা নিয়েও নানা সংশয় ও অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে। আর মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নির্ধারণকারী সংস্থার (এপিজি) কঠিন প্রশ্নের মুখে পড়তে হতে পারে বাংলাদেশকে। এ সংস্থাটির একটি প্রতিনিধি দলের আগামী সপ্তাহে ঢাকা সফরের কথা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বুধবার যুগান্তরকে বলেন, আমাদের রফতানি খাতের অবস্থা মোটেও সন্তোষজনক নয়। বিদেশী ক্রেতারা চায় নিরাপত্তা। তারা এ দেশে না এলে অবশ্যই সমস্যা হবে। তিনি আরও বলেন, বিদেশী বিনিয়োগের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। কিন্তু এর মধ্যে এসব বিষয় চলতে থাকলে নির্ঘাত বিদেশী বিনিয়োগকারীরা নিরৎসাহিত হবেন। আর সে রকম পরিস্থিতিতে দেশী বিনিয়োগকারীদের অনেকে ঝুঁকি নিয়ে বিনিয়োগ করতে চাইবেন না। সব কিছু মিলে এটি অর্থনীতির জন্য শুভ কিছু নয়।
জানা গেছে, সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনায় নিরাপত্তার ইস্যুতে বিদেশী ক্রেতারা বাংলাদেশে সফর বাতিল করেছেন। ইতিমধ্যে পোশাক খাতের ক্রেতাদের সংগঠন বায়ারস ফোরামের বৈঠকও বাতিল হয়েছে। ৫ অক্টোবর পোশাক শিল্পের সংগঠন বিজিএমইএ নেতাদের সঙ্গে এ বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। ২৮ সেপ্টেম্বর নিরাপত্তা ইস্যুতে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট টিম প্রথম বাংলাদেশ সফর স্থগিত করে। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকার মহিলা ক্রিকেট দল বাংলাদেশ সফরও স্থগিত করে। ১৫ অক্টোবর ঢাকা সফরে আসার কথা ছিল এ দলটির।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রফতানিকারক অ্যসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সালাম মুর্শেদী যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা একটি ইমেজ সংকটে পড়েছি। এ মাসে বিদেশী অনেক ক্রেতার বৈঠক ও কারখানা পরিদর্শনের নির্ধারিত সময় ছিল। ক্রয়াদেশ দেয়ার মাসও বলা চলে। কিন্তু দু’জন বিদেশী নাগরিক খুনের ঘটনায় ক্রেতাদের সফরসূচি কিছুটা ওলটপালট হয়ে গেছে।’ তিনি নিজের গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘আমার একজন ক্রেতার ৫ অক্টোবর কারখানা পরিদর্শনে আসার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি তিনি বাতিল না করলেও অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে স্থানান্তর করেছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিগত আড়াই বছরের দুটি বড় ধরনের রাজনৈতিক ধাক্কা শেষ হয়ে মাত্র ৫ মাস অতিক্রম হয়েছে। এরমধ্যে যখন আমরা একটু দাঁড়াতে চেষ্টা করছি, তখন দুই বিদেশী নাগরিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা একটু বিপাকে ফেলে দিয়েছে। তবে আশা করি এটি অতিক্রম করতে পারব।’
বিদেশী নাগরিক হত্যার ঘটনায় ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির মহাসচিব এএইচএম রেজাউল কবির উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, এ ঘটনা দেশের অভ্যন্তরে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ ও রফতানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় পোশাক খাতের অর্ডার পার্শ্ববর্তী দেশে চলে যাওয়ার পথকে সুগম করবে। পাশাপাশি সামগ্রিক রফতানির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আর বাস্তবে যদি তাই হয়, তাহলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভার্বমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হতে পারে। কিন্তু এমনটি কারও কাছে কাম্য নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, সম্প্রতি দু’জন বিদেশী নাগরিক খুন হয়েছেন। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। ঘটনাটি দুঃখজনক। কিন্তু এর জন্য অর্থনীতিতে দ্রুত কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে তিনি মনে করেন না। তবে সরকারকে দ্রুত অনুসন্ধান করে প্রকৃত খুনিদের শনাক্ত করতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন কিছুদিন অপেক্ষা করে দেখতে হবে দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতিতে এর কোনো প্রভাব পড়ে কিনা। তবে তার বিশ্বাস, সরকার যদি আইনশৃংখলা পরিস্থিতি দ্রুত উন্নতি করতে পারে তাহলে সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে। যেসব বিদেশী নাগরিক ঢাকা সফর স্থগিত কিংবা বাতিল করেছেন তারা পুনরায় সফরসূচি ঠিক করে চলে আসবেন।
