বাল্যবিবাহ রোধে দ্রুত আইন পাস ও বাস্তবায়ন চাই

গত ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫, প্রথম আলোর আয়োজনে ‘বাল্যবিবাহ রোধে দ্রুত আইন পাস ও বাস্তবায়ন চাই’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।
আলোচনায় সুপারিশ
** মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৬ ও ১৮ বছর নিয়ে একটা বিভ্রান্তি আছে। আশা করি নতুন আইনে এ বিভ্রান্তি দূর হবে
** বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য দারিদ্র্য, কুসংস্কার, নিরাপত্তাহীনতা, যৌন হয়রানি, বখাটেদের উৎপাত ইত্যাদি বন্ধ করতে হবে
** আমাদের স্কুলগুলোয়, সভা-সমাবেশে অভিভাবকদের সবাইকে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে জানাতে হবে
** ১৮ বছরের আগে বিয়ে বাতিল করতে গেলে যেসব সমস্যা হবে, আইনে তা সমাধানের সঠিক নির্দেশনা থাকতে হবে
** ২০১৫ সালের মধ্যে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ও বাল্যবিবাহের খসড়া আইন, ২০১৪ একসঙ্গে পাস করতে হবে
আলোচনা
আবদুল কাইয়ুম: ১৮ বছরের নিচে বিয়ে হলে সেটা শিশু বিয়ে বলে গণ্য হবে। ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ আইন ১৯৮২ সালে সংশোধন করা হয়। এখন আবার এ আইনের একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে। এ খসড়া আইন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। খসড়ায় ১৬ বছরে নারীদের বিয়ের কথা না থাকলেও গ্রামের নারীরা মনে করছে যে ১৬ বছরে বিয়ে হতে পারে। বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষের বাস। এর ৪৫ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে।
দেশের আইনে ১৮ বছরের কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও উদ্বেগজনক হারে এটা বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে বাল্যবিবাহ বন্ধে অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এখনো শিশুর বিয়ের ন্যূনতম বয়সের আইন প্রণীত হয়নি। দেশবাসী চায় সরকার যেন দ্রুত আইনটি প্রণয়ন ও কার্যকর করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এখন এ বিষয়ে বলবেন মোহাম্মদ নাসিম।
মোহাম্মদ নাসিম
মোহাম্মদ নাসিম
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নারীর ব্যাপক ক্ষমতায়ন হচ্ছে। নারীরা এখন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারছেন। একজন নারী শিক্ষিত হলে তিনি সচেতন হবেন। নিজের জীবনের সব সিদ্ধান্ত তিনি নিতে পারবেন। ১৮ সেপ্টেম্বর একটি খবরের কাগজে দেখলাম, একটি শিশু সরকারি কর্মকর্তাকে ফোন করে বলছে, ‘আমাকে বাঁচান। আমাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই যে সচেতনতা, এটাই সবচেয়ে বড় শক্তি। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সবাইকে সচেতন করতে হবে। দেশে অনেক ভালো আইন আছে, কিন্তু আইনের প্রয়োগ কম। প্রত্যেকে যদি সচেতন হয়, তাহলে আইন লাগবে না। প্রত্যেকে প্রত্যেকের জায়গা থেকে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারবে। আমরা চাই মানুষের মধ্যে সচেতনতার জাগরণ হোক।
চন্দন জেড গোমেজ
চন্দন জেড গোমেজ
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ বাল্যবিবাহ বন্ধে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। বর্তমান সরকারও বাল্যবিবাহ বন্ধে গুরুত্বসহকারে কাজ করছে। তাদের বিভিন্ন উদ্যোগ লক্ষ করি। বাল্যবিবাহ বন্ধে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে আমরা কাজ করেছি।
দেশে ১৯২৯ সালের একটি বাল্যবিবাহ আইন আছে। এ আইনকে পর্যালোচনা করে বাল্যবিবাহের সময়োপযোগী একটি আইনের খসড়া তৈরি করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ এ কাজে আমাদের সহায়তা করেছে। এ খসড়া মানবাধিকার কমিশনের মাধ্যমে অনুমোদনের উদ্যোগ নিই। প্রধানমন্ত্রী এটি নীতিগতভাবে অনুমোদন করেছেন বলে জানি।
এটি একটি যুগান্তকারী আইনের খসড়া বলে মনে করি। এ আইনের খসড়ার একটি বিষয় নিয়ে সারা দেশে আলোচনা হচ্ছে। বিষয়টি হলো, যদি কোনো ছেলেমেয়ের প্রেম-ভালোবাসা বা অন্য কোনো জটিল পরিস্থিতিতে বাল্যবিবাহ হয়, তাহলে আদালত এ বিয়েকে বৈধ ঘোষণা করতে পারেন। কিন্তু দেশের অনেক মানুষ মনে করছে, সরকার বিয়ের বয়স ১৬ বছর করেছে। এই ভুল-বোঝাবুঝির অবসান হওয়া দরকার।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী জেনেভা যাবেন। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি সেখানে কথা বলবেন। সেখানে তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়েও হয়তো কথা বলবেন। সেভ দ্য চিলড্রেন থেকে একজন নারী যাবেন কেবল এ বিষয়ে কথা বলতে।
বাংলাদেশে বর্তমানে বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে একটি জরুরি বিষয় হলো কন্যাশিশুর জীবনমানের উন্নয়ন করা। তাই যত দ্রুত সম্ভব আইনটি জাতীয় সংসদের মাধ্যমে পাস করা ও তার বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
জাতীয় কর্মপরিকল্পনা তৈরি হয়েছে। এখন বাল্যবিবাহ বন্ধের লক্ষ্যে ২০১৫ সালের মধ্যে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ও বাল্যবিবাহের খসড়া আইন, ২০১৪ একসঙ্গে পাস করতে হবে। এটা যত দ্রুত করা সম্ভব, ততই দেশের নারীসহ আমাদের সবার জন্য মঙ্গল।
আর নারীদের বিয়ের বয়স ১৬ ও ১৮ বছর নিয়ে একটা বিভ্রান্তি আছে। আমরা আশা করি এটা অবশ্যই দূর হবে। নারীর বিয়ের বয়স যেন ১৮ বছরই থাকে। কারণ, এর আগে নারীর বিয়ে হলে নারী ও শিশুর মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেড়ে যাবে।
আল আমিন
আল আমিন
আমরা কোনো শিশুর পেটে শিশু নয়, মায়ের পেটে শিশু দেখতে চাই। আমার একজন সহপাঠী আছে। তার বয়স মাত্র ১৩ বছর। দেড় বছর হলো তার বিয়ে হয়েছে। মেয়েটি ও আমি কেরানীগঞ্জে থাকি। আমার পাশের বাসায় মেয়েটি থাকে। তাকে প্রচণ্ড নির্যাতন করা হয়। সে যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকে। তখন এত খারাপ লাগে, যা বলে বোঝাতে পারব না। তার শরীর শুকিয়ে গেছে। বিভিন্ন রোগেশোকে ভুগছে। অথচ বিয়ের আগে তার একটি আনন্দময় জীবন ছিল। বাল্যবিবাহ নারীদের কোনো সুফল দিচ্ছে না, এটি তাদের জীবনে অভিশাপ হয়ে আসছে। বাল্যবিবাহের শাস্তি মাত্র এক হাজার টাকা। এটি এত কম যে একে কেউ গুরুত্বই দেয় না। জরিমানার পরিমাণ কমপক্ষে লাখ টাকায় নিতে হবে। বড় রকমের আর্থিক ক্ষতিতে পড়লে বাল্যবিবাহের সাহস পাবে না। ঘাসফুল শিশু ফোরাম থেকে আমরা কয়েকটি মেয়ের বাল্যবিবাহ রোধ করতে পেরেছি।
তানিয়া আক্তার
তানিয়া আক্তার
আমার একজন বান্ধবী ছিল। সে খুবই মেধাবী। অল্প বয়সে তার বিয়ে হয় একজন বয়স্ক মানুষের সঙ্গে। বিয়ের পর স্কুলে গেলে শিক্ষক ও তার অন্য বান্ধবীরা ভালো ব্যবহার করে না। তাই সে পড়ালেখা বাদ দেয়। মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই আমার বন্ধবীর শরীর অনেক দুর্বল হয়। আর এখন সে পুষ্টিহীন এক শিশুর মা। বর্তমান আইনের দুর্বলতা ও দারিদ্র্যের জন্য মা-বাবারা সন্তানদের বিয়ে দেন। কিন্তু বিয়ের পর তাদের জীবনে আরও দুর্যোগ নেমে আসে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটি নতুন আইন করা প্রয়োজন। নতুন আইন হলে সেখানে শাস্তির মেয়াদ ও জরিমানা বাড়ানোর জন্য অনুরোধ করছি। আর নারীদের বিয়ের বসয় যেন ১৮-এর নিচে না হয়, সেই দিকটিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন। স্কুলে যাওয়ার পথে ছেলেরা মেয়েদের বিরক্ত করে। কুরুচিপূর্ণ কথা বলে। বাড়িতে এসব বললে অভিভাবক উল্টো মেয়েদেরই দোষ দেন। তাঁরা ভাবেন যে মেয়েদের বিয়ে দিলে তাঁদের আর ঝামেলা থাকবে না। যৌন হয়রানি বন্ধ করতে পারলে বাল্যবিবাহ কমবে বলে আশা করি।