এদিকে বাংলাদেশের সন্ত্রাসে অর্থায়ন ও মানি লন্ডারিং নিয়ন্ত্রণে কতটুকু কাজ করেছে তা পর্যবেক্ষণে ১২ অক্টোবর এপিজির একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসছে। কিন্তু তাদের সফরে আসার আগেই বিদেশী দু’জন নাগরিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সরকারকে কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত যদি এটাই প্রতীয়মান হয় যে, এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে জঙ্গিগোষ্ঠীর হাত রয়েছে তাহলে এ বৈঠকে বাংলাদেশকে যেমন কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে, তেমনি এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিচে নেমে যেতে পারে। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এ প্রতিনিধি দলের কাছে যদি মনে হয়, বাংলাদেশে জঙ্গি অর্থায়ন অব্যাহত আছে বা বেড়ে গেছে এবং এ কাজে মানি লন্ডারিং হচ্ছে, তাহলে আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশকে ‘ধূসর’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে। আর সত্যিই যদি এ তালিকায় চলে যায় তবে এখানে বিদেশী বিনিয়োগ, বিদেশীদের সঙ্গে যৌথ ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ধরনের সমস্যায় পড়বে বাংলাদেশ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এপিজি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে এসে পুরনো হিসাব-নিকাশ মেলানোর পাশাপাশি সাম্প্রতিক বিষয়গুলোর প্রশ্ন তুলবে। কেননা দুই বিদেশী খুন এবং চট্টগ্রামে গ্রেনেডসহ জেএমবির একটি গ্রুপকে আটক করার ঘটনাগুলো তাদের আসার পূর্বমুহূর্তে ঘটেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ড. এম আসলাম আলম মঙ্গলবার নিজ কার্যালয়ে যুগান্তরকে বলেন, সম্প্রতি যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তার কারণ বের না হওয়া পর্যন্ত এখানে সন্ত্রাসে অর্থায়ন হওয়ার বিষয়টি বলা যাবে না। তিনি জানান, এপিজি প্রতিনিধি দল আসবে। আমাদের প্রস্তুতিও ভালো। তারা ইতিপূর্বে যেসব প্রশ্ন জানতে চেয়েছে, আমরা সেগুলোর উত্তর দাখিল করেছি। নতুন করে খুব বেশি শংকার কারণ নেই।
এদিকে আগামী মাসে শুরু হচ্ছে দাতাদের সম্মেলন উন্নয়ন ফোরামের বৈঠক। বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যানেত্তি ডিক্সন এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ওয়ানচাই জাংসহ ৩৬টি দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা ওই বৈঠকে অংশ নেয়ার কথা। তবে নিরাপত্তাজনিত ইস্যুতে এ বৈঠক নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দাতাসংস্থার প্রতিনিধিদের দেশে নিয়ে আসা, বিমানবন্দর পর্যন্ত পৌঁছে দেয়াসহ সব ধরনের নিরাপত্তার প্রস্তুতি সরকার নিয়েছে। কারণ দাতা সংস্থার এ বৈঠক কোনো কারণে বানচাল হলে অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন। এ প্রসঙ্গে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কর্মাস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির মহাসচিব যুগান্তরকে বলেন, ‘বিদেশী নাগরিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে এমসিসিআই চিন্তিত। আমরা আশা করছি, পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হবে।’ তবে তিনি মনে করেন, এ দুটি ঘটনায় অর্থনীতির ওপর দ্রুত প্রভাব পড়বে না। কিন্তু এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে এর বিরূপ প্রভাব অবশ্যই পড়বে।’
২৮ সেপ্টেম্বর গুলশান কূটনীতিকপাড়ায় ইতালির নাগরিক সিজারি তাভেল্লাকে গুলি করে দুর্বৃত্তরা হত্যা করে। ৩ অক্টোবর আরেক ঘটনায় রংপুরে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন জাপানের নাগরিক কুনিও হোশি।
No comments