মো. নিজাম হোসেন
মো. নিজাম হোসেন
আমি ঢাকা জেলার যুব ফোরামের সভাপতি। এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৪০ জন শিশুকে শিশু অধিকার সম্পর্কে বুঝিয়েছি। অনেক দিন ধরে শিশু ফোরামের সঙ্গে কাজ করছি। শিশুদের অনেক অসহায় অবস্থা দেখেছি। মেয়েদের কোনো অভিযোগই বাবা-মা শুনতে চান না। সব দোষ যেন মেয়েটির। অভিভাবকেরা মনে করেন, মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়াই নিরাপদ। আমরা ঘাসফুল শিশু অধিকারের মাধ্যমে এসব বোঝানোর চেষ্টা করছি। ছয়টি শিশু ফোরামের মাধ্যমে প্রতি মাসে ২০ জন মেয়ে ও ২০ জন ছেলে মোট ৪০ জনের সঙ্গে কথা বলি। এরা যদি বলে যে বাবা-মা বিয়ে দিতে চাইছে, সে ক্ষেত্রে তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলি। স্কুলে সমস্যা হলে স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলি। যেখানে তাদের সমস্যা হয়, সেখানে কথা বলে সমাধান করার চেষ্টা করি।
আমরা অনেক বাল্যবিবাহ ইতিমধ্যে বন্ধ করেছি। বর্তমান আইনের খসড়ায় নাকি মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৬ করার কথা ভাবা হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য ভীষণ সমস্যার সৃষ্টি করছে। তাই বিয়ের বয়স যদি মেয়েদের ১৮ ও ছেলেদের ২১ বছর হয় এবং শাস্তির বিষয়টি যদি কড়াকড়ি হয়, তাহলে বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে আমরা অনেক অগ্রগতি অর্জন করতে পারব।
মো. মোস্তাফিজুর রহমান
মো. মোস্তাফিজুর রহমান
আমাদের দুটি বিভাগ—একটি হলো আইন ও বিচার বিভাগ, অন্যটি লেজিসলেটিভ অ্যান্ড পার্লামেন্টারি অ্যাফেয়ার্স বিভাগ। আইনটি যদি ভেটিংয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে কিছু বলতে পারব না। খসড়া আইনের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কেও বলতে পারব না।
আজ থেকে ৮৫ বছর আগে ১৯২৯ সালে এ আইন প্রণয়ন করা হয়। ১৯৩০ সালের ১ এপ্রিল কার্যকর করা হয়েছিল। আইনটি সংশোধন করা হয় ১৯৮২ সালে। এই সংশোধনীতে ছেলেদের ক্ষেত্রে বিয়ের বয়স ২১ ও মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৮ বছর বলা আছে। আমি প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী হিসেবে কোনো মতামত দিতে পারি না। এখানে নীতিনির্ধারকেরা রয়েছেন, তাঁরা সিদ্ধান্ত দেবেন। তবে আমার ঘরেও শিশু ছেলেমেয়ে রয়েছে। বর্তমান খসড়া আইনে ১৬ বছর নিয়ে যে আলোচনা হচ্ছে, তার একটি সুষ্ঠু সমাধান হওয়া উচিত।
বিয়ে একটা সামাজিক চুক্তি। প্রেম-ভালোবাসাও একধরনের চুক্তি। চুক্তিতে আসতে পারে কেবল যারা সাবালক তারা। ১৮ বছরের নিচে যারা আছে, তারা তো শিশু, তাদের মধ্যে তো কোনো চুক্তি হতে পারে না। আবেগের মাধ্যমে যে চুক্তি হয়, তার ফল খুব একটা ভালো হতে পারে না। উচ্চ ও মধ্যবিত্তের মধ্যে বাল্যবিবাহ হয় না।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে দরিদ্র মানুষের মধ্যে বাল্যবিবাহ হয়। দরিদ্র কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা অভাব ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার জন্য দ্রুত কন্যাকে বিয়ে দিতে চান। গ্রাম ও শহরের বিশেষ একটি জনগোষ্ঠী এই দারিদ্র্যের শিকার। কেন্দ্র ও স্থানীয় প্রশাসন, এনজিও সবাই মিলে যদি এঁদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে পারি, তাহলে বাল্যবিবাহের হার অনেক কমে আসবে।
শেষ কথা হলো, দরিদ্র মানুষকে আর্থিক নিরাপত্তা দিতে ও সচেতন করতে পারলে বাল্যবিবাহের হার অনেক কমে যাবে।
ফউজুল আজিম
ফউজুল আজিম
মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয় থেকে ২০১৩ সালে বাল্যবিবাহ আইনটি যুগোপযোগী করার জন্য আমাদের একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। আমরা কাজ শুরু করলাম। ইতিমধ্যে প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে দেখলাম, মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয় বাল্যবিবাহ আইনের খসড়া তৈরি করে ফেলেছে। এটা কম সময়ের মধ্যেই কেবিনেটে উপস্থাপন করা হবে।
মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে তেমন কিছু জানতে পারলাম না। আমরা তখন কাজটি বন্ধ রাখি। মন্ত্রিপরিষদ থেকে আমাদের কাছে কার্যবিবরণী পাঠানো হয়েছিল। সেখানে দেখা গেছে যে রাজশাহী বিভাগে বাল্যবিবাহের হার ৬০ শতাংশ। এখানে বাল্যবিবাহের চারটি কারণ নির্ণয় করা হয়। এক. কাজি কর্তৃক অতিরিক্ত টাকার লোভে বাল্যবিবাহ রেজিস্ট্রি করা। দুই. জালজালিয়াতির মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে জন্ম সনদ গ্রহণ। তিন. নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে অ্যাফিডেভিট করে বেশি বয়স দেখানো। চার. বখাটেদের উৎপাতের জন্য পরিবার থেকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়া। আমাদের দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ ও ১৯৮৫ সালে মোট দুবার এ আইনের সংশোধন হয়।
১৯৩০ সালে যখন বাল্যবিবাহের আইনটি কার্যকর করা হয়, তখন শুধু জরিমানা ছিল। এ জরিমানাকে সবাই একটা বাড়তি খরচ হিসেবে নিত। বিয়ে করে জরিমানা দিত। জরিমানা বাল্যবিবাহ বন্ধে কোনো ভূমিকা রাখেনি। ১৯৪০ সালে জরিমানার সঙ্গে জেল যুক্ত হলো।
এখন ভারত বাল্যবিবাহ আইনে দুই বছর জেল ও এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান রেখেছে। কোনো ধর্মের বিধানমতে, ১৮ বছরের নিচে যদি কোনো বিয়ে হয়েই যায়, তাহলে কী হবে? এটি কি বাতিল হবে? নাকি থেকে যাবে? বা শাস্তি হবে? নতুন খসড়া আইনে এ ক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্ত নেই।
কিন্তু ১৯২৯ সালের আইন অনুযায়ী বিয়ে বাতিল হচ্ছে না। কেবল যাঁরা বিয়ে দিচ্ছেন, তাঁদের কিছু শাস্তি হচ্ছে। ভারতের বর্তমান আইনে ১৬ বছরের নিচে বিয়ে হলে সেটা সরাসরি বাতিল বলে গণ্য হবে। ১৬ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে বিয়ে হলে বাতিলযোগ্য বলে গণ্য হবে। বয়স যখন ১৮ হবে, তখন তারা আদালতের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেবে, তারা বিয়েটা রাখবে কি রাখবে না।
আমাদের বর্তমান খসড়া আইনের অনেক দুর্বলতা আছে। এটি তাড়াহুেড়া না করে বেশ সময় নিয়ে সংশোধন করতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে একটা আইন ২০ বছর হলে স্বাভাবিকভাবেই সেটা পর্যালোচনায় আসে। আমাদের দেশে তেমন হয় না বিধায় আইনটা একবারে এমনভাবে করতে হবে, যাতে কোনো ত্রুটি না থাকে।
সাবিরা নুপুর
সাবিরা নুপুর
আমি একসময় সাতক্ষীরা জেলায় কাজ করতাম। একবার একটি ছোট মেেয়কে দেখলাম। মেয়েটি শাড়ি পরে একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে বললাম, শাড়ি পরেছ কেন? বলল, ‘আমার বিয়ে হয়েছে, তাই শাড়ি পরেছি।’ বললাম, শ্বশুরবাড়ি যাওনি? বলল, ‘মা বলেছে আমি এখন ছোট, আরেকটু বড় হলে যাব।’ বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই একই চিত্র বিদ্যমান।
এই উজ্জ্বল-উচ্ছল মেয়েটির জীবনে কী হবে, সেটা হয়তো কিছুটা অনুমান করতে পারা যায়। এভাবে জীবনের স্বপ্নগুলোকে জীবনের শুরুতে শেষ হতে দিতে পারি না।
সাতক্ষীরার আরেকটি অঞ্চলে শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করছিলাম। সেখানে অনেক কন্যাশিশু আছে। তাদের বাবা-মাকে বললাম কন্যাশিশুদের বিয়ে না দিতে।
তাঁরা বললেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, অভাব-অভিযোগের মধ্যে থাকি। আমাদের কোনো শক্তি নেই। রাতে যখন এলাকার খারাপ ছেলেরা এসে দরজা ধাক্কা দেবে, তখন কি আপনি থাকবেন? আমাদের কি রক্ষা করবেন? সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে আমাদের মেেয়রা বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে।
এমন অনেক প্রশ্ন আমাদের শুনতে হয়। এত বড় সমস্যা হয়তো একটা আইন দিয়ে বন্ধ করা যাবে না। তবে আইন একটা ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।
আমাদের সুপারিশ ছিল স্থানীয় প্রশাসন যেন বাল্যবিবাহ বন্ধে ভূমিকা রাখে। ১৮ বছরের আগে বিয়ে বাতিল করতে গেলে যেসব সমস্যা হবে, আইনে তা সমাধানের সঠিক নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। আমরা আশা করি সুপারিশসহ আইনটি পাস হবে। তাই শিশুবিবাহ বন্ধে আইনটির কার্যকর সংশোধন প্রয়োজন, এটাই আমাদের দিক থেকে সুপারিশ।
ওয়াসিকা আয়শা খান
ওয়াসিকা আয়শা খান
আমি আইনজ্ঞ নই। একজন রাজনৈতিক কর্মী। বাল্যবিবাহের যে আইনটি এখনো আছে, সেখানে মেয়ে ও ছেলেদের বিয়ের বয়স ১৮ ও ২১ বছর আছে। আমি একজন নারী, আবার একজন নারীর মা-ও। তাই কোনোভাবেই বাল্যবিবাহকে সমর্থন করতে পারি না। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে। কন্যাশিশুরা শিক্ষিত হচ্ছে। আমার এলাকার স্কুলগুলোতে এমন ঘটনা ঘটে যে একটি মেয়ে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। হঠাৎ শেষ পরীক্ষাটি দিল না। কারণ, বাবা-মা মধ্যপ্রাচ্যপ্রবাসী ভালো পাত্রের সঙ্গে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন।
সব সময় দারিদ্র্য বাল্যবিবাহের কারণ না। সামাজিক অসচেতনতাও বাল্যবিবাহের একটি বড় কারণ। সামাজিক সচেতনতার জায়গায় আমাদের অনেক কাজ করতে হবে। একজন সাংসদ হিসেবে এখানে আমার বেশ দায়িত্ব রয়েছে। আমাদের স্কুলগুলোয়, সভা-সমাবেশে অভিভাবকদের সবাইকে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।
বাড়িতে বাবা-মা তাঁদের ছেলেসন্তান ও মেয়েসন্তানদের কীভাবে মানুষ করেন, কীভাবে তাদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শেখান, সেটি দেখতে হবে বলে মনে করি।
আজ শিশু ফোরামের ছেলেমেয়েরা যেভাবে কাজ করছে, যেভাবে কথা বলছে, তাদের কাজে ও কথায় খুবই অভিভূত। এরা খুবই ভালো কাজ করছে। এদের মতো করে আমাদের সবাইকে কাজ করতে হবে।
আইন তো থাকবেই। আইনের পাশাপাশি আরও অনেক কিছু করতে হবে। সংসদে যখন বিষয়টি আলোচনা হবে, তখন অবশ্যই আমরা কথা বলব, যাতে আইনটি সময় ও যুগোপযোগী হয়। এ ক্ষেত্রে যারা কাজ করছে, তারা একটি ভালো উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছে। তাদের সবাইকে ধন্যবাদ। আমার যদি এ ক্ষেত্রে কখনো কিছু করার থাকে, আমাকে বললে অবশ্যই আমি আপনাদের পাশে থাকব।
নূরজাহান বেগম মুক্তা
নূরজাহান বেগম মুক্তা
বিয়ে সমাজের সবচেয়ে একটি ভালো সম্পর্ক। তবে বাল্যবিবাহ জীবনের অভিশাপ। বাল্যবিবাহের জন্য দায়ী হবেন ছেলেমেয়ের অভিভাবক, িবেয়র রেজিস্ট্রার, বয়সের ক্ষেত্রে মিথ্যা সনদ দানকারী, বিয়ে পড়ানো মৌলভি।
১৯২৯ সাল থেকে আইন আছে। এত বছরে আইন দিয়ে কতটুকু অর্জন করেছি? তাই আইন দিয়ে সবকিছু হবে না। বড় প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা। দারিদ্র্য, সামাজিক কুসংস্কার, নিরাপত্তাহীনতা, যৌন হয়রানি, বখাটেদের উৎপাত ইত্যাদি সমস্যার সমাধান করতে না পারলে বাল্যবিবাহ বন্ধ হবে না।
গত বছর ফেনীতে এক মেেয়র ১৩ বছরে বিয়ে হচ্ছিল। মেয়ের বাবার কাছে দুটি সনদ দেখতে পাই। একটিতে বয়স ১৩ বছর, অন্যটিতে ২৩ বছর। অভিভাবক জানেন যে বাল্যবিবাহ অপরাধ। সে জন্য তিনি মেয়ের দুটি সনদ সংগ্রহ করেছেন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৭৬ শতাংশ মানুষ জানে যে বিয়ের জন্য ছেলের বয়স ২১ ও মেয়ের বয়স হবে ১৮। জেনে-বুঝেই কিন্তু সবাই অপরাধ করছে।
শহরের বস্তিগুলোয় বাল্যবিবাহের হার অনেক বেশি। ২০০৪ সাল থেকে বাল্যবিবাহ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সব শিশুর জন্মনিবন্ধন হচ্ছে না।
২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৩০৩টি বাল্যবিবাহ হয়েছে। এর মধ্যে মামলা হয়েছে সাতটি। বাল্যবিবাহ বন্ধ করা হয়েছে ৩৭টি। বর্তমান আইনে বাল্যবিবাহ দূর করা সম্ভব নয়। নতুন আইনটি পাস করা জরুরি। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কাজ করছে। মনে করি, এর সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে যুক্ত হতে হবে।
প্রতিটি স্কুল ও কলেজে শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী প্রতিনিধিদের নিয়ে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটি থাকতে হবে। ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো ছেলেমেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হলে প্রতিরোধ কমিটি সেটা প্রতিরোধ করবে।
এখানে স্থানীয় জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, মানবাধিকার কর্মী, এনজিও, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা—সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে হবে। নাটক, সিনেমা, যাত্রা, সভা-সমিতি, গণমাধ্যমের সব শাখাসহ সব জায়গায় এ আলোচনা ছড়িয়ে দিতে হবে।
বর্তমান সরকার নারীদের সবচেয়ে বেশি সম্মানিত করেছে। তাদের অন্ধকার থেকে আলোতে এনেছে। দেশের সব ক্ষেত্রে আজ নারীদের জয়জয়কার। কোন পেশায় কোথায় নারীরা নেই? নারীদের কোনো ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ এ সরকার করবে না, এটি আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে চাই।
আবদুল মতিন খসরু
আবদুল মতিন খসরু
বাল্যবিবাহের সমস্যাটা অনেক পুরোনো। এ ক্ষেত্রে সবাইকে বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর বিষয়গুলো বোঝাতে হবে। বাল্যবিবাহের কারণে মায়ের ও শিশুর মৃত্যু বেড়ে যায়, শারীরিক বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। এসব বিষয় সবাইকে বোঝাতে হবে।
নারীদের অনেক বেশি শিক্ষা অর্জন করতে হবে। একজন শিক্ষিত নারী নিজের, পরিবারের ও সমাজের জন্য অনেক কিছু করতে পারেন। শহর থেকে গ্রামে বাল্যবিবাহের হার অনেক বেশি। শহরে পিছিয়ে পড়া মানুষের মধ্যে এ হার বেশি।
বাল্যবিবাহের শিকার নারীদের কোনো অধিকার থাকে না। তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো ক্ষমতা থাকে না। নির্বাক মানুষের জীবনযাপন তাদের করতে হয়। স্বামীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিরুদ্ধে সে কখনোই যেতে পারে না।
কোনো নারী যখন কিছু আয় করতে পারেন, তখন তিনি কথা বলতে পারেন। যেমন আমাদের দেশে যেসব নারী পোশাকশিল্পে কাজ করেন, তাঁরা অনেক বেশি স্বাধীন ও নিরাপদ। নারীদের মধ্যে সবাই একাডেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারবেন না। যাঁরা পারবেন না, তাঁরা কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হবেন।
আজকের গোলটেবিলের শিশুরা অনেক সুন্দর বক্তব্য দিয়েছে। তাদের কথা শুনে অভিভূত। এই সচেতনতা দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষের নেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এ বিষয়টি নিয়ে আসা দরকার। রাজনৈতিক নেতা, মসজিদের ইমাম, গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ সবাইকে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে কমবেশি ভূমিকা রাখতে হবে।
আমার দৃষ্টিতে বাল্যবিবাহ মানবাধিকারের লঙ্ঘন। বাল্যবিবাহ একটা অত্যাচার। এটা একটা জাতীয় সমস্যা। সবাই মিলে এ সমস্যা দূর করতে হবে।
মিজানুর রহমান
মিজানুর রহমান
আলোচনার সব বক্তব্যের সঙ্গে আমি হয়তো একমত নই। আবার খুব বেশি দ্বিমতও নেই। তবে আমার একটা ভিন্নমত আছে। আইনকে ব্যাখ্যা করতে হয় তিনটি দিক থেকে। আইনে থাকে একটি ভাব, একটি স্বভাব ও একটি অভাব। বাল্যবিবাহের খসড়ার আইনের ভাবটা কী, স্বভাব কী ও অভাব কী, সেটা কিছুটা ব্যাখ্যা করি।
আমাদের এ আইনের ভাব হলো পুরোনো আইনের দুর্বলতা কাটিয়ে একটি নতুন আইন করতে হবে। যে আইনটা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে। নতুন আইন কেন করতে হবে, এটা এর ভাবের মধ্যে রয়েছে।
আইনের স্বভাবটা কী? কোনো নারী দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁকে কারাদণ্ড প্রদান করা যাবে না। এখানে নারীর প্রতি ভীষণ সম্মান দেখানো হয়েছে। আইনটি আবার শিশুবান্ধব। যেমন বাল্যবিবাহের কারণে কোনো শিশু জন্মগ্রহণ করলে সে শিশুর নিরাপত্তা দিতে হবে। আগের কোনো আইনে এটি ছিল না। এদিক থেকে চিন্তা করলে আইনটি শিশুবান্ধব। তাহলে আইনটি নারী ও শিশুবান্ধব—এটিই এ আইনের স্বভাব।
এ আইনের সবচেয়ে বড় অভাব হলো, আইনে বলা হয়েছে যে পুরুষের ক্ষেত্রে বিয়ের বয়স হবে ২১ বছর ও নারীর ক্ষেত্রে বিয়ের বয়স হবে ১৮ বছর। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মা-বাবা চাইলে বা আদালতের সম্মতিতে ১৬ বছরের মেয়েরও বিয়ে হতে পারে। আইনের সব উদ্দেশ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এই বিষয়টা।
মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা শঙ্কিত। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বিভিন্ন কর্মশালার মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত নিয়ে বাল্যবিবাহ আইনের একটি খসড়া প্রণয়ন করে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে জমা দিয়েছে।
স্বাস্থ্যের দিক থেকে চিন্তা করলেও এটা একটা ভয়ানক ক্ষতিকর বিষয় হবে। যেমন একজন শিশুর কি সন্তানধারণের জন্য শারীরিক সক্ষমতা থাকে? একজন শিশু কি মানসিকভাবে প্রস্তুত একটি অপরিচিত সংসারের দায়িত্ব পালনের জন্য?
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে একটি পরিপত্র জারি করে দেশের সব ডেপুটি কমিশনারের কাছে পাঠানো হয়েছে। এই পরিপত্রে ‘তবে’ রয়েছে। অর্থাৎ ১৬ বছরে বিয়ে হলে শর্তসাপেক্ষে এটিকে বাধাগ্রস্ত না করার জন্য ডেপুটি কমিশনারদের বলা হয়েছে।
হয়তো চূড়ান্তভাবে ১৬ বছরের এই বিষয়টি থাকবে না। কিন্তু এমন একটি পরিপত্র যখন ডেপুটি কমিশনারের দপ্তরে যায়, তখন কি এই আইনের উদ্দেশ্য ব্যাহত হয় না?
এ আইনের মধ্যে একটি আপসকামিতা রয়েছে। যেমন এ খসড়া আইনের এক জায়গায় বলা হয়েছে, এ আইনে কোনো অপরাধ হলে সেটা আমলযোগ্য, আপসযোগ্য ও জামিনযোগ্য। এই আপসকামিতা আইনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
এই ‘তবে’ থাকলে আন্তর্জাতিক আইন দেশীয় শিশু সুরক্ষার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হচ্ছে। এখানে বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে দারিদ্র্য ও যৌন হয়রানির কথা বলা হয়েছে। এসব নিরসনের দায়িত্ব কার? রাষ্ট্রের।
কার্ল মার্ক্স বলেছেন যে দুই ধরনের জনগোষ্ঠীর দায়িত্ব রাষ্ট্রের। যাঁরা আর কাজ করতে পারেন না। আর যারা এখনো কাজ করে না। অর্থাৎ যাঁরা বয়স্ক ও শিশু, তাদের দেখভালের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র যদি বলে এত সমস্যা, আমরা কয়টা করব? রাষ্ট্র তো এ জন্যই যে প্রতিটি কাজ সমান গুরুত্ব দিয়ে লড়তে হবে।
মোহাম্মদ নাসিম: প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে মনোযোগ দিয়ে সবার কথা শুনছিলাম। নিজেও এ অনুষ্ঠান থেকে সমৃদ্ধ হয়েছি বলে মনে করি। বিয়ে একটা আনন্দের বিষয়। কিন্তু বাল্যবিবাহ কথাটির মধ্যেই নেতিবাচক ভাবনা রয়েছে।
মাত্র তিন দিন আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর নির্বাচনী এলাকায় দরিদ্র মানুষের মধ্যে রিকশা বিতরণের সময় বলছিলেন, ‘দারিদ্র্যকে জয় করতে হলে শিক্ষিত হতে হবে। শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। রিকশা কারও দারিদ্র্য দূর করতে পারবে না।’
অথচ আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক আগে থেকেই মেয়েদের অধিক গুরুত্ব দিয়ে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করেছেন। আজ শিক্ষার প্রায় সব ক্ষেত্রেই মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে।
রাষ্ট্রের কাজ হচ্ছে সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সেটা করেছেন। আমাদের দেশে উল্লেখযোগ্য হারে নারী ও শিশুমৃত্যু কমেছে। দ্রুতগতিতে দারিদ্র্য কমেছে। এসব ক্ষেত্রে উন্নয়ন করা বড় রকমের চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু সরকার সেটা করতে পেরেছে।
প্রধানমন্ত্রী পরিবেশের জন্য কাজ করছেন। অবকাঠামোর উন্নয়ন করছেন। এসব দেশের মানুষের সমৃদ্ধ হওয়ার জন্য সুযোগ সৃষ্টি করছেন। অনেকের মতো আমিও মনে করি, আইন দিয়ে হয়তো সবকিছু হবে না। আমাদের দেশে অনেক ভালো আইন আছে। কিন্তু আইনের সঠিক প্রয়োগ হয়তো হচ্ছে না।
প্রয়োজন হচ্ছে, মানুষের মধ্যে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চেতনা জাগ্রত করা। ইমাম সাহেবরা তাঁদের জলসাগুলোতে, রাজনৈতিক নেতারা সভা-সমিতিতে, শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের যদি অন্তত এ কথাটুকু বলেন—বাল্যবিবাহ ক্ষতিকর, এটা বন্ধ করতে হবে; তাহলে অনেক কাজ হয়। কারণ, সমাজের মানুষ তাঁদের কথা গ্রহণ করে।
১৮ বছরের নিচে বিয়ে হলে একজন মেয়ে পুষ্টিহীনতায় ভোগে। পুষ্টিহীন শিশুর জন্ম দেয়। বিিভন্ন প্রকার শারীরিক জটিল সমস্যা তৈরি হয়। অনেক ক্ষেত্রে মা ও শিশুমৃত্যুর ঝঁুকি সৃষ্টি হয়। তাই ১৮ বছরের নিচে কোনো মেয়ের বিয়ে হতে পারে না। আমি বিশ্বাস করি, আপনারা যে ‘যদি’ নিয়ে আলোচনা করছেন, এটা থাকবে না।
আব্দুল কাইয়ুম: দেশের আইনে ১৮ বছরের কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও উদ্বেগজনক হারে এটা বেড়ে চলেছে। নাগরিক সমাজ এর বিরুদ্ধে সোচ্চার। বাল্যবিবাহ একটি সামাজিক সমস্যা। বাল্যবিবাহের ফলে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার বাড়ে। মাতৃ ও শিশুস্বাস্থে্যর ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। পুষ্টিহীন শিশুর জন্ম হয়। তাই নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে বলে আশা করি। সবাইকে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
যাঁরা অংশ নিলেন
মোহাম্মদ নাসিম : মন্ত্রী, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়
মিজানুর রহমান : চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
আবদুল মতিন খসরু : সংসদীয় অনুমিত হিসাব কমিটির সভাপতি ও আইনবিষয়ক কমিটির সদস্য
ওয়াসিকা আয়শা খান : সাংসদ, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ
নূরজাহান বেগম মুক্তা : সাংসদ, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ
মো. মোস্তাফিজুর রহমান : যুগ্ম সচিব (মতামত), আইন ও বিচার বিভাগ; আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়
ফউজুল আজিম : মুখ্য গবেষণা কর্মকর্তা, আইন কমিশন (জেলা জজ)
চন্দন জেড গোমেজ : অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর, ওয়ার্ল্ড ভিশন, বাংলাদেশ
সাবিরা নুপুর : ম্যানেজার অ্যাডভোকেসি, ওয়ার্ল্ড ভিশন, বাংলাদেশ
আল আমিন : শিশু প্রতিনিধি, ঘাসফুল শিশু ফোরাম
তানিয়া আক্তার : শিশু প্রতিনিধি, ঘাসফুল শিশু ফোরাম
মো. নিজাম হোসেন : যুব প্রতিনিধি
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম : সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

No comments

Powered by Blogger.